মুক্তমনা সম্পাদক এবং লেখক অভিজিৎ রায়ের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অজয় রায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ফারজানা রূপা। একাত্তর টিভির সংবাদ সংযোগে যা প্রচারিত হয়েছিলো ২১ জুন। এর দু দিন আগে বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের মতোই অজয় রায় শুরুতেই উল্লেখ করেছেন বুয়েট শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী এবং তার গ্রুপ ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ পত্রিকার উপদেষ্টা ত্রিভুজ আলমের কথা। শুরুতে এটিও পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, তিনি মনে করেন না ফারসীম, অভিজিৎ হত্যার সঙ্গে জড়িত। তবে তিনি ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়তা করে থাকতে পারেন। এটিও উল্লেখ করেছেন যে, অভিজিতকে হত্যার রাতে র‍্যাডিসন হোটেলে বিজ্ঞান পত্রিকার উপদেষ্টা ত্রিভুজ আলম ‘কোনো একটা সফলতা’ উদযাপন করেছিলেন।

ফারসীম মান্নানের জড়িত নন তবুও ‘‘ক্ষেত্র প্রস্তুতের’’ সহায়ক হতে পারেন অজয় রায় স্যারের এমন কথার ব্যাখ্যা পেতে অভিজিৎ রায় এবং বন্যা আহমেদের ঢাকায় আগমন এবং পরবর্তী সময়টার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। অভিজিৎদা ও বন্যাপা তাদের দেশে আসার বিষয়টি যথাসম্ভব গোপন রাখলেও কয়েকজনকে জানিয়েছিলেন যাদের মধ্যে ফারসীম একজন। ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ গ্রুপের উপদেষ্টা ত্রিভুজ আলমের জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অবগত রয়েছেন অজয় রায়। অভিজিতদের আগমনের খবর ফারসীম মান্নানের কাছ থেকে ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ গ্রুপ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ত্রিভুজ আলমের কাছে গিয়েছিল কিনা সে প্রশ্নটিই করেছেন অজয় রায়।

অজয় রায় ভাবতেই পারেন যে, অভিজিৎ দার বাংলাদেশে থাকার সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে বলেই ২৬ ফেব্রুয়ারি তাকে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছিল বইমেলায়। ত্রিভুজ কি ফারসীম মান্নানকে এই বিজ্ঞান আড্ডা করার জন্য বলেছিল? কারণ সেদিন অজয় রায়ের বাসায় দাওয়াত খাবার কথা ছিল অভিজিতের, বইমেলায় যাবার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাঁর।

এর আগে বেশ কদিন বইমেলা ঘুরে বন্যাপাও ক্লান্ত ছিলেন। আমি জানতাম যে, ২৬ ফেব্রুয়ারি বই মেলায় তাদের যাবার কোনো পরিকল্পনা নেই। পরের দিন, ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা তাদের বরং মুক্তমনার কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা ছিল।

২৫ ফেব্রুয়ারি, বুধবার সকাল এগারোটায় ফারসীম মান্নান ফেসবুকে একটা থ্রেড খুলে সেটাতে অভিজিতসহ আরও ১২ জনকে যুক্ত করে ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টায় মেলার ভেতরে বিজ্ঞান লেখকদের একটা আড্ডা করলে কেমন হয় জানতে চান। অভিজিৎ দা উত্তরে জানান, আইডিয়াটা ভালো। ফারসীম অভিজিৎ দাকে এ-ও জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, ফেব্রুয়ারিতেই মিডিয়ায় আড্ডার কথা প্রকাশে কোনো সমস্যা আছে কি না, নাকি অভিদা যাবার পরে প্রকাশ করবেন? উত্তরে অভিজিৎ বলেছিলেন, ‘‘ফেব্রুয়ারি ইজ ফাইন।’’

২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল এগারোটায় আমন্ত্রণ পাবার পর অভিজিৎ শুরুতে তাঁর উপস্থিতি নিশ্চিত না করে ‘আইডিয়া ইজ ফাইন’ বলেছিলেন। বিকাল পাঁচটায় সেই একই থ্রেডে তিনি বিজ্ঞান বক্তা আসিফকে আড্ডাটির খবর দিতে বলেন এবং জানান যে, তাঁর কাছে আসিফের নম্বর না থাকায় তিনি আমন্ত্রণ দিতে পারছেন না।

২৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর বারোটায় আহমেদুর রশীদ টুটুল ও তার স্ত্রী অভিজিৎ ও বন্যার সঙ্গে দেখা করেন বন্যার মামার বাসায়। তখন অভিজিৎ জানতে পারেন যে, সেদিন সন্ধ্যায় শুধু বিজ্ঞান আড্ডা নয়, শুদ্ধস্বরের মেলার স্টলের সামনেও শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত লেখকদের একটা আড্ডার আয়োজন হয়েছে। এদিন সকালে অজয় রায়ও ছেলেকে ফোন করেন। তখন অভিজিৎ দা বাবাকে জানান যে, তারা বিকেলে যাবেন।

ওদিকে টুটুল ভাইরা বিকাল তিনটার দিকে বিদায় নেবার পর অভিজিতের মন টানছিল বই মেলার দিকেই। বন্যাপাকে জোর করে রাজি করিয়ে অজয় স্যারের বাসায় না গিয়ে বিকালে রওনা দিলেন বই মেলার দিকেই। অবশ্য সন্ধ্যা ছয়টায় বিজ্ঞান আড্ডার ডাক দিয়ে ফারসীম মান্নান নিজেই সেখানে উপস্থিতি ছিলেন না। অভিজিৎ ও বন্যা কাউকে না পেয়ে চলে যান শুদ্ধস্বরের সামনে যেখানে বেশ কয়েকজন পরিচিত মানুষ একত্র হয়েছেন টুটুলের প্রিয় খাদ্য নারিকেলের মোয়া খাবার উদ্দেশ্যে। অভিজিতরা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত শুদ্ধস্বরের সামনে ছিলেন।

মাগরিবের নামাজ পড়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে শুদ্ধস্বরের স্টলের সামনে লেখকদের আড্ডায় উপস্থিতি হন ফারসীম মান্নান। নামাজের জন্য বিজ্ঞান আড্ডায় আসার দেরি হলো কারণ দেখিয়ে অভিজিৎকে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি তাদের ছায়াবীথি প্রকাশনীর সামনে বসতে আহ্বান জানালেন। অভিজিত বন্যা ও তারেক অণুসহ আরও কজন পরিচিতজনকে নিয়ে ছায়াবীথি প্রকাশনীর সামনে হাজির হলেন। তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। তারপর সেখানে পাটি বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসলেন। শুরু হল বিজ্ঞান আড্ডা।

আটটা দশ নাগাদ আড্ডা শেষ। অভিজিৎ রাত আটটা তেইশ মিনিটে আমাকে এসএমএস দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘রায়হান, তুমি কই? আমরা মেলায় আসছি।’’

তাঁর সেই এসএমএস পড়েই জানতে পারি যে, তাঁরা মেলায় ঢুকেছেন। আমি আর সামিয়া তখন পরদিনের আয়োজনের জন্য বাজার করছিলাম। পরে বন্যাপার কাছে জেনেছি যে, তাঁরা তখন বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে খাবার কথা ভাবছিলেন। মনে পড়ল, ২০১২ সালে অভিজিৎ দা যত বারই মেলায় আসতেন, বের হয়ে প্রায়ই রাতের খাবার খেতে যেতাম মটর সাইকেলে চেপে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে সেদিন ওরা দুজন কিছুক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে গাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। তাদের গাড়িটি রাখা ছিল চারুকলার বিপরীত দিকে। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, হত্যাকারীরা পেছন থেকে অনুসরণ করে এসএমএস করে ওঁত পেতে থাকা চাপাতি হাতের আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের খবরটি জানিয়েছিল।

রাত সাড়ে নয়টায় ওদের উপর আক্রমণের খবরটি জানতে পারি। সামিয়াকে নিয়ে তখুনি ছুটে যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে ঢুকতেই দেখি রক্তাক্ত বন্যা স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। তাঁর মাথার কোপের সিটি স্ক্যান করানোর জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জরুরী বিভাগের যে ডাক্তার অভিজিতের মাথার রক্ত বন্ধ করতে চেষ্টা করছিলেন, তিনি আমার পরিচিত ও একই কলেজ পড়ুয়া বড় ভাই। তিনিই জানালেন, অভিজিৎ দা আর নেই। ডিএমসিতে আনার পরও মিনিট পনের জীবিত ছিলেন তিনি। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

পরিচিত আরেক জনকে পেলাম। উনি তখন জানালেন যে, ফারসীম মান্নানের বিজ্ঞান আড্ডায় দেখেছিলেন অভিজিৎ আর বন্যাকে। তখন খুঁজছিলাম ফারসীম মান্নানকে। দেখলাম, উনি ডিএমসিতে নেই। উনি কোথাও নেই!

সবাই হতভম্ব করে দিয়ে এর পরের ষোলটি দিন তার কোনো খোঁজ নেই। সদাসরব তার ফেসবুকও নীরব।

ইতোমধ্যে অজয় রায় অভিজিৎ হত্যার বিষয়ে ফারসীমদের ওই আমন্ত্রণের প্রসঙ্গ তোলেন। এর প্রেক্ষিতে ১৪ মার্চ ফারসীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ত্রিভুজ আলমের সঙ্গে তার গ্রুপের সংশ্লিষ্টটার প্রশ্নে পুরো দায়ভার ‘জিরো টু ইনফিনিটি’ পত্রিকার সম্পাদক আবদুল্লাহ মাহমুদের উপর চাপিয়ে জানান:

“তার পত্রিকা, সে কীভাবে চালাবে, এটা তাকেই ঠিক করতে হবে। এ কথাও ঠিক, বেশ কিছু বেঠিক মানুষের সাথে সখ্য দেখা গেছে, তবে আমি জানামাত্রই সম্পাদককে সতর্ক করেছি। তারপরও ঠিক পদক্ষেপ নেওয়া বা না নেওয়া তার দায়িত্ব। আমি তার কোনোই দায় গ্রহণ করব না।’’

সাক্ষাৎকারে তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, শুরুতে বছর দেড়েক তিনি পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাহমুদ পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার উপদেশ থেকে দূরে সরে গিয়েছে।

কিন্তু আবদুল্লাহ মাহমুদ তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে জানান যে, ফারসীমের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল তখনও। তারা তাদের পত্রিকার পরের সংখ্যায় অভিজিত হত্যার বিষয়ে শোক প্রকাশমূলক বার্তা লিখতে চাইলে সেটা নাকচ করে দেন ফারসীম মান্নান নিজে।

অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে এত সুসম্পর্ক থাকার পরও– বই মেলায় কয়েক দিন, বেশ কিছু সময় এবং একুশে ফেব্রুয়ারি সারাদিন তাঁর সঙ্গে সময় কাটানোর পরও এমন কাপুরুষতা ও অমানবিকতা কেন দেখালেন ফারসীম মান্নান? অভিজিতকে আমন্ত্রণ করে মেলায় আনলেন তিনি, সেই আমন্ত্রণে এসে মানুষটা নির্মমভাবে খুন হলেন। এবার অভিজিৎ, বন্যাপার সাথে বেশ অনেকটা সময় কাটানোর পরেও ফারসীম মান্নান যে একবারের জন্যও নিহত অভিজিৎ, অসুস্থ বন্যাকে দেখতে আসলেন না, বন্যার সাথে যোগাযোগ করলেন না তা আমাদের বেদনার্ত করেছে। যদিও নাস্তিকদের প্রতি এমন অমানবিকতা দেখানো মানে এই নয় যে তিনি অভিজিৎ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। অভিজিৎ হত্যায় জন সম্মুখে শোকের প্রকাশ দেখাতে পারেন নি আমাদের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও।

Farseem-meeting-boimela
সেরাতের বিজ্ঞান আড্ডায় অভিদা, বন্যাপা

লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, মার্চের সংখ্যায় পত্রিকাটির উপদেষ্টা হিসেবে ত্রিভুজ আলমের নামও মুছে দেওয়া হয়। অজয় রায় জানিয়েছেন যে, এই ত্রিভুজ অভিজিৎ রায় হত্যার রাতে র‍্যাডিসনে পার্টির আয়োজন করেছিল। তিনি হোটেলের রেজিস্টার দেখে তার কথার সত্যতাও যাচাই করতে বলেছেন। আমার পক্ষে সেটি করা সম্ভব হয়নি, তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সেটি করবেন।

২.

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে আসলে কে জড়িত সেটার একটা সূত্র হতে পারত ‘শরীফ ওরফে হাদি-১’– জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী যার নাম ‘মুকুল রানা’। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন: “লেখক-ব্লগার হত্যার যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার প্রত্যেকটির বিষয়ে শরীফ জানত।”

শরীফের কথা সংবাদপত্রে প্রথম আসে ২০ মে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়েবসাইটে ছয় জন আনসারুল্লাহ বাংলা সদস্যের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকায় থাকা দুজন শরীফ এবং সেলিমকে ধরিয়ে দেবার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। ডিএমপির প্রেস রিলিজে শরীফ সম্পর্কে বলা হয়:

“আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ সংগঠক শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ নামে পরিচিত। তার বাড়ি বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে। অভিজিৎ রায় হত্যা, নীলাদ্রি নীলয় হত্যা, লালমাটিয়ায় আহমেদ রশীদ টুটুল হত্যা-চেষ্টা এবং সাভারে শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াদ মোর্শেদ বাবু হত্যায় তার সরাসরি উপস্থিতি এবং নেতৃত্ব প্রদানের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা, তেজগাঁওয়ে ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা, সূত্রাপুরে ব্লগার নাজিমউদ্দিন সামাদ এবং কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান ও তনয় হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী। অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজে তার উপস্থিতি ধরা পড়ে। তার সম্পর্কে তথ্যদাতাকে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ।”

পুলিশ সে সময় অভিজিৎ ও বন্যাকে অনুরসরণকারীর সিসিটিভি ফুটেজ থেকে একজনকে লাল দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে জানায় যে, এটিই সেই শরীফ।

কিন্তু অভিজিৎ হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে এটাই পুলিশের একমাত্র কথা নয়।

২০১৫ সালের ১৭ অগাস্ট র্যাব-৩ রাজধানীর নীলক্ষেত থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সাদেক আলী মিঠুকে (২৮) গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ধানমণ্ডির একটি বাসা থেকে রাত ১২টা ২০ মিনিটে ব্রিটিশ নাগরিক তৌহিদুর রহমান (৫৮) ও মোহাম্মদ আমিনুল মল্লিককে গ্রেফতার করা হয়। র‍্যাব তখন জানিয়েছিল যে, আনসার বাংলা প্রধান জসিমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে তৌহিদুর রহমান যুক্তরাজ্য থেকে বিভিন্ন সময় আনসারুল্লাহকে অর্থায়ন করেছেন। কাকে কাকে হত্যা করতে হবে, তা তৌহিদ নির্ধারণ করতেন। আইটি বিশেষজ্ঞ হওয়ায় তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগে বিভিন্ন জনের লেখা পর্যবেক্ষণ করতেন।

গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাব তখন জানিয়েছিল যে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের তিন ঘণ্টা আগে সন্ধ্যার দিকে ওই পাঁচজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মোহাম্মদ মহসীন হলের মাঠে একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা করে। এরপর তারা বই মেলায় এসে দুভাগ হয়ে অভিজিৎ রায়কে অনুসরণ করে। অভিজিৎ মেলা থেকে বের হয়ে চারুকলার দিকে এলে ফুটপাতের পেছন থেকে নাঈম ও রমজান তাকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। অভিজিৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরও তারা ঘাড়ে একাধিক কোপ দিয়ে পালিয়ে যায়।

মিঠু, জুলহাস ও জাফরান কাছাকাছি ছিল। হত্যাকাণ্ড শেষে তারা তৌহিদুরকে বিষয়টি নিশ্চিত করে। এরপর তৌহিদুরের নির্দেশে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দায় স্বীকার করে পোস্ট দেয়। র‍্যাব তখন আরও জানিয়েছিল যে, কেবল অভিজিতকে নয়, তৌহিদুরের নেতৃত্বাধীন এই জঙ্গি সেলটি মে মাসে অনন্ত বিজয় দাশকেও হত্যা করে।

২০১৬ সালের মে মাসে অভিজিৎ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হয়ে যায় শরীফ এবং শরীফের কথা আবার মিডিয়াতে আসে উনিশে জুন সকালে। ‘রাত দুটায় ডিবি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সে নিহত হয়’ বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। অভিজিৎ রায়ের মামলার আসামি থাকার বিষয়টিসহ আনসার বাংলা সদস্য শরীফের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাশরুকুর রহমান খালেদ। খিলগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আল মামুন একই তথ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি জানান:

“শনিবার রাত ২টার দিকে খিলগাঁও মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘সন্ত্রাসীদের’ গোলাগুলি হলে ওই যুবক গুলিবিদ্ধ হন। পরে রাত ৩টার দিকে পুলিশ ওই যুবককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”

ডিএমপি থেকে পুরষ্কার ঘোষণার সময় যে সিসিটিভি ভিডিওর স্ক্রিন শট দেওয়া হয়েছিল, শরীফের মৃত্যুর পর তার ভিডিও ফাইলটি প্রকাশ করা হয় যেখানে দেখা যায়, শরীফ অভিজিৎ-বন্যাকে অনুসরণ করছে। পরের দিন খবর আসে, শরীফের আসল নাম মুকুল রানা। যদিও মানুষ একই।

সিসিটিভির ভিডিওটি দেখে বুঝতে পারি, বইমেলায় একদিন নয় হতে পারে প্রত্যেক দিনই অভিজিৎ ও বন্যাকে অনুসরণ করা হয়েছে। মনে আছে ফেব্রুয়ারির উনিশ তারিখ রাতের কথা। সে রাতে মেলার ভেতরে বন্যা আহমেদের পেছনে কজন কিশোরকে ঘুরতে দেখেছিলাম। এদের একজন বন্যাপার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, চেয়েছিল তাঁর ফোন নম্বরটি। তখন বিষয়টাতে পাত্তা দিইনি। ভেবেছিলাম, এরা ইভটিজার ধরনের কিশোর।

বন্যাপা বলেছিলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি দিনের বেলায়ও হাইকোর্টের সামনে দিয়ে কার্জন হল হয়ে বইমেলায় ঢোকার পথে তাদের অনুসরণ করা হয়েছিল। অনুসরণকারীকে তিনি সরাসরি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকটি বলেছিলেন, তিনি অভিজিৎ ও বন্যাকে চেনেন। কাজ করেন সামরিক বাহিনীতে। তিনি তাদের অনুসরণ করছেন না, একুশে ফেব্রুয়ারির নিরাপত্তার দায়িত্বে এখানে আছেন। কেবল বন্যা ও অভিদাকে চিনতে পেরে তাদের অনুসরণ করেছিলেন।

পাঠক লক্ষ্য করুন, পুলিশের সরবরাহ করা সিসিটিভির ফুটেজে শরীফ ওরফে মুকুল রানা যে তাদের অনুসরণ করছিল সেটা কিন্তু হত্যাকাণ্ডের দিনের ঘটনা নয়। কারণ মৃত্যুর দিন, মানে ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ লাল পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন। কিন্তু মুকুল যেভাবে ওদের অনুসরণ করতে করতে এসএমএস করে যাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছে, সে দিনও হয়তো এরা আক্রমণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনো কারণে সফল হতে পারেনি।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান পুলিশ নিজেই আইন-শৃঙ্খলার প্রতি ও বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখছে না। একই কথা সরকারের জন্যও প্রযোজ্য আর এই কারণেই বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ‘ক্রসফায়ার’ বাংলাদেশের এক নির্মম বাস্তবতা। পুলিশ বা র্যাব তাদের দ্বারা সংঘটিত বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোর কথা সব সময় অস্বীকার করে। তবে প্রতিবার একই গল্প বলে। হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তি কত বড় সন্ত্রাসী ছিল সেটা বলার মাধ্যমে তারা মশকরার সুরে ঠিকই জানিয়ে দেয় যে, অপরাধ করলে এমন ঘটনা পুলিশ ঘটাতেই পারে।

ঠিক যেমনভাবে ‘নাস্তিক’ হত্যার পর জঙ্গিরা সবার উদ্দেশে নিহত ব্যক্তিটির লেখালেখির স্ক্রিনশট ছাড়ে। অর্থাৎ এমন কাজ করলে উচিত শাস্তিই প্রাপ্য। জঙ্গিদের পাতা এই বুদ্ধিহীন ফাঁদে পা দেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি থেকে শুর করে জনগণের একটা বিরাট অংশ!

পরিষ্কার করে আমাদের কারও আজ বলার সাহস নেই যে, অপরাধ যা-ই হোক, কখনও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থিত হতে পারে না। যে কোনো ধরণনের লেখালেখির জন্য, সেটা পর্নোগ্রাফি হলেও তার জন্য কাউকে হত্যা করা জায়েজ হতে পারে না। বাংলাদেশের কজন মানুষ মন থেকে এই দুটো বাক্য বলতে পারবেন? যারা বলতে পারেন, তারা তো একে একে চাপাতির নিচে চলে যাচ্ছেন।

তবে শরীফের ক্ষেত্রে ডিবি পুলিশের গল্প একটু ভিন্ন। ডিবি বলেছে, খিলগাঁও এলাকায় রাত দুটোয় শরীফকে মোটর সাইকেলে আরও দুজনের সঙ্গে চলতে দেখে পুলিশ চ্যালেঞ্জ করলে মোটর সাইকেল আরোহীরা গুলি বর্ষণ করে এবং পুলিশও পালটা গুলি ছুঁড়ে। এরপর দশটি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তারা শরীফের লাশের সন্ধান পান। বাংলাদেশের ক্রসফায়ার সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে একথা আমরা সবাই বুঝতে পারি যে, শরীফ বা মুকুলকে বিচার-বহির্ভূত ক্রসফায়ার করা হয়েছে। পুলিশ যদি এখন দাবি করে যে, শরীফ মূল পরিকল্পনাকারী, তাহলে তারা শরীফের সঙ্গে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার তৌহিদের সম্পর্ক কীভাবে, কখন হয়েছে তা স্পষ্ট করে জানালো না কেনো?

তৌহিদকে গ্রেফতার করার আগে বন্যার সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ আইসিইউতে এসে একবার যোগাযোগ করেছিল। এরপর তাঁর সঙ্গে আর কখনও যোগাযোগ করা হয়নি। তবে বই মেলায় থাকা বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ ও এফবিআই উভয়ই বিশ্লেষণ করে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

অভিজিতকে হত্যার পর শরীফ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা পুঁজি করে ওয়াশিকুর বাবু, নীলয় নীল ও জাগৃতির প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হামলা চালাবার পরিকল্পনা করে। পাঠক, আপনাদের কি মনে আছে যে, অভিজিৎ রায়কে হত্যার পরে, বাবু হত্যার আগে যাত্রাবাড়ীতে বাবুর উপর আক্রমণ করার জন্য যে স্লিপার সেল বাসা ভাড়া নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, তাদের এক সদস্যকে রাস্তায় চাপাতিসহ হাতেনাতে ধরে পুলিশ। কিন্তু সঠিক কারণ উদঘাটন না করে তাকে হাজতে চালান করে দেয়। কেন সেটা করেছিল পুলিশ?

এই গ্রুপ পরে তাদের হারানো সদস্যকে ছাড়াই বাবুকে হত্যা করে। তখন দুজন মাদ্রাসা ছাত্র পালাবার সময় আটক হয়। বাবুর পর নীল ও দীপনকে হত্যা করে শরীফ/মুকুল হয়তো সাতক্ষীরা চলে যায়। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার পরিচিত আরেক আনসার বাংলা সদস্য মজিবুরের বোন রিমিকে যশোরে বিয়ে করে।

নারায়ণঞ্জের সাত খুনের ঘটনার পর গুম-খুনে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়ংকর কৃতিত্ব দেখেছি। তাদের এই সংস্কৃতি পুঁজি করে মাদারীপুরে শিক্ষক রিপনের উপর হামলাকারী ক্রসফায়ারে নিহত ফাহিমের মাধ্যমে জানা গেছে যে, জঙ্গিরা কোনো খুনের অপারেশনে যাবার আগে নিজেকে নিজে গুম করে ফেলে। তারপর তাদের স্বজনরা গিয়ে থানায় জিডি করে। কাজটা করার মাধ্যমে তারা অপরাধ সংগঠনের সময় নিজেদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করে।

রিমির ভাই আমির হোসেন জানান, চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারিতে জঙ্গি মুকুলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার বোন মহুয়া আক্তার পিয়ারির। এরপর মুকুল ২৩ ফেব্রুয়ারি নিজ বাড়ি সাতক্ষীরা যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে জানতে পারেন ওইদিন সন্ধ্যায় বসুন্দিয়া থেকে ডিবি পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন যে, এ ঘটনার ‘কয়েকদিন’ পর যশোর কোতয়ালি থানায় জিডি করেন।

অবশ্য কোতওয়ালি থানার ওসি ইলিয়াস হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, কয়েকদিন নয়, জিডিটি হয়েছে পরের দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি। করেছিলেন আমির হোসেন নিজেই। শরীফের শ্বশুর মোহাম্মদ বিশ্বাস আরও জানান, মুকুল নিখোঁজ হবার পর তার বড় ছেলে ঢাকায় যান মুকুলের খোঁজে এবং ঢাকায় গিয়ে আটক হন তিনিও। পরবর্তীতে মুকুলের স্ত্রী মহুয়া আক্তার পিয়ারি জানান, মুকুলকে খুঁজতে নয়, তার বড় ভাই মুজিবুর ঢাকায় গিয়েছিলেন তার অসুস্থতার চিকিৎসার বিষয়ে।

এপ্রিলে সামাদের উপর আক্রমণের সময় ঘটিয়ে আসার কারণেই কি মুজিবুর চলে যায় ঢাকায়? এগারোই মার্চ থেকে নিখোঁজ মুজিবুরকে গ্রেফতার করা হয় পুলিশের ভাষ্যমতে, ১২ এপ্রিল, অর্থাৎ নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যা করার পর। এরপর এই মুজিবরের মাধ্যমেই কি সন্ধ্যান পাওয়া যায় মুকুলের? যদিও ততদিনে মুকুল হত্যা করে ফেলেছে জুলহাজ মান্নান ও তনয়কে?

মুকুলকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ডিবি ধরে নিয়ে গেলে তার পক্ষে পুলিশের দাবি করা নাজিমুদ্দিন সামাদ, জুলহাজ ও তনয়ের হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার উপায় নেই। মুকুল কি তাহলে নিজেকে নিজে গুম করে তারপর মার্চ মাস জুড়ে আবার স্লিপিং সেলগুলোকে রেডি করে নাজুমুদ্দিন সামাদ এবং জুলহাজ, তনয়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িত হয়েছিল? আজিজ সুপার মার্কেটে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরায় কি তাকে দেখা গিয়েছে?

জুলহাজ হত্যাকাণ্ডে শরীফের সম্পৃক্ততার প্রমাণ কি আছে পুলিশের কাছে? নাজিমুদ্দিন সামাদ এবং জুলহাজ মান্নান ও তনয়ের উপর হামলাও কি পরিচালনা করেছিল মুকুল, আনসার বাংলা সামরিক প্রধান পলাতক মেজর জিয়ার সঙ্গে মিলে?

শরীফ/মুকুলকে ক্রসফায়ারে খুন করার মাধ্যমে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে বাধা তৈরি হল। সমস্যা হল তার এবং মেজর জিয়ার মধ্যে সম্পর্ক আদালতে প্রমাণের ক্ষেত্রে। একই সঙ্গে বাধাগ্রস্ত হলো যে ভাইরাস তাদের এই পথে পরিচালিত করেছে সেই বিশ্বাসের ভাইরাসের বিচার। মাদারীপুরের শিক্ষক হত্যার সময় হাতেনাতে আটক ফাহিম আইএস এর নামে দেশে ঘটে থাকা ক্রমাগত হত্যা কাণ্ডগুলোর তথ্য দিতে পারত। বিচারের কাঠগড়ায় তাদের সংগঠন সম্পর্কে, আদর্শ সম্পর্কে, কারা তাকে এই পথে নিয়ে এসেছে তা জানাতে পারত।

ক্রমাগত হামলার পরও, বিডিয়ারে নিহত সেনা কর্মকর্তার ছেলে বাংলাদেশ থেকে আইএস এর সঙ্গে যোগাযোগ করে সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করে মারা গেছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার তোতা পাখির মতো বলেই যাচ্ছে যাচ্ছে যে, দেশে আইএস ও আল-কায়েদার অস্তিত্ব নেই। না থাকলেও কারা হত্যা করছে নাস্তিক লেখক, বিদেশী অতিথি, প্রগতিশীল মানুষ, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের?

এখন কেউ যদি সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে, বাংলাদেশের পুলিশ নাটক করছে, কারণ তারা একবার বলে তারা অভিজিৎ হত্যা ‘ক্লু-লেস’, একবার বলে, খুনিরা বিদেশে পালিয়েছে, তারপর মে মাসে জঙ্গির ছবি প্রকাশ করে পুরষ্কার ঘোষণা করে। পরিবারের দাবি অনুযায়ী যে কি না ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ। তারপর হঠাৎ এত বড় একজন অপরাধীকে খিলগাঁওএ ভোর রাতে মোটর সাইকেলে দেখা যায়, তার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়, সে মরে পড়ে থাকে।

এসব দেখে কেউ যদি সিদ্ধান্তে আসেন যে, পুলিশ যাকে খুন করেছে, যাকে অভিজিৎ হত্যাকারী বলেছে, তার সঠিক নামটাও ঠিকমতো জানে না তাই পুলিশ মূল অপরাধীকে আড়াল করতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। যেহেতু সরকার পুলিশ বাহিনী পরিচালনা করেন এবং উপরের মহলের নির্দেশ ছাড়া ক্রসফায়ার ঘটে না, তাই সরকারও দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক ব্লগার লেখক, প্রকাশক, সমকামী, ভিন্ন ধর্মালম্বীদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

ঘটনার এমন বর্ননা নৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পারবে বাংলাদেশ সরকার?

মৌলবাদীরা যখন একে একে রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নীলয় নীল, ফয়সাল আরেফীন দীপন, নাজিমুদ্দিন সামাদ, জুলহাজ মান্নান, মাহবুব তনয়কে হত্যা করছিল, তখন আমাদের সরকার নিহতদের লেখালেখি খুঁজে বেড়িয়েছেন। নিহতের যৌনজীবন অসামাজিক বলে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড পরোক্ষভাবে যথার্থ বলে নৈতিকভাবে পরাজিত করেছেন ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনাকে।

গুলি করে একজন সাকিবকে, একজন শরীফকে মারা সম্ভব, কিন্তু যে ভাইরাস লক্ষ শরীফকে এই পথে আনলও, যে ভাইরাসের আমাদের মাথায় চড়ে বসে নিহত লেখকের লেখালেখির অধিকারের পাশে না দাঁড়িয়ে ধর্মানুভূতির ফাঁদে পড়ে লেখাকে পর্নোগ্রাফি বলায়, যে ভাইরাসের কারণে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে, মাইকে সমাবেশ করে নাস্তিকদের কল্লা ফেলে দেওয়ার জন্য উম্মাতাল দাবী তোলা হয়, বাংলার মানুষের মাথায় ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসকে বন্দুক যুদ্ধে প্রতিহত করা যাবে না।

সাকিব কিংবা শরীফরা তো বিশ্বাসের ভাইরাসের বাহক মাত্র। আমাদের অনেকের মনে এই ক্রসফায়ার দেখে আত্মতৃপ্তি আসতেই পারে। মনে হতে পারে যে, যারা এমন কর্মকাণ্ড করছে তাদের একটা উপযুক্ত বার্তা দেওয়া হল এভাবে। কিন্তু এই বার্তা দিলে তারা কি দমবে?

দমবে না। কারণ নিরপরাধ মানুষদের ইসলামের নামে হত্যা করা তাদের কাছে জিহাদ। সেটা করতে গিয়ে তারা যদি পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় তাহলে তাদের ‘দুনিয়াবি’ পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটে এবং চিরস্থায়ী সুখের দরজা দিয়ে তারা প্রবেশ করে। মেজর জিয়া এবং শিবির কিংবা হিজবুত তাহরির মাঠ পর্যায়ের জঙ্গিদের এভাবেই উদ্ভুদ্ধ করে নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করতে।

পাকিস্তানী বিশ্বাসের ভাইরাস থেকে একাত্তরে ত্রিশ লক্ষ লাশের বিনিময়ে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম, সেই ভাইরাসের আক্রমণের সম্মুখীন আজ আবার বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ করে পাওয়া ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্রকে ছিনতাই করে দেশটিকে ওয়াহাবি সুন্নী রাষ্ট্র বানাবার যে আক্রমণ শুরু হয়েছে ইসলাম কায়েমের নামে, ধর্মানুভূতিতে মাতাল আমরা বন্দুকযুদ্ধে তা প্রতিহত করার স্বপ্ন দেখি।

অভিজিৎ, অনন্ত, জুলহাজ, রেজাউল করিমের মতো সূর্যসন্তানদের হারিয়েছি আমরা ইসলামের চাপাতির নিচে। চাপাতি থেকে গলা বাঁচাতে শত লেখক, ব্লগার আজ ভয়ংকর নিরাপত্তাহীনতায় জীবন কাটাচ্ছেন, গোপনে দেশ ছাড়ছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়রা অতর্কিত হামলার আতংকে দিন কাটাচ্ছেন, আইএস তাদের পত্রিকায় বাংলাদেশে ইসলামি খেলাফতের ঘোষণা দিচ্ছে, আল-কায়েদা, আইএস, জামায়াত, হিজবুত তাহরির প্রতিযোগিতা করে চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যা করছে, চাপাতি হাতে তুলে নিচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা থেকে মধু বিক্রেতা। তবুও আমরা যদি না জাগি থামবে না এই রক্তাক্ত ইসলাম কায়েম।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে শুরু করে, ছাত্র, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মী, ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র, মাদ্রাসা ছাত্র, মসজিদের ইমাম থেকে বাংলাদেশের অনেক ধরণের মানুষ আজ হিজবুত তাহরীর, জেএমবি, আইএস, আল-কায়েদা, আইএস এর সাথে সম্পর্ক করে আক্রমণ করছে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চরিত্রকে। একে একে উন্মোচিত হচ্ছে অনেক ঘটনাই। অভিজিৎ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীকে সেটা এখনও উন্মোচিত হয় নি, সুরাহা হয় নি ফারসীম মান্নান বুয়েটে বিজ্ঞান সংগঠনের আড়ালে হিজবুত তাহরীরের কর্মকান্ড পরিচালনা করেন কিনা, সুরাহা হয় নি তার সাথে শিবির কর্মী ত্রিভুজ আলমের সম্পর্ক। সুরাহা হয়নি, কেমন করে জঙ্গিরা জেনেছিলো অভিজিৎ রায়ের ঢাকায় আগমনের কথা, কার মাধ্যমে জেনেছিলো তার গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য। অভিজিৎ দাকে রক্তাক্ত চাপাতির নিচে হারিয়েছি আমরা, বাংলাদেশ হারিয়েছে তার শ্রেষ্ঠতম এক সন্তানকে, অথচ এই মানুষটা যখন রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়েছিলো ঢাকা মেডিক্যালে ঠিক তখন তাকে আমন্ত্রণ করে আনা মানুষদের গলা দিয়ে তেহারি নেমেছে, সেই একই বিজ্ঞান আন্দোলন গ্রুপের সদস্যরা এমন একজন বিজ্ঞান লেখককে হারাবার রাতে র‍্যাডিশনে পার্টি করেছেন। যারা একবারের জন্য সমাবেদনা জানায় নি, যারা গর্ব করে শিবিরের সাথে বিজ্ঞান চর্চা করেন তারা টিকে আছে ঠিকই, টিকে আছে তাদের ছদ্মবিজ্ঞানচর্চাও।

আশা হারাই না, বাংলার এই শত্রুদের মুখোশ একদিন উন্মোচিত হবেই। কতো রক্তের বিনিময়ে, কতো অভিজিৎ কে হারিয়ে তা অবশ্য জানি না।