রাজীবের পর “অন্ধকারের পানে যাত্রা” মিছিলের শুরু হলো অভিজিৎ রায়কে দিয়ে, তারপর পিপীলিকার সারির মত একজনের পর একজন, একটা ধাক্কা কাটতে না কাটতেই আর একটা, মৃত্যুর মিছিল শেষ বেলার ছায়ার মত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো, প্রতিদিন এখনো মিছিলে নতুন নতুন নাম যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরিচিত মুখ গুলো, ফেসবুকের পোস্ট, ব্লগের মন্তব্য থেকে “রিমেমবারিং” এ চলে যাচ্ছে। আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা প্রতিটি মৃত্যুর জন্যে ঘাতককে নয়, নিহতকেই তার নিজের খুন হবার জন্যে দায়ী করে দিচ্ছে। তাদের পছন্দ মত “হত্যার কারণ” জনগণের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, মৃত্যু গুলোকে জনগণের সহ্য সীমার মধ্যে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যারা হত্যা করছে কারণ তারা বলছে না, বলছে তারা যাদের এই প্রাণ গুলো রক্ষা করার দায়িত্ব ছিলও। নিজের অপারগতা ঢাকতে কী নির্লজ্জতা। একদম যে সফল হচ্ছে না, তাই বা কী করে বলি? এখন কি আগের মত হঠাৎ পানি ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে যাওয়া মাছের মত ছটফট করি? না, শুধু খবরের কাগজ খুলে চুপচাপ জেনে নেই, কে গেলো আর কখন গেলো, এই তো। ঢাকার জ্যাম মানিয়ে নেয়ার মত আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের স্নায়ু, এই নৃশংসতার মধ্যে। বরং নিজের অজান্তেই যেনো আজকাল অপেক্ষা করি, আজকে ক’জন, কোথায়, কে কে?

লিখতে চাইছিলাম অনন্তকে নিয়ে, কত কিছুই তো লিখতে চাই কিন্তু লিখতে বসলে নীরব যন্ত্রণায় শব্দ গুলো হারিয়ে যায়। মুক্তমনায় ওয়েব সাইটের বাইরেও যখন ইয়াহু গ্রুপে আমরা আলোচনা করতাম তখন থেকে অনন্তের সাথে পরিচয়। বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা সবাই যার যার মতামত লিখতাম, তর্ক করতাম, যুক্তি দিতাম, ঝগড়াও করতাম। নিজেদের যুক্তির ভুল ত্রুটি, দুর্বলতা সেসব নিয়েও মন্তব্য, প্রতিমন্তব্য চলতো। যদিও কখনো সামনা সামনি বসা হয় নি চায়ের কাঁপে ধোঁয়া উড়িয়ে, তারপরও …

আজও আমি জলের নীরবতায় কান পাতলে শুনতে পাই, কার্পাস তুলোর মত নরম সে গলা, মুঠোফোনের ওপার থেকে বলছে, দিদি, দাদা আর মেয়েকে নিয়ে একবার সিলেট ঘুরে যান, প্লিজ। কিংবা ঠিকানাটা দেন দিদি, যুক্তির কয়েকটি কপি পাঠাবো।

আমি পয়সা কী করে পাঠাবো অন্তত? পয়সা লাগবে না, আপনি ওখানে বিলি করবেন।

-কার কাছে বিলি করবো অনন্ত!
-আপনার বন্ধুদের মাঝে
-কেউ যুক্তির কথা শুনতে চায় না অনন্ত
শুনবে দিদি, শুনবে। আমাদেরকে চেষ্টা করে যেতেই হবে।
এতো পড়াশোনা, এতো জানতো অথচ কী বিনয়ী, কী নম্র গলা তার। কথা ছিলো, সিলেট গেলে একবার নিশ্চয় দেখা হবে, অনেক অনেক কথার মত, নাদের আলী, এ কথাটিও আমার রাখা হয় নি। রাখা হবে না আর কোন দিন, আমাদের জীবন আমাদেরকে এ সুযোগ আর কখনো দেবে না।

এই মানুষ গুলো নিজের জীবন তুচ্ছ করে দিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে, একবার নয়, বার বার দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এদের হত্যার প্রতিবাদে সেভাবে ক’জন রাস্তায় নেমেছে? মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তবে সে সময়ের অসহায়তা আজ অনুভব করতে পারছি। “ধর্মনিরপেক্ষতা” ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ভিত্তি। সে সময়ও ধর্মের নাম দিয়ে বাঙালিদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে, হত্যা গুলোকে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য করার জন্যে বার বার ধর্মের কারণ দেখানো হয়েছে। আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, ধর্মের নামে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করেছিলো এই ব্লগাররা। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তপ্রাণ মানুষের পরিবারের দাবীর সাথে তারাও গলা মিলিয়েছিলো। আজ যখন তারা বিপদে, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার গুলো থেকে তেমন প্রতিবাদ চোখে পরে কি? অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানই তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় আছে, তাদের বিবেকের দায় কোথায় আজ? যারা দিনের পর দিন খুন হচ্ছে তারা আপনার বাবার মতই যে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের কথা ভাবতো, সে কি আপনারা অনুভব করেন? একজন মানুষের মৃত্যুতে প্রতিবাদ করা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান হিসেবে আপনার নৈতিক দায়িত্ব, জেনে রাখুন। এ আপনাদের রক্ত ঋণ তাদের কাছে, পিতৃ দায়।

অনেক অনেক বিচার না পাওয়া মানুষের নামের সাথে খুব দ্রুত কতগুলো নাম আরো যোগ হলো। সাগর, রুনি, অনন্ত, অভিজিৎ, জুলহাস, তনয় কিংবা তনু। রোজ রোজ এতো নাম এই তালিকায় যোগ হচ্ছে যে, প্রতিবাদ করতে করতে মানুষ ক্লান্ত। এক হত্যার ভীড়ে অন্য হত্যা হারিয়ে যাচ্ছে। ইস্যুর নীচে চাপা পরে যাচ্ছে মানুষ গুলো যাদের এই নীল আকাশের নীচে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়ার কথা ছিলো, লাজুক গলায় কাউকে দেয়া কথা রাখার অঙ্গীকার ছিলো। আমরা ভুলে যাই কিন্তু যার যায় সে কী ভোলে?

“আমার শূন্যতা নিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে পথ চেয়ে বসে থাকবে আমার মা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ যখন ধরণী পবিত্র করতে ব্যস্ত থাকবে, অসীম নীলের সাথে শুভ্র জলধারা দিয়ে চেষ্টা করবে এই পৃথিবীর পাপ ধুয়ে দিতে, তখন হয়তো কোন টগবগে তরুণ তার শোবার ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে পাশের বাসার ছাদে খোলা চুলে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা লাজুক তরুণীটির দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে বিভোর। অন্য পাশের ফ্ল্যাট থেকে হাঁক শোনা যাবে বৃষ্টির আওয়াজ ভেদ করে, কী, বৃষ্টি দেখেছো আজ? -অফিস যাবো না ভাবছি। একটু খিচুড়ি করো না আজ, সাথে গরম গরম গাওয়া ঘি, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা আর সর্ষের তেলে ইলিশ ভাজা।

এই শুনে আমার মা ডাক ছেড়ে বিলাপ করে কাঁদবেন, অনন্ত আমার অনন্ত! আমার অনন্ত বড্ড বৃষ্টি আর খিচুড়ি ভালবাসতো। দিনের শেষে শুধু সেই মনে রাখে যার ঘর শূন্য হয়, বুক শূন্য হয়, কোল শূন্য হয়।”

লেখাটি আজ “সিলেটটুডে২৪ ডট কমেও প্রকাশিত হয়েছে।
http://www.sylhettoday24.com/opinion/details/8/461