এক.

কিছুদিন আগে বিজ্ঞানযাত্রা পত্রিকার সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মাসুম মুক্তমনায় একটি পোস্ট লিখেছিলেন। এই বছরই কয়েকজন বিজ্ঞানের ছাত্র মিলে এই পত্রিকাটির সূচনা করেছে, উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ক্রমসংকুচিত বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে একটি বিপরীত প্রচেষ্টা জারি রাখা। পত্রিকার পাশাপাশি আমরা অনলাইনে বিজ্ঞানযাত্রা নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছি যেখানে যে কোন বিজ্ঞান সম্পর্কিত লেখালেখি করা যাবে। যে কোন বিজ্ঞান-উৎসাহী ব্যক্তিই সেখানে একটি আইডি খুলে লিখতে পারবেন। আমাদের বিশ্বাস এর মাধ্যমে তরুণ ও প্রবীন উভয় প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মস্তিষ্কগুলোকে আমরা এক জায়গায় করতে পারব, যারা সকলেই বিজ্ঞানের ছাত্র।

সম্প্রতি ফেসবুকে কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার সাথে আমরা প্রাসঙ্গিকভাবেই জড়িয়ে গেছি। বাংলাদেশিজম নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে OMG! The Science Show নামে একটি ইউটিউব শো করা হয়। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক শো এমনিতেই হাতেগোনা, তাই স্বভাবতই আমরা আগ্রহী হই। এ পর্যন্ত তারা ১২টি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যার শিরোনামগুলো নিম্নরূপ:

  1. রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গালের ১০টি সত্য ঘটনা!!!!
  2. মানুষের চন্দ্রাভিযান মিথ্যা ছিল?
  3. মানব শরীর রহস্য
  4. পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ১০টি দেশ
  5. এখনও বেঁচে আছে ডাইনোসর!
  6. চোখ ধাঁধানো মানব শরীর ফ্যাক্টস
  7. স্বপ্ন রহস্য – স্বপ্ন কি আসলেই সত্য হয়?
  8. Black Knight Satellite
  9. পাওয়া গেল নতুন পৃথিবী!!
  10. যে প্রশ্নের উত্তর জানে না কোন মানুষ
  11. পৃথিবীর অভ্যন্তরের কিছু অবাক করা অজানা রহস্য!
  12. বিগ ব্যাং – মহাবিশ্বের সৃষ্টি | কিন্তু তার আগে কি হয়েছিল?

তাদের এই ভিডিওগুলোর কথা আমরা জানতে পারি মাসরুফ হোসেনের স্ট্যাটাস থেকে, যেখানে তাদের সর্বশেষ ভিডিওটির সমালোচনা করে মাসরুফ লিখেছেন:

সায়েন্টিফিক থিওরি নিয়ে এত এত কথা বলার পর সবশেষে নাহিদ সাহেব বললেন, “আমার ধারণা, সব কিছু সৃষ্টি করেছেন উপরওয়ালা। উপরে একজন বসে আছেন, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন”
আমি আস্তিক নাস্তিক বিতর্কে যাচ্ছিনা- কিন্তু একটা সায়েন্স শো তে এসে বিগ ব্যাং থিওরি ব্যাখ্যা করার সময় কেউ যখন এটার সাথে ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস মিলিয়ে বানী দেয়- তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমি প্রচন্ড সন্দীহান হয়ে পড়ি।
এই ভদ্রলোক খুব ভালভাবেই জানেন, বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষ সায়েন্সের সাথে তাঁর এই ধর্মবিশ্বাস মেলানো কথাবার্তা খুব আগ্রহ নিয়ে গিলবে, তাই এই কাজটি তিনি করেছেন।
প্রিয় পাঠক, দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমি ধর্মবিশ্বাসকে খাটো করছিনা।
কিন্তু বিগ ব্যাং থিওরি ব্যাখ্যা করার এক পর্যায়ে এর মধ্যে যখন ধর্মের মাখন লাগানো হয়- জিনিসটা পচে গলে পুরো গন্ধ বেরিয়ে পড়ে।
“বিগ ব্যাং-এর আগে কি হয়েছিল, জানার প্রয়োজনও নেই এ মুহূর্তে”- এ টাইপ কথা বলে নাহিদ সাহেব যখন অনুষ্ঠানটি শেষ করলেন, আমার মনে হল শ্যাওলা ধরা মলমূত্রযুক্ত কোনও ড্রেনের দুর্গন্ধে আমার পুরো ল্যাব ভরে গেল।
বিজ্ঞানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে অনুসন্ধিৎসা, অজানাকে জানার প্রচন্ড আগ্রহ এবং আমৃত্যু সাধনা- যে সাধনার ফলে মানব জ্ঞান বিজ্ঞান এতদূর এসেছে।
আর সায়েন্স শো নামের এই নোংরা বস্তুটি শেষে মেসেজ দিচ্ছে, “জানার প্রয়োজন নেই”।
দুর্দান্ত মানের ভিডিও এডিটিং আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সেইসাথে চটকদার কথাবার্তা মিলিয়ে এই মলমূত্র আবার খাওয়ানো হচ্ছে বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরকে- যারা এগুলো বেদবাক্য হিসেবে মেনে নিচ্ছেও!

মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে বিগ ব্যাং তত্ত্বের ওপর অনেকেরই আগ্রহ আছে। কিন্তু এই তত্ত্বটি নিয়ে অধিকাংশ মানুষের জ্ঞানই ভাসাভাসা। মোটা দাগে আমরা জানি যে “অনেকদিন আগে একটা মহাবিস্ফোরণ হয়ে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে সৌরজগতের সৃষ্টি হয়েছে। এই সৌরজগতের পৃথিবী গ্রহে আমাদের বসবাস।” ব্যস!

OMG! The Science Show-এর পর্বটি দেখতে গিয়ে দেখলাম অসংখ্য ভুল তথ্য এবং সরলীকরণ করা হয়েছে। এক বিষয়ের সাথে আরেক বিষয় মিলিয়ে ফেলা হয়েছে। ভিডিও বানানোর আগে যে ন্যূনতম পড়াশোনা করে নেয়া প্রয়োজন, তা নির্মাতারা করেন নি। শুধু তাই নয়, প্রায় পাঁচ মিনিটের ভিডিওতে তিন মিনিট পরই উপস্থাপক ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে দর্শকের ওপর চাপিয়ে দিলেন! বললেন:

তবে আমার জন্য ব্যাপারটা সহজ। আমার ধারণা, সবকিছু সৃষ্টি করেছে ওপরওয়ালা। ওপরে কেউ একজন বসে আছেন যিনি সবকিছুই ক্রিয়েট করেছেন। বিগ ব্যাংও তিনি ক্রিয়েট করেছেন। মহাবিশ্বও তিনি ক্রিয়েট করেছেন। প্রতিটা গ্রহ তিনি ক্রিয়েট করেছেন। আমার জন্য ব্যাপারটা ইজি। কিন্তু…
অনেকে বিশ্বাস করতে চান না, যে পৃ… এই মহাবিশ্ব হয়তো কেউ বানিয়েছে। তাদের ধারণা হয়তো অন্য কোনভাবে এসেছে। বাট হোয়াটেভার ইট ইজ, উই হ্যাভ নো আইডিয়া। হোয়াট হ্যাপেনড বিফোর বিগ ব্যাং।…
… হয়তো আমরা কখনো জানবো না বিগ ব্যাংয়ের আগে কী হয়েছিল। কিন্তু আমার মতে, জানার প্রয়োজনও নেই আমার এই মুহূর্তে। পৃথিবী নিয়েই আমি অনেক হ্যাপি। এবং আশা করি আপনারাও হ্যাপি।

বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ঘটেছিল, সেটির কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না করে তিনি সরাসরি অতিপ্রাকৃতিক শক্তির দোহাই তুলে বললেন আমাদের এই রহস্য উদ্ঘাটনের কোন প্রয়োজনই নেই। তিনি এই পৃথিবী নিয়ে হ্যাপি আছেন। আমাদেরও হ্যাপি(!) থাকা উচিত।

মাসরুফ হোসেন পোস্ট দেয়ার পরে সাধারণ ফেসবুক ইউজাররাই বাংলাদেশিজমের এই ভিডিওর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মন্তব্য করতে শুরু করেন। ভিডিও নির্মাতা মোঃ মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদ ওরফে নাহিদরেইনস(!)-এর ফেসবুক পেইজ ও বাংলাদেশিজম পেইজে অসংখ্য মানুষ প্রতিবাদ মন্তব্য করেছেন। মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদ সেসব মন্তব্য মুছে তাদের অনেককেই ব্লক করে দিয়েছেন, মন্তব্য মুছে দিয়েছেন ইউটিউব ভিডিওর কমেন্ট সেকশন থেকেও। হেলাল উদ্দিন নাহিদের এহেন ভিডিও এবং তার প্রতিক্রিয়াকে মুখ চেপে ধরার প্রক্রিয়া দেখে আমরা বিজ্ঞানযাত্রার সদস্যরা একটি বিজ্ঞানকেন্দ্রিক সমালোচনা ভিডিও বানানোর পরিকল্পনা করি। মানুষ যতই প্রতিবাদ করুক না কেন, তা মূলত ক্ষণস্থায়ী। এই ভিডিওটি আগে পরে যারা দেখবেন, তারা ভুল ধারণা পাবেন। বিগ ব্যাং থিওরির ব্যাপারে কোন আইডিয়া না থাকাও এসব ভুল ধারণার চেয়ে শ্রেয়। সে উদ্দেশ্য থেকে আমরা তার ভুল বক্তব্যগুলোকে খণ্ডন করে সঠিক তথ্য তুলে ধরি আমাদের ভিডিওতে। আমাদের ফোকাস ছিল বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক সত্যে, বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল যেন আমাদের ভিডিওটিকে ভুলভাবে না নেয়া হয়। সে ভুল বুঝাবুঝি এড়াতে শুরুতেই আমরা বলে নিয়েছিলাম, যে এটি মূলত তথ্যের বিভ্রাট সংশোধনের নিমিত্তেই বানানো হচ্ছে, ব্যক্তি নাহিদ বা বাংলাদেশিজম প্রজেক্টের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। ভিডিওটি মাত্র দুই দিনেই ফেসবুক ও ইউটিউব মিলিয়ে দেখেছেন প্রায় পৌনে দুই লক্ষ মানুষ। ফেসবুকের ভিডিওটি শেয়ার হয়েছিল দেড় হাজার বারেরও বেশি।

কিন্তু আমাদের সেই উদারতার সুযোগ নিলেন মোঃ হেলাল উদ্দিন নাহিদ। তার ভিডিও ভুলভাল তথ্যগুলো তুলে ধরার পরও তিনি কোন জবাব দেন নি। বরঞ্চ ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে নালিশ জানিয়েছেন কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের। আমাদের ১৩ মিনিটের ভিডিওটি নাকি তার পাঁচ মিনিটের ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘন করেছে। তার ভিডিওর থেকে শুধুমাত্র ভুল অংশগুলো নেয়া হয়েছিল, এবং তারপর আমাদের মৌলিক স্ক্রিপ্টকে যোগ করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ করে নি। আমাদের ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ দেয়া হয় নি। কেবল হেলাল উদ্দিন নাহিদের অভিযোগের ভিত্তিতেই ভিডিওটি মুছে দিয়েছে, মুছে আমাদেরকে ইমেইল করে জানিয়েছে। ফেসবুকের বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের ভিডিওটি ফিরিয়ে আনতে হবে জনাব নাহিদের সাথেই যোগাযোগ করতে হবে। তিনি অভিযোগ তুলে নিলেই শুধুমাত্র তারা ভিডিওটি ফিরিয়ে দিবে। আমাদের কোনপ্রকার অ্যাপিলের কোন অপশনও তারা রাখে নি। এরকম বিদ্ঘুটে শর্ত ও হাস্যকর পরিস্থিতি হতে পারে তা আমাদের ধারণা ছিল না।

যা হোক। যস্মিন দেশে যদাচার। ফেসবুকের তথাকথিত কপিরাইট যেন লঙ্ঘিত না হয়, সে ব্যবস্থা করে আমরা আবারও ভিডিওটি আপলোড করবো। ইউটিউবে ভিডিওটি এখনও আছে। এইদিক দিয়ে ইউটিউবের নিয়মকানুন বেশ ভাল দেখেছি। মাথামোটার মত বিনা নোটিসে ভিডিও ডিলিট করে দেয় না, বরং মগজের কিছুটা ধূসর বস্তু কাজে লাগায়।

দুই.

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কেটে গেছে, এখন কিছু বিশেষ নির্যাস পাই এই পুরো ঘটনা থেকে (যে কারণে মুক্তমনায় এই পোস্টের অবতারণা)।

১। বাংলাদেশের সমাজে বিজ্ঞান নিয়ে জনপ্রিয় মতামতগুলো প্রচণ্ড ভুল ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে।
২। এই সকল ভুল ধারণাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করে কিছু ধুরন্ধর চতুর সুবিধাবাদীরা।
৩। এ সকল সুবিধাবাদীরা সাধারণ মানুষের আবেগকে ম্যানিপুলেট করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।
৪। প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে এদের মূল প্ল্যানকে এক্সপোজ করা বেশ কঠিন, কারণ সাঙ্গপাঙ্গের দল হামলে পড়ে।
৫। বাংলাদেশে সঠিক তথ্যের চেয়ে তথ্যটিকে কতটা চটকদার করে পরিবেশন করা হচ্ছে সেটা বেশি জরুরি।
৬। বিজ্ঞান বিষয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে জানার আগ্রহও প্রবল। এবং এই বিষয়ে মানসম্পন্ন কনটেন্ট নেই বললেই চলে।
৭। ওয়ান-টু-ওয়ান খোঁচাখুঁচিতে আসলে মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। শুকরের সাথে কাদায় নেমে লড়াই করার তাকত থাকলেই যে লড়াইয়ে নেমে পড়তে হবে এমন কোন কথা নেই।

এই কথাগুলো গতকাল থেকেই বারবার করে ভাবছি। ভাবনা এতটাই জ্বালাচ্ছে যে না লিখে পারছিলাম না। বিজ্ঞানযাত্রার সাথে আমার জড়িয়ে পড়া হুট করেই। কিন্তু গত এক সপ্তাহের ঘটনাচক্রে কেমন একটি জেদ চেপে যাচ্ছে। প্রভাবশালী বলয়কে কাজে লাগিয়ে এমন কত প্রচেষ্টাকে রুখে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাতে কেউই থেমে থাকে নি। দিন শেষে সত্যের জয় হয়, যদি সত্যের সপক্ষের মানুষগুলো লেগে থাকে।

বিজ্ঞানযাত্রার পেছনে ও সাথে যারাই আছেন, সকলেই মোটামুটি একমত যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ ও সুন্দর পরিবেশনার ভিডিও সিরিজ বানাতেই হবে। তাই এই বিষয়ে এর মধ্যেই আমরা রান্নাঘরে মশলাপাতির কাজ শুরু করে দিয়েছি। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অনেকগুলো পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এগুলো দেখে উৎসাহ পাই এবং আশাবাদী হই ভবিষ্যৎ নিয়ে। মুক্তমনায় অনেক সহব্লগারই বিজ্ঞানযাত্রার কথা জেনে যোগাযোগ করেছেন, মাসুমের পোস্টে মন্তব্য রেখে উৎসাহ দিয়েছেন। তাই মনে হলো আমাদের চলমান লড়াইয়ে পর্দার পেছনের ঘটনাগুলো আপনাদের সকলকে জানাই। কাদের সাথে আমাদের লড়াই চলছে, এটা জানা থাকলে কর্মপন্থা গুছিয়ে নিতে সুবিধা হয়।

এই লড়াইয়ে অংশ নিতে আগ্রহীরা আমাদের ফেসবুক পেইজে বা ব্লগে যোগ দিতে পারেন। পাঁচ আঙুল একত্রে জড়ো হলেই মুঠো তৈরি হয়!