লেখকঃ শাওন বিশ্বাস

গুলিস্থান-ধামরাই বাসের শেষ সিটে পাঁচজনের স্থানে ছয়জন বসে অবোরোধের ভিতর যেন মহাভারত জয় করে ক্যাম্পাসে ফিরে আসছিলাম । হঠাৎ ফোনের শব্দ শুনতে পেলাম । কিন্তু জিন্স প্যান্টের ভিতর থেকে কিভাবে ফোন বের করি । পাশে বসা প্রিয় বন্ধু শিশিরকে বললাম ফোনটা বের করতে । ও অনেক কষ্ঠ করে ফোনটা বের করে অপরিচিত নাম্বার দেখে রিসিভ করে আমার কানে ধরলো । আমি হ্যালো বলার সাথে সাথে বজ্রকন্ঠের ন্যায় কান্নার শব্দ অস্পষ্ট ভাষায় ভেসে এল, “আমার জামাই মইরা গেছে গা । একটু আগে………।” ও পাশ থেকে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ খুজে পেলাম না ।
“কিরে তুই কানচিস কেন ?”-শিশিরের প্রশ্নে আমি যেন অচমকা ধরনীতে ফিরে এলাম । বুঝতে পারিনি নিজের অজান্তে কখন নয়নের কোণা হতে বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরতে শুরু করলো । শার্টের এক কোনা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে শিশিরকে বললাম যার জন্য রক্ত দিয়ে আসলাম উনি একটু আগে মারা গেছে । শিশিরও শুনে হতভম্ব হয়ে গেল । ওর মুখ মুহুর্তের জন্য যেন কেও কথা কেড়ে নিল ।
যখন আমরা ঢাকা মেডিকেলে পৌছায় তখন ঘড়ির কাটা প্রায় ১০টা ছুই ছুই । জরুরি বিভাগের গেটের সামনে থেকে একজন বৃদ্ধ মহিলা আমাদের রিসিভ করে নিয়ে গেল । উনি প্রথমে উনার স্বামীর কাছে নিয়ে গেল । দেখলাম উল্টা দিকে মুখ করে শুয়ে আছে একজন বৃদ্ধ । আমাদের কথার শব্দ শুনে পাশ ফিরে তাকানোর চেষ্ঠা করল কিন্তু পারল না । বয়স পঁয়ষট্টি কি সত্তর হবে । পরনে লুঙ্গি আর গায়ে একটা ছেড়া গেঙ্গি । একটা পাতলা কাঁথা কোন রকমে গায়ের উপর এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে । আশ-পাশ থেকে কিসের যেন দূর্গন্ধ আসছিল । মনে হচ্ছে এখানে একজন সুস্থ মানুষ আসলেও অসুস্থ হয়ে যাবে । একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবার তাগিদে একটা বিছানার সাথে একটা বিছানা লাগিয়ে শুয়ে আছে অসহায়ার্থী । হয়ত দিনে একবার ডাক্তার আসবে তারপর একটু নিজের অসুস্থতার বিবৃত করে একটা ডাক্তারের লেখা কাগজ পেয়ে সুস্থ হয়ে যাবার শান্তনা খুজে পাওয়ার চেষ্ঠা করবে ।
“কি হয়েছে উনার?”-শিশির মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলো ।
বেদনাময়ী হতদরিদ্র মহিলার কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, “বাবজান, আমার জামাই রেসকা চালাই । শনিবার আজিমপুরে কয়েকটা ব্যাডা একটা বাসে বোম মারে । আমার জামাই রেসকা লিয়া বাসের লগে খাড়াইয়া আছিল । আমার জামাই এর গতরে আগুন লাইগা যায় ।”
মহিলাটি আর কথা বলতে পারে না । কান্না করতে করতে স্বামীর কাঁথাটা একটু গুছিয়ে দিতে থাকে । ক্ষনিকের জন্য আমি চলে যায় উনার স্থানে । একবার ভাবলাম আজ যদি আমি ঐ মহিলার স্থানে থাকতাম তাহলে আমারও তো এই অবস্থা হতো ।
ভাল করে চারপাশ ঘুরে দেখলাম আরও একবার । মহিলাটি কয়েকটা আপেল, ৫০০ গ্রাম প্রাণ আমের জুস আর তিনটা বাটির মরিচা ধরা একটা টিফিন কেরিয়ার হাতে দিয়ে বলল, “বাবজান, আমরা গরিব মানুস । আপনেরা সব বড় মানুস । আপনেদের লেগা কিচ্ছুই করবার পারলাম না । আপনেগো লিয়া গিয়া ভালা হোটেলে পোলাও মাংস খাওয়াইবার পারুম না । বিয়ানে বাইত গিয়া আপনেগোর লেগা দু’টা মাছ ভাত রাইন্দা আনছি ।”
উনার করুনাময় কণ্ঠে বারবার বাবজান ডাক শুনে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায় । আমি নিজেও আবেগী হয়ে পড়ি । আমি খাবার গুলো মমতাময়ী ঐ মায়ের কাছে দিয়ে শুধু মাথাটা নাড়ালাম । শিশিরকে বললাম এক বোতল পানি কিনে আনতে । আমি মহিলাটিকে নিয়ে ব্লাডব্যাংকে গিয়ে রক্ত দিলাম ।
“আপনে যা করছেন আমরা আপনের কাছে সারাজীবনের লাইগা ঋনী অয়া গেলাম । আমার দুইডা পোলা আছে । অহনে ওরা খোঁজ-খবর ল্যায় না । আপনে আমার পোলাগোর চাইয়্যাও আপন ।”-মাথায় হাত রেখে চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বললেন । আমি শুধু বললাম, “আপনার স্বামী সুস্থ হলে আমাকে একটা ফোন দিবেন ।” তারপর শিশির ও আমি চলে আসি ।
এ কান্না শুধু ঐ মহিলার নয়, এ কান্না প্রতিটি মানুষের; যারা এক হাতে একটা কাগজ নিয়ে সন্ধ্যায় ভিড় জমায় বাঁধন অফিসে । এ কান্না হতে পারে আপনার, আমার যে কারোর । হয়তো সেদিন অগ্নিদগ্ধ রিক্সা চালকটি বাঁচে নাই । কিন্তু আপনাদের একব্যাগ রক্ত পারে একজন মূমুর্ষূ রোগীকে আবার জীবন ফিরিয়ে দিতে । পারে দ্বিতীয় বারের একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে ।
আর মহিলার মমতার কথা না হয় নাই বললাম । যেটা হয়ত শুধু এমন কিছু মহৎ কাজের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব ।