‘কর্ণফুলীর কান্না, মধুপুরে মিশে গেছে, চলেশ রিছিলের তাজা রক্তে….’- এমনই শাণিত কথামালা আর সুর-ঝংকার নিয়ে সারাদেশে পাহাড় থেকে সমতলে ছুটে বেড়াচ্ছে আদিবাসীর গানের দল ‘মাদল’। যেখানেই আদিবাসীর ওপর জুলুম চলে, সেখানেই সংগ্রামী গণসংগীত নিয়ে হাজির হয় এই গানের দল। ‘জেগে উঠুক মানবতার জয়োগান’ — এই হচ্ছে তাদের ‘মাদলের’ আহ্বান।
এই লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় ‘মাদলের’ তরুণেরা বলেন, গানই আমাদের সংগ্রামের হাতিয়ার। আর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে আমরা দেখাতে চাই নতুন দিনের স্বপ্ন।

‘মাদলের’ একাধিক কনসার্টের ফাঁকে ফাঁকে টুকরো কথায় জানা গেল, অভিনব এ গানের দলে রয়েছেন ভিন্ন ভাষাভাষী চাকমা, গারো, মারমা, বম ও সিং জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীরা। বাংলা ভাষার পাশাপাশি তাঁরা নিজস্ব জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী গানও পরিবেশন করেন।
‘মাদলের’ শিল্পীরা এখন উদ্যোগ নিয়েছেন হারিয়ে যেতে বসা আদিম সুরের গানগুলো সংগ্রহের। পরে তাঁরা এগুলো আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে নতুন করে পরিবেশন করবেন। বলা ভালো, দেশে এ ধরনের গানের দল এটিই প্রথম। তবে বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজ নিজ ভাষার অসংখ্য গানের দল।

বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের ১৬টি জেলায় রয়েছে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, সিং, কোল, মাহতো, কড়াসহ প্রায় ৩৮টি আদিবাসীর প্রায় ১৬ লাখ মানুষের বসবাস। তাদের বেশির ভাগেরই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ‘মাদল’ নামের এক ধরনের ঢোল। সেখান থেকেই এ গানের দলের নামকরণ। উত্তরবঙ্গ ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের নানা প্রান্তে বাস করে ৫৪টিরও বেশি আদিবাসীর প্রায় ৪০ লাখ মানুষ।
পাহাড়ের আদিবাসীর বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়ের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বিজু (চাকমা), বৈসুক (ত্রিপুরা), সাংগ্রাই (মারমা), বিষু (তঞ্চঙ্গ্যা) অথবা গারোদের নবান্ন উৎসব ‘ওয়ানগালা’তেও এরই মধ্যে গান গেয়ে সাড়া ফেলেছেন ‘মাদলের’ শিল্পীরা। মে দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ নানা জাতীয় দিবসেও গণসংগীত পরিবেশন করেন তাঁরা।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে মাদল হাজির ছিল গান নিয়ে। আবার ২০১৪ সালে একজন ওঁরাও নেত্রী গণধর্ষণের শিকার হওয়ার প্রতিবাদে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ক্ষুদ্রজাতির ৬৫ কিলোমিটার পদযাত্রায় গানে গানে প্রেরণা জুগিয়েছে মাদল। বছর সাতেক ধরে এভাবেই তারা অংশ নিয়েছে শতাধিক অনুষ্ঠান ও কর্মসূচিতে।
ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যমেও সাড়া ফেলেছে মাদলের গান। বেশির ভাগ গানই তাদের নিজেদের লেখা। সুরারোপ করাটাও একান্তই নিজের।

‘মাদলের’ যাত্রা সম্পর্কে এর প্রধান কণ্ঠশিল্পী শ্যাম সাগর মানখিন এই লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমরা কয়েকজন আদিবাসী সংগীত শিল্পী ‘উদীচী’ সাংস্কৃতিক দলে যোগ দিই। ‘সমগীত’ নামে আরেকটি গণসংগীত দলের সঙ্গেও ছিল আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সেটি ২০০৯ সালের নভেম্বরের কথা। সেখান থেকেই আমরা ভিন্ন ভাষাভাষী ক্ষুদ্রজাতির ছাত্ররা জড়ো হয়ে ‘মাদল’ সংগঠনটি গড়ে তুলি। আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, ছাত্র ফেডারেশন, গারো সংগঠন চানচিয়াসহ (চিন্তা) বিভিন্ন সংগঠনের সূত্রে ক্রমেই আমরা ছড়িয়ে পড়ি ক্যাম্পাসের বাইরেও। প্রথমে বৃহত্তর রাজশাহীতে, পরে বৃহত্তর উত্তরবঙ্গ, ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আমরা গান পরিবেশন করতে থাকি।…

‘মাদলের’ আরেক প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ সিং এই লেখককে বলেন, প্রথম দিকে রিটন চাকমা, পিন্টু ম্রং, মানিক সরেন প্রমুখ যুক্ত হন আমাদের সঙ্গে। আদিবাসী গবেষক পাভেল পার্থ আমাদের প্রেরণা দেন। এমনও দিন গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমাদের গানের অনুশীলনের জন্য বসার জায়গা ছিল না। ধীরে ধীরে আমাদের অবস্থান তৈরি করতে হচ্ছে। এখনো রাজশাহী, ঢাকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের শিল্পীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করেন বলে কোনো একটি অনুষ্ঠানের আগে সবাই ঢাকায় জড়ো হলেও অনুশীলনের যথেষ্ট সময় পান না। স্থানাভাবও আছে।…

মাদলের ড্রাম ও কাজন বাদক আন্তনী রেমাও জানালেন একসঙ্গে অনুশীলনে প্রতিবন্ধকতার কথা।

মাদল সম্পর্কে শ্যাম সাগর আরো বলেন, আদিবাসীর শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদ করাই আমাদের লক্ষ্য। আর গানই আমাদের সংগ্রামের হাতিয়ার। আদর্শিক সংগ্রামটিকে আমরা এই ব্যান্ডের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে চাই। পাশাপাশি মাদলকে টিকিয়ে রাখতে আমরা চাই বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করতে।

এদিকে আদিবাসী নেতারাও মাদল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, মাদলের গানগুলো শোষিত আদিবাসীকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। গান গেয়ে তারা সৃষ্টি করেছে জগরণের এক নতুন ধারা।…

একনজরে ‘মাদল’ কর্মীরা : শ্যাম সাগর মানখিন (প্রধান কণ্ঠশিল্পী), হরেন্দ্রনাথ সিং (মাদল), রিটন চাকমা (গিটার), জেনসন আমলাই (লিড গিটার), অন্তুর স্কু (বেস গিটার), সায়ন মাংসাং (আড়বাঁশি), আন্তনী রেমা (ড্রাম, কাজন ও বঙ্গো) এবং যোয়েল চাকমা (ফটোগ্রাফি)।