নীলয় নীল হত্যার এক বছর পেরিয়েছে। বিচারহীনতার ১ বছর চলে গেল। নীলয় নীলকে নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে, কিন্তু কেন যেন বারবার থেমে যাচ্ছিলাম। আজ আবার নীলয়কে নিয়ে লিখতে বসলাম।
নীলয়কে আমি অনলাইনের মাধ্যমে চিনি, কোনদিন সামনা-সামনি দেখা হয়নি তার সঙ্গে। কিন্তু পরিবর্তনের সংগ্রামে সোশ্যাল মিডিয়ায় ও বাস্তব জীবনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ও লেখালেখির কারনেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। এখনও মনে পড়ে,- ২০১৩ সালে গণ জাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হওয়ার পরই নীলয় নীল আমাকে ফেসবুকে বন্ধুত্বের আহ্বান জানান। তার প্রতিবাদ মুখর লেখায় এবং সাহসিকতার সঙ্গে সরাসরি প্রতিবাদে অংশগ্রহণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। বিশেষ করে, যখন ব্লগারদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হলো, তখনও নীলের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ।
মানুষ মাত্রই সমলোচনার উর্ধ্বে না। তার অনেক কাজের ও লেখার তীব্র সমালোচনাও করেছি আমি। কিন্তু সমালোচনার কারনে নীলের সঙ্গে কোনদিনও আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কে ফাটল ধরেনি। বরং সমালোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন তিনি সব সময়। এটা ছিল নীলয়ের একজন মুক্তমনার মতো আচরণ। নীলয় নীলের বড় মন- মানসিকতার একটি স্ক্রীণশট দিতে চাই আমি, যেখানে নীলয় আমাকে নিজের বিপদের কথা জানিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজের বিপদের চেয়ে অনেক বেশি অন্য এক্টিভিষ্টদের জীবন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।
ব্লগার ও লেখক নীলয় নীল লিখেছেন বিভিন্ন বিষয়ে: নারীবাদ থেকে শুরু করে ধর্ম, দর্শন, মানবাধিকার, সমকামিতা, সমাজ, রাজনাীতি; সমাজ এবং রাষ্ট্রের যেখানেই অসংগতি দেখেছেন তাই নিয়ে লিখতেন তিনি। বিশেষ করে বৌদ্ধশাস্ত্রে বিতর্কিত, অবৈজ্ঞানিক ও দূর্বল দিকগুলো নিয়ে তার গবেষণাধর্মী লেখাগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মাম্বলী মানুষের দ্বারা নীলয় প্রাণের হুমকিতে পড়েননি। তিনি জানতেন, তার ওপরও আঘাত আসতে পারে, তবুও ভয় পেয়ে থেমে যায়নি তার কলম। লিখে গিয়েছেন, মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত। তার শেষদিকের লেখাতে মৃত্যুর আশংকা লক্ষ্য করা যায়।
নীলয় বুঝতে পেরেছিলেন, হামলা তার ওপরেও হবে, তাকেও ছাড় দেয়া হবে না। প্রতিটি মুহুর্তে আশংকা করছিলেন- এই বু্ঝি এলো মৃত্যুর ভয়ংকর থাবা। প্রচন্ড আতংক নিয়ে লিখেছিলেন তিনি আমাকেও। বার বার স্থান পরিবর্তন করে ছুটে বেরিয়েছেন তিনি নিজেকে বাঁচাতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত শেষ রক্ষা হয়নি তার। ৫ জুলাই ২০১৫ আমি নীলয় নীলের একটি বিশাল চিঠি পেলাম। এখানে চিঠির কিছুটা অংশ তুলে ধরলাম।
ইসলামী জঙ্গিবাদ নিয়ে রাজনীতির খেলা হচ্ছে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। নিলয় নীলকে হত্যার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিল, তবু আজ পর্যন্ত নীলয় নীলের হত্যাকারীদের বিচার হয়নি। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল- তাদের মধ্যে একজন প্রতিমন্ত্রীর ভাজিতা ছিলেন- তাকে সনাক্ত করে পুলিশকে জানানোও হয়েছিল- কিন্তু তার বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। আজও তাকে নৃশংসভাবে হত্যার সাক্ষী- তার জীবনসঙ্গিনী আশামনি নিজে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আর বিচার চাইছেন দ্বারে দ্বারে। আশামনি বলেন, নীলয়কে ফেরাতে পারবো না আমি, কিন্তু নীলয়ের আদর্শকে বয়ে নিয়ে যাবো আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ২৬ এপ্রিল ২০১৬ গার্ডিয়ান পত্রিকায় আশামনির একটি সাক্ষাতকার ছাপানো হয়।
বছরের পর বছর গড়িয়ে যাবে- কিন্তু অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলয় নীল, ফয়সাল আরেফীন দীপন, নাজিমুদ্দিন সামাদ, জুলহাজ মান্নান, তনয়দের খুনীদের ধরা হলেও বিচার আর হবে না। কারন,- এইসব হত্যাকান্ডগুলোকে ব্যবহার করে, সংখ্যালঘুদের ধর্মান্ধদের ধর্মানুভূতিকে পূজি করে এভাবেই ভোটের রাজনীতি চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু নীলয়দেরকে হত্যা করা হলেও তাদের কন্ঠ বধ করা যাবে না। আমরা যারা অসংখ্য নীলয় এখনো বেচে আছি, আমরা আজীবন রাষ্ট্রের, সমাজের এবং বিশ্বের সকল অসংগতি, ভন্ডামি আর আদিম বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলে যাবো। বিশ্বের সর্বত্র সকল মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিশ্বাসের পাশাপাশি অবিশ্বাসের অধিকার আর মানুষের ব্যাক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাবো। এ ব্যর্থ রাষ্ট্র নীলয় নীলদের শারীরিক মৃত্যুর বিচার করার সাহস হয়তো কোনদিনই অর্জন করবে না, কিন্তু নীলয়ের মতো আত্মত্যাগী মুক্তমনারা এ বিশ্বকে পরিবর্তনের সাহস নিয়েই সংগ্রামে মেতেছে, তা না হলে আদিম গুহা থেকে বিশ্ব আজ সভ্যতার এ দূয়ারে পৌছাতো না। নীলয়দের জয় হবেই। ধর্মান্ধ রাষ্ট্র আর জাতিগুলোকেই বেচে থাকতে হবে ধর্ম-ব্যবসা, মিথ্যা- ভন্ডামী আর বিচারহীনতার দায়ভার কাধে নিয়ে। আর এভাবেই নতুন শক্তি নিয়ে মুক্তমনারা স্মরণ করবে নীলয়ের প্রতিটি মৃত্যুবার্ষিকী।
ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা
১৫ আগষ্ট ২০১৬।
একজন রক্ত-মাংসের মানুষকে মেরে হয়তো দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া যায় কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শের কোনো মৃত্যু নেই।তা বরং কয়েকগুন বেশি শক্তি নিয়ে আলোর দীপ্তি ছড়ায়।
আমার লেখা একটি গানের মাঝের চারটি লাইন,মুক্তমনাদের নিয়েই লেখা গানটি:ধর্ম যেখানে আফিমের মত /ছড়ায়ে রয়েছে নেশা,/আমরা সেখানে জ্বালায়ে আলো /দেখাবই নব দিশা……নীল এখানে আলো জ্বালিয়ে গেছে ,তা তো নিভবে না বিশ্বাসীদের চাপাতিতে!
কজনকে মারবে ওরা, কত বার? কত কাল?
আলোর মিছিলে সবাই মুক্তমনের মানুষ; সবাই একাকার। একটি অভিভিজিৎ রায়, একটি ওয়াশিকুর রহমান বাবু, একজন অনন্ত বিজয় দাশ অথবা নীলয় নীল কিংবা ফয়সাল আরেফীন দীপন, নাজিমুদ্দিন সামাদ, জুলহাজ মান্নান, তনয়; অন্য সব অনেক মুক্তমনের আলোর মানুষ; কেউ আলাদা নয়।
সংগ্রাম চলবেই।
হৃদয় নিঙড়ানো শক্তিশালী লেখাটির জন্য স্নিগ্ধা’কে অনেক ধন্যবাদ।
“এ ব্যর্থ রাষ্ট্র নীলয় নীলদের শারীরিক মৃত্যুর বিচার করার সাহস হয়তো কোনদিনই অর্জন করবে না, কিন্তু নীলয়ের মতো আত্মত্যাগী মুক্তমনারা এ বিশ্বকে পরিবর্তনের সাহস নিয়েই সংগ্রামে মেতেছে, তা না হলে আদিম গুহা থেকে বিশ্ব আজ সভ্যতার এ দূয়ারে পৌছাতো না। নীলয়দের জয় হবেই।” :good: :good: :good: :good: :good: