গত ২ জুলাই, ২০১৫ তারিখে ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশন আয়োজিত এই বছরের ঐতিহ্যবাহী ভলতেয়ার বক্তৃতা দেবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা প্রাঙ্গনে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের চাপাতির হামলায় অভিজিৎকে হারিয়ে ফেলার পর আমি নিজেই যখন নিজের মাথায়, হাতে, আঙ্গুলে চাপাতির আঘাতের চিকিৎসা নিচ্ছি হাসপাতালে তখন বিবিসির একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি চুপ করে থাকবো কিনা? উত্তরটা আপনারা সবাই জানেন, না। অভিজিতের সমাজ সংস্কারের আলোর মশাল আজ আমাদের হাতে, আমরা চুপ করে থাকলে অভিজিৎকে যারা মেরেছিলো ওর আদর্শকে হত্যার জন্য তারাই জয়ী হবে। অন্ধকারের চাপাতির সামর্থ্য নেই আলো নেভানোর।

শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও অভিজিৎ, বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুক্তমনা আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। অনুষ্ঠান স্থলে দূর-দূরান্ত থেকে প্রায় ছয়শ মানুষ উপস্থিত ছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে আমার ধারণা একদমই নেই, তবে আয়োজকের মাধ্যমে জেনেছিলাম আমার ভলতেয়ার বক্তব্যের সময় অনুষ্ঠানটি টুইটারে যুক্তরাজ্যের “ট্রেন্ডিং” টপিক ছিলো। উপস্থিতি মানুষজনের প্রতিক্রিয়া কিছুটা জানতে পারবেন “রায়হান রশীদ” এর এই পোস্টে। এছাড়া নিক-কোহেন গার্ডিয়ানে একটি নিবন্ধ লিখেছন, সেটা পাওয়া যাবে এখানে

ইংরেজিতে লেখা হলেও বাংলাতেও আমার বক্তব্যটা মুক্তমনা পাঠকদের উদ্দেশ্যে দেবার ইচ্ছা ছিলো। মূলত বক্তব্যের ভিডিওটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি। কিন্তু সেটা এখনও এসে না পৌঁছানোয় বাংলায় বক্তব্যটা আপনাদের জন্য পোস্ট করলাম।

2015 05 06 LW v1 FB preview card

শুভসন্ধ্যা সবাইকে,

আমি শুরুতেই ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাকে আপনাদের সাথে আজকে কথা বলার জন্য আমন্ত্রন জানানোর জন্য।

আমার প্রয়াত স্বামী ড: অভিজিৎ রায় এবং আমি বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক, মানবতাবাদী এবং আমরা বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা ইসলামি মৌলবাদের সাম্প্রতিক শিকার। অভিজিৎ এবং আমি, এ বছর ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে, অমর একুশে জাতীয় বইমেলায় অংশ নিতে আমাদের জন্মস্থান বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। এটি বাংলাদেশের মাসব্যাপি উদাযপিত জাতীয় বই উৎসব, হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহন করে এই বইমেলায়।

ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ রাতে জনাকীর্ণ এবং আলোয় আলোকিত বইমেলা থেকে আমরা যখন গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম,তখন ইসলামি মৌলবাদিদের একটি দল অভিজিৎ এবং আমার উপর চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে হামলা চালায়। রাস্তার ধারে আমাদের কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। আক্রমনের এলাকাটি বহু পুলিশ এবং নিরাপত্তা ক্যামেরা দিয়ে ঘেরা ছিলো। হাজার হাজার মানুষও ছিলো সেখানে। কিন্তু কেউ তখন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি। কাছেপিঠে পুলিশও দাঁড়িয়েছিল। একজন তরুণ সাংবাদিক আমাদের রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান, তার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। হাসপাতালে নেবার পর অভিজিৎ মারা যায়। ঘাড় ও মাথার চার জায়গায় চাপাতির কোপে গুরুতর জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যাই আমি। তবে হারাতে হয় একটি বৃদ্ধাঙ্গুল, ক্ষতবিক্ষত হয় আমার দুই হাত, আঙুল এবং শরীরের বেশ কিছু জায়গা। ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু এবং শিরা-ধমনি ঠিক করতে এরমধ্যেই একাধিকবার অপারেশন করতে হয়েছে। ঘটনার চার মাসের একটু বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও এখনো আমার চিকিৎসা চলছে।

অভিজিৎ এই চাপাতিবাজ খুনিদের সবচেয়ে নামকরা শিকার হলেও ও প্রথম শিকার তো নয়ই, এমনকি শেষ শিকারও নয়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ওকে হত্যার পরপরই ইসলামি মৌলবাদীরা আরো দুজন বাংলাদেশি মানবতাবাদী ব্লগার-লেখককে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে, অর্থাৎ, কয়েকজন মিলে একইভাবে রাস্তার ধারে পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করে। ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ৩০শে মার্চ। পুলিশ নয়, উপস্থিত জনগণ দুইজন আততায়ীকে ধরে ফেলে। পরবর্তীতে তারা স্বীকার করেছে যে, ওয়াশিকুরের কোনো ব্লগ না পড়েই মাদ্রাসার হুজুরের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি আবার পরে আসছি। এর পর ১২ই মে অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয়। অভিজিতের মত অনন্তও বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে লেখালিখি করত এবং ‘যুক্তি’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করত। ও আমাদের খুব কাছের মানুষ ছিলো, আমাকে বন্যা আপা ডাকতো এবং একসাথে অনেক বছর ধরে কাজ করেছে আমাদের সাথে। যতদূর জানি, এখন পর্যন্ত ৮ জন সেক্যুলার কর্মী, ব্লগার ও লেখকের উপর আক্রমণ চালিয়েছে ওরা। এদের মধ্যে রয়েছে ২০১৪ সালে প্রফেসর শফিউল ইসলাম, ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার, ২০১৩ সালে আসিফ মহিউদ্দিনের উপর ব্যর্থ আক্রমণ, আর ২০০৩ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণতো আছেই।

এই হচ্ছে এখনকার “বাস্তবতা”। এবার আমি অভিজিতের জীবন, তার কাজকর্ম, লেখালিখি এবং আমাদের একসঙ্গে কাটানো জীবনটা সম্পর্কে কিছু বলব। তারপর আবার ফিরে আসবো সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায়।

আগে দুটো ব্যাপার উল্লেখ করে নেই। প্রথমত, ইংরেজি আমার দ্বিতীয় ভাষা, যদিও বেশ কিছুদিন ধরেই এ ভাষায় কথা বলছি। আমার ইংরেজি উচ্চারণ বাংলাদেশি ইংরেজি, দেশে আমদানীকৃত হাজারো মার্কিন সিটকম, কানাডিয়ান, মিনেসোটান এবং সর্বোপরি আমাদের ‘সুপ্রিয়’ বাইবেল বেল্ট তথা ইউএস-এর দক্ষিণাঞ্চলের উচ্চারণের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। যদি আমার কথার কিছু বুঝতে আপনাদের সমস্যা হয় সেটা দয়া করে লিখে রাখবেন। বক্তব্য শেষে জিজ্ঞেস করলে আমি সানন্দে ব্যাখ্যা করবো। আর দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে: আমি খুবই, জানিনা এখানে সঠিক শব্দটা কী হবে, আমি এখন খুবই বিক্ষিপ্ত, আমার জীবন বিক্ষিপ্ত, খুবই বিক্ষিপ্ত আমার মানসিক অবস্থা। অভিজিতের মৃত্যুর পর মাত্র ৪ মাস পেরিয়েছে। ও ছিলো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, ছিলো আমার সব ভালো এবং মন্দ কাজের সঙ্গী, ও ছিলো আমার সুখে-দুঃখে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এবং ভালোবাসায়।

অভিজিৎ, অভি বলেই ওকে ডাকতাম আমি, ২০০১ সালে যখন সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে পিএইচডি করছিলো, তখনই বাংলায় প্রথম ‘মুক্তমনা’ নামে মুক্তচিন্তার একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলে। মুক্তমনা শুধু একটা ব্লগ ছিলো না, ছিলো একটা মঞ্চ, একটা গোষ্ঠী। খুব অল্প সময়েই মুক্তমনা বাংলাভাষাভাষীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী আন্দোলনের মুখপত্র হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। অভির সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০০২ সালে, এই মুক্তমনার মাধ্যমেই। এর পর থেকে বেশিরভাগ প্রকল্প এবং লেখালিখি আমরা মিলেমিশেই করতাম। আমরা একত্র হয়েছিলাম মানবতাবাদের নীতিতে। কিন্তু আবার কিছু মৌলিক বিশ্বাস এবং নীতিগত অবস্থানের ব্যাপারে আমাদের তীব্র মতবিরোধও ছিলো, আমরা সেগুলো নিয়ে আমরা বিতর্ক করতাম, আমার ধারণা যে কোন মানবতাবাদী ব্যক্তি সেটা করতে বাধ্য। আমরা লেখালিখি, বিশেষ করে মানবতাবাদের বিভিন্ন আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এতটাই প্রাণ ঢেলে বিতর্ক করতাম যে অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের মেয়ের ধারণা ছিলো যে আমরা বুঝি সারাক্ষণ ঝগড়া করি! তার বেশ কয়েক বছর লেগেছিলো এটা বুঝতে যে আমাদের এই ঝগড়ারূপী বেশিরভাগ আলোচনা, সব নয় অবশ্যই, মূলত দার্শনিক বিতর্ক, কোনো দাম্পত্যকলহ নয়।

অভি ছিলো একজন নাস্তিক, একজন ব্লগার, লেখক সর্বোপরি একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী যার আগ্রহ ছিলো জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান। বিজ্ঞান নিয়ে লিখতেই সবচেয়ে ভালোবাসতো ও; শেষ বইটা লিখেছিলো শূন্য থেকে কেমন করে মহাবিশ্বের উৎপত্তি হতে পারে তার সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক ধারনা নিয়ে। অভি বই লিখেছে জীবনের উৎপত্তি নিয়ে, লিখেছে সমকামীতার বৈজ্ঞানিক কারণ নিয়ে, লিখেছে ভালোবাসা নিয়ে অবশ্যই বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে। সাহিত্য নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলো অভি, একটা বই লিখেছিলো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আর্জেন্টিনিয়ান নারীবাদি লেখক ভিকতোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে। কিন্তু ওর দুইটি বই- “অবিশ্বাসের দর্শন” এবং “বিশ্বাসের ভাইরাস” পাঠকপ্রীতি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি, আলোচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। একদিকে এই বইদুটোর কারণে ও খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে বাংলাভাষী মুক্তমনা পাঠকদের কাছে আবার ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের কাছে হয়েছে চরম ঘৃণা আর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।

আমরা বাংলায় লেখালিখি করতাম কারণ আমরা বিজ্ঞান, দর্শন ও শিল্পসাহিত্যের মৌলিক এবং অত্যাধুনিক বিষয়গুলো এই ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। কয়েক বছর আগে আমি “বিবর্তনের পথ ধরে” নামে জৈববিবর্তনের উপর একটি বই প্রকাশ করি। অভি বেঁচে থাকতে অসংখ্য প্রবন্ধ, ব্লগ লিখেছিল। লেখালিখি ছিলো তার ধ্যান-জ্ঞান, তার জীবন; সত্যি বলতে সে কথায় নিজেকে যতটা না ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারত তার চেয়ে ঢের ভালো পারত লিখে প্রকাশ করতে! এমনকি সে মুখের ভাষায় আমার সাথে যোগাযোগ করতে এতটাই ব্যর্থ হতো যে আমরা আমাদের এই ১৩ বছরের ছোট্টো কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর জীবনে প্রায়ই হাতেলেখা চিঠি আদান প্রদান করতাম নিজেদের মাঝে। অভিজিৎ শুধু বিজ্ঞান ও নাস্তিকতা নিয়েই লিখত না, সব রকম কুসংস্কার, অবিচার, অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক বিশ্বাসের বিরূদ্ধেও লিখত। ও লিখতো সমাজের সকল অবিচার ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে, ওর লেখার বিষয়বস্তুর ব্যপ্তি ছিলো সীমাহীন। ও লেখালিখি করেছে নারী অধিকার (হাইপোশিয়ার উপর একটি হৃদয়গ্রাহী নিবন্ধ লিখেছিলো) থেকে শুরু করে, জাতীয়তাবাদ, ইসলামি মৌলবাদিদের দ্বারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার, ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদ, আবু গারাইব কারাগারের নির্যাতন, গুজরাট ও প্যালেস্টাইনে গণহত্যা, এমনকি বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনির দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর উপর নিয়মতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদি নির্যাতনের বিরদ্ধে। অভিজিৎ গত বছরের শুরুতে আমেরিকার ইউএনসি চ্যাপেল হিলে গোলাগুলির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছিল, ফেসবুকে নাস্তিকতার প্রচার চালাতো এমন এক ব্যক্তি এক এপার্টমেন্টে তিনজন শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে হত্যা করে । এ প্রসঙ্গে অভি লিখেছিলো-

নাস্তিকতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো অতিপ্রাকৃত দেবদেবীতে বিশ্বাস না রাখা। অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক বিশ্বাস কোনো নাস্তিকের থাকা উচিত নয়। স্রেফ নাস্তিক হলেই একজন সব রকম বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে মুক্ত হয়ে যায় না, যদি না তার মানবতার প্রতি সহানুভূতি থাকে। কেউ ধার্মিক কি ধার্মিক নয় সেটা ব্যাপার না, অসহিষ্ণুতার উপস্থিতি সবত্র। ইতিহাসে দেখা যায়, এমন অনেক ধর্মহীন হৃদয়হীন স্বৈরাচারী শাসক ছিলো যারা অসংখ্য স্বদেশীকে হত্যা করেছে। আমরা এখন জানি, ক্রেইগ স্টিফেন হিক্স নামক একজন আছে যে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ধারণ করে। এইসব অপরাধীর কোনো ধরনের সহানুভূতি বা অজুহাত প্রাপ্য নয়। এনসি চ্যাপেল হিলের হত্যাকাণ্ড অমানবিক এবং প্রতিটি বিবেগবান মানুষের উচিত এই ঘটনাকে ভর্ৎসনা করা।

যদি ফ্রেডরিক নিটশে এখানে থাকতেন তাহলে তিনি হয়তো বলতেন অভিজিৎ, “বিজ্ঞানকে দেখেছিলো শিল্পীর চোখে আর শিল্পকলাকে দেখেছিলো জীবনের প্রেক্ষাপটে”— অর্থাৎ বিজ্ঞান ছিলো ওর ধ্যান-জ্ঞান যা দিয়ে ও জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতো আর শিল্পকলা ওর কাছে স্রেফ বিমূর্ত মূল্যহীন কিছু ছিলো না বরং ছিলো জীবন যাপনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক।

অভি ছিলো আলাভোলা ভালো মানুষ, গায়ক হিসেবে বড্ড বেসুরো, জীবনের বাস্তবতায় কিছুটা উদাসীন। একই সাথে ছিলো আদর্শ পিতা, ছিলো আমাদের মেয়ের অনুসরণীয় চরিত্র এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু। অভিজিৎ খুব ভালো করে জানতো ও কি চায়, জানতো কী করছে এবং কতোদূর যাবে। ও জানতো মাথা তুলে দাঁড়াবার ঝুঁকি কত বড়। একটা লেখায় ও বলেছিলো-

যাঁরা ভাবেন বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হবে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালেখি করছি।

এই উক্তিটি আমাদেরকে নিয়ে আসে আরো বিস্তৃত প্রসঙ্গে, গভীর ইতিহাসে। কেনো এবং কিভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হলো? কাগজেকলমে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে মানবতাবাদী-ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের রাস্তায় কুপিয়ে মারা হচ্ছে কেনো?

আমেরিকার দক্ষিণে আমাকে প্রায়ই এক ধরনের শূন্য দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয় যখন কাউকে বলি আমার আদিনিবাস বাংলাদেশে। আমি জানি আপনারা তেমন নন, তারপরও স্মৃতিটা একটু ঝালিয়ে নিচ্ছি। দুইশ বছর ধরে বাংলা ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতীয় উপমহাদেশের একটা অংশ। ১৯৪৭ সালে এই উপনিবেশ দুই দেশে বিভক্ত হয়: ভারত এবং পাকিস্তান নামে। তড়িঘড়ি করে-টানা সে সীমানা নির্ধারিত হয়েছিলো ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের বিভাজনের উপড় ভিত্তি করে। ধর্মীয় এই বিভেদে প্রান যায় লক্ষাধিক মানুষের এবং দেশান্তরিত হয় কোটি মানুষ, যা কিনা ইতিহাসে মানুষের সর্বোচ্চ দেশান্তরের দৃষ্টান্ত।

কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের এই বিভাজন শুধু দুদেশের বিভাজনই ছিলো না। পূর্ব বাংলা, যেটা পাকিস্তানের পূর্ব অংশ সেটার, ও পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের মাঝে হাজার মাইল বিস্তৃত ভারতীয় অঞ্চল ছিলো। পূর্বের মানুষের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ও ছিলো ভিন্ন। বাংলায়, বাঙালি এবং মুসলিম এই দুই আত্মপরিচয়ের এক ধরনের মিশেল ইসলাম প্রচারের ব্যাপার ছিল প্রথম থেকেই। অবশ্য বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনা বাঙালির মনের এতো গভীরে প্রথিত যে এটা অবশ্যম্ভাবী ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণ এ অঞ্চলের মানুষ একসময় আর মেনে নেবে না। যার কারণে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর এ অঞ্চলের জনমানুষের মনে স্বাধীনতার একটা আকাঙ্ক্ষাও সৃষ্টি হতে শুরু করে। পাকিস্তানি সরকার যখন বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো তখন তরুণ বাঙালিরা তাদের জীবন দিয়ে এর প্রতিবাদ করেছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার সংগ্রামে প্রাণ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের স্মৃতির সম্মানে, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস পালন করি (যেটা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয়), মাসব্যপি ভাষার উৎসব পালন করি, বই মেলা করি, যেই বইমেলা প্রাঙ্গনে নিহত হয়েছে অভিজিৎ।

১৯৭১ সালে নয় মাসের দুঃসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তান একটা স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। যার নাম বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের নতুন সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র মৌলিক নীতি হিসাবে গৃহীত হয়, যদিও বাস্তবে এদের কোনোটাই ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়িত হয় নি। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে এক অভূতপূর্ব মুসলিম আত্মপরিচয়ের উদ্ভব হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাদ দিয়ে “আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা” এবং “গণতন্ত্র” বাদ দিয়ে সামরিক শাসন স্থাপিত হয়। এতকিছুর পরেও আমার মনে আছে, সেই আশির দশকে যখন আমরা কিশোর ছিলাম তখনকার বাঙালি মুসলিমরা বেশ উদারমনা ছিলো, অন্তত বর্তমানের তুলনায়। কিন্তু ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলেছে, বাংলাদেশে উত্থান হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের।

এই উত্থানের এক বড় নিয়ামক হচ্ছে আন্তর্জাতিক ইসলামিক দল জামায়াত-এ-ইসলামী। সময়ের পরিক্রমায় শুধু যে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বেড়েছে তা নয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অর্থে—অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যও গড়ে তুলেছে তারা স্বাধীন বাংলাদেশে। জামায়াত রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বিস্তার করে মূলত ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে পুঁজি করে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি আর জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে এখন তারা এক মহীরূহে পরিনত হয়েছে। ফলে আমাদের সব সরকারই, সেক্যুলার বা নন–সেক্যুলার, কোনো না কোনোভাবে এদের কাছে মাথানত করেছে এবং করছে।

বাংলাদেশে এখন শাসক দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। কাগজে কলমে তারা এদেশের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধা পাবার নামে, তারা বারংবার ধর্মীয় মৌলবাদের কাছে মাথা নত করেছে, সাড়া দিয়েছে, পূরণ করেছে তাদের অযৌক্তিক নানা দাবি দাওয়া। যাকে বলে ভোটের আশায় স্রেফ ঘুষ দেওয়া। যদিও এবারের আগেরবার তারা ক্ষমতায় এসেছিলো কিছু সমকালীন ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিলো তাদেরকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধ বিচার আদালত গঠিত হয়। বিচারের কাজ আলো পেতে শুরু করে ২০১২-এর শেষে এসে। ২০১৩-এর শুরুর দিকে, ইসলামিস্টরা প্রচন্ড চাপে পড়ে যায়, কারণ তারা জন সমর্থন হারাতে শুরু করে এবং তাদের প্রবীণ নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে একে একে দোষী সাব্যস্ত হতে থাকে। এ প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় মৌলবাদীরা নাস্তিকদের উপর তাদের আক্রোশ প্রকাশ করতে শুরু থাকে। যদি ধর্মীয় নেতাদের যুদ্ধাপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ড হয়—যেটা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা—তাহলে যেসব ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিকেরা ধর্ম অবমাননা করে তাদেরকেও একই পরিণতির হুমকি দেওয়া শুরু করে তারা।

এইসব মৌলবাদীরা গত কয়েক বছর ধরে কয়েকটি হত্যা তালিকা তৈরি করেছে, যেখানে তারা তালিকাবদ্ধ করেছে বুদ্ধিজীবী, লেখক ও ব্লগারদের। যাদেরকে তারা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায়। এমন কিছু তালিকা তারা অনলাইনেও প্রচার করতে থাকে। ২০১৩ সালে ৮৪ ব্লগারের এক কুখ্যাত ‘তালিকা’ তৈরি করা হয় যা কিছু মূলধারার রাজনৈতিক দল সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। তালিকাভুক্তদের ধর্ম অবমাননার দায়ে গ্রেফতার এবং মৃত্যুদণ্ডের দাবী তোলা হয় ইসলামপন্থী নানা মহল থেকে। তারা নতুন একটা ব্লাসফেমি আইনের প্রস্তাব করে (যা অবশ্যই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে পড়ে না) যাতে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং মুক্তমনা মানুষ, লেখক ব্লগারদের উপর ইসলাম অবমাননার দায়ে আইনটি প্রয়োগ করার দাবি তোলে। ব্লগারদের বিরুদ্ধে সকল মাধ্যমে অপ্রপ্রচার চালানো শুরু করা হয়, শুরু হয় উস্কানী মূলক মন্তব্য, আহবান জানানো হয় ভালো মুসলমাদের এগিয়ে এসে হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়ার জন্য: এখানে উল্লেখ্য যে মধ্যযুগের ধর্মতাত্ত্বিক আল-গাজ্জালি একইভাবে সকল ‘ভালো’ মুসলমানকেই মুসলিম দার্শনিকদের হত্যার অধিকার দিয়ে রেখেছেন যারা কিছু আধিভৌতিক ব্যাপারে ভিন্নমত ধারণ করবে। অন্যভাবে বললে, রাজনৈতিক ইসলামিস্ট এবং জঙ্গী ইসলামিস্ট উভয়ই নিয়ম করে তাদের বিরোধিদের মৃত্যু হুমকি দিচ্ছে এবং পালন করছে ভয়-ভীতি-আক্রমনের সংস্কৃতি।

এই পরিস্থিতিতে, শেখ হাসিনা সম্ভবত এসব অন্ধ মৌলবাদীদের থামিয়ে দিতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন, না, মানুষের প্রতিবাদ করার, লেখার, প্রশ্ন করার এবং সমালোচনা করার অধিকার আছে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে তিনি বলেছেন, “আমাদের নতুন করে ব্লাসফেমি আইনের দরকার নেই কারণ আমাদের ইতোমধ্যেই ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেবার বিরুদ্ধে আইন আছে। এবং এটা দিয়েই আমরা ব্লগারদের আইনের আওতায় আনতে পারব! ফলে কর্তৃপক্ষ এই ব্লগারদের তালিকা পাবার পর, কর্মকর্তারা ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন এবং এই তালিকার চারজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে কোর্টে হাজির করেন। অভিজিৎ এই ব্লগারদের মুক্তির জন্যে দিন রাত সংগ্রাম করেছিলো অনলাইন এবং অফলাইনে।
নিপীড়ক যা চায় তাকে কী সেটাই দেওয়া উচিত? যখন তাদের উদ্ভট দাবিদাওয়া আপনি আমলে নেবেন তখন কী ঘটে? শিগগিরই প্রায় এক লাখ ইসলামিস্ট ঢাকার রাস্তায় মিছিল শুরু করে শুধু ‘নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুদণ্ডের’ দাবিতেই নয়, বরং নতুন শিক্ষানীতি যেখানে নারীশিক্ষার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো সেটাও বাতিলের দাবিতে। সরকার এবারও তাদের সাথে আপোস করে। সেই ২০১৩ থেকেই সরকার ইসলামিস্টদের একের পর এক দাবি দাওয়া মেনে চলছে।

নাস্তিকদের উপর সহিংসতার আরেকটি উদাহরণ হতে পারে, ২০১৩ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের নতুন একটি ধারার সংযোজন।

আইনটি প্রস্তুত হয়েছিলো আওয়ামীলীগ সরকারের আগে ক্ষমতায় থাকা জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলের হাতে। আইনটি তৈরির মাধ্যমে সাবেক রক্ষণশীল সরকার বিভিন্ন প্রকাশনা, টিভি চ্যানেল বা ওয়েবসাইট যেগুলো তাদের দৃষ্টিতে “ভুয়া” এবং “অশ্লীল” (অশ্লীলতা- যেটার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই) এবং যেসব বক্তব্য জনগণের মতামতকে “কটাক্ষ” করে (আবারও একটি অসংজ্ঞায়িত শব্দ) সেসব বেআইনি হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই শব্দগুলোর মাধ্যমে আপনারা নিশ্চয়ই এখন শুনছে পাচ্ছেন সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আনা সেই অভিযোগগুলোর প্রতিধ্বনি, যিনি নাকি তরুণদের দিকভ্রান্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে এমন যেকোনো মন্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। উপরে উল্লেখিত অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীকে দশ বছরের কারাদণ্ড এবং চড়া জরিমানার বিধানও রয়েছে।

অবশ্যই শাস্তিটা কঠোর। কিন্তু মনে রাখা দরকার আমরা এখনও ২০০৬ সালে করা মূল আইনটি নিয়ে কথা বলছি। এই আইনের সকল অপরাধ “অ-আমলযোগ্য” ছিলো। “অ-আমলযোগ্য” শব্দটি শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের দণ্ডবিধির একটি মৌলিক পরিভাষা। একটি অ-আমলযোগ্য অপরাধ হচ্ছে এমন অপরাধ যার পুলিশি তদন্ত এবং গ্রেফতারের আগে ম্যাজিস্ট্রেটের বাধ্যতামূলক অনুমতির প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনটিতে সংশোধনী এনে চার ধরনের অপরাধকে আমলযোগ্য ঘোষণা করা হয়। যার ফলে ভবিষ্যতে কোনো ধরণের ছদ্ম “ব্লাসফেমি” অপরাধ কে অপরাধ বিবেচনা করতে বিচারবিভাগের অনুমতির প্রয়োজন পড়বে না। একই সাথে এই অপরাধগুলোকে করা হয়েছে অ-জামিনযোগ্যও। আইনটির সবচেয়ে কুখ্যাত সাতান্ন ধারা যদিও আমলযোগ্য না, কিন্তু পুলিশের ভিন্ন রাস্তা খুঁজে পেতে সময় লাগে নি। কৌশলটি হলো, পুলিশ প্রথমে অপরাধীকে গ্রেফতার করে আমলযোগ্য অপরাধ ৫৪ ধারা ব্যবহার করে। তারপর তার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারার অভিযোগ যুক্ত করা হয়। ঠিক এইভাবেই ধর্মান্ধ মৌলবাদিদের খুশি করতে উপরোক্ত আইনটি ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ ব্লাসফেমি সংক্রান্ত যে কোনো অপরাধ এখন পুলিশ কারও অনুমতি ছাড়া আমলে নিতে পারে, গ্রেফতার করতে পারে।

মানহানিকর অপরাধ ছাড়াও বাংলাদেশের দণ্ডবিধির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো “ধর্মানুভূতিতে আঘাত” যা কেবলমাত্র মুদ্রিত মিডিয়ার জন্য প্রযোজ্য এবং যে অপরাধের শাস্তি ২ বছরের কারাদণ্ড। দণ্ডবিধিটির মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যথেষ্ট পরিমাণে মনে হয় আটকানো যাচ্ছিলো না, তাই এক ধাপ এগিয়ে আইসিটি আইনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে ধর্মের সমালোচনা করলে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান করা হয়। অদ্ভুত হলেও সত্যি, এখন আপনি ইন্টারনেট মাধ্যমে ধর্মের সমালোচনা করে কিছু লিখলে আপনার চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হবে আর প্রিন্ট মাধ্যমে লিখলে হবে দুই বছর। এর মানে হলো, (উদাহরণস্বরূপ) ফেসবুকে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করা কোনো বক্তব্য, কোনো একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রথম পাতায় প্রকাশিত আক্রমণাত্মক সংবাদের তুলনায় সাতগুণ বেশি মাত্রার অপরাধ। এই আইসিটি আইনের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই অনেক লেখক, ব্লগার, সাংবাদিককে অপদস্ত করা হয়েছে, যার উদাহরণ আমরা দেখেছি ভুরিভুরি।

মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামি মৌলবাদের ব্যাপক উত্থান হয়েছে এবং স্থানীয় ও বৈদেশিক বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের অর্থ দিয়ে দেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা স্থাপন করার মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শক্ত ভিত পেয়েছে। মসজিদ-মাদ্রাসা ব্যবহার করে ইসলামি মৌলবাদিরা প্রতিনিয়ত তাদের ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করে যাচ্ছে।

আমার স্বামী অভি, ওয়াশিকুর বাবু এবং অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার পর কী হলো? প্রায় কিছুই না! তারা একজনকে গ্রেফতার করলো যে অভিজিৎকে ইন্টারনেটে হুমকি দিয়েছিলো এবং একটি অদৃশ্য অনলাইনগ্রুপ যারা হত্যার দায় স্বীকার করেছে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। এতো সময় পেরিয়ে যাবার পর পুলিশ বা সরকার কারোর পক্ষ থেকেই আমার সাথে একবারও যোগাযোগ করা হয় নি। এমন একটা অবস্থা যে, তাদের কাছে আমার যেন কোনো অস্তিত্বই নেই। আজ সকালেই আমি জানতে পেরেছি যে বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা (একিউআইএস)-এর ১২ জন সদস্যকে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করেছে অভিজিৎ রায় এবং অন্যান্য লেখক, মুক্তিচিন্তকদের হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে। এখনও বিস্তারিত কোনো কিছু না জানায় আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখছি।

আমার কাছে অনেকেই জানতে চান, আমি কেমন করে নিজেকে উদ্দীপ্ত রাখি? সমমনা মানুষদের উপস্থিতি, সহানুভূতি (যদিও স্বীকার করছি আমার অন্যের থেকে সহানুভূতি নিতে ভালো লাগে না) বিশেষ করে আমার আত্মীয়, বন্ধু এবং চেনা-অচেনা মানুষসহ সমগ্র মুক্তমনা পরিবার আমার সঙ্গী থাকার কারণেই আমি সব হারিয়েও উজ্জীবিত থাকার চেষ্টা করতে পারছি। মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলি এবং এর সম্পাদকেরা তাদের সকল দায়িত্ব সীমাহীন নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলছেন। অভিজিৎ শুধু লেখালিখিই করে নি, সারা জীবন জুড়ে সে আমাদের দেশে এমন একটা শক্তিশালী মঞ্চ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে যেখানে চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার মুক্তচর্চা করা যাবে। অভির মৃত্যুর পর কাবেরী গায়েন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাঁকেও মৃত্যু হুমকি দেওয়া হয়েছে, আমাকে এক ব্যক্তিগত বার্তায় লিখেছিলেন-

আমি জানি এটা আমাদের আইনি সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে যেখানে লেখার প্রতিবাদে চাপাতি ব্যবহার করা হয়। তারপরও, অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের পর, নাস্তিকদের এবং মুক্তচিন্তার চর্চাকারীর পাশে দাঁড়ানোর সামাজিক যে-ছুঁৎমার্গ সেটা ভেঙে পড়েছে। চারিদিকে মানুষ প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই মানুষ লিখছে, প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করছে।

ইতিহাসের শিক্ষার্থী হিসাবে আমরা সবাই জানি যে সমাজ সরল পথে এগোয় না, এঁকে বেঁকে আগ-পিছ করে চলাই এর রীতি। পরিবর্তন তো রাতারাতি ঘটে না।

যখনই আমি ব্যক্তিগত শোকানুভূতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকি, ততবারই আমার মন হয় আমি এখনো একটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছি, আমার আজ কথা বলার মঞ্চ আছে, জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আছে, আছে একদল ভালো বন্ধু ও আপনজন যারা আমাকে এই দুঃসহ সময়ে সমর্থন দেবেন। কিন্তু তাদের কী হবে যাদের কোনো কণ্ঠ নেই, সংগঠন নেই? যখন হাজার হাজার নারী-পুরুষকে পাচারের উদ্দেশ্যে উঠিয়ে দেওয়া হয় গভীরের সমুদ্রের বুকে ছোট নৌকায়, যখন মেয়েরা গণ ধর্ষণের স্বীকার হয় গণপরিবহনে, আইসিসের কসাইরা শিরশ্চ্ছেদ করে নিরপরাধ মানুষের, যখন তারা মেয়েদের যৌন দাসী হতে বাধ্য করে, যখন বোকো হারাম শতশত বালিকাকে অপহরণ করে মধ্যযুগীয় কায়দায় বিক্রি করে দেয়, দরিদ্র দেশগুলোতে হাজারো শিশু যখন মারা পরে, আমি দেখি যে তাদের কোনো কণ্ঠ নেই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের একটা সম্মিলিত্ব দায়িত্ববোধ এবং চেতনা থাকা দরকার। কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আমাদেরকে বুঝতে হবে আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ, বুঝতে হবে প্রতিটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলি কিভাবে একে অপরের সাথে জড়িত।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি পশ্চিমে এই মানবতাবাদের ধারণা সেই প্রাচীন গ্রিসের বীরত্বগাথা, মধ্যযুগের পার্সি এবং মুরদের প্রভাব, রেনেসাঁর সময়ে ধ্রুপদী চর্চার পুনরুত্থান, রোমান্টিসিজম, এনলাইটেনমেন্ট, ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব ইত্যাদি বহু পথ পাড়ি দিয়ে এমন পর্যায়ে এসেছে। বিশ্বের অনেক অংশ, যেমন বাংলাদেশ, এমন ধরনের নানান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের ধাপ পার করে নি। ভেবে দেখুন পশ্চিম যখন গত কয়েক শতাব্দি ধরে এইসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো তখন বাকি বিশ্বে কী ঘটছিলো? ভারতীয় উপমহাদেশ ছিলো একটা বিলেতি উপনিবেশ। আফ্রিকা নিষ্পেষিত হচ্ছিলো বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির হাতে। আমেরিকার আদিবাসিরা নিয়মতান্ত্রিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছিলো। এইসব বিশ্বশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ণবাদ, দাসপ্রথাও চালু ছিলো। তাই সব জায়গার সব পরিস্থিতি সবসময় একই রকম ছিলো না এবং থাকেও না। এই কারণে আমরা যখন কোনো নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠির মানবতাবাদ নিয়ে আলোচনা করব তখন সতর্ক থাকতে হবে। উত্তর-ঔপনিবেশিক কামালবাদের মত করে কোনো জনগোষ্ঠির উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। নির্দিষ্ট কোনো জাতি ও সংস্কৃতির আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের সাথে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের সম্পর্কগুলো ও ঘটনাএ প্রেক্ষাপটগুলো আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে।

যাই হোক, গত কয়েক মাসে নানা সময় আমি আমার নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ে ভেবেছি— সব হারানোর শোকে কাতর হয়েছি, ক্রুদ্ধ হয়েছি। মাঝে মাঝে আমার হারানোর বেদনা আমার কাছে প্রচন্ড বাস্তব, প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়, আমি হয়ে যাই শুধুমাত্র ‘আমি কেন্দ্রিক’। তার পর মুহূর্তেই আবার ভাবি আমার এইসব প্রচন্ড শক্তিশালী অনুভূতি উদ্দেশ্যহীন, উদ্বেগহীন, মূল্যহীন মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে কতটাই না নগণ্য। মানব মূল্যবোধের সাথে মহাজগতের এই উদ্দেশ্যহীনতার বৈপরীত্যই আমার কাছে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই হেত্বাভাস আমরা কিভাবে গ্রহণ করব? আমার মতে, দুই উপায়ে! প্রথমেই উপলব্ধি করতে হবে এই উদ্দেশ্যহীন, শূন্য মহাবিশ্বের মূল্যহীনতা! তারপর ভাবতে হবে, মহাবিশ্বের তুলনায় আমরা নগণ্য হলেও আমাদের চিন্তা, অনুভূতি, হার জিত, জীবনের অর্থ, এগুলো জীবনের এই ক্ষুদ্র মঞ্চে খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের ক্ষুদ্রতা অনুভব করে আমারা যতক্ষণ না পর্যন্ত ‘আমাদের’ ব্যক্তিগত জীবনবোধ সমগ্র মানবজাতির জন্য বিস্তৃত করতে না পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আসলে এর কোনো মূল্য নেই। শুধু নিজের জন্য নয়, পাচার হওয়া প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক অপহৃত লেখক, প্রত্যেকটি একাকী কিংবা দিগ্ভ্রান্ত মন সবার কথা ভাবা সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান।

তাত্বিকভাবে আমরা এসব জানি। আমাদের এখনই এই ঘৃণা আর বিক্ষোভের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের সকল সীমানার উর্দ্ধে উঠে, আমাদের ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও সমানুভূতির বৃত্ত প্রসারিত করতে হবে প্রতিটি মানুষের জন্য। সবাইকে ভাবতে হবে পরিপূর্ণ এবং স্বাধীন মানুষ হিসেবে। এভাবেই আমরা অভিজিতের জীবনবোধকে উদযাপন করতে পারবো, উদযাপন করতে পারবো অনন্তসহ আর সবার জীবনকে যাঁরা দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন কিংবা বেঁচে আছেন মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে। বাংলাদেশে মুক্তচিন্তকরা চাপাতির বিরুদ্ধে লড়ছেন কলম দিয়ে। সারা বিশ্বেই মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে সহানুভূতি, যুক্তিবোধ, সার্বজনীনতা এবং বিভিন্ন সংঘাতকের কারণকে গভীরভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে। এটাই মানবতাবাদের একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ।

ধন্যবাদ সবাইকে।