21657046_BG1
সেই ছোটবেলা থেকে বামপন্থার সাথে বসবাস। আমার বাবা বাম রাজনীতির সাথে জড়িত,কিন্তু সেটা বোঝারও আগে থেকেই এই ভালোলাগার উৎপত্তি। সোভিয়েত ইউনিয়নের আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিকাড়া পতাকা, অসাধারণ স্বপ্নময় সোভিয়েত শিশুসাহিত্য,উদয়ন পত্রিকা সহ আরো অনেক কিছুই এর সাথে জড়িত। প্রসঙ্গত সোভিয়েত তখন মৃত্যশয্যায়। তাই এর সবটুকু স্বাদ পাওয়া সম্ভব হয়নি। দুটো মাত্র বই পড়তে পেরেছিলাম। তাও প্রগতি আর রাদুগা প্রকাশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের স্কুলে বইগুলো ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হয়েছিল। একটির নাম আলতা জবা ছবি সহ শিশুতোষ উপন্যাস। আরেকটি পেলিকান পাখির ওপর লেখা বই। এমন সুন্দর ছবি আর বর্ণনায় ভরপুর বই আমি আমার শৈশবে আর পাইনি। এর সংগে যদি হুমায়ূন আজাদের ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না বইটি যোগ করি তাহলে আমার শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় তিনটি বইয়ের নাম বলা হয়ে যাবে। হয়ত আমার চেয়ে আরেকটু বড় যারা তাদের শৈশবকালও এমন অসাধারণ সোভিয়েত সাহিত্য দিয়ে মোড়ানো ছিল। আমি অত সৌভাগ্যবান ছিলাম না। কারণ সোভিয়েত তখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। তাই ছিঁটেফোঁটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
বামপন্থার গ্রাউন্ডওয়ার্ক তাই তৈরীই ছিল। তাই বাংলাদেশের যত প্রগতিশীল আন্দোলন এর পরে হয়েছে তার সবগুলোর সংগেই সামান্য হলেও যোগ ছিল। আমার সমবয়সী ছেলেপুলেরা যখন সবরকমের দস্যুপনায় হাত পাকাচ্ছে তখন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভার জন্য শিশুদের বৃন্দ আবৃত্তির রিহার্সাল করছি। তখনো শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বেঁচে আছেন। তাকে দেখার পরম সৌভাগ্য আমার হয়নি। কলেজে ওঠার পর ছেলেরা যখন মেয়েদের পেছন নেয়া আর প্রেম করার ক্রেডিট নেয়াতে ব্যস্ত আর কেউ কেউ সরকারী ছাত্র সংগঠনের মাস্তান হয়ে হিরোগিরি প্রদর্শনের হাতেখড়ি দিচ্ছে; তখন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের হয়ে রাস্তায় মিছিল করছি।
নাস্তিকতায় তখন বামপন্থীদের একচেটিয়া অধিকার। তাই নাস্তিকতায় পদার্পণ ত অবশ্যম্ভাবী ছিল। এরপর আরো অনেকদিন সেই পথে চলেছি। কোনো দোদুল্যমানতা আসে নি। আবার সেই সময়ে ধর্মীয় জঙ্গীবাদীরাও আফগান যুদ্ধ থেকে ফিরে আসে তাদের গ্রাউন্ডওয়ার্ক শুরু করেছে। তবে সমাজে তখনো ধর্ম প্রদর্শনের এমন বাহুল্য তৈরি হয়নি। তসলিমা নাসরিন তখন ধর্মের নাড়ি ধরে টান দিয়ে দেশে হুলস্থুল ফেলে দিয়েছেন। প্রাত:স্মরণীয় আরুজ আলী মাতুব্বর বা আহমদ শরীফ স্যার তাদের লেখনী দিয়ে আলোড়ন তৈরি করলেও তা অতটা বিস্তৃত হয়নি। বামপন্থীরা এই সময়ের ধর্মান্ধতা মোকাবেলায় তাদের সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা রাখলেও তসলিমার বেলায় কেমন যেন গুটিয়ে গেলেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা প্রচ্ছন্ন পুরুষতান্ত্রিকতা এর একটা কারণ। অনেক অবাম নাস্তিকও এর ব্যতিক্রম নন। অত বুঝতাম না তখন তবে তসলিমার বিদ্রোহী ভাবমূর্তির প্রতি যথেষ্ট আকর্ষিত হয়েছিলাম। এখনো তার সবকিছুর সঙ্গে একমত না হতে পারলেও তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রয়ে গেছে। এই পঁচা,গলা, স্থবির,বদ্ধ ধর্মীয় হুজুগে আকন্ঠ নিমজ্জিত সমাজে তসলিমা তার মত করে যে জোর লাথি দিয়েছেন তা খুব কম মানুষকেই দিতে দেখেছি। তাই তখন তসলিমার ওপর ধর্মান্ধদের আঘাতের প্রত্যুত্তরে বামপন্থীদের যখন তেমন কোনো ভূমিকা দেখতে পাইনি,একটু অবাক হয়েছিলাম বৈকি। অতশত বুঝতাম না তবে মনে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম হয়েছিল।
এখানে একটা কথা বলে রাখি বামপন্থী মানেই কমিউনিস্ট ব্যাপারটা কিন্তু এত সরল নয়। এর বাইরেও বামপন্থী আছেন। ইউরোপ আমেরিকায় যারা আছেন তারা বিষয়টি ভালো বুঝবেন। এসব দেশে যারা লিবারেল,সোশ্যালিস্ট বা সোশ্যাল ডেমোক্রেট তারাও মোটাদাগে বাম বা বামঘেঁষা বলে পরিচিত। বাংলাদেশেও বেশ কিছু সংগঠন বামপন্থী বলে নিজেদের পরিচয় দিলেও একধরণের জাতীয়তাবাদী লিবারেল আদর্শই ধারণ করেন। বামপন্থা নিয়ে আলোচনার সময় এই বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিৎ।
যাই হোক এবার আগের জায়গায় ফিরে আসি। ধর্ম নিয়ে আলোচনার সময় লেফটিস্টরা সবসময়ই একটু হিসেব করে চলেন। অনেকক্ষেত্রেই যা উনাদের নেতা,কর্মী সমর্থকদের মধ্যে একধরণের বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। অবশ্য প্রবলভাবে ধর্মাচ্ছন্ন আর ধর্মনির্ভর একটি সমাজে তা খুব স্বাভাবিক। এমনকি অনেকে ত যারা সরাসরি ধর্মের সমালোচনা করে তাদের বিষোদগার করতেও ছাড়েন না। বিপুল সংখ্যক বামপন্থী নেতা সংগঠক ধর্মের সমালোচনা এড়িয়ে চলেন। যা আমার কাছে সারভাইবালের সূত্র হিসেবে ঠিকই মনে হয়। কিন্তু কষ্ট বা হতাশা পেয়ে বসে তখনি যখন কেউ কেউ ধর্মের প্রবর্তক বা মহাপুরুষদের গুণগান করা শুরু করেন। অনেকে আবার ধর্মকে পুঁজিবাদ,সাম্রাজ্যবাদের উপজাত হিসেবে দেখে ধর্মান্ধতা,মৌলবাদ,জঙ্গিবাদ,সাম্প্রদায়িকতাকে খুব বেশি বা একদমই গুরুত্ত্ব দিতে চান না। বিভ্রান্তির শুরুও হয় তখন থেকে। সবকিছুর সরলীকরণ করা একদম সহজ হয়ে যায়। বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র বা শক্তিসমূহের ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থানের পেছনে বিশাল অবদান রয়েছে। এছাড়া বিশ্বজুড়ে গণহত্যা,হানাহানি, যুদ্ধ, দূর্ভিক্ষ,মাদক সন্ত্রাস,অবাধ লুটপাটের জন্য তারা ষোলোআনা না হোক অন্তত বারো আনা দায়ী এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। তবে ধর্মীয় সন্ত্রাসের জন্য সম্পূর্ণরূপে তারা দায়ী এই চিন্তাটাই ভুল। ধর্মের ভেতর থেকে যদি অনুপ্রেরণা না আসে বা ধর্মীয় উপাদান যদি না থাকে তবে কোনোভাবেই এই ভয়ংকর ধর্মীয় ফ্যাসীবাদের জন্ম নেয়া সম্ভব নয়। আর এখানে এসেই নাস্তিক মুক্তমনাদের এক বিরাট অংশের সাথে বামপন্থীদের এক মানসিক দুরত্ত্ব তৈরি হয়ে যায়। নাস্তিকদের এক অংশ এই ধর্মীয় জঙ্গীবাদের জন্য শুধুমাত্র ধর্মকেই দায়ী করে থাকেন। ধর্মের দায় ত আছেই কিন্তু এর সঙ্গে একে উস্কে দেবার জন্য দায়ী অন্য উপাদানগুলো তাদের চোখ এড়িয়ে যায়। একইভাবে বামপন্থীরাও উলটো সরলীকরণ এ ব্যস্ত হয়ে পরেন। যা আগেই উল্লেখ করেছি।
পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের জন্মের বহু আগে থেকেই এই ধর্মীয় ফ্যাসীবাদ নানাভাবে তার বীভৎস, বিভীষিকাময় চেহারা প্রদর্শন করেছে। সেই দাসব্যাবস্থা থেকে শুরু করে যখন যেই মতবাদ বা সমাজব্যাবস্থা পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে তার সঙ্গেই সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এই দিকটি বামপন্থীদের এক অংশ কিছুতেই বুঝতে চান না।
তবে পৃথিবী যতই আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তা যত ধীরেই হোক তার সঙ্গে প্রায় সব ধর্মই তার তলোয়ারটিকে খাপে পুরে সভ্যতার ভেক ধরছে। কিন্তু কিছু কিছু ধর্ম এখনো সেই ভেক ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না। আর এ থেকেই এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পুনরায় ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ এর জন্ম হচ্ছে। এই ফ্যাসীবাদ কিন্তু প্রচলিত যেকোনো রাজনৈতিক মতবাদ থেকে ভিন্নধারার। অনেকটাই বিমূর্ত। যার ফলে যারা এর সবচেয়ে বড় শিকার তারাই এর প্রধান সৈনিক। যেমন গোটা মুসলমান বিশ্বে নারীরাই তাদের হিজাব পড়ার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সবচেয়ে বড় সৈনিক। কিন্তু এই হিজাব বোরকা যে সরাসরি নারী অধিকারের পরিপন্থী ও নারীদের প্রতি চুড়ান্ত অবমাননাকারী এটা বোঝার বোধশক্তিই তাদের নেই। একইভাবে তারা এবর্শন,সমকামীতা,ইউনিফর্ম সিভিল কোড,অন্য ধর্মে বিবাহ, নাস্তিকতা ও ধর্মকে সমালোচনা করার অধিকারের বিরুদ্ধে। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। ধর্ম প্রকারান্তরে পুরুষতন্ত্রের জমজ ভাই তাই তাদের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক। কিন্তু এর সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন নারী সম্প্রদায়। আর তারাই এ সমস্ত আধুনিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চারকন্ঠ। এটাই বর্তমান যুগের অন্যতম গ্র‍্যান্ড প্যারাডক্স।
300x200_religion-disability_wiki_1
এই মুসলমান সমাজই আবার পশ্চিমা বিশ্বে এসে তাদের আধুনিক লিবারেল সমাজব্যবস্থার সব সুযোগসুবিধা নিয়েও নিজেদের মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার হাত থেকে খুব বেশি মুক্ত করতে পারেন না। বরং বৃহত্তর সমাজে এর বিরোধিতা করে সুবিধা হবে না দেখে নিজেদের পরিবার বা কম্যুনিটিতে এর জন্য ধর্মান্ধতার স্টিমরোলার প্রয়োগ করেন। যার ফলে এই কম্যুনিটিগুলোতে অনার কিলিং,জোরপূর্বক বিবাহপ্রদান,নারী নির্যাতনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। কিন্তু পশ্চিমা লিবারেলগোষ্ঠী যেন এসব দেখেও না দেখার ভান করেন। উপরন্তু অনেক সময়ই তাদের এসব বিষয়ে নমনীয় বা নতজানু হতে দেখা যায়। তাই এই ফ্যাসীবাদ অনেকটাই অদৃশ্য হলেও কোনোভাবেই কম ভয়ংকর নয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর কথা হিসেব করলে ত এর আরো অনেক বেশি ভয়াবহ রূপই চোখে পড়বে।
তাহলে আশা কোথায়? সেই আশার জায়গা কিন্তু বামপন্থী লিবারেল মতবাদই। যদিও তাদের মধ্যে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে। কিছু উদাহরণ ত উপরেই দিয়েছি। এর বাইরে জাতীয়াতাবাদ,স্বাধীকার আন্দোলন নিয়েও তারা বিভ্রান্তিতে ভোগেন। যেমন ভারতের কাশ্মীরের বা উত্তরপূর্ব অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদ। প্রথমটি এখন একটি সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িকতা বা ইসলামিক ফ্যাসিবাদ দ্বারা চালিত আন্দোলন। আর উত্তরপূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদ ভয়ংকর প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ দ্বারা পুষ্ট। আগ্রহী যে কেউ ওই অঞ্চলের বংগাল খেদা আন্দোলনের ইতিহাস খোঁজ করতে পারেন। কিন্তু বামপন্থীদের মধ্যে এদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে।
তারপরও আশা কিন্তু বামপন্থী লেফট লিবারেলরাই। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে,মানুষে মানুষে সাম্য,সমান অধিকার,নারী স্বাধীনতা,মত প্রকাশের অধিকার,বৈষম্যবিলোপ তার সবকিছুই এই লেফট লিবারেল আইডিয়োলজির অবদান। কারণ এর উলটো দিকে যারা সেই পশ্চিমা কনজারভেটিভ গোষ্ঠী প্রকারান্তরে ইসলামিক ধর্মান্ধ ফ্যাসীবাদের স্যুটটাই পরিহিত খ্রিষ্টীয় পরিশীলিত রূপ। তাই বামপন্থীরা যদি তাদের বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠে সঠিক পথটি চিহ্নিত করতে পারেন আর নাস্তিক মুক্তমনা অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সমস্যার বহুমুখী রূপটি উপলব্ধি করে একটি কমন প্ল্যাটফর্মে নিজেদেরকে নিয়ে এসে সবগুলো ফ্রন্টে তীব্র আদর্শিক সংগ্রাম শুরু করতে পারেন,তবে আমি বলব এখনও স্বপ্ন দেখার দিন শেষ হয়ে যায়নি।