পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, পর্ব-৬, পর্ব-৭, আগের পর্ব,
পর্ব-৯ (ভাষান্তরিত)
প্রথম অধ্যায়
সামরিক আগ্রাসনের প্রথম মাস: কোচাং (Kochang) এবং সিনজু (Chinju)
মা’য়ের কথা …
শৈশব থেকে আমরা যখন বেড়ে উঠছিলাম ভাবতাম সংসারে বড় সন্তান হিসেবে জন্ম গ্রহন যেনো একটি বিশাল সৌভাগ্যের বিষয়! কিন্তু পরে অনুভব করেছিলাম যে আমার বাবা-মা কে সেই জন্যে সংসারের কতো কষ্টসাধ্য বিষয় গুলো সারা জীবন ধরে সমাধান করে আসতে হয়েছে!ধন্যা দিতে দিতেই এক সময় বাবা তৎকালীন প্রাদেশিক রাজার সক্ষাৎ পেলেন যা ছিলো বিষ্ময়কর! সম্ভবতঃ রাজা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এই জন্যে যে, কোচাং এর এই মানুষটি শুধু আন্তঃ প্রাদেশীক রাষ্ট্রীয় পরীক্ষাতে একজন মেধাবী হিসেবেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ত্ব প্রমান করেন নি বরং এসেছেন এক অতি সম্মানীত সম্ভ্রান্ত পরিবারের (ইয়াংবান (Yangban), বা উচ্চশ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা বা বিশেষজ্ঞ) সরাসরি উত্তরসূরী হিসেবে যে পরিবার বংশপরম্পরায় দিয়েছিলো ওয়াই রাজপরিবারে পূর্বতন রাজার দু’জন সম্ভ্রান্ত রাণী অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা এমনকি একজন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত! বাবা কাজে ঢুকলেন। তখন থেকেই আমার বাবাকে আঞ্চলিক সরকারী এক অফিসে অতি সাধারন এক চাকুরী করতে হয়েছে এবং মা সারা জীবন আমাদের সংসার সামলিয়েছেন বাবার ঐ স্বল্প উপার্যন দিয়েই। যদিও অর্থনৈতিক ভাবে আমরা মোটেও স্বচ্ছল ছিলাম না, তবে পারিবারিক ভাবে আমরা সুখীই ছিলাম বিশেষ করে আমার মায়ের সাংসারিক অবদানেই। চন্দ্রবছরের পঞ্জিকা মতে যখন নববর্ষ আসতো তখন আমাদের সব আত্মীয় স্বজনেরা আমাদের বাড়ি আসতেন এবং পরষ্পরের সাথে সৌহার্দ্য বিনিময় করতেন। আমার মা-বাবা এবং ঠাকুরমা সাধারনতঃ আগত স্বজনদের অভ্যর্থনা জানাতেন এবং প্রচলিত রীতি অনুযায়ী নববর্ষের আপ্যায়ন করাতেন। তখন প্রচুর মজাদার খাবার দাবার থাকতো বিশেষ করে চালের পিঠা। বয়োজ্যোষ্ঠ আত্মীয়রা এলে তাঁদের প্রথানুসারে শুভেচ্ছা জানালে মাঝে মাঝে তারা মুদ্রা উপহার দিতেন। নববর্ষের দিন গুলো আমার খুব ভালো লাগতো তবে আমি অনুভব করতাম যে তখন এতো এতো আত্মীয় স্বজনকে আপ্যায়নে দীর্ঘ কয়েকটা দিন ধরে রাত-দিন আমার মা-কে সুস্বাদু খাবার রান্না করতে হতো। স্বল্পতম আয়ের সংসারে কায়িক শ্রম ছাড়াও বিষয় গুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনায় তাঁকে হিমসিম খেতে হতো। কিন্তু এতো কষ্টের মাঝেও তিনি হাসিমুখে তা করেছেন অবলীলায়; একটা চৌকোনা টেবিলে অতিথিদের জন্যে সাজিয়েছেন সবচেয়ে উপভোগ্য খাবার গুলো। কিছু কিছু অতিথি আমার মায়ের হাসিমুখের এ আপ্যায়নটুকুর আস্বাদের জন্যেই কেবল তখন আসতেন। তাঁরা দেখতেন তাঁর সুখী ও পরম বন্ধুপরায়ন যত্নে লালিত মুখ এবং সবচেয়ে বেশী যা ছিলো তা হলো তাঁর লক্ষ্মীভাব এবং কমনীয় মন।
আমার ঠাকুরমা প্রায়ই অতিথিদের সন্তুষ্টি দেখতেন এবং মা-কে প্রশংসা করে ধন্যবাদ জানাতেন তার এতো এতো পরিশ্রমের জন্যে। এরকম কঠিন শ্রমে নিষ্ঠায় এবং আনুগত্যে আমার মা জয় করে নিয়েছিলেন তাঁর শাশুরীর হৃদয়। তারপরেও যে সংসারে অপ্রীতিকর সম্পর্ক কারো কারো সাথে গড়ে উঠতোনা তা নয়। মা সব সময় তার শাশুরীর সাথে একটা নৈকট্য এবং মধুর সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি সব সময় তাঁর বাধ্য ছিলেন এবং অত্যন্ত সম্মান করতেন এমনভাবে যে, আমার ঠাকুরমা যেনো তাঁর জন্মদাত্রী মা। তিনি এমন ভাবে গুছিয়ে কাজ করতেন এবং ঠাকুরমার সেবা করতেন যে দেখে মনে হতো তিনি তাঁর অত্যন্ত ভালো যোগ্যা বৌ-মা। আমার ঠাকুরমা অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন যখন মা তাঁর প্রথম পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন, যেনো এটিই আমার ঠাকুরমার কাছে একমাত্র এবং অতি প্রত্যাশিত একটি চাওয়া ছিলো মা’য়ের কাছে। বিয়ের পর পরই আমার মা তাঁর শাশুরীর কাছে একজন বিশ্বস্ত এবং আদরের বৌ-মা হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন।
জাপানী অধিকৃত নতুন দেশ, কোরিয়া প্রজাতন্ত্রে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে যুদ্ধকালীন বছরের টালমাটাল দিন গুলোর শুরুতে আমার মা-ই ছিলেন ঐক্য ধরে রেখে পরিবারটিকে অটুট রাখার একমাত্র বিশেষ শক্তি। প্রকৃতপক্ষে সেসময়ে আমাদের পরিবারটি যথেষ্ট ভালো ভাবেই টিকে ছিলো। এরকম এক বিপদ জনক সময়ে আমাদের পরিবারটি সব রকমের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই তার স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছিলো, এবং আমি বিশ্বাস করি যে এটা সম্পূর্নই সম্ভব হয়েছিলো আমার মা’য়ের অক্লান্ত শ্রম-মেধার সম্মিলিত প্রয়াসে যা আমাদের ভালো ভাবেই দিনগুলো অতিক্রমে এবং আজকের আবস্থানে টেনে আনতে ভূমিকা রেখেছিলো। তিনি সব সময়েই আমাদের পর্যাপ্ত যত্ন নিতেন এবং এতো এতো হতাশার মাঝেও উৎসাহ দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকার আর বেড়ে উঠার প্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন। যেখানে আমরা পেয়েছিলাম এক ছিম-ছাম যত্নের পারিবারিক সুষ্ঠ পরিবেশ। যে পরিবারে অপর্যাপ্ত খাবার আর পয়সা-কড়ির নিত্য টানাপড়েন ছিলো, সেটিকেই তিনি ঐ দুঃসময়ে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়। আমি সব সময়েই ভাবতাম যে আমার মায়ের বোধ হয় এক আশচর্য-অলৌকিক ক্ষমতা আছে আমাদের মুখের নিশ্চিন্ত গ্রাস-আচ্ছাদনের ব্যবস্থপনায় অভাবের ঐ নাই নাই দিন গুলোতেও! আমাদের গোলাকার খাবারের টেবিলটাতে গরম সদ্য রান্না ভাতের পর্যাপ্ত যোগান থাকতো। থাকতো মাছ ও সব্জির ঋতু অনুযায়ী পছন্দের খাবার গুলোর সমাবেশ। মা সাধারনতঃ রোববারের রাতের খাবারে গরু, শুকর কিংবা মুরগীর তরকারীর যোগান রাখতেন। আর এই জন্যে সাপ্তাহিক খোলাবাজারের সস্তা পণ্যগুলো জোগার করে আনতেন। বাড়ির সামনের উঠোনে ছিলো আমাদের এক ছোট্ট সব্জি বাগান। সেখানে প্রায়ই আমি মা-কে সাহায্য করতাম বীজ বুনতে, বাগান করার সময়গুলোতে মা সেখানে কাজ করতেন যা আমাদের সেই দুঃসময়ের পারিবারিক খাদ্য চাহিদা পুরণে গুরুত্বপূর্ন ছিলো। পর্যাপ্ত সব্জির চাহিদা মেটাতো মা-য়ের সেই বাগান।
যখন শীতের ঠান্ডায় গোটা দেশ জুবুথুবু, মা জেগে থাকতেন গভীর রাত অবধি। নিশ্চিত হতেন বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে স্বস্তিতে কিংবা প্রথাগত প্রকৃয়ায় ঘড়ের মেঝে রয়েছে কিনা স্বাভাবিক ভাবে উষ্ণ! রাতের রান্না যখন শেষ হতো, তার পরেও কিছুটা সময় তিনি জ্বলতে দিতেন উনুন, যাতে ঘর গুলো থাকে স্বাভাবিক রকমে উষ্ণ যতোটা সম্ভব। মেঝের উষ্ণতা বজায় থাকলেও ঘরের দরজা গুলোতে থাকতো এক সারি পাতলা কাঠের খোপওয়ালা কাঠামো! এর উপড়ে লেপটে দেওয়া থাকতো মোটা কাগজ, যা ভেদ করে ঢুকতো কনকনে ঠান্ডা স্পর্শ। মা সব সময়ই মেঝেতে ঐ দরজার পাশেই ঘুমোতেন; যাতে হীম শীতল ঠান্ডা স্পর্শ তাঁর সন্তানদের নিঃশ্বাসে না পৌঁছোয়। আমি প্রায়ই তার গায়ের উপড়ে থাকা ইবুল (কম্বল বিশেষ) খানা টেনে নিতাম যখন মধ্যরাতে জেগে উঠতাম বাথরুমে যাবার তাড়নায়!
একবার আমার বাবা আমাকে চুপি চুপি বলেছিলেন, ”আমি জানিনা তোমার মা কেমন করে সব সামলান…! আমি নিশ্চিত যে সে হাল না ধরলে এ সংসার কবেই ভেসে যেতো…!” কোনদিন মা-কে শুনিনি তিনি অভিযোগ কিংবা অনুযোগ করছেন অপর্যাপ্ত খাবারের কিংবা অতিরিক্ত কায়িক শ্রমে তাঁর বেহাল দশায়। সেই কোন সকালে ঘুম থেকে উঠে মধ্যরাত অবধি টেনে চলেছেন তার উপড়ে চাপিয়ে দেয়া এক প্রায় নিশ্চল সংসারের বোঝা। সারাটা দিন ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে সামলে নিচ্ছেন চারপাশে ঘটে যাওয়া যাবতীয় বিষয়। মাঝে মাঝে তিনি বলতেন, “বিশাল এবং উঁচু একটা গাছের এক বিন্দুও কি ফুরসৎ থাকে যখন স্বাভাবিক বাতাসেই তার ডাল-পালা গুলো অনবরত অস্থির হয়ে উঠে?” এভাবেই তিনি তাঁর জীবনকে মাঝে মাঝে শিল্গের মতো করে প্রকাশ করতেন! অথচ সেই শিল্পের শিল্পী ছিলেন তিনি নিজেই! বিশেষ করে একান্নবর্তী সংসারে প্রায় ১২টি উঠতি ছেলে-মেয়ের কাছে তিনি এভাবেই উৎসাহ হয়ে নিজের শিল্পীত জীবনের আলেখ্য তুলে ধরতেন। বাবা সব সময়ই বিশ্বাস করতেন যে তিনি এক বিদূষী ও নম্র মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁরা উভয়েই অনুভব করতেন যে দু’টি ভিন্নমতের ভেতর থেকেই উন্মুক্ত যাপিত জীবনের নানা বিশৃঙ্খলার উত্তম সমাধানই কেবল উপযাত হতে পারে, সৃষ্টি হতে পারে সন্তান-সন্ততিদের জন্যে সুষ্ঠভাবে বেড়ে উঠার নির্ভরযোগ্য নিয়ামক। মা বাবাকে সাহায্য করতেন সংসারের সব ধরনের গুরুত্ত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গুলো নিতে। কিন্তু বাবা জানতেন যে মা কি প্রত্যাশা করেন। নির্ভর করতেন তাঁর ইচ্ছা গুলোতে, ভরসা করতেন তাঁর মতামতে; যেহেতু তিনি জানতেন মা অনেক বোঝেন এবং তাঁর একটি অগ্রযাত্রার লক্ষ্য ছিলো।
আমার অভিভাবক, বিশেষ করে আমার বাবা; অবশ্য বাবা-মা দু’জনেই মনে করতেন যে কঠোর নিয়মানুবর্তীতা উঠতি ছেলে-মেয়েদের গড়ে উঠার জন্যে গুরুত্ত্বপূর্ন। আমি এমন একটি পরিবারে বড় হয়ে উঠেছি, যেখানে ছেলে-মেয়েরা তাদের বাবা-মা কে কোন রকম কোন প্রশ্ন ছাড়াই মেনে চলতো, এমনকি ঠিক ততটুকুই অনুসরন করতো যেটুকু বলা হতো। এটা অবশ্যই অনুমেয় যে বাচ্চাদের সবসময়ই তাদের বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিৎ। মা-বাবা সব সময়ই বলতেন, সততা, বাধ্যতা ও শ্রদ্ধা পিতা-মাতা তো বটেই এমনকি এলাকার বয়স্ক এবং অন্যান্যদের প্রতিও সাধারন ভাবে প্রদর্শনটা সবচাইতে মূল্যবান এবং অবশ্য কর্তব্য হিসেবে পালনীয়। এব্যাপারে তাঁদের আমাদের প্রতি অনুপ্রেরণার কোন কমতি ছিলোনা কখনো। বাড়িতে বাবার নিরঙ্কুষ আধিপত্য ছিলো বটে তবে তিনি কখনোই আমাদের কোন বিষয়ে তেমন কোন আদেশ নির্দেশ দিতেন না। যা আবার মা এবং বাবা দু’জনেই সঠিক হচ্ছেনা বলে মনে করতেন! তাঁরা তাদের নিজেদের স্বার্থে নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যৎ কল্যানের কথা ভেবেই তাঁদের ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণ সংস্থায় এবং ভালো শিক্ষায়তনে পাঠিয়েছিলেন। এবং যত্ন নিয়েছিলেন প্রত্যেকের, সর্ব্বোচ্চ যতোটা তাঁদের সাধ্যকে একেবারেই অতিক্রম করে না যায়। বিপরীতে আমরাও বয়সানুপাতে তাঁদের প্রতি রেখেছি অসীম শ্রদ্ধা, বাধ্য থেকেছি, পালন করেছি প্রতিটা নির্দেশ ও আদেশ শ্রদ্ধায়-নমনীয়তায়।
ছোটবেলা থেকেই আমি মা’য়ের খুব ভক্ত ছিলাম। বাড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে বসত ঘর থেকে আলাদা ছিলো আমাদের রান্না ঘর। আমি মাঝে মাঝে মা’কে এই রান্না ঘরে সাহায্য করতাম। বাড়ির কাছের নদীতে যখন মা কাপড় ধু’তে যেতেন আমি যেতাম তাঁর পেছন পেছন। আমার মনে পড়ে, শীতের দিনগুলোতে জমে যাওয়া নদীর বুকে কি করে মা বরফ ভেঙ্গে গর্ত করতেন ধোয়া-ধুয়ির জলের জন্যে! তাঁর হাত গুলো চিপসে যেতো, কেটে যেতো কিংবা ফেটে যেতো ঠান্ডা বরফ জলে। মা তখন বিশ উত্তীর্ন এক তরুনী কিন্তু কঠিন এক জীবনযুদ্ধ তাঁকে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধেছিলো। আমাকে বলতেন, কৈশোরে তাঁর দারুন কোমল এবং অসম্ভব সুন্দর দু’খানা হাত ছিলো! জমিতে ফসল কাটার সময় আমাদের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করতে হতো। মাঝে মাঝে সেই জমিতে কর্মীদের দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে আমি মা’কে সাহায্য করতাম। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির ছোটখাট অথচ সাদাসিদে আমার মা’কে বহন করতে হতো মাথায় করে একগাদা খাবার আর পিঠে একটি শিশু যে ছিলো আমার ছোট ভাই! পুরো বিষয়টি ছিলো এক আশ্চর্য্যরকমের ভারসাম্য রক্ষার প্রকৃয়া! বাড়ি থেকে খামারের দুরত্ত্ব ছিলো প্রায় দু’মাইল! মাথায় অত্যন্ত ভারী এক খাবারের বোঝা সমেত তাঁকে হাঁটতে হতো গোটা পথ! জীবন তাঁর কাছে ছিলো আত্যন্ত আয়াসসাধ্য তবুও সবসময় তাঁকে দেখাতো একজন সুখী রমনীর মতো। সম্ভবতঃ তিনি জানতেন যে এইটেই হলো তাঁর জন্যে নির্ধারিত জীবন এবং এর ভেতর থেকেই তাঁকে জীবনের সর্বোত্তমটুকু বের করে আনতে হবে।
আমার বয়েস যখন মাত্র ছয় তখন একদিন আমার মা কারোও সহযোগিতা ছাড়াই নিজে নিজেই আমার ছোট ভাইদের একজনকে জন্ম দিলেন! আমার ঠাকুরমা গিয়েছিলেন বন্ধুদের সাথে গল্প বলার আসরে, আর বাবা গিয়েছিলেন কাজে। বাবা সাধারনতঃ কখনোই কাছে থাকতে পারেননি যখন মা তাঁর সন্তানদের জন্ম দিয়েছেন। বাড়ির সামনের উঠোনে আমি খেলছিলাম, হঠাৎ শুনতে পেলাম এক শিশুর কান্নার আওয়াজ! আমি দৌড়ে আসতেই মা বললেন আশে পাশের প্রতিবেশী কোন মা’কে যেনো এখনই ডেকে আনি। আমাদের ছিলো নিকটাত্মীয়ের মতোই হৃদয়বান প্রতিবেশী। সাধারনতঃ প্রতিবেশী পরিবার গুলো সময়-অসময়ে একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়ায়। কারন এখনকার মতো নয়, কোচাং তখন আতীতের এক ছোট্ট শহর। খবর পেয়ে পাশের বাড়ির সহৃদয় মহিলা শিশুটিকে স্নান করাতে গরম জল করতে সাথে সাথে চলে এলেন। মা ততক্ষনে নিজের সাথে যুক্ত নবজাতকের নাড়ির যোগ কেটে সেটিকে বেঁধে দিয়েছেন! এর পরে প্রতিবেশী মহিলাটি মায়ের জন্যে নরম ভাত এবং বাদামী সামুদ্রিক শ্যওলার একটি স্যূপ রাঁধলেন। প্রথা অনুযায়ী মায়েরা যখন নবজাতকের জন্ম দেন, তার পরপরই নরম ভাত আর এই বাদামী সামুদ্রিক শ্যাওলার বিশেষ স্যূপটি তাঁদের পরিবেশন করা হয়। কারণ এতে আছে উচ্চমানের খাদ্যপ্রাণ এবং খনিজ!
দিদি, এখানেই শেষ নয়….! এ স্মৃতি-গাঁথায় আরোও আছে তথ্য। আমি আমার শৈশব, আমার বেড়ে উঠা, আমাদের অতীত হয়ে যাওয়া সমাজেরও একটা স্পর্শ এখানে পাই। আমি অনুভব করি লেখক একজন কোরীয় নাগরিক এবং অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক অথচ কোথায় যেনো একটা নৈকট্য আছে আমাদের মাঝে! অনুভবে, চিন্তায় ও চেতনায়……..
এক শাশ্বত মায়ের চিত্রই পেলাম।