লেখকঃ পলাশ পাল
‘উৎসব’ শব্দটির মধ্যে একটি সর্বজনীন আবেদন রয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের সেখানে অংশগ্রহণ হবে স্বতঃস্ফূর্ত। পরিসর বা ব্যাপ্তি ছোট কিংবা বড়ো যাই হোক না কেন, সকল মানুষের কাছে তা হতে হবে সমান গ্রহণযোগ্য। যদিও ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থান উৎসবের সর্বজনীনতাকে অনেকটাই ব্যহত করে। ধনীর গৃহে যেভাবে উৎসবের আয়োজন জাঁককমকপূর্ণ হয়, দরিদ্রের কুটিরে তা থাকে যথেষ্ঠ ম্রিয়মান। সুবিধাভোগীরা উৎসব নিয়ে যতটা আমোদিত হয় সুবিধাবঞ্চিতরা ততটাই নিস্পৃহ। ঈদ, দুর্গাপুজো কিংবা বড়োদিন সমস্ত সম্প্রদায়গত অনুষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। তাই উৎসবের সর্বজনীন আবেদন এখানে কতটা ধরা দেয়, সেটা নিঃসন্দেহে একটি বিতর্কের ব্যাপার।
দুর্গাপুজো, ঈদ কিংবা বড়োদিন যে কোনো সম্প্রদায়গত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সর্বজনীন উৎসব বলার একটা প্রবণতা বহুদিন ধরেই প্রচলিত। ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় উভয় ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে, সম্প্রদায়গত অনুষ্ঠানকে উৎসব হিসাবে মান্যতা দেওয়ার মধ্যে এক ধরণের ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ রয়েছে। কেননা- কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের পরিচয় দিয়ে কোনো জাতির পরিচয় নির্ধারণ হয় না। একটি জাতির মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থান থাকে। তাই একটা সম্প্রদায় কোনোভাবেই গোটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এবং করা উচিত-ও নয়। বরং এই প্রবণতা অতি বিপজ্জনক। এতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অলিখিতভাবে মান্যতা দেওয়া হয়। ফলে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা অধিক সুবিধা পায়, অন্যদিকে সংখ্যালঘুরা পড়ে থাকে পিছনের সারিতে। যা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরোধী। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে উৎসব বলার মাধ্যমে সব ধর্মের মানুষকে একাত্ম করার একটা শুভ প্রচেষ্টা থাকলেও এই অনুষ্ঠান আবার মানুষের মধ্যে ভেদাভেদের প্রাচীর তৈরি করে। পুজো, ঈদ বা বড়োদিন এলেই সকলের মধ্যেই সম্প্রদায়গত অনুভূতিগুলি ফিনকি দিয়ে ওঠে। জাতিগত পরিচয় নয়, সম্প্রদায়গত পরিচয় তখন অধিক প্রকট হয়।
বলা হয়ে থাকে, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হল শারদীয়া উৎসব তথা দুর্গাপুজো। প্রশ্ন থেকে যায়, হিন্দু আর বাঙালির সংজ্ঞা কী অভিন্ন? ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল তা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে গুড়িয়ে দিয়েছিল। তৎকালীন চরমপন্থী রাজনীতিবিদ্দের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন, দেশমাতৃকাকে দেবি হিসাবে বন্দনা এবং তাকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির মুসলিম নেতাদের হিন্দু বিদ্বেষনীতি দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভ্রুন প্রসব করেছিল। জন্ম নিয়েছিল হিন্দু মহাসভা কিংবা মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ। হিন্দুত্ববাদ ও দ্বিজাতি তত্ত্ব তারই উর্বর ফসল। একই কথা খাটে ঈদ বা বড়োদিনের ক্ষত্রেও। অনেক দেশেই এগুলিকে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা দেওয়া হয়। ইউরোপ থেকে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফ্রিকা সকল দেশের ক্ষত্রেই এই দুষ্ট প্রবণতা বিদ্যমান রয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশে ধর্মীয় অনুভূতিগুলিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ততটা গুরুত্ব না দেওয়া হলেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে একরকম উৎসবের স্বীকৃতি দেওয়ার রীতি বহুদিন ধরেই চলে আসছে।
অথচ যে কোনো দেশের স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস কিংবা সংহতি দিবস— অনেক বেশি পরিমানে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পাওয়ার দাবিদার। এই ধরনের অনুষ্ঠান বা উৎসবের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের পরিবর্তে জাতিগত চেতনা জেগে ওঠে। ধর্মীয় সংহতির বদলে জাতীয় সংহতি প্রকাশ পায়। দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং কর্তব্যবোধ তৈরি হয়। উৎসবের সর্বজনীন আবেদন-ও বহুলাংশে সার্থক হয়ে ওঠে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত হলেও সত্যি, দেশে দেশে সম্প্রদায়গত উৎসব নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যতটা মাতামাতি হয়, স্বাধীনতা দিবস নিয়ে ততটা নয়। নাগরিকদের ব্যক্তিগত খরচের কথা না-হয় বাদ দিলাম, আধুনিক রাষ্ট্রগুলি সম্প্রদায়গত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পশ্চাতে যতটা তার জাতীয় সম্পদের অপচয় করে তার সিকিভাগ এই সমস্ত জাতীয় অনুষ্ঠানের প্রচারে ব্যায় করতে আগ্রহ দেখায় না। ভারত, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই সম্পদ সার্বিক জনকল্যানে ব্যায় করলে রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক দূরাবস্থা অনেকটাই বদলে যেতে পারত। নৈতিকতা ও আইনগত দিক থেকেও প্রশ্নটা উঠতে পারে—রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাজে লাগানো বা ব্যায় করার নীতি কী আদৌ গ্রহণযোগ্য?
যদিও আধুনিক রাষ্ট্রগুলি আবার খুব জোরের সঙ্গেই দাবি করে—রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার। কথাটা যে একধরনের ভরং তাতে সন্দেহ কিছু নেই। ধর্ম যদি যার যার হয় তবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বেলায় রাষ্ট্রের এতো মাতামাতি কেন? বরং রাষ্ট্রের উচিত ধর্মকে নিরুৎসাহিত করা। কোনো ধর্মীয় কাজে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করলে তার ওপর কর আরোপ করা। ইদানিং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে কর্পোরেট পুঁজির আগ্রহ বাড়ছে। পুঁজি লগ্নির অন্যতম আকর্ষনীয় কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি। উদ্দেশ্য, বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন। তথাকথিত সর্বজনীন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারাও সেই লগ্নির অন্যতম অংশীদার। উভয়ের এই আঁতাতের ফলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে উঠছে এক ধরণের বানিজ্য। এতে লাভবান হচ্ছে দুপক্ষ-ই। অথচ উভয় ক্ষত্রেই রাষ্ট্রীয় সম্পদের যতেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ঘিরে এই বানিজ্য করের আওতায় আসা একান্তভাবে প্রয়োজন। ধর্ম যদি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার হয় তাহলে ধর্মীয় আচরণ ও তার পালন ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকা উচিত। তা যদি না-হয়, ধর্মীয় আচরণকে বিনোদনের পর্যায়ে নিয়ে এসে বানিজ্যকীকরণ করা হয় তবে সে কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় করের বাইরে থাকতে পারে না।
ধর্মীয় আচারকে সর্বজনীন উৎসব হিসাবে বিপনন করার ক্ষত্রে নাগরিক সমাজ বিশেষত সুশীল সমাজ-ও কম দায়ি নয়। পুজো কিংবা ঈদ এলেই তারা নানারকম কর্মকান্ডে মেতে ওঠেন। মিডিয়ার প্রচার তো রয়েছেই। এই সঙ্গে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বিজ্ঞাপন, জলসা’য় ঈদ, পুজো বা বড়োদিন শব্দের আগে পড়ে ‘উৎসব’ শব্দটিকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এবং সেটা সচেতন ভাবেই করা হয়ে থাকে। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। সমাজ যাদের বিবেক বলে মনে করে, যারা সমাজের মুক্ত কন্ঠস্বর, তাদের কাছ থেকে এটা মোটেও কাম্য হতে পারে না। বরং এই সুশীল সমাজকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সাদামাটা অনুষ্ঠানের পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিত। পাশাপাশি জাতীয় অনুষ্ঠানগুলিকে প্রচারের অধিক আলোয় নিয়ে এসে সত্যিকারের উৎসবের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাও নেতিক ও সামাজিক কর্তব্য। তা না-হলে দিন দিন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জৌলুশ যেভাবে বাড়ছে তাতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির শিকর আরো গভীরে গ্রোথিত হবে। ফলে ভেদাভেদ মুছে যাবার পরিবর্তে তা আরো গাঢ় হবে।
সাহিত্য সাময়িকীর ক্ষেত্রে ঈদ সংখ্যা, পুজো সংখ্যা বা বড়োদিনের সংখ্যার যে ঘনঘটা দেখা যায় তা স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা, শিশু দিবস সংখ্যা, মানবাধিকার দিবসে মোটেও দেখা যায় না। পুজোর গান, ঈদের গান নিয়ে যে উন্মাদনা থাকে স্বাধীনতা দিবসের গান, প্রজাতন্ত্র দিবসে আর আর তেমন করে গান রচনা বা প্রকাশ হয় না বললেই চলে। সাহিত্যিক, শিল্পিদের এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। প্রতিবাদটা আসা উচিত যুক্তি ও বাস্তবতার দিক থেকেও। কারণ, ধর্ম তো বিভাজন, হিংসা, বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু সভ্যতাকে দিতে পারেনি। তার সে ক্ষমতা কোনো কালেই ছিল না, আজো নেই। ধর্মবাদীদের একথা ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।
ধর্মবাদীরা অবশ্য খুব জোরের সঙ্গেই মানব সভ্যতার পশ্চাতে ধর্মের অবদানকে বড়ো করে দেখাতে ভালোবাসেন। তারা মনে করেন— এই সভ্যতার যা কিছু মহান তা ধর্মের অবদান। বাস্তবে একথা শূন্যগর্ভ জ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু তো নয়। ধর্ম সভ্যতার ভিত্তি কোনোদিন ছিল না। বরং উল্টোটাই ঠিক। ধর্ম সভ্যতর গতিকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। মানবতার গলা টিপে ধরেছে।
ধর্মবাদীরা অনেক সময় ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতাকে গুলিয়ে ফেলতে ভালোবাসেন। সত্যিটা হল– ধর্ম আর নৈতিকতার অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। নৈতিকতার পরিসর অনেক বড়ো। সে মানুষকে মহান করেছে। সভ্যতাকে দেখিয়েছে উন্নয়নের পথ। আর ধর্ম সেখানে মানুষকে বেধে রেখেছে কিছু চিরাচরিত অসার নিয়ম-বিধি এবং বিশ্বাসে। যার বাস্তব ভিত্তি নেই। এই নিয়মের বাইরে সে কিছু ভাবতে নারাজ, অন্যের ভাবনাকে দমিয়ে রাখতে-ও সমান তৎপর।
সভ্যতা আর মানবতার সম্পর্ক এক সূতোয় বাঁধা। ধর্মের সেখানে কোনো স্থান নেই। ধর্মের কোনো অনুশাসন হয় না, যা হয় তা অপশাসন মাত্র। সেই খ্রিষ্টেয় যুগ থেকে এখনো পর্যন্ত তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে এই কথাটি স্পষ্টত ভাবেই দৃশ্যমান হবে। তাই ধর্মকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ধর্মীয় উৎসব নিয়ে মাতামাতি করা মানেই যে কোনো দেশের বহুত্ববাদকে অসম্মান করা। সভ্যতা, মানবতা কিংবা নৈতিকতা বহুত্ববাদকে শ্রদ্ধা জানাতে শেখায়। আর ধর্ম শেখায় বিভাজন। অন্য কিছু নয়।
ভাল লাগল আপনার লেখা পড়ে। কলকাতায় বাবু সংস্কৃতির যুগে যে দুর্গা পুজা হত তা আসলে দম্ভ প্রদর্শনের উৎসব।
কে কিভাবে বিদেশি প্রভু দের আনন্দ দিতে পারবে তার প্রতিযোগিতা । বসত বাইজী নাচের আসর , সাধারণ মানুষের থেকে
জোর করে টাকা আদায় করে , সাধারন মানুষদের ঢুকতে দিত না এই উৎসবে জমিদার রা। সুতরাং এই উৎসব কক্ষনোই
সার্বজনীন নয় । পরে রানী রাসমনি এই অন্যায় এর বিরদ্ধে নিজেদের দুর্গা পুজা শুরু করেন , সাধারণ মানুষদের সামিল করে।
পরবর্তি কালে সার্ব জনীন পুজো সুরু হয়ে মানুষের হাতে আসে এই উৎসব। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি , চাঁদার জুলুম , আর
পক্ষপাতিত্ব। এটা অনেকেই জানেন চাঁদার জুলুম কি ভয়ানক ছিল একসময় এবং অনেক পাড়ার দুর্গা পুজো এখনও
এইটা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ , সাধারণ মানুষ গেলে পাত্তা পায় না । আপনার সঙ্গে আমি একমত যে ধর্মের উৎসব সার্বজনীন
হয়ে ওঠে নি অনেক ক্ষেত্রেই। মনে পড়ে কবি গুরুর সেই উক্তি “সে মন্দিরে দেব নাই” বা “শুন্য নয় রাজ দম্ভে পূর্ণ”।
তবে আরও একটা দিক আছে। অন্য ধর্ম অতটা বলতে পারব না কিন্তু সনাতনী (হিন্দু) ধর্মের একটা জেনুইন দিক আছে।
হিন্দু ধর্ম সুধু একটি ধর্ম নয় , জীবন যাপনের একটি পদ্ধতি (বলেছিলেন স্বামী বীবেকানন্দ) । এই যে সুন্দর মুর্তি গুলি তৈরি
হয় এটি একটি সুন্দর শিল্প , ইতালিয় পর্যটক রা পর্যন্ত দেখে মুগ্ধ হয়েছেন , এবং নিজেরা এটা শিখে নিয়েছেন ।
যে সব পুজোগূলিতে সবাই এখনো মণ খূলে মিশে আনন্দ করতে পারে , সেটা তাদের সারা বছরের দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।
তাই সার্ব জনীন ভাবে এই উৎসব কিন্তু মানুষের হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা চেষ্টা করি । লেখক মহাশয়কে বলব
একবার আপনি স্বামি বীবেকানন্দের বই গুলো পড়ুন , দেখুন আদি সনাতনী মতবাদ কিভাবে বিস্ব ভাত্রিত্ব শেখায়,
শেখায় , দেশ , বেড়া সীমা এগুলি কিছুই নয় । তাই বলি “ধর্ম যার যার উৎসব সবার”।
আপনার লেখাটি পড়ে ভাল লাগল, ধন্যবাদ ।
ধন্যবাদ অনিন্দ্যবাবু। আপনার কথাগুলি অত্যন্ত মূল্যবান, সুন্দর এবং প্রাসঙ্গিক।
“এই উৎসব গুলি স্থানীয় সংষ্কৃতির সাথে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত যে তার ইতিহাসের সাথে জড়িত যে দুম করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াও অসম্ভব। আমাদের শৈল্পীক ও সাংষ্কৃতিক উপাদান গুলির প্রায় সমস্তই ধর্ম থেকে উঠে এসেছে। ফলে ধর্ম-সংশ্লিষ্ট সব উৎসব বাদ দিতে গেলে যেটা পড়ে থাকে সেটা নিতান্ত সাদা মাটা বেরঙ্গীন একটি যাপন।”
তবে কী-না একটা খটকা থেকেই গেল, যে ধর্ম রয়েছে বলেই হিংসা হানাহানি ও বিভাজন রয়েছে। ধর্ম রয়েছে বলেই তালিবান রয়েছে। রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, জাকির নায়েক-রা। আবার ধর্মের কারণে ৫৬ বছরের বৃদ্ধ গরুর মাংস রাখার অপরাধে খুন হয়েছেন। অভিজিৎ, অনন্তদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। ধর্ম রয়েছে তাই ধর্মীয় উৎসব রয়েছে, ধর্মীয় সংস্কৃতি রয়েছে এবং রয়েছে শৈল্পিক উপাদান। তাই এগুলো না থাকলে জীবন অনেকটাই বেরঙিন সাদা-মাটা হয়ে উঠবে একথাও মোটের ওপর সত্যি। তবে কীনা সেই সত্যি কী অভিজিৎ, ওয়াশিকুর-দের রক্তের থেকে রঙিন? পৃথিবী থেকে এইটুকু রঙ হারিয়ে গেলে কী সভ্যতার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? ঢাকের বাদ্যিতে শিল্পের উপাদান রয়েছে, হক কথা। কিন্তু সেই উপাদানে যদি এসে মেশে কারো বাবা কারো সন্তান হারানোর করুণ সুর, সেই শিল্পকে ছুড়ে ফেলে দিলে কী খুব বেশি শিল্পের ঘাটতি পড়ে যাবে সমাজের। এই প্রশ্নগুলি ভাবিয়ে তুলছে বড়ো বেশি করে।
আসলে সবটাই বোধহয় আমাদের অভ্যাসের ব্যাপার। এগুলো না থাকলে আমাদের জীবন বড়ো একঘেয়ে হয়ে যাবে, এই বোধ থেকেই আমাদের অভ্যাস ত্যাগ করতে এতো ভয়। একবার এই ভয় কাটিয়ে ওঠা দরকার, তবে অভ্যাসের-ও বদল হবে।
পলাশবাবু, আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। ধর্মের সাথে আমার জম্ম-শত্রুতা। কোন বিস্বাস-ই আমি পছন্দ করি নে। কিন্তু ওই যে কাঙ্গাল মন ‘মন-রে কৃষিকাজ জাননা, সাধের মানব জমিন রইল পতিত আবাদে ফলত সোনা’ শুনলেই কি রকম একটা হয়ে ওঠে। আমি আবার-অ বলছি পলাশবাবু, আমি আপনার সাথে দু’শো শতাংশ একমত যে রাষ্ট্র কোন ধর্মকে প্যাট্রন করা শুরু করলে তার থেকে হানিকর ব্যপার খুব কম-ই আছে। কোন একটি বিশেষ ধর্মের উৎসবকে জাতীয় ঘোষনা করা একটা নারকীয় অসভ্যতা ও বর্বরতা।
আমার কেবল মনে হয় এই উতসবগুলো যদি কেবল উতসব হয়ে উঠত! ‘নবান্নের ঘ্রাণ’ বলতে আমরা যদি কেবল একটি সাংষ্কৃতিক উপমা বুঝি… ধর্ম নয়… রবিবর্মার ছবি দেখে যদি ওই ছবিটিতে হারিয়ে যেতে পারি… দেবিটিতে নয়। ‘ আমি ইস্রাফিলের বাঁশরি, সিন্ধু উতলা ঘুম ঘুম, ঘুম চুমু দিয়ে নিঃঝুম, মম বাঁশরির তানে পাশরি,” বলতে গিয়ে যদি আমাদের না বাধে মনে না হয় ইস্রাফিল আসলে ম্লেচ্ছ।
বা “Jesus was a sailor, when he walked upon the water. He spent a long time watching from his lonely wooden tower…” এর থেকে চার্চ, ইনকুইজিশান, পোপ, পাদ্রী, স্যাল্ভেশান-এর আড়ম্বর ভেঙ্গে পড়ত…যদি যীশু মানুষ হয়ে উঠতেন!
জানি আমি একি কথার পুনরাবৃত্তি করে চলেছি। জানি আপনার যুক্তি আমার এ অবান্তর ভাবালুতার থেকে অনেক জোড়াল (এটি কোন রকম বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য নয়,- অনেস্ট স্টেটমেন্ট)। আমিও অভিজিতের মৃত্যুতে বিহ্বল হয়ে পড়েছি…। কিন্তু কি করব বলুন…আমার গোটা অস্তিত্ব জুড়ে এই। এগুলো নিলে আমার আস্তিক-নাস্তিক কোন অস্তিত্ব-ই আর ঠাকে না যে!
অনিন্দ্যবাবু আবার কলম(কি-বোর্ড) ধরতে বাধ্য হলাম। কেননা যে-কথা গুলি আমার প্রচন্ড রকমের ভাবিয়ে তুলেছে যে, তবে কী ধর্ম আমাদের সংস্কৃতিকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে তার থেকে মুক্তি একরকম অসম্ভব? কিংবা অন্যভাবেও বলা যায়, আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের এমন হৃদয় মন্থনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে যে তার থেকে কোনো ভাবেই আমাদের নিস্তার নেই?
ধর্ম আর সংস্কৃতির মধ্যে এই সম্পর্কের বন্ধন কীভাবে তৈরি হয়েছে? ধর্মের মধ্য ইশ্বর রয়েছে। আর সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে আমাদের কৃষ্টি, পরম্পরা আর রয়েছে আমাদের সমাজের নানা উপাদানের সন্নিবেশ। আবার এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে এক অভিন্ন যোগাযোগ।
আমার উদ্দেশ্য নয় আপনাকে কোনোভাবেই আপনার নিজস্ব যাপনের প্রনালীতে আঘাত করা। আমার উদ্দেশ্য নয় আপনার মন ও মনকে কটুক্তি করা। মূলত নিজের ভাবনার শান দেওয়ার তাগিদেই এই লেখা।
বহুদিন আগে অশোক মিত্রের আপিলা চাপিলা পড়তে গিয়ে ঠিক আপনার কথার প্রতিধ্ববি শুনেছিলাম তাঁর মুখে, যে নাস্তিক হয়েও কীর্তন শুনে তার চোখে জল এসেছে। তিনি বারবার এই ভাবজগতে আলোড়িত হয়েছেন। সেদিন এই কথাটা ততটা আমাকে আন্দোলিত করেনি। হয়তো বয়সের কারণেই করেনি। হয়তো তখন চেতনার জগতে জরতার জন্যই করেনি। আজ করল। তীব্রভাবেই করল। হয়তো জ্ঞানের সীমিত পরিসীমার জন্যই করল। আমি এর উত্তর খুঁজছি।
মানুষের উতসব করতে মন চায় বলেই মানুষ উতসব করে বলে আমার মনে হয়। ছুতো হিসেবে অনেক কিছুর সাথে ধর্মকেও ব্যবহার করে(প্রসংগতঃ ইহুদীদের উতসব দেখে মুসলমানগন উতসবের আবদার করার ফলেই মুসলমানদেরকে দুই ঈদ উৎসব দেয়া হয়)। এতে ধর্মের পান্ডা আর ব্যাবসায়ী সহ নানা ফন্দিবাজদের নানা কারবারী মুনাফা লাভেরও সুযোগ হয়। তাতে সাধারণের উৎসব আনন্দে কোন বাঁধা হয় না। সমস্যা হয় যখন ফ্যাসিবাদী মোল্লা পান্ডারা এর মধ্যে ঢুকে পড়ে। উতসবের চেয়ে ধর্ম তখন মুখ্য হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িকার খরগে তখন শান দেয়া শুর হয়। পন্ড হয় সবার উৎসব।
আসলে সব কিছুকে বিষিয়ে দেবার পেছনে যারা দায়ী তাদেরকে সমাজে দমিয়া রাখার কার্য্যকর ব্যাবস্থা না করে সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে অবস্থার কোন পরিবর্তন আসবে কি? ওরা তো সব উৎসবকেই ধর্মীয় নয় সাম্প্রদায়িকতার রঙ লাগিয়ে দেয়। মনে নেই পহেলা বৈশাখের কথা? যে দেশের অজস্র বিদ্যালয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না, সেদেশে স্বাধীনতা দিবসকে পরাজয় দিবস হিসেবে রং দেয়ার স্বেচ্ছাসেবীর(আনসার) অভাব হবে কি?
পলাশের পর্যবেক্ষন সঠিক দিকেই দৃকপাত করছে, কিন্তু আমার মনে হয়, সমস্যার আরো গভীরে যাওয়া দরকার।
প্রথমতঃ পলাশবাবু, এতো প্রাসঙ্গীক লেখা নিকট অতীতে পড়েছি কিনা সন্দেহ। এক প্রচন্ড প্রয়োজনীয় এবং অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন আপনি।সমস্যাটি হোল, ঠিক যেমনটি শ্রী রুশো আলম মন্তব্য করেছেন, যে এই উৎসব গুলি স্থানীয় সংষ্কৃতির সাথে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত যে তার ইতিহাসের সাথে জড়িত যে দুম করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াও অসম্ভব।
আমাদের শৈল্পীক ও সাংষ্কৃতিক উপাদান গুলির প্রায় সমস্তই ধর্ম থেকে উঠে এসেছে। ফলে ধর্ম-সংশ্লিষ্ট সব উৎসব বাদ দিতে গেলে যেটা পড়ে থাকে সেটা নিতান্ত সাদা মাটা বেরঙ্গীন একটি যাপন। এটা ব্যাক্তিগত ভাবে নীরিশ্বরবাদী হয়ে মেনে নেওয়া কঠিন কিন্তু নেহাৎ উড়িয়ে দিতে পারছি না। এই পথ ধরে চললে কীর্তন গাওয়া ছলে না, শ্যামা সংগীত গাওয়া চলে না, মোৎসার্টের রেকোয়েম গাওয়া চলেনা, রবীন্দ্রনাথের ‘আমারে কর তোমার বীনা’ গাওয়া চলেনা, খৃষ্টধর্মের অসামান্য হিমনাল সঙ্গীত গুলো ফেলে দিতে হয়। অসামান্য শৈল্পীক প্রতিমাগুলির থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে হয়…এ ফর্দ শেষ হবার নয়। আর এই বিপুল অনুপস্থিতির অভাব কেবল স্বাধীনতা দিবস ও দেশাত্মবোধক গান পূরন করেতে পারে না।
আমি কোন ডিভিনিটিতে বিশ্বাস করিনে। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিনে। কিন্তু তাই বলে আমার (ব্যাক্তি আমার) ঢাকের বাদ্যি শুনলে কানে তুলো দিতে পারবোনা এই ভেবে, পাছে মন নেচে ওঠে।
আমার এক কলিগ বম্বের খৃষ্টান, তিনি বহুদিন তাঞ্জানিয়ায় ছিলেন তিনি একবার বলেছিলেন, যে সে সময় প্রত্যেক দিওয়ালীর জন্য তারা উন্মুখ হয়ে থাকতেন কারন সেইটেই একমাত্র উৎসব ছিল যেখানে দেশের গন্ধ পাওয়া যেত।
আমি গুজরাটে থাকি। এখানে গর্বা মানে এক বিপুল সাংষ্কৃতিক মহোৎসব। সে হিন্দু উৎসব হওয়া সত্ত্বেও এবং এ রাজ্যের চরম ধর্মীয় মেরুকরণ সত্ত্বেও অসংখ্য মুসলিম প্রত্যেক বছর গর্বা নাচতে যান।গত বছর শ্রী নরেন্দ্র মোদী নামক একটি প্রানী এ দেশের প্রধান মন্ত্রী হবার পরে একদল হিন্দুত্ববাদি প্রচার করে যে গর্বায় আর বিধর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হবে না। সে নিয়ে এখানে বেশ শোরগোল পরে গিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তেমন কোন একুশে আইন শেষ পর্যন্ত বলবৎ হয় নি। একে কিভাবে সমাজজীবন থেকে তুলে নেওয়া চলে, কেবল ধর্ম-সংশ্লীষ্ট বলে?
তবে পলাশবাবু আপনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সরকারী আনুকূল্য বা কোন বিশেষ উৎসব কে জাতীয় খেতাব দেওয়া একান্তই অনুচিত এ কথা আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করি।
ধর্মীয় উৎসবের সর্বজনীনতা ধর্ম তার নিজস্ব দৃষ্টিকোন থেকেই সমর্থন করে না । যেমন মুসলমানদের ঈদ উল ফিতরে ফিতরার টাকা কোন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দরিদ্রকে দেওয়া হয় না। কিন্ত হাজার বছর ধরে সব ধর্মের মানুষ সমাজে একসঙ্গে বসবাস করায় ধর্মীয় উৎসব গুলো এদেশে সংস্কৃতির একটা অংশে পরিনত হয়েছে। অনেকের কাছে এগুলো এখন যতটা না ধর্মীয় উতসব তার চেয়ে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক উৎসব। আমি আজ বনানী পুজা মন্ডপে অনেক হিজাব পরিহিতাকেও দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখেছি। তবে এই বিষয়ে একমত যে ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে জাতীয় দিবস কেন্দ্রীক উৎস গুলোকেই সরকারের পক্ষ থেকে অধিক পরিমানে প্রমট করা উচিত।
ঈদুল আজহার মাংসও যদি বিতরণ করা হয় তা শুধু মুসলমানদের মধ্যে করা হয়। অমুসলিমদের তা দেওয়া হয় না। শত শত বছরের ধর্মগুলি কেবল উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না। বাস্তবে একেকটা ধর্মের একেকটা উৎসব হচ্ছে তাণ্ডব। লোকে যে বলে, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। তার মানে হচ্ছে, দেশব্যাপী তাণ্ডব হতে থাকলে তা থেকে রক্ষা পাবার উপায় কারো নেই।