ananta

অনন্ত বিজয় দাশের মুক্তমনা পাতা

আজ ১২ ই মে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোটকাগজ ‘যুক্তি’র সম্পাদক, বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশ (অক্টোবর ৬, ১৯৮২-মে, ১২, ২০১৫) এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। একটি শোষণ-নিপীড়ণহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠণের জন্য মুক্তচিন্তা, ইহজাগতিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও কুসংস্কারবিরোধিতা যে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াটা অতি আবশ্যক তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন গুটিকয়েক মানুষ। অনন্ত বিজয় তাদের মধ্যে একজন।

অনন্ত বিজয় সকল কুসংস্কার, ছদ্মবিজ্ঞান, মিথ্যা অলৌকিকতার দাবিকে যৌক্তিক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছেন, এর অন্তঃসারশুন্যতা নিজের বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে উন্মোচন করেছেন। আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিলো জীববিজ্ঞান, বিশেষত জীববিবর্তন তত্ত্ব। তার জীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিটির নাম চার্লস ডারউইন। তাই তার বেশিরভাগ লেখার মূল উপজীব্য জীববিবর্তন তত্ত্ব। মুক্তমনার নিবেদিতপ্রাণ লেখক অনন্ত বিজয় মানবতা এবং যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৬ সালে মুক্তমনা র‌্যাশনালিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন।

গত বছর ২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ইসলামি জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে নির্মমভাবে খুন হন মুক্তমনা সম্পাদক, লেখক অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদ গুরুতর আহত হন। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পরে দেশের মুক্ত-চিন্তক’রা নিজেদের জীবনের উপর বিপদের আঁচটা টের পেয়েছিলেন ভালোভাবেই। একদিনে জীবন শংকা, অন্যদিকে বৃদ্ধ অসুস্থ পিতামাতাকে দেখভাল করার মূল দায়িত্ব। নিরাপত্তার জন্য তাই চিঠি লিখেছিলেন কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছে। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার একমাস পেরোতেই হত্যা করা হলো ওয়াশিকুর বাবুকে। বিপদগ্রস্থ লেখকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘আইকর্ন’ অনন্ত বিজয় দাশকে ইউরোপের একটি শহরে নিয়ে আনার আগ্রহ প্রকাশ করলেও, শহর খুঁজে পাবার জন্য চেয়েছিলো অনির্দিষ্টকাল। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তমনা একজন সিনিয়র সদস্য অনতিবিলম্বে অনন্তকে স্টকহোমে নিয়ে আসার জন্য সুইডিশ পেনের সাথে যোগাযোগ করেন। ‘আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিবসে’ অংশগ্রহণ ও বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য অনন্ত বিজয়ের ঠিকানায় আমন্ত্রণ আসে সুইডিশ পেনের পক্ষ থেকে। সেই আমন্ত্রণপত্র নিয়ে অনন্ত বিজয় দাশ সুইডেনে ভ্রমণ ভিসার আবেদন করেন। অনন্ত বিজয় দাশের নিরাপত্তাহীনতার কথা বোঝা স্বত্তেও সুইডেন তাকে ভিসা প্রদানে বিরত থাকে। ১২ই মে’র সেই বিভীষিকাময় সকালে বাসার সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে আনসার বাংলা নামধারী কয়েকটি বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত ধর্মান্ধ জঙ্গী। নিপাট ভদ্র, মেধাবী, অত্যন্ত অমায়িক, শান্তিপুর্ণ আলোচনায় বিশ্বাসী ও আগ্রহী মানুষটিকে হত্যা করে চুপ করানো হলো সর্বোচ্চ পাশবিক পন্থায়।

হত্যার এক বছরে অনন্ত হত্যা মামলায় অগ্রগতি হতাশাব্যাঞ্জক। ধৃত আসামীদের দুজন ইতিমধ্যে এই মামলায় জামিন লাভ করেছে, যদিও মুক্তির পর তাদের ফের গ্রেফতার করা হয়েছে। মুক্তমনা আবারও মৌলবাদি জঙ্গিদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে অনন্ত বিজয় দাশ সহ মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীদের ওপর হত্যা-হামলার শাস্তি দাবী করছে।

অনন্ত বিজয় স্মরণে বিশেষ আয়োজন

এই দিনকে সামনে রেখে অনন্ত বিজয়কে স্মরণে মুক্তমনা নতুন একটি ওয়েবপেইজ চালু করেছে। এই পেইজে অনন্ত বিজয়ের কর্মজীবন, প্রকাশিত বইয়ের তালিকা ও ই-বুক ভার্শন, মুক্তমনা সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ব্লগ-নিবন্ধ স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল সিলেট নগরের সুবিদবাজারের চৌরাস্তায় প্রতিবাদী সেই দেয়ালচিত্রে এবার স্মৃতিস্তম্ভ হয়েছে। অন্ধকার বোঝাতে কালো, রক্তাক্ত হওয়া আর কলমের প্রতীকী চিত্রসংবলিত ‘অনন্ত, অনন্তকাল’ নামের এ স্মৃতিস্তম্ভ কাল বৃহস্পতিবার উন্মোচন করা হবে।

১২ মে ২০১৬ (বৃহস্পতিবার) সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উন্মুক্ত মঞ্চে অনন্তকে স্মরণ করে সাংস্কৃতিক সমাবেশ, অনন্তের লেখা নাটক ব্রুনোর মৃত্যুদণ্ডের মোড়ক উন্মোচন ও শেষে আলোর সমাবেশে দেশব্যাপী চলমান প্রগতিশীল মানুষদের গুপ্ত হত্যার প্রতিবাদ করা হবে।
ইভেন্টের ফেসবুক লিংকঃ https://www.facebook.com/events/1746863438868568/

কর্মসূচী-

বেলা ১১টায় হত্যার স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ উন্মোচন ও পুষ্পস্তবক অর্পণ
-বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টায় পর্যন্ত শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক সমাবেশ ও “ব্রুনোর মৃত্যুদণ্ড” বইয়ের মোড়ক উন্মোচন।
-সন্ধ্যা ৭টায় দেশব্যাপী প্রগতিশীল মানুষ হত্যার প্রতিবাদে মশাল মিছিল।

এক নজরে লেখক অনন্ত বিজয়

বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোটকাগজ ‘যুক্তি’র সম্পাদক। মানবতা এবং যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৬ সালে মুক্তমনা র‍্যাশনালিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ :
(১) পার্থিব, (সহলেখক সৈকত চৌধুরী), শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১১।
(২) ডারউইন : একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা, (সম্পাদিত), অবসর, ঢাকা, ২০১১।
(৩) সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায়, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১২।
(৪) জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ (মূল: ফ্রান্সিসকো জে. আয়াল, অনুবাদ: অনন্ত বিজয় দাশ ও সিদ্ধার্থ ধর), চৈতন্য প্রকাশন, সিলেট, ২০১৪

আজ অনন্ত বিজয় আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের দিয়ে গেছেন এগিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা। হয়ত একদিন মানুষ জাতি ধর্মান্ধতা-কুসংস্কার মুক্ত ন্যায়ভিত্তিক মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলবে, আর তখন এই পৃথিবী আবারও কৃতজ্ঞচিত্তে অনন্ত বিজয়ের অবদানের কথা স্মরণ করবে। অকালপ্রয়াত এই প্রতিভা তার অসংখ্য অতুলনীয় কাজের মাধ্যমে বন্ধু-সহযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাবেন, অসংখ্য পাঠককে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে যাবেন অনন্তকাল।

মুক্তি আসুক যুক্তির আলোয়!