“কণ্ঠ আমার রূদ্ধ আজিকে বাঁশি সঙ্গীত হারা,
অমাবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপ্নের তলে….।”
আজ আমাদের বাঁশি সঙ্গীত হারিয়েছে, স্বপ্নগুলো তলিয়ে গেছে দুঃসহ অমাবস্যার অন্ধকারে; প্রতিটি ভোর আজ আর সোনালি প্রত্যূষের অপেক্ষায় থাকেনা। আজ কেবল মৃত্যুপুরীর বজ্রপাতের প্রতীক্ষা সবার! অকস্মাৎ যমদূতের আবির্ভাব হোক এই প্রত্যাশাই করে সবাই (?)(!)
লক্ষ্মী পূজোকে ঘিরে ফেনীতে ঘটে যাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসের নিকৃষ্টতম নারকীয় ঘটনার সাথে সাথেই আবার চোখ ভেজাতে হল শুদ্ধস্বরের প্রকাশকসহ আরো দুজন ব্লগারকে হত্যা চেষ্টার সংবাদে। ওঁরা লড়ছে মৃত্যুর সাথে এখনো, জানিনা কতটা শঙ্কামুক্ত ওঁরা ! কিন্তু বেঁচে গেলেও কি বাঁচতে পারবে ওঁরা আমাদের কথিত এই স্বাধীন দেশে? দীপনের মৃত্যুতো সেই কথাই বলে গেল! কী আশ্চর্য দিন! কী অদ্ভুত সুন্দর রক্তঝরা সকাল! যেন এমনই হবার কথা ছিল! প্রতিদিন বাড়ছে লাশের সংখ্যা, মৃত্যুর মিছিলে আরো লম্বা হয়ে উঠছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বিস্তৃতি, বাড়ছে এই জঘন্য হত্যালীলার কলঙ্কঋণ !
“যাহারা তোমার বিষায়েছে বায়ু, নিভায়েছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভাল?’’
ঈশ্বর বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ প্রবল বিশ্বাস নিয়ে এই প্রশ্ন রেখেছিলেন বিধাতার কাছে, বহুকাল আমিও এমন বিশ্বাসই করতাম। জীবন যুদ্ধের কত দুঃসময়ে একেলা একাকী আমি এই চরণ দুটো নিভৃত্যে উচ্চারণ করেছি কোন এক অদৃশ্য শক্তির কাছে সাহায্য চেয়ে । জানিনা তখনও কি ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-কলহের শেকড় সমাজের এত গভীরে প্রোত্থিত ছিল? তখনও মানুষের বাক স্বাধীনতার টুটি এইভাবে টিপে দেওয়া হত কিনা জানিনা। তবু কেন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- “প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে, বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কাঁদে..।”
আমদের কত রক্তঋণ জমা পড়ে আছে! অভিজিৎ, বাবু, অনন্ত, নিলয়ের সাথে আজ আবার যোগ হল দীপনের নাম! অথচ আমরা নির্বিকার-প্রতিকারহীন! এই শক্ত অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত মেরুদণ্ড নেই আমাদের, এই জঘন্য হত্যা কি কেবলই ধর্মান্ধতা নাকি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? দেশটিকে মেধাহীন করার খেলায় মেতেছে কোন অপশক্তি; কিন্তু কে করবে এর বিচার আজ? যে প্রশাসন অন্ধ ক্ষমতার মোহে, ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধে আর কিছুই নেই যার কাছে, যে দেশের আইন জোনগণকে রক্ষা নয় হয়রাণীতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যে দেশে জন্মিলেই মরিতে হইবে অপঘাতে; সেইখানে কার কাছে করি এই মানবীয় আবেদন! সংবিধান যেখানে গলা টিপে হত্যা করেছে বাক-স্বাধীনতাকে, সেখানে কেনই বা করি এই অরণ্যে রোদন?
বহুকাল আমিও বিশ্বাস করেছি ভগবান নিশ্চয়ই এত বড় অনাচার সইবেন না। কিন্তু আজ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ঈশ্বর বলে ভগবান বলে কেউ ছিলেন না কখনো, নেই এখনো; কোন অস্তিত্ব নেই এই মনগড়া ঈশ্বরের। যদি থাকত তবে এমনটি হতে পারত না। একটি স্বাধীন দেশে ধর্মের কাছে জিম্মি হয়ে এইভাবে একের পরে এক নীরবে নির্বিচারে প্রাণ দিচ্ছে আলোর পথের দিশারীরা, সত্য অনুসন্ধানীরা, স্বপ্নের পাখি মুক্ত চিন্তকেরা, আর যেভাবে বসন উড়িয়ে উদ্ভট উটের পিঠে চলছে উদাস দেশ-প্রশাসন আর রাজনীতিকেরা; সত্যই ঈশ্বর বলে কেউ থেকে থাকলে তিনি এই ধরায় নেমে আসতেন। তিনি নিজহাতে এর বিচার করতেন। দূর্গাদেবী ত্রিশূল হাতে নিধন করত অসুররূপী মোল্লাদের, কিম্বা কৃষ্ণ এসে বধিত নয়া কংস মামাদের !
আমি অতি দুর্বল চিত্তের মানুষ; বড় অসহায় বোধ করি এই দুঃসময়ে । আমার ধর্মবোধ মানবতার উর্ধে ওঠেনি কোনদিন। শৈশবে বাবার বন্ধু নিতাই ঘোষ, নারায়ণ চন্দ্র এরাই ছিল আমার প্রাণের কাকু । হঠাৎই এক সকালে শুনতাম নিতাই কাকুরা ভারতে চলে গেছেন। বুকের ভেতরে কেমন ফাঁকা লাগত। যদিও চলে যাওয়ার কারণ জানার কৌতূহল নিবৃত্ত হতে খুব বেশি দেরি হয়নি। স্কুলের গন্ডিতে পা রেখে সেই কৈশোরে আমার প্রিয় বন্ধু হল মাধুরীলতা, কৃষ্ণা হালদার; কলেজে নীলিমা, বনানী বিশ্বাস, শিখা আর মিলন মূখূজ্যে । যৌবনে আমার প্রিয় বন্ধু ছিল সবুজ চন্দ; হয়তো বন্ধুর চেয়েও আরও বেশি কিছু হতে পারত চাইলে । এসব সম্পর্কের জালে জড়িয়ে নিজেকে কোনকিছু প্রমান করতে চাইনি; এসব হয়ে গিয়েছিল। কারণ, ভেতরের বোধে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ আর সাম্প্রদায়িকতা দেয়াল তুলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি কোনদিন। আমি খুব প্রগতিশীল, আধুনিক মানুষও নই; কেবল ভেতরের আমি’র সাথে লড়াই করে বেড়ে ওঠা অতি সাধারণ একজন । আমার জীবনবোধে রঙ ছটানো অকারণ আধুনিকতা যেমন নেই তেমনি সস্তা প্যাকেটে মোড়ানো ধর্মের অন্ধ খোলসও নেই।
আমি আস্তিক কতটা সন্দেহ আছে, আবার নাস্তিক হতে পারি তেমন সাহসও নেই; এই সাহসহীনতা মৃত্যুভয়ে নয়, অজ্ঞতা! জ্ঞান তো শক্তির আধার! জেনেছি অসির চেয়ে মসি বড়! কিন্তু আজ দেখছি মসি ভূলুণ্ঠিত, কেঁদে ফিরছে মানবতার দ্বারে, হেরে যাচ্ছে মসি, জিতে যাচ্ছে অসি। নিরব নিথর বাকরূদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে সব লেখনী, ভেসে যাচ্ছে সব যুক্তি তর্ক রক্তের বন্যায় । আজ আমারও রক্ত মিছিলে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার অসহায়ত্ব আমাকে সাহসী করে তুলছে ভীষণ! আজ আমি প্রস্তুত দিতে বলিদান! আজ এই মুহূর্তে আমি ঘোষণা দিচ্ছি আমি নাস্তিক! আমার এই স্পর্ধার জন্য আমাকে মেরে ফেলা হোক! তবু আমি দেখবনা এই বীভৎস হত্যার প্রলয়োল্লাস! সুন্দর এই চোখে জীবনের এতো কদর্য রূপ! তবু বন্ধ হোক হত্যার এই মহোৎসব! জীবনের মিছিলে হেরে গিয়েও এই আমি এবার জিতে যাব নিশ্চয়ই। আমি জিতে গেলে আরেকবার জয়োল্লাসে মেতে উঠবে দেশ-প্রশাসন-আর ঘৃণ্য নোংরা ধর্মীয় জঙ্গীবাদ! কিন্তু আরেকবার হেরে যাবে তুমি মা, বারংবার তুমি হেরে যাচ্ছ! আমার প্রিয়তমা জননী, প্রিয় স্বদেশ!
বিচারের বানি নিরবে নিভৃতে কাঁদে ।
লেখাটা ভালো লাগলো, আরো বেশি ভালো লাগলো ভয়ের আাঁধার কাটিয়ে যে সাহসটা জেগে উঠছে। আমার মনে হয় এটাই এখন আমাদের বড় সম্পদ।
আমার মস্তিষ্ক কোষগুলোর জেন গতি থেমে গেছে। কত প্রান নেবার পর আসবে ভর, আছি তারি প্রতীক্ষায়।
“আমার জীবনবোধে রঙ ছটানো অকারণ আধুনিকতা যেমন নেই তেমনি সস্তা প্যাকেটে মোড়ানো ধর্মের অন্ধ খোলসও নেই।”
আপনার কথাটি অনেক ভালো লেগেছে ।
এতটা নিরাশ হবেন না | সত্যের জয় হবেই | সত্যের প্রদীপ টিম টিম করে অনন্তকাল জ্বলে আর মিথ্যার প্রদীপ দাউদাউ করে অতি অল্পকাল জ্বলে | অন্ধকার যখন গভীর তখন প্রভাতের আর দেরী নেই | রাত যখন গভীর , ভর তখন অদূরে |