১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন সময়ে ইরানের প্রতিনিধি বক্তব্য প্রদান করলেন যে, ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস(UDHR) মূলত ইহুদী-খ্রিস্টান সংস্কৃতির একটি ইহজাগতিক ভাষ্য মাত্র, যা মুসলিমদের দ্বারা প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। যদি এতে উত্থাপিত দাবিগুলো এবং “দেশের স্বর্গীয় আইনের” মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হয়, তবে ইরান সবসময়েই ইসলামি আইনকেই বেছে নিবে’। একই বছরে প্যারিসে ইউনেস্কোর কাছে ইউনিভার্সাল ইসলামিক ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস(UIDHR) উত্থাপন করা হয়। মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের সাথে সংশ্লিষ্ট লন্ডন ভিত্তিক সংগঠন ইসলামিক কাউন্সিলের উদ্যোগে এটি প্রস্তুত করা হয়। ১৯৯০ সালে ওআইসি’র পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের এক সম্মেলনে মানবাধিকার বিষয়ে কায়রো ঘোষণা Cairo Declaration on Human Rights in Islam(CDHRI) সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। কায়রো ঘোষণায় শরিয়া আইনকে মুসলিম দেশগুলোতে মানবাধিকার রক্ষায় ‘একমাত্র স্বীকৃত রক্ষাকবচ’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, যার ফলে বৈশ্বিক ঘোষণার উপর কায়রো ঘোষণার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
মানবাধিকার সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণার(UDHR) সূচনাবক্তব্যের প্রথম লাইনে বলা হয়েছে,
Whereas recognition of the inherent dignity and of the equal and inalienable rights of all members of the human family is the foundation of freedom, justice and peace of the world…(১০)
কায়রো ঘোষণা(CDHRI) একইভাবে একটি সূচনাবক্তব্য দিয়ে শুরু হয়েছে, কিন্তু প্রথম লাইন থেকেই UDHR এর সাথে এর বৈপরীত্য চোখে পড়ে,
Reaffirming the civilizing and historical role of Islamic Ummah which God made the best nation that has given mankind a universal and well-balanced civilization in which harmony is established between this life and the hereafter and knowledge is combined with faith; and the role that this Ummah should play to a guide a humanity confused by competing trends and ideologies and to provide solutions to the chronic problem of this materialistic civilization…(১১)
আমরা এরই মধ্যে দুটি ভিন্ন বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তুলনা করছি। বৈশ্বিক ঘোষণাটি যেহেতু বৈশ্বিক, সেহেতু তা মানবজাতিকে জাতি কিংবা ধর্মের বেড়াজালে বিভক্ত করেনি। অপরদিকে কায়রো ঘোষণাটি তার প্রথম লাইন থেকেই তা করে আসছে। বৈশ্বিক ঘোষণা যেখানে সকল মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে শুরু হয়েছে, কায়রো ঘোষণার শুরুতেই ইসলামি উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্ব বয়ান করা হয়েছে।
বৈশ্বিক ঘোষণার জন্ম হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রেখেঃ নাৎসিদের চালানো গণহত্যা, বার্মা রেলওয়েতে জোরপূর্বক শ্রমের কারণে ২ লক্ষ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ হাজার শ্রমিক এবং ১৬০০০ যুদ্ধবন্দির মৃত্যু(১২), ড্রেসডেন, টোকিও, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমাবষর্ণ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে মৃত্যুর মিছিল যার ফলে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরই মৃত্যু হয়।(১৩) মানবাধিকার যদি শুধুমাত্র ক্ষেত্রবিশেষে প্রযোজ্য হয়, তবে আমাদেরকে সেই পুরোনো ধ্যানধারণায় ফিরতে হবে যেখানে তথাকথিত ‘শ্রেষ্ট জাতি’ নয় এমন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের উপর নৃশংসতা চালানো অনুমোদিত হয়ে যায়।
বৈশ্বিক ঘোষণার প্রথম ধারাটি এক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত অথচ টু দ্য পয়েন্টঃ
All human beings are born free and equal in dignity and rights. They are endowed with reason and conscience and should act towards one another in a spirit of brotherhood.
কায়রো ঘোষণার প্রথম ধারা অন্যদিকে দীর্ঘ এবং এর আলোচনার প্রেক্ষাপটও ভিন্ন,
(a) All human beings form one family whose members are united by submission to God and descent from Adam. All men are equal in terms of basic human dignity and basic obligations and responsibilities, without any discrimination on the grounds of race, colour, language, sex, religious belief, political affiliation, social status or other considerations. True faith is the gurantee for enhancing such dignity along the path to human perfection.
(b) All human beings are God’s subjects, and the most loved by him are those who are most useful to the rest of his subjects, and no one has superiority over another expect on the basis of piety and good deeds.
প্রথম লাইনেই বলা হচ্ছে ঈশ্বর ভক্তির উপরই মানব সমাজের সদস্যপদ পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করছে। বৈশ্বিক ঘোষণায় এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। কায়রো ঘোষণা এক্ষেত্রে যে মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিচ্ছে তা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং তা মানবাধিকারের মূল চেতনার বিরোধী। বৈশ্বিক ঘোষণা যেখানে বলছে ‘all human beings’, কায়রো ঘোষণা বলছে ‘all men’। বৈশ্বিক ঘোষণায় বলা হচ্ছে বৈশ্বিক যুক্তি ও চেতনার কথা। অন্যদিকে কায়রো ঘোষণায় শুধু ‘সত্যিকারের বিশ্বাস’ এর জয়গান গাওয়া হয়েছে যা আবশ্যিকভাবেই ‘মিথ্যা বিশ্বাস’ এ বিশ্বাসীদের বর্জন করে। এতে আরো বলা হয়েছে, ‘সত্যিকারের বিশ্বাস’ মানুষের প্রকৃত মর্যাদা নিশ্চিত করে। বৈশ্বিক ঘোষণার মতে মানুষ মাত্রই অধিকার এবং মর্যাদার অধিকারী, কায়রো ঘোষণা মতে তা শর্তসাপেক্ষ। কারা ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রিয়ভাজন তা চিহ্নিত করে কায়রো ঘোষণা মানবজাতিকে আরও বিভক্ত করে। এতে পরিস্কারভাবেই এক শ্রেণীর মানুষকে অন্যদের চেয়ে বেশি মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। বৈশ্বিক ঘোষণায় এমন কোন বক্তব্য নেই।
বৈশ্বিক ঘোষণার ধারা ৫ বলছে,
No one shall be subjected to torture or to cruel, inhuman or degrading treatment or punishment.
কায়রো ঘোষণার ধারা ২ বলছে,
(a) Life is a God-given gift and the right to life is guaranteed to every human being. It is the duty of individuals, societies and state to protect this right from any violation, and it is prohibited to take away life except for a Shari’a prescribed person.
(b) Safety from bodily harm is a guaranteed right. It is the duty of the state to safeguard it, and it is prohibited to breach it without a Shari’a- prescribed reason.
ধারা ১৯(ঘ) বলছে,
There shall be no crime or punishment except as provided for the Shari’a.
শরিয়া মতে পাথর ছুঁড়ে হত্যা, ধর্মত্যাগের কারণে মৃত্যুদণ্ড, অঙ্গচ্ছেদের শাস্তি, পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে হত্যা, সমকামীতার অভিযোগের মৃত্যুদণ্ড, চাবুকের প্রহারের মতো শাস্তিগুলোকে এই ধারাগুলোর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হল।
বৈশ্বিক ঘোষণার ১৬ নং ধারা বিয়ের অধিকারের ক্ষেত্রে বলছে,
(1) Men and women of full age, without any limitation due to race, nationality or religion, have the right to marry and to found a family. They are entitled to equal rights as to marriage, during marriage and at its discussion.
(2) Marriage should be entered into only with the free and full consent of the intending spouse.
কায়রো ঘোষণার ৫নং ধারা একই প্রসঙ্গে ভিন্ন কথা বলছে,
(a) The family is the foundation of society, and marriage is the basis of its foundation. Men and women have the right to marriage, and no restrictions stemming from race, colour or nationality shall prevent them from enjoying this right.
কায়রো ঘোষণায় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কতার শর্তটি উহ্য রাখা হয়েছে এবং যেহেতু এতে আন্তঃধর্মীয় বিয়ের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি সেহেতু বিধর্মীকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে বলেই প্রতীয়মান হয়। কায়রো ঘোষণার কোথাও বলা হয়নি যে, বিয়ের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের পূর্ণসম্মতি আবশ্যক। ফলশ্রুতিতে, কায়রো ঘোষণায় মতের বিরুদ্ধে বিয়েকে নীতিগতভাবে সমর্থন দেওয়া হল।
কায়রো ঘোষণার ৬ নং ধারায় নারীর প্রসঙ্গ এসেছে,
(a) Woman is equal to man in human dignity, and has rights to enjoy as well as duties to perform; she has her own civil entity and financial independence, and the right to retain her name and lineage.
(b) The husband is responsible for the support and welfare of the family.
ধারা ৬ এর কোথাও বলা হয়নি নারীর পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে, কিংবা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমান। উপরন্তু পুরুষকে সংসার চালানোর দায়িত্ব দিয়ে নারীকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল এবং স্বাবলম্বী হবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল।
ধারা ১০ এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,
Islam is the religion of unspoiled nature. It is prohibited to exercise any form of compulsion on man or to exploit his poverty or ignorance in order to convert him to another religion or to atheism.
‘the religion of unspoiled nature’ ত্যাগের কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বের অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলাম ধর্ম ত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
১১ নং ধারায় ঔপনিবেশকতাবাদের নিন্দা করা হয়েছে যা প্রশংসার দাবিদার। বৈশ্বিক ঘোষণায় এ বিষয়টি যোগ করা যেতে পারে। কিন্তু একই ধারার প্রথম লাইনেই আবার মানবজাতিকে ঈশ্বরের মুখাপেক্ষী করা হয়ছে, যা বৈশ্বিক ঘোষণায় করা হয়নি।
Human beings are born free, and no one has the right to enslave, humiliate, oppress or exploit them, and there can be no subjugation but to God the most high.
বাস্তবে, ঈশ্বর নিজে যেহেতু এসে দেখা দেন না, সেহেতু তার মনুষ্য-প্রতিনিধিরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। একই লাইনে অধিকার দিয়ে আবার ফিরিয়ে নেবার ঘটনা ঘটলো।
২২ নং ধারার বক্তব্যগুলো উদ্বেগজনক।
(a) Everyone shall have the right to express his opinion freely in such manner as would not be contrary to the principles of the Shari’a.
(b) Everyone shall have the right to advocate what is right, and propagate what is good, and warn against what is wrong an evil according to the norms of Islamic Shari’a.
(c) Information is a vital necessity to society. It may not be exploited or misused in such a way as my violate sanctities and the dignity of Prophets, undermine moral and ethical values or disintegrate, corrupt or harm society or weaken its faith.
২২(গ) দ্বারা সমাজ-সংস্কারের সকল দায়িত্ব ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত করা হল। জানুয়ারী ২০০৮ এ সাইদ পারুইজ কমবখস নামের এক আফগানি ছাত্র-সাংবাদিককে ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সাইদের অপরাধ ছিল, সে ইন্টারনেট থেকে ইসলামে নারীর মর্যাদা নিয়ে একটি নিবন্ধ ডাউনলোড করেছিল।(১৪)
২৪ এবং ২৫ নং ধারাগুলো দ্বারা বাকি ধারাগুলোর বক্তব্যকে নিশ্ছিদ্র করা হয়েছে।
ধারা ২৪
All the rights and freedoms stipulated in this declaration are subject to the Islamic Shari’a.
ধারা ২৫
The Islamic Shari’a is the only source of reference for the explanation or classification of any of the articles of this declaration.
কায়রো ঘোষণা উত্থাপনের পেছনে মূল যুক্তি হল-মানবাধিকার সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণাটি আদতে বৈশ্বিক নয়, বরং জাতিসংঘে ইরানের প্রতিনিধির ভাষায় তা ‘একটি পশ্চিমা ও ইহুদি-খ্রিস্টান সংস্কৃতির অংশ যা প্রাচ্যের সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য নয়’ এবং ‘মুসলিমদের পক্ষে এর প্রয়োগ সম্ভব নয়’। আমরা জানি দুটি ঘোষণাপত্রের মধ্যে তুলনা করি, তবে হয়তো আমরা কায়রো ঘোষণাপত্রের রচয়িতা এবং এতে সাক্ষরকারীদের মনস্তত্ব জানতে পারবো এবং কেন মুসলিমদের পক্ষে বৈশ্বিক ঘোষণাটি মানা সম্ভব নয় তার প্রকৃত কারণও খোলাসা হবে।
কায়রো ঘোষণাপত্রের ধারা ২৪ এবং ২৫ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এর রচয়িতারা মানবাধিকারকে শরিয়া আইনের সম্পূর্ণভাবে মুখাপেক্ষী করে তুলেছেন, যদিও এর প্রায়োগিকতা সম্পর্কে কোনো সম্যক ধারণা পাওয়া যায়নি। এতে পাথর ছুঁড়ে হত্যা, ধর্মত্যাগের কারণে মৃত্যুদণ্ড, জোরপূর্বক বিয়ে, অপ্রাপ্তবয়স্কের বিয়ে, পুরুষের অনুমতি সাপেক্ষে নারীর চলাফেরা ও ভ্রমণের অধিকার প্রসঙ্গে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। বরং ‘except as permitted by shari’a’ বাক্যাংশটি ব্যাখ্যা ব্যতিরেকে প্রতিটি লাইনের শেষে জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে মূলত শরিয়া আইনের দোহাই দিয়ে চালানো বর্বরতম নির্যাতনগুলোকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কায়রো ঘোষণা মানবাধিকার সম্পর্কিত নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে বৈশ্বিক ঘোষণাকে পাশ কাটিয়ে গেল। ঘোষণার রচয়িতারা শরিয়া আইনের বোধগম্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত, যেকারণে প্রতিটি অধিকার হরণে তারা শরিয়া আইনকে ভেটো হিসেবে ব্যবহার করতে উদগ্রীব। বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ‘except as permitted by shari’a’ বাক্যাংশটির অর্থ এবং প্রয়োগ খার্তুমে এক আর জাকার্তায় আরেক। তাহলে এমন একটি আইনি কাঠামো যা স্থান-কাল ও সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন রূপ ধারণ করে, তা কিভাবে মানবাধিকার সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক ঘোষণায় জায়গা করে নিতে পারে?
ঠিক কোন অবস্থান থেকে কায়রো ঘোষণা গৃহীত হয়েছে সে বিষয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। যেহেতু কায়রোতে ৫ অক্টোবর, ১৯৯০ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ১৯ তম ইসলামিক সম্মেলনে তা গৃহীত হয় এবং এর শুরুতে যেহেতু বলা হয়েছে ‘The member states of the Organization of the Islamic Conference’, সুতরাং দেখা যাচ্ছে এটি একটি ওআইসি(OIC) নথিপত্র। সংগঠন হিসেবে ওআইসির অবস্থান কি? সাদামাটাভাবে দেখলে, ওআইসি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশগুলোর একটি সংগঠন, এদের অধিকাংশেরই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আবার ওআইসি’র সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে ভারত বিশ্বে তৃতীয়। অন্যান্য ধর্মগুলোর যেহেতু এধরণের কোনো রাষ্ট্রভিত্তিক জোট নেই, সুতরাং ওআইসি’র সমতুল্য সংগঠন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ওআইসি ন্যাটোর মতো কোনো সামরিক জোট নয়, জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক সংস্থা নয়, আসিয়ান কিংবা আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো আঞ্চলিক ও বাণিজ্যিক জোটও নয়। সম্ভবত ভ্যাটিকানের মতো প্রভাব বিস্তার ও মর্যাদা অর্জনের লক্ষেই এর জন্ম। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সাথে জুড়ে দিয়ে ওআইসি নিজের অবস্থান আরো পাকাপোক্ত করতে চায়। ভ্যাটিকান ও ওআইসি’র মধ্যে মিল হল, উভয় সংস্থাই বিশ্বের বিপুল জনগোষ্ঠীকে বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করতে চায়, এবং বাকি বিশ্বের সামনে নিজেদেরকে প্রভাবশালী ধর্মীয় আদর্শবাদী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আজকের যুগে তেমন কোনো দৃশ্যমান উপযোগিতা না থাকলেও এই সংগঠন দুটি বহাল তবিয়তে টিকে আছে কিভাবে?
জাতিগত হীনমন্যতায় ভোগা জনগোষ্ঠীর জন্য ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের সামঞ্জস্য তৃপ্তিদায়ক। ওআইসি’র সদস্য রাষ্ট্রগুলো আপেক্ষিকভাবে অনুন্নত, গুটিকয়েক উন্নত রাষ্ট্রগুলো তেল সম্পদের কারণে ধনী, বৈজ্ঞানিক কিংবা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে নয়। মানব উন্নয়ন সূচকে সবগুলো রাষ্ট্রই পিছিয়ে। ভ্যাটিকানেরও একই দশা। ক্যাথলিকদের এককালের শক্ত ঘাঁটি ফ্রান্স আজ কট্টর সেক্যুলার। উত্তর ইউরোপের অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশ পোল্যান্ড, এবং উত্তর ইউরোপের প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ ইউরোপের স্পেন, ইটালি, পর্তুগাল; ল্যাটিন আমেরিকা, কঙ্গো ও ফিলিপাইনেই কেবল ভ্যাটিকানের গুরুত্ব বেশি। জি-৭ এর মতো অর্থনৈতিক জোট কিংবা ন্যাটোর মতো সামরিক জোটের বিপরীতে ধর্মের লেবাসে এই সংগঠন দুটি বিশ্বে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। অনুমিতভাবেই এই দুই সংগঠনের মতাদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ও কর্তৃত্বপরায়ণতার প্রভাব বেশি।
গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য এবং আধিপত্যবাদ একে অন্যের পরিপূরক, যা থেকে সম্ভবত ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতি আধিপত্যবাদী ধর্মের বিদ্বেষের কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ইরানের প্রতিনিধি মানবাধিকার সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণার কতগুলো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের দাবি করলেন এবং আরও বললেন ‘ইরান সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ব্যতীত কারো কর্তৃত্ব বা ক্ষমতাকে স্বীকার করে না’।(১৫) ইরানের প্রতিনিধির বক্তব্য অন্ধবিশ্বাস ও কর্তৃত্ববাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঈশ্বর নামক ব্যক্তিটির কোনো একক বৈশ্বিক সংজ্ঞা নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই তা নিয়ে ঢের বিতর্ক আছে। ঈশ্বরের চরিত্র কী, ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি, ঈশ্বর আমাদের কাছে কি চান, কিংবা ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তা কি আদৌ সঠিক? ফলে আবশ্যিকভাবেই বৈশ্বিক ঘোষণায় ঈশ্বরের প্রসঙ্গ অন্তভূর্ক্ত করা হয়নি।
‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা’-কে জোরপূর্বক বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা থেকে একজন বোধগম্যতা ও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে অবস্থানকারী শক্তি তথা স্বৈরাচারীকে মানবাধিকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের হর্তাকর্তা বানিয়ে দেওয়া হল। ইরানের প্রতিনিধি যে ঈশ্বরের দোহাই দিচ্ছেন সেই ঈশ্বরকে কেউ দেখেনি, তিনি প্রকাশ্যে হাজির হননা, নিজে কোন বার্তা পাঠান না, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেই তিনি পছন্দ করেন, কেবল কতিপয় নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি দাবিকারীদের মাধ্যমেই তার অস্তিত্ব জানান দেন। এমন একজন ব্যক্তি সর্বকল্যাণময় তা ভাবার পেছনে শক্ত প্রমাণ নেই, বরং এর বিপরীতে প্রচুর আলামত পাওয়া যায়। আপনার ঈশ্বর যদি আপনাকে ব্যভিচারের অপরাধে অভিযুক্ত একজন নারীকে কোমর অবধি মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে নির্দেশ দেন; তাহলে সেই সাধারণ সৈনিকটির সাথে আপনার কোনো পার্থক্য নেই যার ক্যাপ্টেন সকল গ্রামবাসীদেরকে গুলি করে মেরে ফেলতে নির্দেশ দেয়। উভয় আদেশই কেবল মস্তিষ্কবিকৃতদের পক্ষে করা সম্ভব এবং আপনার উচিত সকল ক্ষেত্রেই সেগুলো প্রত্যাখ্যান করা।
এক্ষেত্রে সম্পূরক দুটি প্রশ্নের জবাব খোঁজা জরুরী হয়ে পড়ে। ঈশ্বরের আদেশবলে কি নিষ্ঠুরতা পূণ্যকাজ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে? নাকি নিষ্ঠুরতার সংজ্ঞা অপরিবর্তনীয়, কারো আদেশে বা ক্ষেত্রবিশেষে তা পরিবর্তিত হয়ে যায় না।
বৈশ্বিক ঘোষণা দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়েছে। কায়রো ঘোষণায় সরাসরি স্বীকার না করলেও প্রথম প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়েছে। এবং এসব প্রশ্নের উত্তরের কিছু সুনির্দিষ্ট পরিণতি রয়েছে। বৈশ্বিক ঘোষণা নিষ্ঠুরতা এবং অবিচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে, অন্যদিকে কায়রো ঘোষণা ‘শরিয়া আইনের অধীনে’ উভয়কে গ্রহণ করেছে।
ঊৎস নির্দেশঃ
১০। ‘The Universal Declaration of Human Rights’ , UNDHR http://www.un.org/Overview/rights.html
১১। ‘Cairo Declaration on Human Rights in Islam’, CDHRI http://www.oic-oci.org/english/article/human.htm
১২। ‘The Thailand Burma Railway’ PBS, 26 June 2008, http://pbs.org/wnet/secrets/kwai/the-thailand-burma-railway
১৩। Nation Master Encyclopedia, http://www.nationmaster.com/encyclopedia/Demographics-of-the-Soviet-Union
১৪। BBC News, ‘Afgan MPs back blasphemy death’,
১৫। David Littman, ‘Universal Declaration of Human Rights, http://www.un.org/Overview/rights.html
বেশ শক্তিশালী লেখা হয়েছে… :rose: :rose:
লেখা চলুক দূর্বার গতিতে,ছিন্নভিন্ন হউক চিন্তার জড়তা…...।।
আত্যান্ত সুন্দর বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষন। মোল্লাদের আধুনিকতার নির্লজ্জ অনুকরনের ব্যার্থ প্রচেষ্টাকে সফলত ভাবে উন্মোচন করা হয়েছে। কয়লা ধুলে কি আর ময়লা যায়!