নামটার সাথে প্রাথমিক পরিচয় ঘটে ২০১৩ সালে। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। একদিন এক বড় ভাইয়ের কাছে একটা বই দেখলাম-‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ অনেক কষ্টে লেখকের নামটা বের করার পর ভাইয়া নিজেই বলে দিল, সাথে আরও বলল ‘ভালো রাইটার, পড়ে দেখতে পার’।একদিন দোকানে বইটা পেয়ে গেলাম।কিন্তু দুঃখের বিষয় বইটা আমি তখনো পুরো শেষ করিনি। তাঁকে আমি লেখক হিসেবেই চিনতাম। সময়ের ধারার সাথে অন্যসব লেখকের মত তাঁকেও আমি আলাদা করে মনে রাখতে ভুলে গেলাম।
আমি টেলিভিশন দেখিইনা বলাচলে। একদিন সকালে(হয়ত সত্যিই সেই সকালটা ছিল রাতের চেয়ে অন্ধকার)বাবা যখন টিভি দেখছিল, আমার চোখ কান দুটোই চলে গেল ওখানে।সংবাদ দেখে আমি হা হয়ে গেলাম। অভিজিৎ রায়(না, মরেননি)চৈতন্য রূপ থেকে ধারন করেছেন জড় রূপ।তখন আমার মাথায় শুধুই একটা কথা ঘুরছিল-মানুষটা গেল কেন? আরও অনেক অনেক বই লিখে দেবে আমাকে……।
মা আমাকে ইন্টারনেটে বিজ্ঞান ব্লগগুল পড়তে দিত। কিন্তু গোটাকতক বিষয়ের লেখা পড়ে আমার ক্ষুধা মিটত না। নেট ঘাটতে ঘাটতে শেষমেষ পেয়েই গেলাম আমার সোনার হরিন… মুক্তমানা ব্লগ!!আমার পড়া প্রথম ব্লগটা ছিল ‘স্ববিরোধী বীবেকানন্দ’ সেরেফ সময় কাটানর জন্যে যে কাজটা করেছিলাম আজ কিনা সেটাই আমার লক্ষে পরিণত হয়েগেল! আর এভাবেই শুরু হল আমার আলোকিত হবার যাত্রা।
আমি যখনই সময় পাই মুক্তমনাতে হানা দি। মানুষটা আমার চিন্তার ভিত্তিপ্রস্তর পুরো পালটে দিয়েছেন।আগে আমি কেমন ছিলাম(আদেও ছিলাম কিনা!)সেটা আমি মনে করতে পারি না। যতই আমি অন্ধকার থেকে আলোর পানে যাচ্ছি ততই যেন জানা পৃথিবী থেকে ক্রমশ অজানা পৃথিবীর দিকে ধাবিত হচ্ছি।আর অনুভব করতে পারছি …এই অজানা অচেনা রহস্যাবৃত জগতটাই আসল জগত, যেখানে কোন মিথ নেই কিংবা নেই কোন উগ্র বিশ্বাসের মায়াজাল।আর এই জগতটা আমাদের কল্পনার থেকেও অনেক অনেক সুন্দর আর বড়। আর সেখানে আমরা কত্ত ছোট। আমি মনে করি কেউ যদি একবার এই সত্যকে মনে ধারন করতে পারে তাহলে সে কোনদিন পাপ করতে পারবানা।
জীবন ও জগত সম্পর্কে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল।এই মানুষটা তার সব জবাব জানত। আমি ডাইরি লিখি। ২০১৪ সালের ডাইরি তে আমি কিছু প্রশ্ন লিখে রেখেছিলাম।পরে আমি অবাক হয়ে দেখি প্রায় সব প্রশ্নের উপর এই মানুষটা রীতিমত একেকটা বই ই লিখে ফেলেছেন!! প্রশ্নগুল ছিল
১ আমাদের জীবনের উদ্যেশ্য কি?
২ জন্ম মৃত্যু কি?
৩ প্রেম ভালবাসা কি এবং কেন?
৪ আমি কে?এ বিশ্বজগতে আমার অবস্থান কি?
৫ আলোর বেগ যত তত কেন? কম বেশি হলে কি হত?
৬ what is happening?
৭ who and where is god?
কিছুদিন আগেও আমি যখন মুক্তমনার পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়াতাম এক ধরনের শিহরণ অনুভব করতাম। তাঁর লেখা কমেন্টগুলোতে তাঁকে জীবন্ত মনে হত। আমি তাঁর কাছের কেউ নই, কোনদিন সামনাসামনি দেখি নি তাঁকে কিন্তু(মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশির মত শোনালেও) প্রায় তিনটা মাস আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম।অবুঝ বালিকার মত প্রশ্ন করতাম…কেন?কেন?কেন?…আমারই এত কষ্ট হচ্ছে, তাহলে তাঁর পরিবারের মানুষগুলো না জানি কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।আমাকে ত আমার মা বলত-‘অভিজিৎ রায় তকে গ্রাস করে ফেলেছে’।আর আমি তখন বলতাম- যদি তাই হয় তবে আমি অনেক খুশি হব’,এই মানুষটার সান্নিধ্য মানে তাঁকে অন্ধবিশ্বাস করা না বরং অন্ধবিশ্বাসকে দূর করা! আমি তাঁর মত জ্ঞানী নই,অত বই পড়িনি, অতি তুচ্ছ আমি।কিন্তু আমার একটা বিষয় হল আমি সত্যিই মানুষটাকে ফীল করতে পারি।আর আমি মনে করি এই ফীল করতে পারাটাই আসল। সবাই সবাইকে ফীল করতে পারে না। গত ১০জুলাই আমি তাঁকে নিয়ে একটা ছবি(দ্বারথবোধক) ছবি এঁকেছি। এখানে দিয়ে দিলাম।
হাতের মাঝে আঘাত লাগলেও আঙুলগুলো যেমন কিছু করতে পারে না, আমরা আজ সেরকমই সমস্ত অপরাধ চেয়ে চেয়ে দেখি!
আমি এখন আমার জীবনটাকে একটা ভ্রমণের মত করে দেখি। যেন আমি পাহাড় বেয়ে উঠছি-আলোর পাহাড়, জ্ঞানের পাহাড়।কোনদিন কোন বিষয়ে আমি এতো আনন্দ পাইনি! আমি তাঁর কাছে এমন ঋণেই ঋণী যে সেটা কোনদিন শোধ করা যাবে না, আর কারকার কাছে ঋণী থাকতে ভালো লাগে।
আমার অবস্থান অতি ক্ষুদ্র। তুচ্ছ আমি।আমি কিই বা করতে পারি? কিন্তু এরকম অনেকগুলো আমি যদি এক হয়ে যায়, তখন কিন্তু তাদের আর আটকে রাখা যায় না।আমার দুঃখ এই জায়গায় যে শক্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা অক্রিয়, তাকিএ থাকা সত্ত্বেও আমরা ঘুমাচ্ছি…না ভুল বল্লাম-আসলে আমরা ঝিমাচ্ছি!আমি যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবার দ্বারা শিশু নির্যাতনের ভিডিও দেখলাম,তখনি পত্রিকার অফিসে জানাবো…কিন্তু না, আমি পারিনি!কারন আমার মা আমাকে করতে দেয়নি।আমাকে বলেছে যে আমরা যেহেতু সাধারণ মানুষ, তাই আমরা কিছু করতে পারি না!কি আর করা? মানুষ বড়ই বিচিত্র! বাঙালি বলে কথা! আমরা আগুনে দঘধ হলে যন্ত্রণায় ছটফট করবো আর তারপর এক সময় ওই ওই দগদগে যন্ত্রণার ঘা শরীরে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকতে শিখে নেব। তবুও ভুলেও কখনো ওই আগুন নেভাতে যাব না!সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই বাঙালি!!
আনেক তো ধর্ম নিয়ে কচকচি করে।তা বাবারা, এতই যদি ধর্ম মান, তাহলে হাতে ছুরি-চাপাতি ধরো কেন? আমি আমার আশেপাশের মানুষদের জিজ্ঞেস করি-‘ব্লগ লেখার কি ইচ্ছা আছে?’ অধিকাংশ উত্তর দেয়-‘পাগল?মরব নাকি?!!’এই হচ্ছে আমাদের মনভাব,তাহলে আমাদের গন্তব্য কথায়? ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটা আমি পড়েছি আমার বন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে(ওর বাবার বই)।আমার বন্ধুরা এখন আমাকে পাগল আর আতেল বলে ডাকে।যখন দেখি, আমার বন্ধুর অসুখ সারার পর হিজাব পরতে শুরু করে, তখন আমি কিছুই বলতে পারি না। স্কুলে স্যার যখন বলেন স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর স্বর্গ, আমি প্রতিবাদ করতে পারি না। আমাদের তৈরি সমাজব্যাবস্থাতে আজ আমরাই বন্দী। ছোটবেলা থেকেই আমাদের মগজধোলাই শুরু।যে দুই একজন এই প্রথা ভাঙতে যাবে তারা কিনা হবে ভিলেন!!!
‘অভিজিৎ রায়’ আমার কাছে শুধু একজন মানুষের নাম না, একটি চেতনার নাম, আশার আলো, চলার পথ। হয়তো আমি এখনও পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারিনি,কিন্তু আমি বলতে পারি ‘স্বপ্ন দেখি-চোখ বুজে, চোখ খুলেও।লেখলেখি করার চেষ্টা করি। বিতর্ক ভালবাসি।’ আমি স্বপ্ন দেখি একদিন জগতের সব রহস্য অনাবৃত করবো, পৃথিবীতে কোন ভেদাভেদ থাকবে না মানুষে মানুষে।আমার আগামিদিনের চলার পথটা খুব কঠিন। আমার বন্ধু আমাকে বলে,’কেন তুই এমন?কেন তুই আমার মত,আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত স্বপ্ন দেখতে পারিস না…’ প্রশ্নটা আমার মনে দাগ কেটেছিল। সহজ জীবন রেখে কেন আমি নিজেকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে চাই? আমিও তো চাইতে পারতাম- সাজানো সংসার, মিলন-বিরহ, শিশুর মুখের আধো আধো বোল…।কিন্তু মানুষ কৌতূহলী প্রাণী। সংসার, পুরুষ, ভালবাসা, প্রেম এগুলর কৌতূহল যখন মিটে যায়, তখন মেয়েটা নিজেকে আবিষ্কার করে কারাগারে।শ-কেসের পুতুল হয়ে থাকতে থাকতে যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠে। আবার অনেকে নিজেদের অবস্থাকে নিয়তি(!!) বলে মেনে নেয়।
একসময় আমি খুব চিন্তিত থাকতাম- যদি আমার এই সদ্যজাত চেতনার মৃত্যু ঘটে? আমি যদি অন্ধকারের দুঃস্বপ্ন থেকে বের হয়ে আস্তে না পারি? এর চেয়ে তো শারীরিক মৃত্যুও অনেক ভালো! এখন আর ভিয় পাই না।যতদিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন আমার মধ্যে একটা সুন্দর উজ্জ্বল আলো থাকবে। আর সেই আলোর নাম…… ‘অভিজিৎ রায়’
আপনাকে শুভ জন্মদিন……এই ফাঁকে বলে রাখি আমার জন্মদিন ১৩ সেপ্টেম্বর!!!!
:good:
অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার লেখা। আপনার ছবিটা খুব অর্থপূর্ণ। মুক্তচিন্তা চালিএ যান। আমাদের জয় একদিন হবেই।