সংস্কৃতি তা সে নিচু হোক আর উচু হোক তার একটা বাঞ্ছিত মাত্রায় পৌছাতে হলে পরিবার সমাজ তথা পারিপার্শিকতার মাধ্যমে একাগ্র অনুশীলন করতে হয়। নিশ্ছিদ্র বিশ্বাসী হতে হলে যেমন দরকার ধর্মানুশীলন, যুক্তিসিদ্ধ মুক্তমনের ধারক হতে গেলেও তেমনি লাগে একাগ্র চিত্তের সাধনা। তারমানে দাড়াচ্ছে, একাগ্র অনুশীলন ছাড়া সঠিক মাত্রায় পৌছানো সম্ভব না। বিশ্বাস আবেগ থেকে আসে। কাম-ক্রোধ-লোভের স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে যথেচ্ছ ব্যবহারও আবেগ সঞ্জাত। কেওস বা বিশৃঙ্খলা তাই আবেগ উদ্ভুত পন্য। জীবজগত তাই বিশৃঙ্খল এবং আবেগের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সহজাত-প্রবৃত্ত। মানব যখন এমন হয়, তখন সে হয় প্রাকৃতিক। সে এইভাবে গড়ে তোলে প্রাকৃতিক পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। টমাস হবসের স্টেট অব নেচার এমনই এক মানব সমাজের আদলে জংলী বিশৃঙ্খল জীবজগত।

তাহলে কি করতে হবে, কিভাবে একটা মনুষ্য-সমাজ গড়ে তুলতে হবে? প্রকৃতিকে পুরাপুরি অস্বীকার করে? নাকি প্রকৃতির প্রাকৃতিক স্রোতের উজানে দেহ-মন ভাসিয়ে দিয়ে! কোনটাই নয়, তবে স্রোতের প্রতিকুলে যে একটুখানি বাইতে হবে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্রোতের প্রতিকুলে যাওয়ার শক্তি যোগাতে হলে যে দক্ষতার দরকার তার নাম- যুক্তি, প্রশ্ন, সন্দেহ, অবিশ্বাস। এইসব উপকরণ আসে সন্দেহাতীতভাবে বিজ্ঞান ও দর্শনের শাণিত চর্চার মাধ্যমে। অবশ্যই একাগ্র অনুশীলনের বন্ধুর পথ ধরে। প্রকৃতির গতবাধা পথের বাইরে একটু খানি নিজের মতন করে এই চলার নাম কৃত্রিম নির্বাচন বা আর্টিফিসিয়াল সিলেকশন, যা অর্জিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে মুক্তচিন্তার নিজস্ব পথ ধরে।

কৃত্রিম নির্বাচনে সাড়া দিয়ে প্রকৃতির বেঁধে দেয়া পথের বাইরে চলার চেষ্টা মানে প্রকৃতিকে অস্বীকার করা নয়। বরং প্রকৃতির সব উপহারকে যুক্তির কষ্টিপাথর দিয়ে যাচাই করে গ্রহন করার প্রবণতা ঘটাতে পারে বুদ্ধি ও চিন্তার মুক্তি। এমন একটা চর্চা বা জীবন-দর্শন একটা মনুষ্য-সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে নিঃসন্দেহে। মানুষ সমাজবদ্ধ এবং র‍্যাশনালও বটে। তাই তার যে কোন পথে চলতে হলে লাগে একজন নেতা। ভেড়ার পাল দিশা হারিয়ে ফেলে মেষ পালক ছাড়া, নেতা ছাড়া মানুষও অসহায়। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মনে, মনুষ্য-সমাজ প্রকল্পের এই এবড়ো-থেবড়ো পথে কে হবে মেষপালক, কেইবা হবে নেতা? নিশ্চয়ই বুদ্ধিব্যবসায়ী কোন অধ্যাপক, কোন বিজ্ঞানী বা কোন দর্শনজীবি নন। এমন একজন বিজ্ঞানী বা দার্শনিক যে শুধু মগজে নয়, মননেও ধারণ করার সক্ষমতা রাখেন যুক্তি-প্রশ্ন-সন্দেহ-অবিশ্বাসকে। একজন যুক্তিমনস্ক শিক্ষক, যে একজন সাধারন মানুষ হয়ে শেখাতে পারেন মানুষকে তার নিজের বানানো পথে হাটতে, প্রকৃতিকে এতটুকু আহত না করে।

গতানুগতিক পথের বাইরে থেকে এমনই একজন সাধারনের বেশে অসাধারন মানুষ এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশে মানুষকে কিছু শেখাবার দায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অনলাইন ও অফলাইনের জগতে নিজেকে একজন লেখক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী তথা শিক্ষক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সেই লেখক-বিজ্ঞানী অভিজিত রায়ের চুয়াল্লিশতম জন্ম দিনে, তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এই কথাই বলি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে-

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।