২০০২ সালে সবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি। লেখাপড়া শেষ, এই রকম একটা ফুরফুরে ভাব মনে। কাজের সূত্রে যে প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হলাম, সেখানকার এক বড়ভাই মুক্তমনার ওয়েবসাইটের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন নতুন করে লেখাপড়া শুরু করেছিলাম। অভিজিত দা সদ্য লেখা শুরু করেছেন – তার প্রথম লেখাটি আমার মুক্তমনায় প্রথম পড়া আর্টিকেল- বিজ্ঞানময় কিতাব। এখনো মনে পড়ে, সেই সব উজ্জ্বল মানুষের লেখার সাথে পরিচিত হয়ে এক নতুন দুনিয়ার সন্ধান পেয়েছিলাম।
এর পর থেকে মুক্তমনার সাথেই বেড়ে উঠছি। সেখানে শুধু অভিজিত রায় একা নন, তার উতসাহে, সাহচর্যে এবং সঞ্চালনায় একঝাঁক মানুষ আলোচনা করেছেন এমন সব বিষয় নিয়ে, যা আমাদের গতানুগতিক ভাবনার অচলায়তনকে আঘাত করে তীব্রভাবে। যারা কোন একটা বিশ্বাস বা মতবাদে অন্ধ নন, যারা তাদের মগজের কিছু অংশকে তখনো বিশ্বাসের ভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, তারা সেই আঘাতে নিজেদের বিশ্বাসের জগতকে ভেঙে যেতে দেখলেন। সেখানে গড়ে উঠল এক নতুন চিন্তাপ্রক্রিয়া, প্রশ্ন আর সন্দেহই যার ভিত্তিমূল; এক নতুন পৃথিবীর হাতছানিতে তারা মেতে উঠলেন, প্রশ্ন করতে থাকলেন আশেপাশের সবকিছুকে। এমনি তীব্র ছিল এই আন্দোলনের ডাক যে, তাতে সাড়া দিতে না পারাটা অসম্ভব ছিল আমার কাছে। সাড়া দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, আমি রাস্তায় নেমে মিছিল করা শুরু করলাম, কিম্বা কলম/কি-বোর্ড ধরে সেই আন্দোলনে শরীক হলাম। আমি শুধু পড়ছিলাম, ভাবছিলাম, আর নিজের বারংবার ভেঙে পড়া বিশ্বাসের জগতকে জলাঞ্জলি দিয়ে নতুন এক স্বচ্ছ ভাবনাপদ্ধতির সাথে খাপ খাওয়াচ্ছিলাম নিজেকে। মিথ্যার আবরণহীন সেই স্বচ্ছতার অনাবিল আনন্দ আমাকে স্বর্গলোভ থেকে মুক্তি দিয়েছিল, মুক্তি দিয়েছিল নরকযন্ত্রনার ভয় থেকেও। ভয় থেকে মুক্তি, লোভ থেকে মুক্তি, আর মতবাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি – নশ্বর মানবজীবনকে বড় অমূল্য মনে হয়েছিল সে সময়।
কি চেয়েছিলেন এই মুক্তমনা আন্দোলনের মানুষেরা? মুক্তমনা আন্দোলন কি শুধুই ধর্মের বিরোধিতা, যেটা ধার্মিক এবং ধর্মব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে থাকেন?
কারো প্রতি বিদ্বেষ থেকে নয়, একদিন বিশ্বাসভিত্তিক ধর্মগুলো বিস্মৃতির অতল গহবরে তলিয়ে যাবে অথবা মানুষের ব্যক্তিগত সিন্দুকে ঢুকে পড়বে, আর বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্মহীন কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র মানুষের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে উসকে দেবে, সেই দিনের আশায় মুখ খুলেছিলেন তারা। তেমন দিনের সন্ধান পেতে চলেছে আমাদের এই পৃথিবীর নানা অংশের মানুষ, অথচ আমরা বাংলাদেশের মানুষকে সেই আলোকিত সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করে চলেছি ধর্মের অপরাজনীতির কূটকৌশলে। তারই বিরুদ্ধে আন্দোলন এই মুক্তমনা বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। লালন-রোকেয়া-নজরুল-আরজ যে আন্দোলনের পথিকৃত, হুমায়ুন আজাদ যে আন্দোলনের একজন প্রধান পুরুষ, অভিজিত রায় সেই আন্দোলনেরই আমাদের সময়ের একজন মশালবাহী। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারের সময়টাতেই মুক্তমনার বেড়ে উঠা, ফলে এই আন্দোলনের বেগটা আগের অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে তীব্র হয়েছিল। তারা আরজ আলী মাতুব্বরের মত একটি লেখা প্রকাশের জন্য বহুদূরে অবস্থিত শহুরে গুণগ্রাহীদের উপরে নির্ভরশীল ছিল না; তারা লালনের মত মনের কথা সরাসরি বলতে না পেরে সুফী গান আর দেহতত্বের রুপকের আশ্রয় নিতে চায় নি। তারা ইন্টারনেট নামক মুসার লাঠির সাহায্যে যাদুবলে মাউসের এক ক্লিকে পৌঁছে গিয়েছিল লক্ষ পাঠকের কম্পিউটারের স্ক্রীনে, কিম্বা ক্লাউডে। জুকারবার্গের মোজেজায় তারা শহরে-গ্রামে-মফঃস্বলে অসংখ্য অনুসন্ধানী তরুণ মনকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল।
আমি ভাগ্যবান যে, সেই সময়ে আমি বড় হয়েছিলাম।
আমার মনে আছে, যেদিন অভিজিত রায় প্রকাশ্যে রাস্তায় খুন হলেন, তার কয়েক মিনিট পর থেকেই ফেসবুকারের দল, অনলাইনে যত্রতত্র গজিয়ে উঠা পোর্টাল, মূলধারার পত্রপত্রিকা, এমনকি রাষ্ট্রের কর্তাদের মুখেও তার চরিত্রহননের এক উতসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। অভিজিত রায় খুন করেন নি, ডাকাতি করেন নি, ঘুষ খান নি, কাউকে খুন করতে প্ররোচনাও দেন নি; তিনি স্রেফ লিখেছিলেন তার নিজের ভাবনাগুলো। আমাদেরকে ভাবিয়েছিলেন। অথচ তার বিরুদ্ধে এই উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, অভিজিত রায়কে চেনেন না বা তার লেখালেখি পড়েন নি, এমন কারো পক্ষেও তাকে কতলযোগ্য মনে হয়েছিল, এবং সেটা ছিল এইসব সমন্বিত প্রচারণার সাফল্য। কি নির্মম, কি হৃদয়হীন সেই যৌথ অপপ্রচারের তীর, একজন মৃত মানুষের প্রতি!
তার খুনের বিচার হয় নি, এবং হবে বলে আশা করাটাই এখন বোকামী। তবে এই দেশ ও সমাজ একদিন অভিজিত রায় কিম্বা হুমায়ুন আজাদের কাছে নতশিরে ক্ষমাপ্রার্থী হবে, সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। হুমায়ুন আজাদকে খুন করেছে ধর্মান্ধরা। অভিজিত রায়ের মগজ রাস্তার কংক্রীটে ছিটিয়ে দিয়েছে ধর্ম আর অপরাজনীতির মিশ্রণে বানানো চতুর এক ককটেল। তবে তাদের জ্বালানো সেই বিজ্ঞান ও যুক্তির প্রদীপ নেভাতে পারে, তেমন সাধ্য নেই আমাদের এই সময়ের। মানুষ একদিন যখন মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, ভয়হীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, সেদিন তারা এই মুক্তমনা আন্দোলনকে স্মরণ করবে, যেমন করে আমরা স্মরণ করি মানুষের ইতিহাসের চিন্তানায়কদের। অভিজিতেরা তাই অমর।
অভিজিত রায়ের জন্মদিনই হোক আমাদের নতুন করে শপথ নেওয়ার দিন, মুক্তমনা আন্দোলনকে বেগবান করার দিন।
আলম ভাই , আমি ও নিজেকে নানা দিক দিয়ে বদলে ফেলছি । আগের অবস্থান থেকে 180 ডিগ্রি কোণে এখন অবস্থান আমার ।আপনার লেখা টি পড়ার সময় চোখ ফেরাতে পারি নি ।অনেক দিন আগেই লিখেছিলাম এই কবিতাটি: (গদ্য কবিতা) অভিজিৎ দা,আপনি চলে যাবার পর আরো বেশি করে আপনাকে কাছে পেয়েছি, /আপনার রক্তের প্লবতা -আমাকে এখনো ভাসিয়ে রাখে মুক্তির নেশায় ;/ আপনার স্বপ্ন প্রতিনিয়তই ঝরে – আমার স্নায়ুর উত্তেজনায় । /দাদা, আমার অণুবীক্ষণে ও বিশ্বাসের ভাইরাস ধরা পড়ে, / অবিশ্বাসের দর্শন আমি ও বুঝি, /প্রাণের রহস্য খুজতে গিয়ে/ রসায়নের দারুণ জটিলতা আয়ত্বে আনি;/দাদা, ভিতরে ভিতরে খুব গভীর ভাবে- /অনুভব করি আপনাকে ।
মন্তব্য…এরিস্টটল থেকে হুমায়ূন অাজাদ, হেমলক থেকে চাপাতি। জিজ্ঞাসুদের জিজ্ঞাসা কম হয় না, তাই প্রত্যেক সমাজের রক্ষণশীল শ্রেণি এদের পরাস্ত করতে পদ্ধতি ও অস্ত্র পরিবর্তন করে মাত্র। কিন্তু, নতুন চিন্তাকে পদ দলিত করতে পারে না।