লেখক: প্রীতম চৌধুরী
সৌরজগতের সাপেক্ষে আমরা যদি সূর্যকে ধরি মা, পৃথিবী, মঙ্গল এরা যদি হয় সূর্যের সন্তান সমতূল্য ;
তাহলে এটা বলাই যেতে পারে প্লুটো পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের সৎ ভাই।
প্লুটোর পরিচয় এখন ‘বামন গ্রহ’। এই পুঁচকে গ্রহের গ্রহত্ব নিয়ে যেমন বিতর্ক ছিল, তেমনি আবিষ্কারের পর এর নামকরণ নিয়েও বেঁধেছিল ঝামেলা। অবশেষে গ্রিক পুরাণের ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের দেবতা’ প্লুটোর নামে এর নাম দেওয়া হয়। লাতিন সাহিত্যে প্লুটোকে বলা হয় ‘দোজখের দেবতা’। হ্যাঁ, নরকের এই নৃপতির সঙ্গে ‘দেখা’ করতেই নভোযান পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যেটি কাল প্লুটোর সবচেয়ে কাছে পৌঁছেছে।
এ অভিযানটি কেন এতো গুরুত্ববহ?
১৪ই জুলাই Nat Geo তে দেখানো Mission Pluto নামক এক চমৎকার ডকুমেন্টারির আলোকে আলোচনার চেষ্টা করছি।
আগে প্লুটো সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেই। এর ব্যাস [আনুমানিক] ২,৩০০ কিলোমিটার (১,৪৩০ মাইল); যা কিনা পৃথিবীর উপগ্রহ, চাঁদের তিন ভাগের দুই ভাগ সমান। সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব ৫৮,৭২,০০০ মিলিয়ন কিলোমিটার (৩,৬৮০ মিলিয়ন মাইল)। পৃথিবীর হিসাবে [মোটামুটি] ১৬৪ বছরে সূর্যকে একবার ঘুরে আসে। পৃথিবীর হিসাবে এর ১ দিনের দৈর্ঘ্য [মোটামুটি] ৬ দিন-৯ ঘণ্টা-১৮ মিনিট। পৃথিবীতে আপনার ওজন ৫০ কেজি হলে প্লুটোতে হবে মাত্র আড়াই কেজি। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে এর একটি উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়, নাম রাখা হয় ক্যারন (Charon)।
আজকে প্রথম পর্বে শুধু একটা বিতর্ক নিয়েই আলোচনা করবো যা প্লুটোকে খুবই বিখ্যাত করে তুলেছিল।
প্লুটো কেন গ্রহ নয়…
মহাকাশ নিয়ে যারা সিরিয়াসলি ঘাটাঘাটি করেন কিংবা স্রেফ শখের বসেই টেলিস্কোপে চোখ রেখে বসে থাকেন তারা অনেক সময়ই নানা গ্রহসদৃশ বস্তু এই সৌরজগতে খুঁজে পাবার দাবি জানান।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে একটা প্রতিবেদন ছাপা হয় এরকম: মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সৌরজগতে দশম গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। প্রায় একই খবর ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকে “সূর্যের দশম গ্রহ” শীর্ষক শিরোনামে ছাপা হয়। সেখানে নাসা’র (NASA) বিজ্ঞানী জন এন্ডারসনের (John Anderson) সূত্রে উল্লেখ করা হয়: কথিত দশম গ্রহটির আকৃতি পৃথিবীর আকৃতি থেকে পাঁচ গুণ বড় আর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে এর কমপক্ষে ৭ হাজার বছর লাগে। আবার ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক যায়যায়দিনে শিরোনাম হয় সৌর পরিবারে যোগ হচ্ছে ৩ সদস্য। বোঝাই যাচ্ছে, সৌর পরিবারে জায়গা করে নেবার জন্য ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই [কিংবা আরো আগে থেকেই] গ্রহসদৃশ বস্তুপিণ্ডরা উঁকিঝুকি মারছে।
যারাই এসকল মহাকাষীয় বস্তুপিণ্ডকে সৌরজগত সংশ্লিষ্ট করতে চাচ্ছেন, তাঁদের জোরালো দাবিই হচ্ছে প্লুটো যদি গ্রহ হয়, তবে এগুলোও কেন নয়? যৌক্তিক দাবি বটে, কেননা প্লুটো আর-সব গ্রহের তুলনায় একটু বেশিই ছোট। তাই নতুন নতুন গ্রহসদৃশ বস্তুপিণ্ডের আবিষ্কর্তারা জোর দিয়েই তাদের আবিষ্কৃত বস্তুপিণ্ডের সৌর পরিবারে স্থান চাইতে থাকলেন। কিন্তু মহাকাশের এতো এতো বস্তুপিণ্ডকে গ্রহ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে থাকলে একসময় গ্রহের তালিকাই আর পড়ার ধৈর্য হবে না। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা স্বাভাবিকভাবেই এর মিমাংসা করতে বসলেন।
পৃথিবীর তাবত জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার মূল হর্তাকর্তা হলো আইএইউ (International Astronomical Union: IAU)। আইএইউ’র জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাকাশের এই উঁকিঝুকি দেয়া বস্তুপিণ্ডের একটা সুরাহা করতে বসলেন গত ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ আগস্ট চেক প্রজাতন্ত্রের (Czech Republic) রাজধানী প্রাগে (Prague)। এই সম্মেলনে প্রায় ৫০০ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করলেন। তাঁরা আলোচনায় বসেই প্রথম যে সমস্যার সম্মুখিন হলেন তা হলো, হয় তাদেরকে এইসব নব্যআবিষ্কৃত বস্তুপিণ্ডকে গ্রহ ষোষণা করতে হবে; নতুবা বিতর্কিত প্লুটোকে বাদ দিতে হবে। কিন্তু যেহেতু গ্রহ ঘোষণা সম্ভব নয়, তাই প্লুটোকে বাদ দেয়াই উচিত।
প্লুটো বাদ পরে যাবে। সমস্যা নাই। কিন্তু বাদ দিবো কিসের ভিত্তিতে!
বিজ্ঞানীরা হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন তাদের হাতে গ্রহের নির্ভুল আর যুক্তিযুক্ত কোনো সংজ্ঞা নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো সেই প্রাচীন গ্রিস থেকে আজ অবধি বিজ্ঞানের কাছে গ্রহের সঠিক কোনো সংজ্ঞাই নেই।
অতএব, আগে গ্রহের সংজ্ঞা নির্ণয় করা লাগবে।
গ্রহ কী:
গ্রহকে এককথায় সংজ্ঞায়িত না করে দেখা যাক কী কী বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে একটা মহাকাশীয় বস্তুপিণ্ডকে গ্রহ বলা যাবে:
(১) গ্রহ হতে হলে একে নক্ষত্রের চারপাশে স্থায়ী কক্ষপথে আবর্তনশীল হতে হবে;
(২) এর আকার ও ভর নিজস্ব মহাকর্ষ বল দ্বারা একটি গোলাকার কাঠামো ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট হতে হবে;
(৩) এর কক্ষপথ হতে হবে অন্যান্য যেকোনো গ্রহ, উপগ্রহ কিংবা গ্রহাণুর কক্ষপথ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বা আলাদা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘গ্রহ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বস্তুর গোলাকৃতিই মুখ্য হওয়া উচিত, কারণ এটি ইঙ্গিত করে বস্তুটির পর্যাপ্ত অভিকর্ষ আছে, যা এটিকে গোলাকৃতি দিয়েছে।
ব্যাপারটা আরেকটু বলি। এইটাই মূল পয়েন্ট কিনা।
অভিকর্ষ কি করে? বস্তুর চারপাশের স্পেসরে বাঁকাইয়া ফেলে। এই ফোর্স যত বেশি, সে বাঁকাবেও তত বেশি। ঠিক সেই কারনে নক্ষত্রগুলা গোল হয়। এর যে পর্যাপ্ত অভিকর্ষ বল আছে যার ফলে গ্রহগুলা এর চারপাশে ঘুরবে এইটা প্রমাণ এর গোল আকৃতি। গ্রহও সেইম। গোল হওয়া মানে এর পর্যাপ্ত অভিকর্ষ বল আছে যার ফলে উপগ্রহ গুলো এর চারপাশে ঘুরবে।
এবার আসি প্লুটোর কাছে।
প্লুটোর আকার এতো ছোট যে, অনেক উপগ্রহের আকারই অনায়াসে প্লুটোকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আবার কুইপার বেল্টেও এমন কিছু মহাকাশীয় বস্তু (Kuiper Belt Objects: KBOs) রয়েছে যাদের আকার প্লুটোর আকারের সাথে পাল্লা দিতে সক্ষম। এছাড়াও প্লুটোর কক্ষপথ অনিয়মিত; এই অনিয়মিত কক্ষপথে এটি মাঝে মাঝেই নেপচুনের কাছাকাছি এসে পড়ে। এমনকি প্রতি ২৩৮ বছরে প্লুটো সূর্যের এতো কাছাকাছি এসে যায় যে, সূর্য থেকে নেপচুনের যে দূরত্ব, তার চেয়েও কম দূরত্ব দিয়ে অতিক্রম করে; তখন নেপচুন অষ্টম নয়, [সাময়িকভাবে] নবম গ্রহ হয়ে যায়। তবে বিজ্ঞানীরা প্লুটোর সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করেছেন এর ভর; এর কক্ষপথ ; আর আকৃতিতো সব সময়েরই বিতর্কিত।
প্লুটো তাহলে এখন কী:
হ্যা, প্রশ্নটা এখন সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। কেননা যতদিন প্লুটো গ্রহ ছিল, ততদিন ক্যারন নামে তার একটা উপগ্রহও ছিল। এখন যেহেতু প্লুটো গ্রহ নয়, তাই ক্যারনকেও উপগ্রহ বলা যাবে না। আবার ক্যারনের উপস্থিতির কারণে প্লুটোকে এক ধাক্কায় গ্রহাণুতে নমিয়ে দেয়াও যাচ্ছে না; তাই প্লুটোকে বলা হবে বামন গ্রহ (Minor Planets) সেইসাথে ক্যারন গ্রহাণু হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। অন্যান্য বিতর্ক সৃষ্টিকারী সেরেস, ২০০৩ ইউবি ৩১৩ এবং সেড্নাও বামন গ্রহ আখ্যা পাবে।
তবে অতি সম্প্রতি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্লুটোসহ নব্য আবিষ্কৃত অন্যান্য বস্তুপিণ্ডগুলোকে আখ্যায়িত করেছেন একটি পরিবার হিসেবে, যার নাম দেয়া হয়েছে: প্লুটোইড। এদেরকে গ্রহাণু আর গ্রহের মাঝামাঝি একটা অবস্থান দেয়া হয়েছে। প্লুটোইডে স্থান পাবার জন্য নির্দিষ্ট ভর আর ঔজ্জ্বল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে প্লুটোইডে প্লুটো ছাড়াও আছে [প্লুটোর কাছাকাছি, আবিষ্কৃত] এরিস (Eris)। এই পরিবারের ভবিষ্যত বংশধর কারা তা জানার জন্য এই নিউ হরাইজন অভিযানের বিকল্প নেই।
[ চলবে…… …… …… ]
:good:
“পৃথিবীর হিসাবে [মোটামুটি] ১৬৪ বছরে সূর্যকে একবার ঘুরে আসে”- এটা দেখেই চট করে গুগোল করে জেনে নিলাম প্লুটো আবিস্কার হয়েছিল কবে। ১৯৩০ সালে। অর্থাৎ গ্রহ হিসাবে আবিস্কার হওয়ার পর সূর্যকে পুরো একপাক ঘুরে আসার আগেই বেচারার গ্রহত্ব শেষ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা চিন্তা করেই কেমন হাসি পেয়ে গেল।
আপনি লিখেছেন, “কথিত দশম গ্রহটির আকৃতি পৃথিবীর আকৃতি থেকে পাঁচ গুণ বড় আর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে এর কমপক্ষে ৭ হাজার বছর লাগে।”
জন অ্যান্ডারসনের সূত্রে এই খবরটা ইত্তেফাক ছাপিয়ে থাকলে তাতে বড় ধরণের ঘাপলা ছিল মনে হয়। এরকম কোনো গ্রহ তো সৌরজগতে কখনই পাওয়া যায়নি। একটা ব্যাপার হতে পারে যে, হয়ত এখানে কোনো বহির্গ্রহের (সূর্য নয়, বরং অন্য কোনো নক্ষত্রকে আবর্তনকারী গ্রহ) কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ১৯৮৭ সালে কোনো বহির্গ্রহও আবিষ্কৃত হয়নি। প্রথম বহির্গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৯০ এর দশকে, এবং এযাবৎ ২০০০ এরও বেশি বহির্গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে, এবং ধারণা করা হয় আমাদের গ্যালাক্সির আনুমানিক ১০ হাজার কোটি নক্ষত্রের প্রতিটির চারপাশেই একাধিক করে গ্রহ রয়েছে। কিন্তু ১৯৮৭ সালে এর কোনোটাই দেখা যায়নি।
আর বামন গ্রহের ইংরেজিটা dwarf planet; minor planet নয়। আর বিশেষ ধরণের বামন গ্রহকেই (যেসব বামন গ্রহ মূলত বরফ দিয়ে গঠিত) সম্ভবত প্লুটোইড বলা হয়, এটা বামন গ্রহ থেকে আলাদা কোনো পরিবার নয়, বরং বামন গ্রহেরই অংশ।
ধন্যবাদ আপনার সিরিজটির জন্য। আরো লিখুন।
বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে বস্তুর ভর অপরিবর্তনশীল । ভরের একক কেজি । তাই পঞ্চাশ কেজিটা আড়াইয়ে রুপান্তর হওয়া কি স্বাভাবিক ?? আপেক্ষিকতার ভিত্তিতে ভরের পরিবর্তন হয় । তাই বলে স্থির অবস্থায় এইটা সম্ভব না ।
বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক বাক্যটা হতো, পৃথিবীতে আপনার ওজন ৪৯০ নিউটন হলে প্লুটোতে হবে সাড়ে চব্বিশ নিউটন।
তবে লেখক যেভাবে বললেন সেভাবে বলাটা প্রচলিত হয়ে গেছে। পাঠককে বুঝে নিতে হবে, একটা আড়াই কেজির বস্তুর যে ওজন সে অনুভব করে পৃথিবীতে, প্লুটোতে গেল তার নিজের ৫০ কজি শরীরকে তেমন হালকা মনে হবে । তবে আমি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে সঠিকভাবে লেখার পক্ষপাতি। পাঠককের মনে সহজে তুলনামূলক চিত্র আঁকতে, পরে যেভাবে বললাম (বোল্ড করা) সেভাবে বলা যেতে পারে।