বাঙলাদেশের স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচি গুলো দেখলে মাঝে মাঝে হতাশ হই। রাষ্ট্রীয় ভদ্রতার আড়ালে বেশিরভাগ অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ঠেসে রাখা পাঠ্যপুস্তকে ছেলেমেয়েরা কেন মনোযোগ দিবে? স্কুলে আমার জীবনের অন্যতম ভয়ের ব্যাপার ছিলো ইতিহাস। কোন সময় কোন দল গঠিত হয়েছিলো, কোন তারিখে কোন জায়গায় কার কার উপস্থিতিতে গোলটেবিল বৈঠক হয়েছিলো, এইসব জানার চাইতে ঐ বয়সে আমার জানা উচিত ছিলো বীরত্বের ইতিহাসগুলো। আমার জানা উচিত ছিলো ক্র্যাক প্লাটুনের অসীম সাহসী ছেলেগুলোর কথা। বীরশ্রেষ্ঠদের নাম জানাটাই আমার যথেষ্ট ছিলোনা, আমার জানার অধিকার ছিলো বীরত্বের কথা, সম্মুখ যুদ্ধের কথা। ভাষা শহীদদের নাম জানানোটাই স্রেফ রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যে পড়েনা। প্রথম কবে পতাকা উত্তোলন হয়েছিলো সেটা জানানোটাই রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যে পড়েনা। বরং, সেই বায়ান্নোর পেছনে কি ছিলো, একটা পতাকা উড়াতে কীপরিমাণ পরিকল্পনা, কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিলো সেসব জানাটা আমার উচিত ছিলো ঐ বয়সে। নাম, তারিখ মুখস্ত করার চাইতে সেই বয়সে গল্পের ছলে আমার মাঝে এই চেতনাগুলো জ্বালিয়ে দেয়া সরকারের কর্তব্য ছিলো। কিন্তু তারা সেটা করেনাই। একটা সামাজিক বিজ্ঞান নামক বইতে নামকা ওয়াস্তে ‘কখন, কোথায়’ এইসব ইতিহাস দেখিয়ে শেষ করে দেয়া, শিশু কিশোররা শিখবেটা কী? সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, আগরতলা, গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহাযুদ্ধ সবকিছুই তাই শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে গেছে পরীক্ষায় পাশ করার মত বিরক্তিকর টপিকস। অথচ, এগুলোকে মুখস্ত করানোর চাইতে, শিখিয়ে দেয়া, ধারণ করিয়ে দেয়াটাই রাষ্ট্রের ডিউটি ছিলো ।

বাঙলা বইতে রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষের কবিতা থাকে, নদীর কবিতা থাকে। অথচ, এইসবের চাইতেও তাঁর লিখে যাওয়া ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’ লিরিক্সটা বেশি হৃদয়গ্রাহী। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এইসব পড়তে দেয়া হয়না স্রেফ ভদ্রতা করে। কী আশ্চর্য! জীবনানন্দের ‘আবার আসিবো ফিরে’ কবিতার পাশাপাশি ‘সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটির কথা হয়’ কবিতাটা থাকলে কার কপাল পুড়তো? নজরুলের ‘ওমর ফারুক’ কবিতা থেকে কি শিখেছি আমি ঐ বয়সে? তাঁর ‘মানুষ’ কবিতাটা আমাকে ঐ বয়সে মুক্তভাবে কিছু ভাবতে শেখাতো। কিন্তু স্কুল কলেজে নজরুলকে খুব নিপুণভাবে দেশের একমাত্র মুসলমান কবি বানানোর ষড়যন্ত্র দেখেছি আমি। ইংলিশ ফর টুডে আমাকে কি শিখিয়েছে সত্যিকার অর্থে আমার কিছু মনে নেই। ঈশপের কিছু গল্প আমাকে কিছুটা নৈতিক শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু সাহিত্য? ইংরেজি বই, অথচ বিদেশী সাহিত্যের ঠাঁই নাই সেখানে। আমাকে রবার্ট ফ্রস্ট, শেলী, কীটসদের কথা লাইব্রেরী থেকে জানতে হলো? তাঁদের কবিতার সাথে ‘ইংলিশ ফর টুডে’ পুস্তকে পরিচিত হওয়াটা কি উচিত ছিলোনা আমার? ইন্টারে বাঙলা বই এর নতুন সিলেবাসটা অবশ্য কিছুটা ভালো লেগেছে আমার। কিন্তু এখানে মোপাসাঁর ‘নেকলেস’ গল্পের পরিবর্তে ‘ম্যাদমজেল ফিফি’ থাকাটা উচিত ছিলোনা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে? ছেলেমেয়েরা দেশপ্রেমের চেতনা সম্পর্কে কিছুটা শিখতো মোপাসাঁর এই বিখ্যাত ছোটগল্প থেকে। কেন নেই? কারণ, সেখানে পতিতাদের কথা আছে তাই? আহা রাষ্ট্রীয় ভদ্রতা। চেখভের ‘আমলার মৃত্যু’ কিংবা কাফকার ‘জনৈক বুভুক্ষার শিল্পী’ গল্পগুলো কি আমাদের সমাজ বাস্তবতায় প্রচন্ড প্রয়োজনীয় নয়?

শিক্ষার ব্যাপারটা নতুনকরে ঢেলে সাজানো উচিত বলে মনে করি। অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধ, নৈতিক মূল্যবোধ এগুলা একদিনে তৈরী হওয়ার জিনিস না। কিংবা বইতে মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় বমি করে দেয়ার মত জিনিসও না এগুলা। এগুলা শিখার ব্যাপার নয়। আত্মীকরণের ব্যাপার। আর এই আত্মীকরণটা ইনজেক্ট করতে চাইলে শিশুদের প্রথম থেকেই সেভাবে গড়ে তোলা উচিত। এবং এই কাউন্সেলিংটা ভালোভাবে দিতে পারে বাধ্যতামূলক পাঠ্যপুস্তকগুলো। পাঠ্যপুস্তক কেবল পরীক্ষা পাশের মাধ্যম হবে কেন? পাঠ্যপুস্তক নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা করার সময় আসছে।