বৃটিশ শাসনামলে মেঘনাদ সাহা ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বে একজন খ্যাতিমান পদার্থবিদ হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন। ১৯২০ এর দশকে তিনি নক্ষত্রের বর্ণালী বিশ্লেষণে তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্বে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে আমৃত্যু তিনি বিজ্ঞানের জন্য এবং বিজ্ঞানমনষ্কতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন। তাঁর জীবনী আমাদের উৎসাহীত করবে নানা ভাবে। প্রথমতঃ তিনি বাংলাদেশের এক অজপাঁড়া-গাঁ এর দরিদ্র ও নিন্মবর্ণের হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেও নানা প্রতিকূলতার বাধা পেরিয়ে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি কেবল একজন বিনম্র পড়ুয়া লোকই ছিলেন না, তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য বৃটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবে জড়িয়েছিলেন যে আন্দলনের ফসল হিসেবে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আজ এই বিপ্লবী-বিজ্ঞানীর কঠোর জীবন-সংগ্রাম ও অবদানের গল্পই করব।
মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ সালের ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে শ্যাওড়াতলী গ্রামে। তিনি তাঁর পিতা জগন্নাথ সাহার আট সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন। একজন সাধারণ মুদি দোকানী পিতার পক্ষে এতবড় সংসার চালানো দুঃষ্কর হয়ে পড়েছিলো। তাই তাঁর পিতা চেয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর বড়ভাই দোকানের বিক্রি-বাট্টার কাজে তাঁকে সাহায্য করবেন। তবে মেঘনাদের মা এবং চাচা এই পরিকল্পনায় বাধা দিয়ে তাঁর মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করার ব্যবস্থা করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষায় তিনি খুবই ভালো ফলাফল করেন এবং তাঁর সুযোগ খুলে যায়। ১৯০৫ সালে তিনি ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি হিসেবে পূর্ণবৃত্তি নিয়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এই বছরটি ভারতের বিশেষ করে বাংলা প্রদেশের ইতিহাসে ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ ছিলো। এই বছরেই লর্ড কার্জন বাংলাকে মুসলিম ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুযায়ী দুই ভাগে বিভক্ত করে দেন, যা বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত হয়েছিলো। এই ঘটনায় সারা বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পূর্ববঙ্গ ও আসাম অংশের লেফটেন্যান্ট গভর্ণর জোসেফ ব্যাম্পফাইল্ড ফুলার ঢাকা ভ্রমনে আসলে ঢাকার নাগরিকগণ প্রতিবাদকর্মসূচীর উদ্যোগ নেন। মেঘনাদ সাহা ও অন্য আরো অনেক ছাত্র এতে অংশ নিয়েছিলেন। এই ঘটনায় মেঘনাদের বৃত্তি বাতিল করা হয় এবং তাঁকে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়। এসময় তাঁর ভাই তাঁকে সাহায্য করায় তিনি রক্ষা পান।
১৯১১ সালে মেঘনাদ ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। তিনি পদার্থ ও গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর লাভ করেন, তবে সার্বিকভাবে তৃতীয়স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯১৩ সাল নাগাদ গণিতে বিএসসি সম্পূর্ণ করেন। এ সময় তিনি কলেজের নিজস্ব হোস্টেল ইডেন হিন্দু হোস্টেলে বাস করতেন। এখানে নিজের নিন্ম বর্ণের পরিচয়ের জন্য তিনি প্রবল বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। সেই সময় শিক্ষা-দীক্ষা মূলতঃ উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দখলেই ছিলো। তাই হোস্টেলে শুদ্র শ্রেনীর কারো উপস্থিতি অনেকের জন্যই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো এবং উচ্চবর্ণের ছাত্রদের অনেকে তাঁর সাথে একই ডাইনিং হলে খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো। কিছু কিছু ব্রাহ্মন ছাত্র তাঁকে এমনকি বিদ্যার দেবী স্বরস্বতীর প্রতি শ্রধ্যার্ঘ অর্পন করতেও বাধা দিয়েছে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে সাহার সহপাঠী ছিলেন আরেকজন বরেণ্য পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এই সময় তাঁরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন স্বনামধন্য রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং পদার্থবিদ ও উদ্ভিদ-শরীরতত্ত্ববিদ জগদীশ চন্দ্র বসুর মত ব্যক্তিত্বকে। সেই সাথে ছিলেন খ্যাতিমান গণিতবিদ দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক। এই বরেণ্য শিক্ষাগুরুদের সংস্পর্শে এসে তিনি বিজ্ঞানকে ভারতের স্বাধীনতা এবং অগ্রসরতার পথে কাজে লাগাতে উব্ধুদ্ধ হলেন।
গ্র্যাজুয়েট ছাত্র থেকে পদার্থবিদ হওয়ার পথে তাঁর অবিশ্মরনীয় উন্নতি ঘটে। এর মধ্যে কিছু দৈব ঘটনা যেমন: বিভাগ বদলী এবং একটি সেমিনারে শিক্ষকতা তাঁকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের হালনাগাদ গবেষনাগুলোর সান্নিধ্যে নিয়ে আসে। সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো তাই কলকাতায় বিজ্ঞানের নতুন হালনাগাদকৃত তথ্য সমৃদ্ধ বইগুলো সহজপ্রাপ্য ছিলো না। তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একজন অস্ট্রীয় বিজ্ঞানীর সান্নিধ্যে তিনি আসতে পেরেছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই তিনি ম্যাক্স প্ল্যাংক রচিত Treatise on Thermodynamics এবং ওয়ালথার নার্নস্ট রচিত The New Heat Theorem: Its Foundation in Theory and Experiment এর ইংরেজি অনুবাদগুলো পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি প্রফুল্ল চন্দ্র রচিত A History of Hindu Chemistry from the Earliest Times to the Middle of the Sixteenth Century A. D. বইটি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর বাইরেও নীলস বোর এবং আরনল্ড সমারফেল্ডের কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত তত্ত্ব সম্বন্ধে তিনি অবগত হয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকার সময় সাহা অস্ট্রিয়া ফেরত একজন রসায়নবিদের কাছ থেকে জার্মান শিখেছিলেন। বাংলামুলুকে বসে জার্মান ভাষা প্রয়োগ করা দুঃষ্কর ছিলো, কিন্তু তিনি এর পেছনে কঠোর শ্রম দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর শ্রম খুব ভালোভাবে কাজে লেগে গেল। ১৯১৯ সালে যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন তখন সত্যেন্দ্রনাথ বোসকে সাথে নিয়ে আলবার্ট আইনস্টাইন এবং হারম্যান মিনকোস্কির লেখা আপেক্ষিকতার গবেষনাপত্রটি প্রথমবারের মতো জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললেন। সারা বিশ্ব সেই প্রথমবার আপেক্ষিকতার গবেষনাপত্রটি ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ পেল। এটি পড়ে ব্রিটিশ জোতির্বিদ আর্থার এডিংটন পরীক্ষামূলকভাবে আপেক্ষিকতার সত্যতা নিরূপন করেন এবং রাতারাতি আইনস্টাইন একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিতে পরিণত হন।
একই বছর মেঘনাদ সাহা চিরায়ত বিভিন্ন জোতিঃপদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ের সমস্যা যেমন: সৌর উদগীরন, করোনা, এবং বিশেষ করে ধুমকেতুর লেজ সর্বদা সুর্যের বিপরীতে অবস্থান করার ঘটনা ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করেন। আলোক তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এধরনের বিভিন্ন বিষয়ে নানাবিধ ত্রুটি দেখা যাচ্ছিলো। তিনি জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের আলোর তীব্রতা ও চাপসংক্রান্ত ফলাফলের বিষয়ে ওয়াকীবহাল ছিলেন। কিন্তু সেই সাথে তিনি দেখতে পেলেন ম্যাক্সওয়েলের ফলাফল কেবল সেসব বস্তুর জন্য প্রযোজ্য হয় যেগুলোর প্রতিবন্ধক বস্তুটির মাত্রা আরোপিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি হয়। যেহেতু পরমানুর ব্যাস আলোক তরঙ্গের চেয়ে ক্ষুদ্র তাই এরা কোনো বিকিরণ চাপ অনুভব করে না এবং এই কারণে এই ফলাফলের মাধ্যমে ধুমকেতুর লেজের সূর্যের বিপরীত দিকমুখীতার কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।
মেঘনাদ সাহা শক্তি এবং ভরবেগের অবতারণা করে ধুমকেতুর এই আচরণ ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, আলোর কোয়ান্টা পরমাণুতে চাপ প্রয়োগ করবে যদি পরমাণুটি বিকিরণটিকে শোষন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি পর্যবেক্ষণ করলেন হাইড্রোজেন আলফা লাইনের আলোর একটি পালস শোষন করলে একটি হাইড্রোজেন পরমাণু সেকেন্ডে ৬০ সেমি গতি লাভ করতে পারে।
সেই সাথে ১৯১৯ সালে সাহা “On selective radiation pressure and its application,” নামে Americal Astrophysical Journal এ একটি গবেষনাপত্র প্রকাশ করেন সেখানে তাঁর বিখ্যাত “সাহা সমীকরণ” প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের বছর তাঁর তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব সুর্য এবং অন্যান্য নক্ষত্রের আভ্যন্তরীন ক্রিয়া, রাসায়নিক গঠন, মৌল ঘনমাত্রা এবং পৃষ্ঠীয় মধ্যাকর্ষন সম্বন্ধে নতুন দিক নির্দেশনা দেয়। এই সময়ে তিনি আলোর কোয়ান্টাম তত্ব এবং নীলস বোরের পারমাণবিক তত্ত্বের মাধ্যমে দেখান যে নাক্ষত্রিক পরমাণুসমূহের বিকর্ষন বল অনুভব করার জন্য বিকিরণ চাপ দায়ী। তাঁর তত্ত্ব থেকে অনুমান করা যায়, মৌলের কিছু বর্ণালী রেখা কেবল মাত্র নক্ষত্রের নিন্ম তাপমাত্রা এলাকাতেই পাওয়া যেতে পারে। তিনি একই সাথে তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ
প্রতিপাদন করেন। এটি জোতিঃপদার্থবিদ্যার বর্ণালীর সমীকরণ যা থেকে কোনো মৌলের আয়নীকরণ মাত্রা গননা করা যায়।
সাহা কয়েকবছরের মধ্যে আলোর পালস এবং শক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে কম্পটন প্রভাব অনুমান করেন। ইউরোপের অনেক পদার্থবিদ কম্পটন প্রভাব সম্বন্ধে জানার আগে আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিষয়ে সংশয়গ্রস্থ ছিলেন, তাঁর এই আবিষ্কার পদার্থ বিজ্ঞানে তাই যুগান্তকারী হিসেবেই দেখা হয়। সাহা বিভিন্ন জোতির্পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত ঘটনা যেমন: ধুমকেতুর লেজের আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যাবহার করেন। জোতির্পদার্থবিদ্যায় আয়নীকরণ তত্ত্ব সংক্রান্ত তাঁর কাজের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়েছিলো কেননা এটি জোতির্বর্ণালী সংক্রান্ত গণনার ক্ষেত্রে গুনগত তৎপর্যের উর্দ্ধে উঠে যথাযথ পরিমাণগত গণনায় ব্যাবহার উপযোগী হয় এবং তার ফলে নক্ষত্রসমূহকে যথাযথভাবে শ্রেনীবিন্যাস করা সম্ভব হয়। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৭ সালে মেঘনাদ সাহা লন্ডনের রয়াল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।
বিপ্লবী আন্দোলন:
প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় মেঘনাদ সাহা বিপ্লবী স্বদেশী আন্দোলনকারী নেতৃত্ববৃন্দের সংস্পর্শে আসেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং শৈলেন ঘোষ। অবশ্য বিপ্লবীদের গুঢ় আন্দোলনপন্থার কারণে ইতিহাসবিদগণের পক্ষে মেঘনাদ সাহার বিপ্লবী আন্দোলনের বিস্তারিত জানা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদীদের স্বাধীনতা আন্দোলনে তৎকালীন আইরিশ রিভোলিউশনারী সিন ফেইন পার্টির স্বাধীনতা আন্দোলন অনুপ্রেরনা জুগিয়েছিলো। জার্মানীর সহায়তায় আইরিশ অভ্যুথ্থানকারীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু গুপ্ত সংগঠন তৈরি করেছিলো।
সিন ফেইন বাঙ্গালিদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিলো কারণ শুত্রুপক্ষ ছিলো একই –ব্রিটিশ, যারা এই দুটি জাতির মধ্যেই দীর্ঘদিন ধরে উপনিবেশ কায়েম করে রেখেছিলো। আইরিশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টির আন্দোলন নানা দিক থেকেই উপমাহাদেশীয় গান্ধীবাদী আন্দোলনের সাথে তুলনীয় ছিলো। মেঘনাদ সাহা এই ধরনেরই সংগঠন অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তরের সাথে জড়িত ছিলেন।
বিপ্লবী গোষ্ঠিতে যোগ দিয়ে যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী (বাঘা যতীন নামে অধিক পরিচিত) এবং পুলিন দাসের মতো নেতার সংস্পর্শে এসে তরুন মেঘনাদ সাহা সশস্ত্র প্রতিরোধে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এবং এর ফলে ব্রিটিশ নানাবিধ চাপে তাঁর জীবন ওষ্ঠ্যাগত হয়ে যায়। একটি ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে একজন পদার্থবিদের এধরনের বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে যাওয়া খুবই বিরল ঘটনা।
বাংগালীদের সংগঠন অনুশীলন সমিতির সাথে ১৯১৫ এর দিকে পাঞ্জাবের বিপ্লবী সংগঠন গদর পার্টির বেশ ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে এই দলটির কর্মকান্ড পরিচালিত হত কানাডা ও সানফ্রান্সিসকো প্রবাসী বিভিন্ন বিপ্লবী নেতার মাধ্যমে। বার্লিনে অবস্থিত গদর বাহিনীর কিছু সদস্য বাঘা যতীনকে অবহিত করেন যে জার্মানীর কাইজার উইলহেম ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভুতিশীল এবং জার্মানী এই বিপ্লবীদের অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে আগ্রহী। এই কর্মকান্ডের তদারকিতে ইন্ডিয়ান রেভোলিউশন কমিটি নামে বার্লিনে একটি সংগঠন তৈরি হয়। কাইজারের মারফত বাঘা যতীন জানতে পারেন হেনরী নামের অস্ত্রবাহী একটি জাহাজ সিঙ্গাপুর থেকে ফিলিপাইন হয়ে সুন্দরবনে ভীড়বে।
মেঘনাদ সাহা এবং যাদুগোপাল মুখার্জীকে এই জাহাজ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে ১৯১৫ এর ২ জুন, হেনরী যখন সাংহাইয়ের বন্দরে ভেড়ে, তখন বি্রটিশ এবং ফরাসী বাহিনী জাহাজটিতে তল্লাশি চালিয়ে সব অস্ত্র উদ্ধার করে নিয়ে যায়। জাহাজটি সুন্দরবনে না ভীড়ে জার্মানীতে ফিরে যায় এবং মেঘনাদ সাহা খালি হাতে ফিরে আসেন।
১৯১৯ সালটি শুধু মেঘনাদ সাহার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্যই গুরুত্বপূর্ন নয়, বরং এ বছরটি ভারতীয় মুক্তিকামী আন্দোলনের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার ঠিক পর-পরই এইবছর ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী বিতর্কিত রাওলাট আইন জারি করে। এই আইনের আওয়ায় যে কোন ব্যক্তিকে সন্দেহের বশে এবং কোনো রকম আপিল করার সুযোগ প্রদান ছাড়াই আটক করে রাখা যাবে এবং তাদের আইনি সুবিধাবঞ্চিত করা যাবে। এই আইনের বিরুদ্ধে সারা ভারতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আন্দোলনের তীব্রতা বাংলা এবং পাঙ্জাবেই সবচেয়ে বেশী দেখা যায়। এই আইনের প্রেক্ষিতেই মহাত্মা গান্ধী সত্যগ্রহ চালু করেন। ব্রিটিশ সরকার সেই সময় যেখানে সম্ভব হয়েছে কঠোরভাবে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছে।
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসারের জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি নৃসংস ঘটনা ঘটে। বি্রটিশ কর্নেল রেজিনাল্ড ডায়ের একটি নিরস্ত্র প্রতিবাদের উপর নির্বিচারে গুলি করার আদেশ দিলে প্রচুর প্রাণহানি ঘটে। মেঘনাদ সাহা এর প্রতিবাদে লেখালেখি করেন। বিদ্যমান নৃশংসতায় মনোবল হারিয়ে তিনি পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেন। নিজের জ্ঞান দিয়ে তিনি ভারতের উন্নয়নকল্পে মনোনিবেশ করেন।
অন্য অনেক বিদুষকের বিপরীতে মেঘনাদ সাহা ভারতবর্ষের নানাবিধ সমস্যা যেমন: নদী ব্যবস্থাপনা, রেলওয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারতের বিদ্যুৎব্যবস্থা এসব নিয়ে লেখালেখি করেন এবং ভারতজুড়ে এসব বিষয়ে সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। তাঁর সারা জীবনের অন্যতম প্রেরণা ছিলো জাতির জন্য বিজ্ঞান সচেতনতা এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমেই জাতির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা। ১৯৩১ সালে তিনি Academy of Sciences of the United Provinces of Agra and Oudh প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩২ সালে তিনি এর প্রেসিডেন্ট নিয়োজিত হন।
মানবীয়করণে বিজ্ঞানের ভুমিকা মেঘনাদ সাহার আরেকটি অনুপ্রোরনা ছিলো। একাডেমির প্রেসিডেন্ট পদ নেওয়ার দুই বছেরের মাথায় তিনি Indian Science News Association প্রতিষ্ঠা করেন। এই এসোসিয়েশনের সহায়তায় তিনি Science and Culture নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করেন। ১৯৫৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি একই জার্নালের সম্পাদক হিসেবে কাজ করে গেছেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ জার্নাল Nature এর আদলে গঠিত এই জার্নালটিতে বিজ্ঞানের সামাজিক অবদানসমূহ তুলে ধরা হতো এবং অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার দূর করে সাধারণ মানুষের মাঝে বিজ্ঞানের ধারনা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালানো হতো। সাহা আশা করেছিলেন এই জার্নালের লেখাগুলোতে সাধারণভাষায় গবেষনাপত্র প্রকাশ করা হবে যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হবে এবং বিজ্ঞান প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের সমস্যাগুলো এই জার্নালের গবেষনাপত্রে উঠে আসবে। এর মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন ভারতীয় সমাজে সাংস্কৃতিক এবং মানবীয় চর্চা বৃদ্ধি পাবে, জাত-পাতের সমস্যা ধুর হবে, মানুষের মধ্যে সমতা তৈরি হবে এবং সরকারের বিভিন্ন নীতির গঠনমূলক সমালোচনা উঠে আসবে।
Scince and Culture জার্নালটির প্রথম ভলিওমে মেঘনাদসাহার নিজেরই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষনা প্রকাশ পায়। এর মধ্যে রয়েছে “Ultimate constituents of matters” যাতে সমসাময়িক নিউক্লীয় পদার্থ বিজ্ঞান, বোরের এটমিক মডেল এবং তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ক অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। “The march towards abosolute zero” তে জার্মানীতে নার্নস্টয়ের গবেষনাগারে থাকাকালীন তাঁর পোস্টডক্টরাল কাজকর্ম তুলে ধরেন। “The existence of free magnetic poles” এ ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল ডিরাকের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ধারনা এবং একক চৌম্বক মেরুর অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এবং “Spectra of comets” গবেষনাপত্রে সাহার প্রাথমিক গবেষক জীবনের জোতিঃপদার্থবিদ্যার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় যাতে তাঁর ধুমকেতুর বর্ণালী বিষয়ক গবেষনা উঠে আসে।
এই জর্নালের সম্পাদকীয়তে তিনি খোলা মনে ভারতীয় সরকারের বিজ্ঞান বিষয়ক নীতিমালার সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে তিনি ভারতের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বিভিন্ন উদ্যোগের সমালোচনা করেন। তিনি মনে করতেন নেহেরু বিজ্ঞান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠার জন্য খুবই তাড়াহুড়া করছেন এবং এটি করতে গিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতের উপযোগী প্রযুক্তির প্রতি জোর দিচ্ছেন না। নেহেরু একজন স্বপ্নদ্রষ্টা কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক দক্ষতার অভাবের কথা সাহা তাঁর সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া সাহা একেবারে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশ থেকে থেকে উঠে আসা মানুষ তাই তাঁর পক্ষে সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা, প্রয়োজনীয়তা এসব উপলব্ধি করা সহজ, কিন্তু অভিজাত পারিবারিক ইতিহাসের নেহেরুর পক্ষে সাধারন্যের প্রয়োজনীয় সবকিছু উপলব্ধি করা সহজ নয়। এসবের ফলের সাহার সাথে নেহেরুর তিক্ততাও তৈরি হয়।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা জোরদার হতে শুরু করলে মেঘনাদ সাহা একটি নিউক্লিয় গবেষনা প্রতিষ্ঠান চালু করার উদ্যোগ নেন। এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রভাবমুক্ত রাখার পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। তাঁর ছাত্র বাসন্তী দুলাল নাগ চৌধুরি ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কেলিতে আর্নেষ্ট লরেন্সের সাথে কাজ করেন। ভারতে ফিরে আসলে তিনি তাঁকে সাথে নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সাইক্লোট্রোন নির্মান করেন। ১৯৪৯ সালে সাহা কলকাতায় নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বিশিষ্ট পদার্থবিদ এবং কুরি দম্পতির কন্যা আইরিন জুলিও-কুরি আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করেন।
ভারতীয় অন্যান্য স্বনামধন্য গবেষকের তুলনায় সাহার জীবনে ছিলো অনেক নাটকীয় মোড়। তিনি হতদরিদ্র, অশিক্ষিত এবং নিন্মবর্ণের পরিবার থেকে দুঃখ-কষ্টের কষাঘাতে জর্জরিত হতে হতে বড় হয়েছেন। তারপরেও তিনি নিজেকে ভারতীয় ‘ভদ্রসমাজে’ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন যথেষ্ট প্রভাবের সাথে। তিনি শুধু একাডেমিক দিক থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন নি বরং একজন সাংগঠক হিসেবে বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারা ভারতের মানুষের মাঝে।
মেঘনাদ সাহার বিপ্লবী চরিত্রটি বাঙ্গালি নেতৃত্বের দ্বারা প্রভাবিত ছিলো, যারা গান্ধীবাদী আন্দোলনের বিপরীতে সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বু্দ্ধ হয়েছিলো। সাহার বেড়ে ওঠার সময়কালীন রাজনৈতিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ তাঁর ক্যারিয়ারে প্রবলভাবে ছাপ রেখে গিয়েছিলো। তাঁর চারিত্রিক বৈচিত্র্য তাঁর জীবনযাত্রার বৈচিত্র্য থেকেই উঠে এসেছে। বাঙ্গালী ও ভারতীয় তরুনসমাজের কাছে তিনিই হতে পারেন সবচেয়ে কাছের উদাহরণ এবং সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
:yes:
ভাল লাগলো, কিন্তু লেখার মধ্যে নিম্ন বর্ণে হিন্দু আর উচ্চ বর্ণের হিন্দু একটা বড় বৈশম্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, আমার প্রশ্ন হলো সাহা কি করে নিম্ন বর্ণের হিন্দু হলো বলবেন কি????
ভালো লাগলো, পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
ধন্যবাদ।
চমৎকার লাগল। এই অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের নিয়ে এমন লেখা বেশি করে লেখা উচিত। :good: :good:
ধন্যবাদ। 🙂