তিন
অামার একটা স্বভাব হলো যেখানে যাই সেখানকার মানুষের বচন থেকে ধার করে ফেলি। শুভ্রর থেকে নিয়ে নিলাম ফ-অন্ত দ্বিরুক্তি। কাকে যেন ফোনে বলছিল, “স্বাক্ষর দা – ফাক্ষর দা রা এসচে..”, সেই থেকে শুরু। এর পর “লাদাখ-ফাদাখ”, “দিল্লি-ফিল্লি” ইত্যাদি ইত্যাদি। সন্ধ্যায় সময়ের অভাবে কোলকাতার দক্ষিণে যাওয়া অার হয়ে উঠে নি, যদিও মিনুর ইচ্ছা ছিল ধর্মতলা, এসপ্লানেড এগুলি দেখাবে। বলে দিল জাহাজে উপর থেকে দেখতে।
দিল্লি থেকে শ্রীনগরের উড়াল সময় অল্প, এক ঘন্টার একটু বেশি। পাশে বসা পাঞ্জাবি মেয়েটা আর তার পারিবারিক ব্যস্ততা সময়টা কাটিয়ে দিল। উপর থেকে দেখলাম অনেকগুলো পার্বত্য নদীবাহিত উপত্যকা। সবুজ একটু কালচে, উপর থেকে দেখা কাঠমান্ডুর সবুজের মতন না। কাছেই তুষার -শুভ্র শৃঙ্গগুলি। শ্রীনগর বিমানবন্দর একটা মালভূমির উপর। রানওয়ে আসার আগেই চোখে পড়লো সেনাবাহিনীর স্থাপনা, রানওয়ের আশেপাশেই একাধিক বাংকার। কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাস কোনোভাবেই ভুলে যাতে না যাই তার ব্যবস্থা। এর মধ্যে ফুটে আছে অজস্র বুনোফুল -অযত্নে অবহেলায়! ডাক্তার একটু পর পর “কী সুন্দর” “কী সুন্দর” বলে যাচ্ছে। একটা সেনাগর্তের বাইরে ভারী জলপাই রংয়ের আগ্নেয়াস্ত্রের মুখ, পাশেই বিরাট গোলাপী ঝোপ, কী নিদারুণ বৈপরীত্য!
ছোট্ট এয়ারপোর্ট।ব্যাগ নিতে নিতে বিদেশি নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক নিবন্ধন করতে হলো। সেখান থেকে একটা প্রিপেইড ট্যাক্সি নিলাম শ্রীনগরের ট্যুরিস্ট রিসিপশন সেন্টার (TRC) পর্যন্ত। ম্যাপে দেখেছিলাম সেটা ডাল লেকের আশে পাশেই। আমাদের লক্ষ্য যত দ্রুত সম্ভব শ্রীনগর ছেড়ে লেহর দিকে যাওয়া। জম্মু-কাশ্মীর সড়ক পরিবহন (JKSRTC) এর অফিসও তার আশেপাশেই। ব্লগে পড়েছিলাম শ্রীনগরে প্রচুর টাউট প্রজাতির লোক পাওয়া যাবে, একটু সাবধান থাকতে। ট্যাক্সি ছাড়ার কিছু আগ দিয়ে একজন বললো, তার ভাই ইউসুফ আছে ট্যুরিস্ট রিসিপশন সেন্টার এর কাছে, পছন্দ হলে তার দেখানো হাউজবোট বা হোটেলে উঠতে। “আস-সালামু আলাইকুম” এই টুকু বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ট্যাক্সিতে আমাদের সহযাত্রী কবীর-ইভান যুগল। পথেও লক্ষ্য করলাম ব্যাপক আর্মি উপস্থিতি। ক’দিন আগের বোমা হামলার কথা মনে পড়লো। শ্রীনগর শহরের বাড়িগুলি কাশ্মীরি ধাঁচের – টিন বা টালির ছাদ। বিমান বন্দর থেকে শহরের দূরত্ব খুব বেশি না আর রাস্তাও বেশ ফাঁকাই ছিল। একটু পরেই চোখে পড়লো ঝিলম, পঞ্চনদের দেশ পাঞ্জাবের নদী – আরেক নাম বিতস্তা।
চার
সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল–যেন খাপে-ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার;
দিনের ভাঁটার শেষে রাত্রির জোয়ার
এল তার ভেসে-আসা তারাফুল নিয়ে কালো জলে;
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার তরু সারে সারে;
মনে হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি,
অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।
রবীন্দ্রনাথ তার শ্রীনগর বাসকালীন সময়ে ঝিলম তীরে বাস করেছিলেন, বলাকা’য় তারই উল্লেখ। ঠাকুর অবশ্য পদ্মার সাথে ঝিলমের মিলও খুঁজে পেয়েছিলেন। ঝিলমের উপর দেখলাম অনেকগুলি ব্রিজ, কোনোটা কাঠের, কোনোটা কংক্রীটের। ঝিলম পার হয়ে বাম দিকে দেখলাম, টিঅারসি বা ট্যুরিস্ট রিসিপশন সেন্টারের ব্যানার, বুঝলাম গন্তব্যে এসে গেছি। ট্যাক্সি মনে হলো ডান দিক ঘুরলো, হয়ত টিঅারসির অন্য দিকের গেটের দিকে নিচ্ছে, এমনটা ভাবলাম, একটুক্ষণ পরই থামলো গাড়ি, ঝিলমের ধারেই। দরজা খুলে বের হতেই হাত মেলে শান্তি কামনাকারী, নাম তার ‘ইউসুফ’। মুখশ্রী হুবুহু নাইন কুইনের সেই অার্জেন্টাইন অভিনেতার। বুঝলাম, একে নিয়েই টিঅারসি যেতে হবে। বুঝলাম অাসলে উল্টো! ট্যাক্সিওলা অার ইউসুফ বলছে ব্যাগ নামাতে। টিঅারসি কোথায় জিজ্ঞেস করায়, বললো এটাই টিঅারসি। প্রমাদ গুণলাম। অামি বললাম এটা তো না, ট্যাক্সিচালক অার ইউসুফ বোঝাতে লাগলো, গোটা এলাকাকেই টিঅারসি বলে। অামরা বললাম না টিঅারসি এটা না, ব্যানার রাস্তায় দেখেছি, ওখানে নিয়ে চলো। সে বললো “ওখানে কি করবে, এখানে ঝিলমের উপর ভালো হাউজ বোট অাছে, এখানেই থাকো, অার অামরা সব খানে নিয়ে যাবো।” ভাগ্যিস বলে বসেনি, “চলো তোমাদের রবীন্দ্রনাথের হাউজবোটে নিয়ে রাখবো”! বুঝলাম টাউটের পাল্লায় পড়তে যাচ্ছি। বললাম, টিঅারসি নিয়ে চলো, অন্য কথা নাই। কিছু ক্ষণ মন খারাপের পর, ইউসুফ বাধ্য হলো, কিন্তু পিছু ছাড়লো না। টিঅারসি পর্যন্ত সাথেই লেগে রইল।
শ্রীনগর টিঅারসি অফিসে চলে অাসলাম। অামাদের অাশা-ভরসার স্থল। থাকার জায়গা, যাতায়াতের ব্যাবস্থা সব ব্যাপারে পরামর্শ পাওয়া যাবে, তেমনটাই পড়েছি। কিন্তু বিধিবাম। যে মেয়েটা ঐ সময়ে রিসিপশনে, তার খুব অাগ্রহ মনে হলো না কথা বলায়। কোন-কিছুরই সমাধান হলো না। থাকার জায়গা – জানা নেই, যাতায়াত- বাস স্ট্যান্ডে যাও, ম্যাপ – জানা নেই, মানি এক্সচেঞ্জ-ওদিকে কোথাও ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝলাম, ব্যাবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। বাবা-মার কাছ থেকে হোটেল ইসফানের কথা জানা ছিল, ডাল গেটের কাছাকাছি কোথাও। মেয়েটা সেটাও চেনে না বলে দাবি করলো। এদিকে সুযোগ বুঝে অাবার ইউসুফ। ইউসুফ ছাড়াও অারো কিছু দালাল ঘুরঘুর করছিল। বুঝলাম, এই ব্যাপারে অভিযোগেরও ফায়দা নেই। ইউসুফ অাবার বলে বসলো, “চলো তোমাদের ঝিলমের পাড়ের হাউজ বোট দেখাতে নিয়ে যাই, ওখানেই ভালো, ঝিলমের বাতাস খাবে অার কাঠের পুলে ঘুরে বেড়াবে”। অামাদের প্রলুব্ধ করার অাপ্রাণ চেষ্টা। বলেই বসলাম, “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে।”
পাঁচ
অন্য কোথায় আর যাবো? ইউসুফ নাছোরবান্দা। আমাদের হাউজ বোট দেখিয়েই ছাড়বে। অবশেষে তাকে বলা হলো, দেখবো, পছন্দ হলে থাকবো, নয়ত নাই, জোর করা যাবে না। আমাদের আশংকা এরা কোনো ঝামেলায় না ফেলে আমাদের। টিআরসির পাশেই জম্মু-কাশ্মীর সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের অফিস ও বাস স্ট্যান্ড। এটা অনেকটা আমাদের বিআরটিসির মতন। রাস্তার উল্টোধারে ট্যাক্সি বা শেয়ারড জিপের স্ট্যান্ড, সারাক্ষণ “জম্মু” “জম্মু” বলে ডাকাডাকি ও লোক তোলার চেষ্টা করছে। নানান প্রলোভন চলছে, ভালো সিটের জন্য ইত্যাদি, আমাদের গাবতলী বা সায়েদাবাদের মতন মানুষ নিয়ে টানাটানি।
তিন চাকার অটো চলে প্রচুর। তারই একটাতে চড়ে বসা গেলো। শ্রীনগর ডালগেট (যেখান থেকে লেকের শুরু) থেকে রাস্তা একটা গেছে লালচকের দিকে (পুরানো বাজার) ও অন্যটি ঠিক লেকের পাড় ঘেঁষে মূল লেকের দিকে, নাম বুলেভার্দ। বুলেভার্দ রোডের শুরু থেকেই সব হোটেল ও ডাল লেকের ঘাটগুলির শুরু। ঘাট নম্বর দেয়া, প্রত্যেক ঘাটে নিয়মাবলী-নির্দেশাবলী-ভাড়ার তালিকা পর্যটক দের সুবিধার জন্য দেয়া আছে। বুলেভার্দ রোড বরাবর লেকটা সরু, আরেক পাশে এক ঝাঁক হাউজ বোট। লেক জুড়ে অসংখ্য হাতে টানা সুসজ্জিত ছাউনি-অলা ছোট নৌকা – এগুলির নাম শিকারা, এগুলির কোনোটিতে যাত্রী বোঝাই, কোনো কোনোটিতে সদাই নিয়ে ছোট ব্যবসায়ীরা ক্রেতা খুঁজছে। আমাদের অটো থামলো ৯ নম্বর ঘাটের কাছে।
এখানে ইউসুফ এর সাথে আছে তার চাচাতো ভাই নাজির। সে আমাদের একটা শিকারাতে এনে তুললো, উদ্দেশ্য বয়ান করলো হিন্দিতে, “নাজির ভাই কে শিকারা, জান্নাত কে নাজারা। ” নাজিরের উদ্দেশ্য বিফল, কারণ ডাক্তার হিন্দি ভালো বুঝে না, সে খুবই সন্দেহবাদী দৃষ্টি ও মুখ করে শিকারায় বসে থাকলো। বুলেভার্দের ঠিক বিপরীত দিকের হাউজ বোট এর সারিগুলি খুবই চমৎকার, নাজির ভাই এর জান্নাত ঠিক তার পিছনে, জায়গাটা থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য অনুপস্থিত উল্টো একটা নোংরা পদ্মপুকুরের মুখোমুখি। ডাক্তারের পছন্দ হলো না, সে নৌকা থেকে নেমেও দেখবে না। কবীর ভাই, ইভান ভাই আর আমি একটু ঘুরে ঘুরে দেখলাম হাউজবোট, সেটা বেশ রাজসিক, কিন্তু ভাড়া অন্ত্যন্ত বেশি। নাজির ও ইউসুফ কে এইবারে বিদায় বলতেই হলো। আমাদের আশংকা অমূলক, তারা আমাদের সাথে আর কোনো ঝামেলা না করে আবার ৯ নম্বর ঘাট এর কাছে রেখে দিয়ে আসলো। বেলা ততক্ষণে বেশ বেড়ে গেছে। ক্ষুধা আর ক্লান্তি আর অগতির হতাশা শুরু হলো বলে। জুলাই এর ঝকঝকে রোদেলা দুপুরে শ্রীনগরের তাপমাত্রাও কম নয়। দ্রুত একটা হোটেল পাওয়া গেলো নয় নম্বর গেটের কাছেই, রুমগুলি মোটামুটি।২ টা রুমের একটায় কবীর ভাই আর ইভান ভাই, অন্যটায় আমি আর ডাক্তার উঠে গেলাম। একটা গতি হলো।
ছয়
হাউজ বোট গুলি আমাদের দেশের বজরার মতন। দেবদারু কাঠের তৈরি। একেকটার নির্মাণ ব্যায় দেড় থেকে দু’কোটি ভারতীয় টাকা। বছর দুয়েক সময় লেগে যায় বানাতে।ডাল লেক ছাড়াও নাগিন লেক আর ঝিলমের ধারেও হাউজবোট আছে। সমগ্র শ্রীনগরে হাউজবোটের আনুমানিক সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি। সবগুলিই পানিতে ভাসছে। তবে খুঁটির সাথে লাগানো। প্রায় প্রত্যেকটিই বৈদ্যুতিক সংযোগ সম্পন্ন, মাগনা ওয়াই-ফাই দিচ্ছে অনেকেই। বুলেভার্দ এর সাথে ফ্রি বা স্বল্পমূল্যে যাতায়াত ব্যবস্থা এবং কয়েকটির ক্ষেত্রে বুলেভার্দের উল্টাদিকের ডাঙার সাথেও সরাসরি সংযোগ বিদ্যমান। হাউজবোট গুলি বিভিন্ন শ্রেণীর হয়, এরা বলে এ বি সি ডি ইত্যাদি, মোটামুটি ঘুরে বা জিজ্ঞেস করে যা ধারণা হলো খাবার দাবার সহ দু-হাজার রুপিতে বেশ আরামদায়ক ডিলাক্স শ্রেণীর হাউজবোট পাওয়া উচিত।আর আমাদের মতন বাজেট ভাবনাকারীদের জন্য ৪০০-৬০০ ভারতীয় টাকায়ও মুটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হাউজবোট সম্ভব। নাজির ও ইউসুফ দাবি করেছিলো ৩৫০০ রুপি, আর তাদের হাউজবোটের অবস্থান বা জায়গাটা একটু বেকায়দার, দামাদামি করা যেত, কিন্তু খুব পছন্দ না হওয়ায় এবং তাদেরকে এড়াতে গিয়ে আর এগোই নি।
হাউজবোটগুলির বেশিরভাগের সম্মুখদিকে একটা বারান্দা মতন। সেখান থেকে ঘাটের মতন করে নামানো একটা সিঁড়ির সাথে পাটাতন, যেখানে শিকারা বা ছোট নৌকাগুলি ভিড়তে পারে। বারান্দার বসার জায়গায় আরামদায়ক সোফা, ভেতরে টিভি ইত্যাদি সহ সুসজ্জিত বসার ঘর, একাধিক বেডরুম, মখমল জাতীয় কাপড়ে মোড়ানো সব, নিচে লালচে রঙের কার্পেট, আলোকসজ্জা ইত্যাদি, আধুনিক টয়লেট। বেশিরভাগ হাউজবোটের মালিক পরিবার-পরিজন নিয়ে আশেপাশেই থাকে। সেখানেই রান্না-বান্না / খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। নাজির ও ইউসুফের পরিবার দেখতে পেলাম। আমাদের কে ছেড়ে দেবার পর নাজির ইউসুফ হয়তো নতুন কোন পর্যটকের সন্ধানে গেলো, পরের দেড়দিনে শ্রীনগর অবস্থানকালীন আর ওদের দেখা পাই নি, টিআরসিতেও না, নয় নম্বর ঘাটের আশেপাশেও না।
সাত
আমাদের হোটেলের নাম মারজান গেস্ট হাউজ, স্বল্প মূল্যের বা বাজেট ব্যবস্থা। পাসপোর্ট এর ফটোকপি ইত্যাদি তাৎক্ষণিক ভাবে লাগলো না। ইন্টারনেট নাই। বিদ্যুৎ আছে, বাথরুমে গিজার এ গরম পানির ব্যবস্থা, জেট স্প্রে সহ আধুনিক টয়লেট। কলকাতা থেকে মিনুর দেয়া সিম প্রিপেইড, ওটি আর কাজ করছে না, খবর জানানোর উপায় আপাতত নেই, ইভান ভাই হোটেলের বয়কে দিয়ে কিভাবে যেন একটা সিম ভোরে নিয়ে দিব্যি ইন্টারনেট ভাইবার করতে শুরু করলেন। তখনকার মতন ফ্রেস হয় ব্যাগ ইত্যাদি রেখে উদর পূর্তির জন্য বের হলাম। গেস্ট হাউজের ঠিক বাইরেই দিল্লি ধাবা দেখে যেতে ইচ্ছা করলো, ডাক্তারের লোভ হলো মাগনা ওয়াইফাই লেখা একটা তিব্বতি কিন্তু হালাল (!) রেস্টুরেন্ট, নাম লাসা। দুপুরের খাবারের মেন্যু চাইনিজ মাশরুম দেয়া সবজি, মুরগির কাশ্মীরি তরকারি আর সাদা ভাত। সবজিটা ভালোই, সাদা ভাত বাসমতি চালের, এরা চাল আমাদের মতন করে সিদ্ধ করে না, হালকা শক্ত থাকে। পূর্ব এশিয়ার (ভিয়েতনাম, কোরিয়া) লোকেরা আবার বেশি সিদ্ধ করে ফেলে, আঠালো ভাত পছন্দ করে। মাগনা ওয়াইফাই সংযোগ করা গেলো না, ডাক্তার এর উদ্দেশ্য বিফল। আমরা ছাড়াও ওখানে একটা বেশ বড় মঙ্গোলয়েড চেহারার পরিবার কে পেলাম, তিব্বতি বলেই মনে হলো।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। এখনো সামনের প্ল্যান বাকী। পরের দিন বা ঐদিন বিকেলে কি করবো কিছুই স্থির হয়নি। শুরুতে প্ল্যান ছিল পরের দিন ভোরেই সম্ভব হলে লেহ’র দিকে রওনা দেয়া। এখন ডাক্তারের মত হলো, শ্রীনগর যেহেতু এসেই পড়েছি, আর কবে না কবে আসি, আশপাশটা দেখেই যাই। আশপাশ বলতে শ্রীনগর শহরের কাছে পর্যটক আকর্ষণের জায়গা হলো: গুলমার্গ, সোনমার্গ আর পেহেলগাম। শেষের টা দুইদিনের ট্যুর আর সোনমার্গ শ্রীনগর-লেহ রাস্তায় পড়বে, উপরন্তু এই দুইজায়গাতেই এই মৌসুমে অমরনাথ যাত্রীদের ভিড়। গুলমার্গ স্থির হলো। হোটেলে একটু জিড়িয়ে চলে গেলাম জম্মুকাশ্মীর সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের অফিসে। এর মধ্যে আমরা বুঝে গেছি টিআরসি থেকে বুলেভার্দ বা আমাদের হোটেলের আশপাশ পর্যন্ত অটো ভাড়া চল্লিশ রুপির মতন। বাস স্ট্যান্ডে পরের দিনের জন্য দুজনের জায়গা বুকিং দিলাম গুলমার্গের বাসে। আমাদের সিরিয়ালের আগের নামটা কবির ও ইভান ভাইদের। লেহর জন্য বাসের বুকিং এক দিন আগে অর্থাৎ পরের দিন দিলেই হবে এমনটা জানালেন বুকিং এর লোকজন। বলে রাখা ভালো এদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে ভাঙা হিন্দি-উর্দু তে, এদের মাতৃভাষা কাশ্মীরি, সবাই উর্দু জানে, পর্যটনের সাথে জড়িত বলে হালকা ইংরেজিও চলে। পাশেই টিআরসির অফিস থেকে জানতে পারলাম গুলমার্গে “ঝুলন খাটোলা” বা ক্যাবল কারে চড়তে হলে এখান থেকেই বুকিং দিতে হবে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে সেটাও করা গেলো।
আট
দুপুরে নাজির, ইউসুফ ছাড়াও আরো অনেকগুলি দালাল ঘুরঘুর করছিল, তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক মতনকে দেখিয়ে রিসিপশনের মেয়েটা বলছিলো, সে তাকে সৎ হিসেবে চেনে। চাচা আমাদের ভাষা শুনে বাংলাভাষী বুঝতে পেরে বাংলায় “দাদা, শোনো ” বলে পরের টুকু উর্দুতে চালাতে লাগলেন, উদ্দেশ্য ডাল লেকে শিকারার বন্দোবস্ত। আমরাও এবারে রাজি হলাম, বিকেল টা ডাল লেকেই কাটানো যাক সূর্যাস্ত ইত্যাদি দেখা যাবে। চাচা আমাদের নিয়ে গেলেন ডাল গেটের কাছে, সেখান থেকে আমরা এক বৃদ্ধ বয়সী মাঝির শিকারায় উঠে হাত পা ছুড়ে বসলাম, শিকারার বসার গদি গুলি আরাম দায়ক, হেলানো, বসা মানে অর্ধশায়িত অবস্থা। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো শিকারা। মাঝি আমাদের প্রথমে বুলেভার্ডের দিকে না নিয়ে পদ্মপুকুরের দিকে নিয়ে গেলেন, আসলে ওগুলি সব পদ্ম ছিল না, শাপলা – হলুদ।
তুলনা করে অভ্যাস, মার্চে ইনলে তে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তাই ডাক্তার আর আমি মিলে তুলনা করতে লাগলাম ডাল লেক আর ইনলের মধ্যে, অবশ্যই ইনলে আকারে অনেক বড় আর পর্যটন এখনো খুব প্রসারিত হয় নি শ্রীনগরের মতন। একটা জিনিস খুব ভালো লাগলো সেটা হলো দাল লেকের শিকারাগুলির কোনোটাই মোটর চালিত না, শব্দদূষণ বা ধোঁয়া-তেলের অনুপস্থিতির কারণে পানি বা বায়ুদূষণও অনুপস্থিত। ইনলেতে ভটভট শব্দে বিরক্তি এসে গেছিলো। এখানে পানি বেশ স্বচ্ছ, রঙিন অনেক মাছ দেখা যাচ্ছিলো, এছাড়া বেশ কিছু বক, হাঁস আর ঈগলের দেখা পাওয়া গেলো। ডাল লেকের শুরু এদিকে ডাল গেটের কাছে, শ্রীনগর শহরের কেন্দ্র থেকে আরেক মাথা গিয়ে মিশেছে দূরে পাহাড়ের গায়ে হযরত বাল মসজিদের কাছে। কথিত আছে, ঐ মসজিদে ইসলামের নবীর একটা বা এক গোছা চুল রক্ষিত আছে। এদিকে বুলেভারদের লাগোয়াপাহাড়ের আগায় হিন্দু মন্দির, নাম – শঙ্করাচার্য। বাবামার কাছে দুটোরই কথা শুনেছিলাম। পাহাড় ডিঙানোর ইচ্ছার উদ্রেক হলো না।
ইনলের সাথে ডাল লেকের আরো মিল আছে। ইনলেতে ভাসমান টমেটো-শসার বাগান দেখেছিলাম, এখানেও তাই। সারি সারি ভাসমান শালগম-শসার বাগান। তৃণগুল্মের মাটি আটকে বেঁধে রাখা, তারই উপরে ফলে যাচ্ছে নানান পদের সবজি, কোথাও ফুলের বাগান। লেকের তলানিতে অনেক আগাছা, প্রায়ই দেখা যাচ্ছে আগাছা উপরে তুলে বাগানের উপর দিয়ে দিচ্ছে, উদ্দেশ্য এগুলি পঁচে মাটির সাথে মিশে কম্পোস্টের কাজ দিবে। লেকের উপরে ছোট ছোট কয়েকটা পার্ক আছে, এরকম একটার নাম নেহেরু পার্ক। ওটার পাশ দিয়েই মূল লেকে পড়তে হয়। শিকারা চালক আমাদের নানান জায়গা চেনাতে লাগলেন, বলিউডের সিনেমার নাম করে করে । শঙ্করাচার্যে রাজেশ খান্না-মুমতাজ নেচেছিল, কোন এক হাউজবোটে প্রীতি জিনতা-হৃতিক কি করেছিল, কাশ্মীর কি কলি তে শর্মিলা ঠাকুর কোথায় ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি।বোঝা গেলো ভারতীয় পর্যটকেরা এগুলি বেশ উপভোগ করে। শিকারা চালক আমাদের মধ্যে তেমন উৎসাহ না পেয়ে বিমর্ষ হলো কিনা বোঝা গেলো না। আরেক উপদ্রব শুরু হলো লেকের মধ্যেই। কতগুলি শিকারা লেকের মধ্যেই ফেরি করে বেড়ায়, চা, কাহবা, বুট – বাদাম, কাবাব-টিক্কা, কেউ ফ্রুট স্যালাদ বা জুস, কেউ কেসার বা জাফরান, কেউ কুলফি-মালাই, স্থানীয় গয়নাগাটি ইত্যাদি। আমরা একজনের কাছ থেকে পাহাড়ি কূল (প্লাম), ন্যাশপাতি, কলা ইত্যাদির সাথে চাট মশলা দেয়া সালাদ খেলাম। এরই মধ্যে একদল ক্যামেরা ও কাশ্মীরি পোশাক নিয়ে ঘুরছে, পর্যটকদের ছবি তুলে দেয় ঐসব পোশাক পড়িয়ে। দার্জিলিঙের বাতাসিয়া লুপের কাছে গোর্খা পোশাকে অনেকে ছবি তুলছিলো, এখানেও অনেকে তুলছে, নানান সাইজের পোশাক আছে তাদের ভাণ্ডারে। শ্রীনগরের গরমের মধ্যে ঐ পোশাক পরে অনেকেই ফটো তুলছিল স্মৃতি হিসেবে নিয়ে যাবে বলে। বেরসিক ডাক্তারকে কেউ ভজাতে পারলো না।
লেকের এক অংশে পুরানো বাজার, ডাল লেকের উপরেই। কাশ্মীরি কাজ করা পশমিনা, শুকনো ফলমূল, কেশর ও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী। এই প্রত্যেকটা দোকানের সাথে শিকারা চালকদের যোগাযোগ। এখানে কিছু কেনাকাটা করলে ওরাও বখশিশ পায়, আমাদের শিকারা চালক অনেক কোশেশ করল আমাদের কোনো একটাতে ভেড়াতে। আমাদের অনুত্সাহে খানিক বিরক্তও মনে হলো। লেকের থেকে দূরে আকবর ফোর্ট দৃশ্যমান উপরে পাহাড়ের চূড়ায়, যেদিকে শঙ্করাচার্য তার উল্টা দিকে। লেকের মূল অংশটা বেশ চওড়া, একদিকে কিছু ফোয়ারা আছে, একটা দুইটা যেটির মতন ঘাট আছে রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গাতে বসার বেঞ্চিসহ। শীতের সময় নাকি লেকের উপরটা জমে যায়, ছোট বাচ্চারা স্কেটিং করে, হেঁটে বেড়ায়। রোমান্টিক জায়গা হতে পারতো, কিন্তু লোকজন গিজগিজ করছে। হয়ত আগের সপ্তাহেই বোমা হামলার পর লোকশূন্য ছিল, কে জানে! অভিশপ্ত মনে হচ্ছিলো লেকটাকে, কোথাও যেন অসস্তোষ চাপা আছে। যেকোনো সময় বিদ্রোহের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করবে কোনো একটা হাউজবোট। ইউসুফ, নাজির আর আমাদের শিকারা চালকের দারিদ্র্য খুব বেশি করে কটাক্ষ করছিল, এরই মাঝে বুলেভার্দে ক্বচিৎ ছুটে যাওয়া আর্মি ভ্যান বা জিপ। আমাদের সাজেক বা নীলগিরিতে গিয়ে যে অস্বস্তি হয় সেরকম একটা ভাব।
নয়
সূর্যাস্তের আগেই আমরা নেমে গেলাম শিকারা থেকে। নামার পর ভালো লাগছিলো একটু। সময় আছে বেশ হাতে। একটা ছাদ খোলা ট্যুরিস্ট বাস পাওয়া গেলো। উঠে পড়লাম আমি আর ডাক্তার। ১০০ টাকায় ডাল লেকের পাড় ধরে ঠিক উল্টা দিকের হযরতবাল মসজিদের কাছের মুঘল গার্ডেন গুলির দিকে যাবে। ডাল লেকের ভালো ভিউ পাবো আর সন্ধ্যার বাতাস এই ভেবে উঠলাম। আমরা উঠার পরই হুড়মুড়িয়ে কয়েকটা পাঞ্জাবি পরিবার উঠে এলো। ডাল লেকের পাশেই মুঘল বাদশাহের আমলে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু সুদৃশ্য বাগান, এরাই মুঘল গার্ডেন নামে পরিচিত। এমনিতে আলাদা নাম আছে: শালিমার বাগ, নিশাতবাগ ইত্যাদি। এই বাস ভ্রমণ টা আমরা বেশ উপভোগ করলাম, নিশাত বাগেরও এক ঝলক দেখা হলো, পরিপাটি কাটা ঘাস, অনুচ্চ প্রাচীর, বাগানগুলি আমাদের লালবাগের কেল্লার মতন, এদিক ওদিক কয়েকটা ফোয়ারা, পেছনে সবুজ পাহাড়ের পটভূমি। বাসে চড়ার পর বুঝতে পারলাম কি পরিমাণ পর্যটক ঐ মুহূর্তে শ্রীনগরে অবস্থান করছে। রাস্তার ফুটপাথ বা লেকের ধারগুলিতে ভিড় প্রচুর, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের লোক প্রচুর। ভারতে জুন-জুলাই স্কুল হলিডে, সবাই বাল-বাচ্চা সহ বেড়াচ্ছে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুক কাহিনী মনে পড়ে গেলো “কাশী বনাম কাশ্মীর” তা নিয়ে কর্তা গিন্নির লড়াই। এখন অবশ্য কাশ্মীর যাতায়াত সুলভ, রাজীনীতির নাকি সুবাতাস বইছে গত ৩-৪ বছরে।
বাস ভ্রমণ সেরে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রাতের খাবার এর জন্য সময় আছে হাতে। এই ফাঁকে আমি আর ডাক্তার মিলে বুলেভার্দের আসে পাশের হকার দের দোকানগুলি ঘুরতে লাগলাম। রোযার মাস, লোকজন মাত্রই ইফতার সেরে উঠছে। আমাদের শহুরেদের মতন খুব জবরজং খাওয়া দাওয়া না। হয়তো একটু সত্তু (ছাতু) আর একটা কলা। এর পর সামোভার থেকে ধোয়াঁ উঠা চা। এরই মধ্যে কেনাকাটা চলছে, ইফতারের জন্য কোনো লক্ষ্যণীয় বিরতি নেই। খরিদ্দার বেশিরভাগ হিন্দু, দোকানি মুসলিম। ডাক্তার একটা দোকান থেকে শুধু একটা কান ঢাকা টুপি কিনলো, লাদাখের ঠান্ডা ইত্যাদি চিন্তা করে, দোকানি অবশ্য আরো কিছু গছাতে চাচ্ছিল।
রাতের খাবার জন্য বেশ কিছু ধাবা দেখলাম, বাংলা দোকানও দেখলাম আছে। একটা মিষ্টির দোকান দেখে বেশ আগ্রহ পেলাম। কাশ্মীরি ঠিক না উত্তর ভারতীয়, নাথুস। শুকনা মিষ্টি, আমাদের মতন রসালো না, কিন্তু দেখতে ভারী সুন্দর, নানান রকম বাহারি, কোনোটা সেপ (আপেল), কোনোটা ন্যাশপাতি (পিয়ার), কোনোটা গোলাপের র মতন দেখতে, কিন্তু তৈয়ার দুধ-মাখন-কাজু-ইত্যাদি হতে। আমরা একটা প্যাকেট নিলাম কয়েক প্রকারের সাজানো, দাম বেশ চড়া। আরেকটা দোকান থেকে কিছু পেস্তাবাদাম, বুট, কাজু আর জংলী রসুন কেনা হলো লাদাখের রাস্তার রসদ হিসেবে। রাতের খাবার সারলাম চাপাতি আর ডাল ফ্রাই দিয়ে নাথুদেরই রেস্টুরেন্টে। দেখি ব্যানারে লেখা ২ জুলাই থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে ঈদের জন্য। এখানে ফ্রি খাবার জলের ব্যবস্থা ছিল, রান্না পরিচ্ছন্ন ও সুস্বাদু। খেয়ে দেখে খুশি মনে গেস্ট হাউজে ফিরে এলাম। সারাদিনে ইন্টারনেট, ফোন কোনোকিছুরই প্রয়োজনীয়তা বোধ করি নি, রুমে টিভি চালানোর ইচ্ছেও হলো না। আগামী কাল ভোরে গুলমার্গ।
(চলবে )
[…] আগের পর্ব […]
ধর্মীয় চেতনায় নয়—-উপর থেকে শ্রীনগর দেখার জন্যেও শঙ্করাচার্যের মন্দিরে যাওয়া যেত।