পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, পর্ব-৬, পর্ব-৭, পর্ব-৮, আগের পর্ব

পর্ব-১০

সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম প্রচেষ্টা: একটি অভিজ্ঞতা

১৯৪৫ সালের ১৫ই আগষ্ট যখন দেশ জাপানী দখলদার মুক্ত কেবল হয়েছে, আমি তখন কোচাং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ গ্রডের ছাত্র। গরমের ছুটির পরে আমরা যখন সেপ্টেম্বরের কোন এক প্রত্যুষে স্কুলে আবার ফিরছি, আমাদের জাপানী অধ্যক্ষ তখন স্কুলের ঘন্টা বাজাচ্ছিলেন! বরাবরের মতোই এরকম অবস্থায় যে যাই করি না কেনো সব ফেলে রেখে সমবেত হই এবং সারি বদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে যাই বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় চত্বরে। কিন্তু অধ্যক্ষ মহোদয় সেদিন আমাদের সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াতে হবেনা বলে জানালেন। আমরা তাঁর চারদিক ঘিড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। এই সময় তিনি কিছু বলার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমরা লক্ষ্য করলাম তাঁর গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে! বললেন, “যুদ্ধ শেষ, আমাকে জাপানে ফিরে যেতে হবে। আমি জাপানী এবং বালকেরা, তোমরা কোরিয়ান।“ তাঁর গলার স্বর ক্রমশ ক্ষীণ হলো। “এখন থেকে মাঠে তোমাদের আর কোন শ্রম ঐ হাতে তোমাদের দিতে হবে না,“ তিনি তাঁর পাশে দাঁড়ানো ছেলেদের ঘাড়ে হাত রাখলেন এবং বললেন, “সাইয়োনারা, মিনাসাং” (বিদায় সবাইকে; Goodbye, Everyone)। আমরা কোনদিন আগে তাঁর এই পরম সুন্দর মানবিক দিকটি দেখিনি। সব সময় আমাদের কাছে তিনি ছিলেন এক সরু গোঁফ-ওয়ালা কঠোর এবং ভীষন দর্শন মানুষ।

প্রত্যেক গ্রেডেই তখন তাঁর চারটে করে ক্লাশ ছিলো। দুটি থাকতো মেয়েদের ক্লাশে আর দুটি থাকতো ছেলেদের ক্লাশে, আর প্রত্যেক ক্লাশে ছাত্র/ছাত্রী সংখ্যা ছিলো প্রায় ষাট জন। আমাদের অবশ্য কোরিয়ান শিক্ষকও ছিলো এবং বিদ্যালয়গুলো প্রায়ই নতুন নতুন কোরিয়ান শিক্ষক বৃন্দকে নিয়োগ দিতেন যখন জাপানী শিক্ষকেরা চলে যেতেন একটা নির্দ্দিষ্ট মেয়াদের পরে। আগের দিন গুলোতে শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো বছরের ১লা এপ্রিল থেকে আর শেষ হতো পরের বছরের ২৫শে মার্চ। যাই হোক ১৯৪৫ এর হেমন্তে কোরিয়ান প্রশাসন নতুন করে সিদ্ধান্ত নিলো, আর তাতে ঘোষিত হলো যে এখন থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু হবে বছরের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে আর আর শেষ হবে পরের বছরের ২৫শে জুলাই। সেসময় আমরা বলাবলি করতাম যে এই পরিবর্তনের ফলে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে ছেলে-মেয়েরা ভর্তির আগে প্রয়োজনীয় কোরিয়ান ভাষাটা শিখে নেবার জন্যে যথেষ্ট ফুরসত পাবে। কারন, জাপানের অধীনে থাকা-কালীন এবং যুদ্ধ-কালীন সময়ে কোন কোরিয়ান শেখানো হতো না। সেইহেতু, আমাদের সবাইকেই আসলে ভাষাটা শুরু থেকেই শুরু করতে হতো। আসলে সেই সময় গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-৬ পর্যন্ত একই কোরিয়ান ভাষা সংক্রান্ত বই পড়ানো হতো। যেহেতু বাসায় সে সময় আমরা কোরিয়ান ভাষাই ব্যবহার করতাম তাই এই পড়াশুনাটা মূলতঃ ছিলো কোরিয়ান ভাষাটা লিখতে ও পড়তে পাড়ার জন্যে। আমরা বরাবরই আমাদের নিজেদের ভাষা-শিক্ষার এই পাঠ্যক্রমটিকে আনন্দের সাথে নিতাম। বিশেষ করে কি করে কোরিয়ান ভাষায় নিজেদের নামটি আমরা লিখতে পারি, বিষয়টা ছিলো সত্যিই আনন্দের ও গর্বের। তবে এই ভাষা শিক্ষার কার্যক্রমটি পুরোটাই ছিলো খুবই ভালো এবং সফল।

১৯৪৬ সালের বসন্তে আমি সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে আবেদন করেছিলাম। সেসময় জুলাইয়ের মধ্যভাগে সিনজুতে অনুষ্ঠিতব্য ভর্তি-পরীক্ষার জন্যে আমাকে প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছিলো। অথচ সে সময়টিতে গোটা দক্ষিণের প্রদেশে ভয়ানক ভাবে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, মৃত্যুবরণ করে অগণিত অসংখ্য মানুষ। বলা হতে লাগলো যে এই রোগটি সেই সব ফিরে আসা কোরিয়ান শ্রমিকদের মাধ্যমে সাড়া দেশে ছড়িয়ে পড়ছে যারা জাপানী মিলিটারী-শ্রমিক হিসেবে বাধ্যতামূলক ভাবে পূর্ব-এশীয় দেশ গুলোতে কর্মে নিয়োজিত ছিলো। রোগটির উপর্যুপরি বিস্তার রোধে আঞ্চলিক সরকার তখন কোচাং সহ উপদ্রুত এলাকা গুলোকে সমগ্র দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে ডিক্রি জারি করলেন। আমার মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবার উপক্রম হলো যেহেতু আমার পক্ষে সে সময় কোন অবস্থাতেই সিনজু ভ্রমণ করা অসম্ভব হয়ে উঠলো। শুধু তাই নয়, এমনকি শুধু মাত্র এই শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, ‘কোচাং কৃষি মাধ্যমিক বিদ্যালয়’-এ (Kochang Agricultural Middle School) ভর্তির জন্যে অনেকটা দেরিও হয়ে গেলো। ঐ বিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তার কাছে বাবার অনুরোধ এবং আমার ৬ষ্ঠ গ্রেডের একজন শিক্ষকের নিরন্তর চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত আমি আমার ভর্তির আবেদন পত্রটি জমা দিতে পেরেছিলাম এবং তা গৃহীতও হয়েছিলো। পরীক্ষার দিনে দু’জন ছাত্র বসতে পারে এমন একটি বেঞ্চের এক কোনে আমার আসন নির্ধারিত হয়েছিলো। আমার সাথে যে ছেলেটি বসেছিলো সে আমার স্বল্প পরিচিত আমাদের প্রাথমিক স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র এবং আমার দুই বছর আগেই পাশ করে বেড়িয়েছিল। তাদের পারিবারিক কাপড়ের বড় একটা ব্যবসা ছিলো এবং সেই সুবাদে তার বাবা আমাদের এলাকায় অতি পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। সে আমার বড় ভাই এর সহপাঠী ছিলো এবং আমি জানতাম যে সে এর আগেও দুইবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলো। আমি ভেবেছিলাম যে পরীক্ষাটি খুব একটা কঠিন হবে না এবং তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যাবে। পরিদর্শক বলেছিলেন যে পরীক্ষা শেষ হলে আমরা খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি। আমি যখন বেরিয়ে যাই, আমার পাশে বসা ছেলেটি তখনো লিখছিলো তার খাতায়। পরের দিন আমার ৬ষ্ঠ গ্রেডের শিক্ষক মহোদয় কর্মস্থলে আমার বাবার সাথে যোগাযোগ করে ভীষন অসন্তুষ্টিতে খবর দেন যে ঐ পরীক্ষায় আমি অকৃতকার্য হয়েছি। সেই দিন গুলোতে স্বাভাবিক নিয়মেই আশঙ্কা থেকে ৬ষ্ঠ গ্রেডের শিক্ষকেরা স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত সময়ের আগেই ফলাফল সম্পর্কে জানতে পারতেন। এই খবরটি আমার কাছে এক ভয়াবহ রকমের আঘাত ছিলো। বিশেষ করে যেখানে আমার কাছে পরীক্ষাটি অপেক্ষাকৃত সহজ ছিলো এবং আমি ভালোই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমার বাবার পরিচিত কয়েকজন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি তাদের সাথে দেখা করে পরীক্ষার ফলাফলের বিস্তারিত জানতে চাইলেন। তুলনামূলক যাচাইয়ের জন্যে তাঁরা আমার হাতের লেখার বিস্তারিত চাইলেন, যেহেতু পরিদর্শকের মন্তব্যে আমার পাশে বসা ছেলেটি সম্পর্কে কিছু অস্বাভাবিক আচড়নের বিষয়ে উল্লেখ আছে। কর্তৃপক্ষের আভ্যন্তরীন তদন্তের পরে তারা সিদ্ধান্তে এলেন যে ঐ ছেলেটি আমার খাতার সাথে তার খাতা অদল-বদল করেছে এবং খুব ভালো নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে! যাই হোক যেহেতু পরিদর্শকের কোন প্রশ্নাতীত পর্যবেক্ষন ও প্রমাণ ছিলোনা এ বিষয়ে, তাই কর্তৃপক্ষ সে’বার আমাদের দুজনের কাউকেই ভর্তির সুযোগ দিলোনা।

হেমন্তের ঠাণ্ডা আমেজ শুরু হবার সাথে সাথে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া কলেরার প্রকোপও কমতে শুরু করেছে। এ সময় ধীরে ধীরে আমরাও স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরতে শুরু করেছি এবং ভ্রমণ-যাতায়াতও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার স্বপ্নের সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পড়ার অভিপ্রায়ে তখনো একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। আমার শিক্ষক, অভিভাবক ও আমার নিজেরও কিছু করার সেখানে ছিলো না। বাবা-মা মনে করছিলেন যে আমার পরবর্তী বছরে পুনরায় ভর্তি-পরীক্ষার জন্যে অপেক্ষা এবং প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। সুতরাং সে-জন্যে আমার পুরো একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে! তখন আমাদের বাড়িতে জমি-জমার প্রাণান্তকর শ্রমসাধ্য কাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য গৃহস্থালী কাজে সাহায্যকারী হিসেবে ছেলে-ছোকরাদের দরকার লেগেই ছিলো। সাধারণতঃ তখন শীতের শেষে এবং বসন্তের শুরুতে প্রায়ই আমাদের রান্না ও ঘর গরমের জন্যে জ্বালানি কাঠের স্বল্পতা দেখা দিত। সেই শীতটা ছিলো অস্বাভাবিক রকমের ঠাণ্ডা, রান্না ও ঘর গরমের জন্যে আমাদের স্বভাবতই অতিরিক্ত জ্বালানি কাঠ ও পাইনের শ্বাস-মূল দরকার হতো। সুতরাং আমি মা-কে বললাম যে, আমাকে যেনো তিনি পাইনের শ্বাস-মূল সংগ্রহে পাহাড়ে যাবার অনুমতি দেন। যদিও তিনি জানতেন যে ১২ বছরের একটা ছেলেকে পাহাড়ে জ্বালানির সন্ধানে পাঠানোটা অত্যন্ত বিপদজনক তবুও ভাবলেন যে আমার সে ছোট্ট প্রয়াস পরিবারটিকে শীতে ও বসন্তের শুরুতে বয়ে যাওয়া শৈত্য প্রবাহের নিদারুণ যন্ত্রনা থেকে কিছুটা হলেও হয়তো স্বস্তি দেবে। সে যাত্রায় আমাকে একটা এ-ফ্রেম পিঠে, সাথে র‍্যাক ও একটা কুড়াল বহন করে কয়েক মাইল পথ পাহাড়ে অতিক্রম করে যেতে হয়েছিলো। সারাদিনের জন্যে বাইরে কাটাবার প্রস্তুতি নিয়ে অনেক ভোরে আমাকে বেরোতে হয়েছিলো। সে সময় সাধারণতঃ পথে আমি উঠতি বয়েসের আরোও অনেককেই পেয়ে যেতাম আমার সহযাত্রী হিসেবে যারা একই উদ্দেশ্যে পাহাড়ে যেতো, আমি যুক্ত হতাম তাদের দলে। পাইনের শ্বাস-মূল ঐ সময়টাতে হতো প্রায় দুস্প্রাপ্য কারণ জ্বালানির জন্যে এর চাহিদা ছিলো অনেক এবং তন্ন তন্ন করে খুঁজে নিয়ে যেতো একে সবাই। আমি তাই প্রায়ই যথেষ্ট পরিমানে পাইনের শ্বাস-মূল সংগ্রহে একেবারে পাহাড়ের অনেক উপরের গভীরে চলে যেতাম সে স্থান গুলো খুঁজে পেতে যেখানে যথেষ্ট পরিমানে এর সংগ্রহ বিদ্যমান থাকে। চার ফুট উঁচু, তিন ফুট প্রস্থ ও দুই ফুট পুরু আকারের একটা পাইনের শ্বাস-মূলের চৌকো-বান্ডিল বাঁধতে বিশেষ এক ধরনের পারদর্শিতার দরকার হয়। কারন সেটা যেনো সহজেই আমার এ-ফ্রেমে বহন যোগ্য হয়। যেহেতু পাইনের শ্বাস-মূল গুলো তখনো কাঁচা, তাই ঐ চৌকো বান্ডিলটা হতো যথেষ্ট ভারী। আর তাই সেই ভারী শ্বাস-মূলের বান্ডিলটা প্রথমে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামিয়ে আনা এবং পরে সমতলের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ব’য়ে আনা আমার জন্যে সত্যিই অত্যন্ত শ্রমসাধ্য একটা ব্যাপার তখন ছিলো। বসন্তের স্বাভাবিক উষ্ণতা না আসা অবধি সপ্তাহে দু’বার করে আমাকে পাহাড়ে যেতে হতো এই কাজটির জন্যে। আমার মা প্রায়ই প্রশংসা করে ১৯৪৬-৪৭ সালের কনকনে শীতের দিনগুলোতে আমার এই শ্রমসাধ্য কাজের কথা বলতেন।