জেন এন ইউ কেন্দ্রিক, জাতীয়তাবাদ বিতর্ক বড়ই বিরক্তিকর এবং সময়ের অপচয়। পৃথিবীতে প্রথম দেশ তৈরী হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে-মেসোপটেমিয়ায়। সেই প্রাক আক্কাডিয়ান সভ্যতায় ছিল অনেক সিটিস্টেট বা শহর রাজ্য। শহরের শাসক শ্রেনী সম্পদ এবং নারীর জন্য একে অন্যের সাথে লড়ত। কিন্ত মজার ব্যপার হল ঐতিহাসিকরা বলছেন-সিটিজেন গেভ এ ড্যাম। জনগন মনে করত, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হচ্ছে-তাতে আমার কি। কারন যেই আসুক- কর বসাবে-লুঠ করবে-ঘর থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে যাবে! দেশ আমার মাতা বা পিতা-এই জাতিবাদি ধারনার বয়স দেড়শো বছর ও না! তার আগে পর্যন্ত রাজা ধণে প্রানে বাঁচিয়ে রাখলেই বর্তে যেত লোকজন।
জাতীয়তাবাদের শুরু উনবিংশ শতকে। যেহেতু আলোচনা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে-এশিয়ান দেশগুলি -যেমন চীন বা জাপানের সাথে ভারতে জাতিয়তাবাদের তুলনা করাটাই ঠিক ঠাক হবে। চীন এবং জাপান-দুটো ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদের উত্থানের মূল কারন কলোনিয়াল শক্তিগুলি-বিশেষত আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের কাছ থেকে স্বাধীন থাকার জন্য উন্নত মিলিটারী শক্তির প্রয়োজনিয়তা। প্রথম আফিং যুদ্ধে বৃটেনের কাছে হেরে, ন্যাংকিঙের চুক্তি সম্পাদন করা মাত্র চীনের কুইং রাজবংশ পরিস্কার বুঝতে পারে মিলিটারী উন্নত না হলে সব গেল। সুতরাং যুদ্ধাস্ত্র কিনে মিলিটারী ঊন্নত করার চেষ্টা চললো। তাতে কিস্যুই হল না- জাপান থেকে সব ইউরোপিয়ান শক্তির কাছে গোহারা হারা বন্ধ হল না।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট গুয়াংজু বুঝতে পারেন শুধু অস্ত্র দিয়ে একটা দেশ উন্নত হয় না-তার জন্যে চাই শিক্ষা, শিল্প, রাজনীতিতে আমূল আধুনিক সংস্কার-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যপক প্রয়োগ। উনি বিখ্যাত ১০০ দিনের সংস্কার শুরু করলেন চীনে-যদিও তা রাজমাতার জন্য বন্ধ হবে। কিন্ত ওই ১০০ দিনের সংস্কার চীনের আধুনিক জাতিয়তাবাদের মূল সূচক-যা সান ইয়েৎ সানের কুয়োমিংটাং পার্টির ভিত্তি। ১৯২০-৩০ সালে চতুর্থ মের জাতীয়তাবাদি আন্দোলন নামে খ্যাত এই বিদ্রোহ, চীনের জাতিয়তাবাদি আন্দোলনকে সংজ্ঞায়িত করে এই ভাবে
“”Nationalism, patriotism, progress, science, democracy, and freedom were the goals; imperialism, feudalism, warlordism, autocracy, patriarchy, and blind adherence to tradition where the enemies. Intellectuals struggled with how to be strong and modern and yet Chinese, how to preserve China as a political entity in the world of competing nations.”
জাপান কিন্তু এই ভুল করে নি। আমেরিকান নৌসেনাপতি ম্যাথ্যু পেরির গানবোটের ধাক্কায় (১৮৫৩), সম্রাট মেইজি বুঝেছিলেন জাপানের অতীতে মৌজে থাকলে জাপানও চীনের মতন বিদেশীদের গর্ভে চলে যাবে। ফলে মেইজি সংস্কারে (১৮৬৮-১৯১২)মিলিটারী সংস্কারের সাথে সাথে প্রথমেই চললো শিক্ষার সংস্কার। সবার জন্য বিনা পয়সায় আধুনিক শিক্ষা। তার জন্য ইউরোপ থেকে শিক্ষক আনো। প্রচুর প্রোপার্টি ট্যাক্স বসানো হল স্কুলের ফান্ডিং এর জন্য । জাপানের স্থানীয় জনগণ রেগে গিয়ে ২০০০ স্কুল পুড়িয়েছিল সেকালে। পরে বোঝে শিক্ষা হচ্ছে একটা জাতির আসল শক্তির উৎস।
আমি চীন এবং জাপানের জাতিয়তাবাদের ইতিহাস এই জন্য আনলাম, এটা বোঝাতে ভারতে যারা নিজেদের জাতিয়তাবাদি বলছেন- যেসব বিজেপি বা আর এস এসের লোকেরা নিজেদের জাতিয়তাবাদি বলে দাবি করেন-আমি তাদের জাতিয়তাবাদি শক্তি বলে মানতে নারাজ। বিজেপি আদৌ কোন জাতিয়তাবাদি পার্টিই না-শ্রেফ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা দিয়ে কোন জাতিয়তাবাদি পার্টি হয় না। কারন পৃথিবীতে চীন, জাপান বা জার্মানির জাতিয়তাবাদের ইতিহাসে দেখা যাবে জাতিয়তাবাদের পাঁচটি স্তম্ভ
(১) প্রথম স্তম্ভ- শিক্ষা । জাপান, চীন সর্বত্র প্রথমে বিনা পয়সায় সার্বজনীন শিক্ষার ওপরে জোর দেওয়া হয়েছিল। বিজেপি পুরো উলটো রথে। শিক্ষার প্রাইভেটাইজেশন করতেই ব্যস্ত। সার্বজনীন শিক্ষার পেছনে টাকা খরচ করবে না। শিক্ষা খাতে বাজেট কমাচ্ছে। অথচ মেইজি সংস্কারে শিক্ষার পেছনে টাকা ঢালার জন্য এত ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছিল জনগণ রেগে গিয়ে স্কুল পুড়িয়ে দিয়েছিল। সার্বজনীন সরকারি শিক্ষার প্রতি বিজেপির নেতিবাচক মনোভাব- প্রথম প্রমান-এরা জাতিয়তাবাদ কিস্যুই বোঝে না।
(২) দ্বিতীয় হচ্ছে-ম্যানুফ্যাকচারিং এবং শিল্পে স্বয়ং সম্পূর্নতা। এই ব্যপারে মোদির ঘোষিত নীতি হচ্ছে মেইড ইন ইন্ডিয়া। এটা পাতি স্লোগান। ম্যানুফ্যাকচারিং এর জন্য যা ইনফ্রাস্টাকচর এবং ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্রেইন্ডলি আইন দরকার-তা এখনো ভারতে নেই-চারি দিকে লাল ফিঁতের ফাঁস। কংগ্রেস আমল থেকে কোন পরিবর্তন হয় নি। হবেও না । কারন লাল ফিতেই দিল্লীর দালালদের ইনকামের উৎস। বিজেপি এই মৌতাত ভাংবে না। কারন ইহাই সকল রাজনৈতিক নেতাদের ইনকামের ইৎস।
(৩) মহিলা শক্তির উত্থান – মেইজি সংস্কার এবং চীন-সবর্ত্রই জাতিয়তাবাদের একটা গুরুত্বপূর্ন দিক ছিল -নারীশিক্ষা। কারন মা শিক্ষিত না হলে, ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত হবে না। পৃথিবীতে সব থেকে বেশী নিরক্ষর ভারতে। নিরক্ষরতা দুরীকরন অভিযানে বিজেপিকে কখনোত দেখিনি। মেয়েদের বাইরের কাজে, আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে উৎসাহিত করতেও দেখিনি-বরং এই ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদির পার্টিগুলোর ভূমিকা মেয়েদের ঘরে ঢোকানোতেই উৎসাহিত করেছে বেশী।
(৪) নিজেদের সংস্কারের ভাল জিনিসগুলি রেখে বাজে জিনিসগুলি বর্জন-পাশ্চাত্য সভ্যতার ভালগুনগুলি অর্জন। এইব্যপারে ল্যান্ডমার্ক কাজ করেছিলেন জাপানী বুদ্ধিজীবি ইকুচি ফুকুজুয়া (১৮৮৮)। উনি ঘোষনা করলে, জাপানকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমেরিকা আর ইউরোপের দিকে তাকাতে হবে-চীন আর কোরিয়ারদিকে তাকিয়ে থাকলে জাপান ও তাদের মতন স্বাধীনতা হারাবে। কোন জাতিয়তাবাদ বলে না নিজের সংস্কার বা নিজের অতীতে আঁকড়ে থেকে আরো পিছিয়ে যাও। ভারতে জাতীয়তাবাদের নামে যা চলছে-তা হচ্ছে ভারতের অতীতের সব কিছু মহান এবং ভাল ছিল। পাশ্চাত্যের সব কিছু খারাপ। চীন বা জাপানের জাতিয়তাবাদি ইতিহাস পুরো উলটো। চীন এবং জাপানের জাতিয়তাবাদি নেতারা স্বীকার করে নিয়েছিলেন-তাদের অতীত তাদের বাঁচাবে না। জাতির স্বার্থে হাজার হাজার বছরের পুরাতন সংস্কার ছাড়তে হবে। এইভাবেই মেইজি সংস্কারে সামুরাই প্রথার মতন ঐতিহ্যকে বাতিল করা হয়।
এর মূল কারন চীন এবং জাপানের তাগিদ ছিল ইউরোপের হাত থেকে বাঁচার। ভারত বৃটেনের কল্যানে একটা আধুনিক ইউরোপিয়ান ইনফ্রাস্ত্রাকচার পেয়েছে-ফলে রক্ষনশীলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জাতিয়তাবাদের মাধ্যমে ইউরোপিয়ান এনলাইট্মেন্ট ভারতে আসে নি-এসেছে কলোনিয়ালিজমের মাধ্যমে।
ইতিহাসের এই টুইস্টটা ভারতের জাতীয়তাবাদের সব থেকে বেশী ক্ষতি করেছে-ভারতের জাতিয়তাবাদ মানে পাশ্চাত্যের এনলাইট্মেন্ট বর্জন। সব এনলাইট্মেন্টের অধিকারি ভারতীয় দর্শন! এই ধরনের মনোভাব রক্ষনশীল চিন্তা-এবং তা কোন ভাবেই জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায়িত হতে পারে না।
(৫) বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং যুক্তিবাদের দিকে অগ্রসর- ইউরোপ, চীন এবং জাপানের জাতিয়তাবাদে ধর্ম কোন ভূমিকা রাখে নি- বরং সব রাষ্ট্রই নিজেদের শক্তিশালি করার জন্য বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির পেছনে প্রচুর টাক্স মানি ঢেলেছে। ভারতে বিজেপি বিজ্ঞান বলতে বোঝে সব ব্যাদে আছে-সব প্রাচীন ভারতে ছিল। বিজেপির আমলে ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেস তামাসাতে পরিনত -এটা নোবেল বিজয়ী ভারতীয় বিজ্ঞানী ভেঙ্কটরামন রামাকৃষ্ণানের কথা। হিন্দু কুসংস্কার নিয়ে মাতামাতি করে জাতিয়তাবাদ হয় না। সম্ভব না।
সুতরাং আমি যদি পৃথিবীর জাতিয়তাবাদের ইতিহাস ঠিক ঠাক পড়ে থাকি, বিজেপি বা আর এস এসকে জাতিয়তাবাদি শক্তি মানতে নারাজ।
পাশাপাশি জেন এন ইউ ইস্যুতে বামেরা যে ভাষায় জাতিয়তাবাদের গালাগাল করেছে, সেটাও তাদের এস ইউজ্যুয়াল অজ্ঞানতার পরিচয়। ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদি শক্তি বোমা ফাটানো শুরু করলে-যেটা সবার প্রথমে হবে- বিদেশী কোম্পানীগুলো তাদের ব্যাক ওফিস ভারত থেকে তুলে নেবে। সুতরাং এখন যেমন ফেবুকের বাম পুঙ্গবরা আমেরিকান কোম্পানীর পা চেটে গরম গরম লিখে চলেছেন-তখন মারোয়াড়ি কোম্পানীর হয়ে কাজ করলে-লেখার সময় পাবেন ত?
জাতিয়তাবাদ অর্থনৈতিক যুক্তির বিচারে থাকার কথা না। কারন দেশের বর্ডার মার্কেট ছোট করে। কিন্ত তবুও বিজ্ঞানীরা বলছেন জাতীয়তাবাদের জনপ্রিয়তার মূল কারন- সিকিউরিটি এবং স্ট্যাবিলিটি। নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীল সমাজের দরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই।
বিজেপি জাতিয়তাবাদি শক্তি না-এটি একটি সামন্ততান্ত্রিক ঘোঁটেল-যার উৎস ভারতের অন্য পার্টিগুলির ইসলামিক মৌলবাদের তোষন। ইসলামিক মৌলবাদ ভারতের জন্য, হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য খুব ভয়ঙ্কর-এটা ঐতিহাসিক ভাবেই প্রমানিত। চীন এবং জাপানের জাতিয়তাবাদের উৎস ছিল বৃটেন এবং আমেরিকার কাছে স্বাধীনতা হারানোর ভয়। হিন্দু জাতিয়তাবাদের উৎস মুসলমানদের হাতে মার খেয়ে জমি সম্পতি হারানোর ভয়। জাপান পাশ্চাত্য শক্তির হাতে জমি হারানোর ভয়ে, পাশ্চাত্যের পূজারি হয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদিরাও মুসলমানদের হাতে জমি হারানোর ভয়ে মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদি আন্দোলনে কোন পাশ্চাত্য এনলাইট্মেন্ট নেই-আছে ইসলামের বর্বরতার ধর্মীয় অন্ধ অনুকরন। কিন্ত এর জন্যেও ভারতের সোকল্ড সেকুলার রাজনীতিই দায়ী। যা ইসলামিক মৌলবাদকে আস্কারা দিয়েছে প্রথম থেকেই।
ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে, হিন্দু মৌলবাদিদের আটকানো যাবে না।
An excellent write-up, truly well-thought, well-reasoned and well-worded.