হাজার বছর ধরে মানুষ রাতের ঝলমলে আকাশ দেখে বিস্মিত হয়েছে আর মুগ্ধ নয়নে ভেবেছে বহুদুরের ঝুলন্ত আলোক বিন্দু নিয়ে। আকাশের বুকে জ্বলজ্বলে এই ঝুলন্ত বিন্দুই হলো তারা বা নক্ষত্র। তখনকার দিনে নক্ষত্র মানুষের মনে ঐশ্বরিক চিন্তার যোগান দিত, এমনকি নক্ষত্রদের মাধ্যমে নাবিকরা সমুদ্রে দিক ঠিক করতো। যদিও নক্ষত্র কি, কিভাবে এদের উৎপত্তি – এসব সম্পর্কে তাদের কোন ধারনা ছিলনা। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আজ নক্ষত্রদের সম্পর্কে জানার তেমন কিছু বাকি নাই। মজার বিষয় হলো, নক্ষত্ররা নিষ্প্রাণ হলেও অনেকটা জীবিত; এদের জন্ম হয় এবং জীবন শেষে মৃত্যুবরন করে।
মহাবিশ্বে প্রাচুর্যতার দিক দিয়ে নক্ষত্ররাই সবথেকে এগিয়ে। নক্ষত্র হলো সৌরজগতের শক্তি এবং আলোর মুল উৎস। নক্ষত্রগুলো অনেকটা আজকের দিনের পারমানবিক চুল্লির মত, এদের কেন্দ্রেই উৎপন্ন হয় জীবন গঠনের যত প্রয়োজনীয় মৌল। মহাবিশ্ব যদি নক্ষত্রশুন্য হতো তাহলে কোন প্রানের উৎপত্তি হতোনা। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত সুর্য কিন্তু আদতে একটা নক্ষত্র।
নক্ষত্রের জন্মকথা
মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বহুপ্রকার গ্যাস এবং ধূলিকণা। স্থান বিশেষ এই গ্যাস এবং ধূলিকণার অনুপাত বা পরিমান কমবেশি হয়ে থাকে। বিশেষ কিছু জায়গায় ধূলিকণার পরিমাণ অত্যন্ত বেশি থাকে, এরকম জায়গাকে নেবুলা বলে। যখন কোন ভারী বস্তু নেবুলার পাশ দিয়ে যায় অথবা কাছাকাছি কোন সুপারনোভা বিষ্ফোড়ন ঘটে তখন তার মহাকর্ষ বলের প্রভাবে নেবুলা সঙ্কুচিত হতে থাকে। এই সঙ্কোচনের ফলে নেবুলার অভ্যন্তরে অবস্থিত গ্যাস এবং ধূলিকণা কেন্দ্রে জড়ো হতে থাকে এবং শিশু নক্ষত্র গঠন করে, যাকিনা অনেকটা নক্ষত্রের মত কিন্তু অতবেশি ঘনত্বের নয়। মহাকর্ষের প্রভাবে শিশু নক্ষত্রটি আরো সঙ্কুচিত হয় এবং অধিক পরিমাণ ধূলিকণা এর সাথে যোগ হতে থাকে ফলে এর ভর ও ঘনত্ব দুটোই বেড়ে যায়। ভর ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রে তাপ উৎপন্ন হতে থাকে। এভাবে যখন ভর এবং তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন নক্ষত্রটির কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয় এবং নক্ষত্রটি পরিনত হয়। এটা নক্ষত্রের প্রথম পর্যায় এবং একে মেইন সিকুয়েন্স ফেজ বা মেইন সিকুয়েন্স নক্ষত্র বলে। নক্ষত্রদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে এই ধাপে। উল্লেখ্য যে আমাদের সুর্য এখনো এ পর্যায়ে আছে।
নক্ষত্রের বিবর্তন
নক্ষত্রগুলো প্রকৃতপক্ষে বিশালাকৃতির পারমানবিক চুল্লী যেখানে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন পরমানু হিলিয়াম পরমানুতে রুপান্তরিত হয়। ফিউশন প্রক্রিয়াই নক্ষত্রদের শক্তির উৎস। ফিউশন বিক্রিয়ায় মুলত দুটি পরমানু মিলে একটি বৃহৎ পরমানু তৈরি করে। হাইড্রোজেন পরমানুর নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন। হাইড্রোজেন পরমানুর দুটি ভিন্ন প্রকরন বা আইসোটপ আছে -ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়াম। এদের প্রত্যেকেরই প্রোটন সংখ্যা একটি কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা যথাক্রমে ১ এবং ২। অর্থাৎ ডিউটেরিয়ামে থাকে ১টি প্রোটন ও ১টি নিউট্রন ; এবং ট্রিটিয়ামে থাকে ১টি প্রোটন ও ২টি নিউট্রন। নক্ষত্রদের কেন্দ্রে ১টি ডিউটেরিয়াম এবং ১টি ট্রিটিয়াম মিলে ১টি হিলিয়াম পরমানু তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত একটি নিউট্রন নির্গত হয় এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়।
এভাবে যখন নক্ষত্রের সমস্ত হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রুপান্তরিত হয়, তখন হটাৎ করে এটি ফুলে যায়। নক্ষত্রের এই অবস্থাকে বলে রেড জায়ান্ট। যেসব নক্ষত্র আকারে খুব বড় তারা রেড সুপারজায়ান্টে পরিণত হয়; এবং হিলিয়ামকে অক্সিজেন ও কার্বনে রূপান্তর করে। আকার যদি সেইরকম বড় হয় তাহলে এই রূপান্তরকরণ চলতে থাকে কার্বন, অক্সিজেন থেকে নিয়ন, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার এবং সিলিকন পর্যন্ত। সেগুলো আবার পুনরায় রুপান্তর হয় ক্যালসিয়াম, নিকেল, ক্রোমিয়াম, কপার, এভাবে চলতে থাকে লৌহ পর্যন্ত। যখন নক্ষত্রের কেন্দ্র পুরোপুরি লৌহে পরিণত হয় তখন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া হটাৎ করে থেমে যায়, কারন লৌহকে ফিউজ করার জন্য অত্যন্ত বেশি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়।এখন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া থেমে যাওয়ার কারনে এর উপরে মহাকর্ষ বল পুরোদমে কাজ করবে ফলে তারাটি নিজের উপরেই চুপশে যাবে। কারন নক্ষত্রে ঘটা নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন চাপ বাইরের দিকে কাজ করে এবং মহাকর্ষ বল নক্ষত্রের কেন্দ্রের দিকে চাপ প্রদান করে – এভাবে দুটো বল পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে নক্ষত্রকে সাম্যাবস্থায় রাখে। যাহোক ক্রমাগত এভাবে চুপশে যাওয়াই নক্ষত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারন করে; এটা অবশ্য ভরের উপরেও নির্ভর করে। গড়পড়তা ভরের নক্ষত্রগুলো তাদের বহির্বারন বা খোলস ছড়িয়ে দেয় এবং প্লানেটারি নেবুলা গঠন করে। প্লানেটারি নেবুলার কেন্দ্রে থাকে উক্ত নক্ষত্রের চুপশে যাওয়া কেন্দ্র যেটা সাদা বামন হিসাবে জ্বলতে জ্বলতে একসময় শীতল হয়ে পরে এবং নিভে যায়। তখন এটাকে কালো বামন বলে।
এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু উক্ত তারার ভর যদি অস্বাভাবিক রকম বেশি হয় তাহলে তারাটি খুব দ্রুত গতিতে চুপশে যাবে ফলে ভয়ংকর রকমের বিষ্ফোড়ন ঘটবে। একে সুপারনোভা বিষ্ফোড়ন বলে। তারাটির ভর যদি আমাদের সুর্যের ভরের ১.৪ গুন বেশি হয়, তাহলে এটি বিষ্ফোড়নের পরেও সঙ্কুচিত হতে থাকবে এবং নিউট্রন তারায় রুপান্তরিত হবে। কিন্তু যদি তারাটির ভর আমাদের সুর্যের ৩ গুন বা তার বেশি হয়, তাহলে এর সঙ্কোচনের হার এতোবেশি হবে যে তারাটির মধ্যকার সমস্ত পদার্থ একটি বিন্দুতে জড়ো হবে এবং বলতে গেলে এটা মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবে। সবশেষে থাকবে অসীম মহাকর্ষ বলের একটা গর্ত যেখান থেকে কোন কিছুই বের হতে পারেনা, এমনকি আলোও নয়। এটাকে তখন ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর বলে।
যাহোক, সাধারণত নক্ষত্রগুলো প্লানেটারি নেবুলা হিসাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রসারিত হতে থাকে এবং নিকটবর্তী কোন ভারী বস্তুর মহাকর্ষের প্রভাবে পুনরায় সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। এভাবে অসীম সংখ্যকবার চলতে থাকে নক্ষত্র সৃষ্টির মহাজাগতিক পুনর্জন্ম এবং বিবর্তন। আমাদের সৌর জগত মুলত সৃষ্টি হয়েছে এধরনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় জেনারেশনের নেবুলা থেকে। একারনে আমাদের পৃথিবী তথা সৌরজগতে বিভিন্ন হালকা ও ভারী মৌলের এতো প্রাচুর্যতা যেটা প্রানের উৎপত্তি সম্ভব করেছে। আমাদের শরীর গঠনের যাবতীয় পরামানু এসেছে নক্ষত্রের কেন্দ্রে ঘটা নিউক্লিয়ার ফিশন থেকে অথবা সুপারনোভা বিষ্ফোড়ন থেকে। এমনকি এমনো হতে পারে যে, আমার দুটি হাতের মৌল হয়তো এসেছে দুটি ভিন্ন নেবুলা থেকে। সত্যি বলতে আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান। নক্ষত্রের বর্জ্যেই আমাদের পত্তন।
চমৎকার বস্তূনিষ্ঠ লেখা । খুবই ভালো লাগলো । তবে এখনো তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে “হয়তোবা” ,”মনে হয়’, ধারণা করা যায়” এধরনের শব্দ বা বাক্য ব্যাবহার কমছে না । বরং বাড়ছে । অর্থাৎ অনিশ্চয়তা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে মানুষের চিন্তা ভাবনায় ।
supernova ,blackhole ,এবং neutron star সম্পরকে একটা গুরুত্তপুরন জিনিস জানলাম, চমৎকার লেখাটার জন্য ধন্নবাদ আপনাকে !!
আমরা জানি শক্তির বিনাশ হয় না, রূপান্তর ঘটে। তাহলে নিউট্রন এর সাথে যে এনার্জি তৈরী হচ্ছে সেটা কোথায় যাচ্ছে?
সেটা মহাবিশ্বেই ফেরত যাচ্ছে, অর্থাৎ মহাবিশ্বের মুক্ত শক্তির সাথে যুক্ত হচ্ছে যা শুন্যতার মধ্যে বিরাজমান। হয়তো এই শক্তিই উস্কে দিচ্ছে নতুন কোন নেবুলার জন্মগ্রহনকে। ধন্যবাদ 🙂
বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যপূর্ণ আলোচনা, বেশ ভাল লাগল।
ধন্যবাদ 🙂
দারুন ভাল লেগেছে…।। :rose:
কলম চলুক দূর্বার গতিতে,ছিন্নভিন্ন হউক সকল চিন্তার জড়তা……
ধন্যবাদ 🙂 গোলাপ নিন :rose: কলম চলবে। :yes:
একটি প্রাণী কোষে যা আছে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে তাই বিদ্যমান ।
যথার্থ বলেছেন :yes: আসলে মহাবিশ্বের সবকিছুই কেমন জানি সম্পর্কযুক্ত 🙂
মন্তব্য…
সাব্বাস ব্রো!!!
carry on…
ধন্যবাদ ভাইডি 🙂 জ্ঞানেই মুক্তি, মুক্তির সোপানে পা চলুক। :mail:
ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য 🙂
লেখাটি অনেক ভালো লাগলো। বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা।
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂 আরো একটু বিস্তারিত লিখলে ভালো হতো বোধহয়!
ভালো লাগলো
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
তাহলে কি একদিন এমন হবে যে সমস্ত জায়ান্ট আর সুপার জায়ান্ট স্টারগুলোকে আর খুজে পাওয়া যাবে না? তারাগুলো সবাই ই রুপান্তরিত হয়ে যাবে। তখন কি নতুন করে প্রাণের স্ফুরণ ব্বন্ধ হবে?
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ 🙂 । না তা কেন হবে! সুপার জায়ান্ট গুলো হয়তো মিলিয়ে যেতেই পারে কিন্তু নতুন করে সুপার জায়ান্ট তৈরি হচ্ছে এবং হবে প্লানেটারি নেবুলা থেকে, আর প্রাণের স্ফুরন সম্ভবত কখনোই বন্ধ হবেনা কারন এই সুবিশাল বহুবিশ্বে প্রাণের অনুকুল জায়গার তেমন অভাব নেই বোধহয়। 🙂