ফিল্ড মেডাল জয়ী গণিতবিদ মারিয়াম মির্জাখানি
ফিল্ড মেডাল জয়ী গণিতবিদ মারিয়াম মির্জাখানি

বিজ্ঞানী – শব্দটি শুনলেই অনেকের মনে ভেসে উঠে মোটা কাঁচের চশমা পড়া এলোমেলো চুলের আত্মভোলা একজন মানুষ। আমি কি ঠিক বললাম? এইবার আপনার ভাবনার সাথে একটু মিলিয়ে দেখুন, বিজ্ঞানীর এই যে ছবিটা আপনি কল্পনা করলেন, তা কি একজন পুরুষের ছবি ছিল নাকি একজন নারীর? আমি নিশ্চিত ৯৯% মানুষ বিজ্ঞানী বলতে একজন পুরুষকেই কল্পনা করে। এই প্রবণতা অনেক গণিতবিদ, প্রকৌশলী আর পদার্থবিজ্ঞানীদের মাঝেই আছে। ইরানী গণিতবিদ নারী মারিয়াম মির্জাখানি যখন গণিতের নোবেল পুরষ্কার তুল্য ফিল্ড মেডাল পেয়ে যান, তখন একযোগে সারা পৃথিবীর সব পত্রিকায় ঝড় ওঠে, বিসিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো যারা বিজ্ঞানের জগতের রসালো খবরগুলো ভুলভাল অনুবাদ করে নীচে ইন্টারনেট থেকে লিখে ছেড়ে দেয় তারাও খবরের শিরোণাম দেয়, প্রথম ফিল্ড মেডালিস্ট নারী গণিতবিদ মারিয়াম। যারা নারী শুনলেই লালা ঝরায়, তারা শীর্ণকায় মারিয়ামের বয়কাট চুলের ছবি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, আরেহ, এ তো দেখতে তরুণের মত, একে তো ঠিক মেয়েই বলা চলে না। যখন শোনা যায়, তিনি চার বছর বয়সী এক সন্তানের জননী, তখন তারা শুনেও শোনেন না। থাক এ নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো। তাহলে তো আর “আরেহ ধুর! মেয়েরা গণিতের কি বোঝে!” বলে বুলি কপচানো যাবে না। বুয়েট থেকে পাশ করার ঠিক পরপর আমি অফিস থেকে বসের গ্রামে নির্মাণাধীন হেলথ কমপ্লেক্স পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। বস ওই প্রজেক্টের প্রধানকে জানিয়েছিলেন, তার সাথে একজন ইঞ্জিনিয়ার আসবে। আমরা গাড়ি থেকে নামার পর তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আসবে, ইঞ্জিনিয়ার কই? বস যখন তার সামনে দাঁড়ানো আমাকে দেখিয়ে দিলেন, তিনি বিব্রত হয়ে আমাকে কি বলে সম্মোধন করবেন বুঝতে না পেরে সম্মোধনের ব্যাপারটাই এড়িয়ে গেলেন। অথচ আমার জায়গায় একজন পুরুষ হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতেন। বাংলাদেশ স্বল্প শিক্ষিতের দেশ বলে ইঞ্জিনিয়ার বলতে সাধারণে পুরুষ কাউকে দেখবে বলে আশা করে, তাই যদি ভেবে থাকেন, তাহলে আরেকটা গল্প শোনাই। দক্ষিন কোরিয়া থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার্স শেষ করার পর একটা কোম্পানীর প্রাথামিক বাছাই শেষে ইন্টারভিউ-এর কল পেলাম। উনারা তিনদিন পরে আমার ইন্টারভিউ নেবেন, ইন্টারভিউ এর ভেন্যু কোথায় সেটা পরদিন ফোন করে জানিয়ে দেবেন জানালেন। পরেরদিন ফোন আসেনি। ইন্টারভিউ এর আগের দিন আমি নিজেই তাদের ফোন দিলাম, কি ব্যাপার কাল ইন্টারভিউ অথচ আপনারা এখনো আমাকে ভেন্যু জানালেন না? যা উত্তর পেলাম তা আমি একেবারেই আশা করিনি। আমার শিক্ষা এবং কর্মবৃত্তান্ত দেখে উনারা আমাকে পুরুষ ভেবেছিলেন, নামটা বিদেশী- সেখান থেকেও বুঝতে পারেন নি আমি নারী, তাই ইন্টারভিউএর জন্য ডেকেছিলেন। উনারা আশাই করেননি টেলিফোনে উনারা একজন নারীর কন্ঠ শুনবেন। আমি নারী, তা জানার পর উনারা আমাকে আর চাকরীটা অফার করতে পারছেন না। হ্যা, অর্থনৈতিক ভাবে প্রথম বিশ্বের একটি দেশে, প্রযুক্তি শিল্পের নেতা স্যামস্যাং-এর দেশে একজন নারী ইঞ্জিনিয়ারকে এভাবে লিঙ্গবৈসম্যের শিকার হতে হয়েছে। গণিত, বিজ্ঞান বা প্রকৌশল পুরুষের পেশা – এই পক্ষপাত দুষ্টতা বিশ্বজুড়ে। এই দোষে কেবল গণিত-প্রকৌশলের লোকেরাই দুষ্ট তাই নয়, জীববিজ্ঞানী আর রসায়নবিদেরা- তাদেরও বেশীর ভাগ এই দলেই পড়ে। সাম্প্রতিক কালে টিম হান্ট নামের একজন নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী দক্ষিন কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এক বিজ্ঞান সম্মেলনে মন্তব্য করেছিলেন,

“Let me tell you about my trouble with girls. Three things happen when they are in the lab: you fall in love with them, they fall in love with you, and when you criticize them they cry.”

তার এই মন্তব্যের বিপরীতে ঝড় ওঠে ইন্টারনেট জুড়ে, সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারী বিজ্ঞানীরা সমালোচনা করতে শুরু করেন টিম হান্টের। একজন পুরুষ বিজ্ঞানী যদি নারী দেখলে লালা সামলাতে না পারেন, তাহলে তার কর্মক্ষেত্রেই আসার যোগ্যতা নেই। ভালোলাগা-ভালোবাসা-প্রেমের মত ব্যাপার প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে যেকোন সময় ঘটতে পারে। কিন্তু নিজের দূর্বল অনুভূতি নিজে সামাল দিতে না পেরে যার জন্য দূর্বল হচ্ছে তাকে দোষারোপ করাটা যে তারই চারিত্রিক বা ব্যক্তিত্ব্যের দূর্বলতা, তা বোঝার মত ক্ষমতা বোধ করি টিম হান্টের নেই। টিম হান্টের উচিত ঘরে বসে থাকা যাতে কর্মক্ষেত্রে কোন নারীর সাথে দেখা হয়ে তিনি হৃদয়জনিত দূর্ঘটনায় জড়িয়ে না পড়েন। তার এই কথা প্রতিবাদে ডিস্ট্রাক্টিংলি সেক্সি শব্দটির সাথে হ্যাশটাগ জুড়ে দিয়ে টুইটারে নারী বিজ্ঞানীরা তাদের বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডের মজার মজার ছবি দিতে থাকেন, ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজিস্ট দিতে থাকেন তার চিতার মলের নমুনা সংগ্রহের বর্ণনা, কেমিস্ট দেন পাইপেট হাতে তার রাসায়নিক পরীক্ষণের ছবি, নারী বিজ্ঞানীদের এই ছবিগুলো সারাবিশ্বকেই আসলে একবার বলে দিল, টিম হান্টদের মত লিঙ্গ বৈষম্যকারী বিজ্ঞানীদের সমঝে চলার দিন শেষ, তা হোক সে নোবেল বিজয়ী। ঠেকায় পড়ে রয়্যাল সোসাইটি ঘোষনা দিল, তারা টিম হান্টের মতানুসারী নয়, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন পদত্যাগে বাধ্য করল টিম হান্টকে। কিছু বিজ্ঞানী অবশ্য মিন মিন করে বলতে লাগলেন, টিম হান্টকে এতোটা শাস্তি দেয়া কি ঠিক হল? এই মিন মিন করা বিজ্ঞানীদের দলে রিচার্ড ডকিন্স, ব্রায়ান কক্সের মত বিজ্ঞানীরাও পড়েন। এই বিজ্ঞানীদ্বয়কে আমি যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখলেও আমি মনে করি, টিম হান্টের এমন উল্লেখযোগ্য শাস্তির প্রয়োজন ছিল। না জানি লিঙ্গবৈষম্য করে কত উঠতি নারী বিজ্ঞানীর পেশাগত জীবনের বারোটা বাজিয়েছেন তিনি। এর শাস্তি না হলে এই ধারা বিজ্ঞানের জগতে হয়ত আরো বেড়ে যেত।

যেখানে খোদ বিজ্ঞানীরাই লিঙ্গবৈষম্যের দোষে দুষ্ট, বিজ্ঞানী মানেই পুরুষ- এই কল্পছবির বেড়াজাল থেকে বের হতে পারেন না, সেইখানে যারা বিজ্ঞানী নয়, তাদের দোষারোপ করা বোধহয় আমার উচিত হবে না। তবু আমি আজ সেইসব বিজ্ঞানীদের গল্প শোনাতে এসেছি যারা নারী, আমি শোনাতে এসেছি বিজ্ঞানের জগতে তাদের তুখোড় পদচারণার গল্প। চেনাতে এসেছি তাদের কর্মক্ষেত্রের প্রতিচ্ছবি। সেই সাথে বলতে এসেছি আমার গল্প, বাংলাদেশের একটি মেয়ে আজ একাধারে নিজেকে মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং নিউরোসায়েন্টিস্ট বলে বিজ্ঞানের জগতে নিজের পরিচয় দিতে পারে। বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী এবং গবেষক হিসেবে বিজ্ঞানের জগতে আমার কাজের অভিজ্ঞতাটাই যখন বর্ণনা করতে এসেছি, তাই গল্পের শুরুটা আমাকে দিয়েই, ক্রমাগত উঠে আসবে কর্মক্ষেত্রে আমার দেখা বিজ্ঞানীদের কথা। আসবে সেসব মানুষের কথা যারা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, গবেষণা করতে শিখিয়েছেন তাদের কথা। সেইসাথে আসবে আমার সহকর্মী নারী বিজ্ঞানীদের কথা, যাদের দেখে আমি প্রতিদিন নতুন করে জীবনকে চিনতে শিখি, একজন নারী হিসেবে কি করে একইসাথে ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের সাফল্য ও সাম্য উভয়ই অর্জন করতে হবে তা শিখি। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন বাংলাদেশের অজস্র মেয়ে এমনি দাপুটে পদচারণায় মাতিয়ে তুলবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের জগত!

ঘটনাচক্র-১

মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তৃতীয় বর্ষে আমাদের ফ্লুইড মেকানিক্স পড়াতেন কামরুল ইসলাম স্যার- যিনি ক্লাসে পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝেই বলতেন ইউরোপ আমেরিকায় কোন ধরনের গবেষণার কাজ চলছে। তেমনই কোন এক ক্লাসে তিনি বললেন বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর কথা। চিকিৎসা ক্ষেত্রে শুধু চিকিৎসক নয়, প্রয়োজন ইঞ্জিনিয়ারেরও! এইযে এক্সরে মেশিন, এম.আর.আই মেশিন এগুলো তো ডাক্তারেরা বানায় না, ইঞ্জিনিয়াররাই ডিজাইন করে। সেইজন্য বোঝা চাই মানব দেহ কিভাবে কাজ করে। সাধারন একটা লোহা জাতীয় ধাতু দিয়ে গাড়ির ডিজাইন করা যায়, মটর বানানো যায়, কিন্তু মানব দেহের ভাঙ্গা হাড়ের জায়গায় তো বসানো যায় না। মানব দেহে প্রতিস্থাপনের জন্য চাই দেহের উপযুক্ত বায়োম্যাটেরিয়াল, যা দেহের ভেতর ক্ষয়ে যাবে না, ভেঙ্গে যাবে, দেহে প্রতিক্রিয়া ঘটাবে না। স্যারের কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই! এত দারুন কাজ করতে পারে ইঞ্জিনিয়াররা! সেই সময় বুয়েটের ছাত্রী হলে সদ্যই পেয়েছি ইন্টারনেট সংযোগ। ঘরে ফিরে ইন্টারনেটে খোঁজ দ্য সার্চ! সেই নেশায় নেশায় কেটেছে প্রায় দুইবছর। ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ করার পর থেকে সুযোগ খুঁজতে থাকি, কিভাবে বায়মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া যায়। বাংলাদেশে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিক্যাল ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট ছাড়া এই ধরণের কোন কাজ আর কোথাও হয় না, সেখানেই ঢুকে গেলাম রাব্বানী স্যারের অধীনে কৃত্রিম হাত বানানোর প্রজেক্টে। আমার কাজটা ছিল হাতের মেক্যানিকাল ডিজাইনটা করা। সেই কাজ করতে গিয়েই জানতে শুরু করি নার্ভ নিয়ে। ক্রমাগত আগ্রহ বাড়তে থাকে এই বিষয়ে। অচিরেই বুঝতে পারি, কেবল মেকানিক্যাল ডিজাইন দিয়ে কৃত্রিম একটা হাত বানানো যায় বটে, কিন্তু সেই কৃত্রিম হাতের সাথে দেহের সংযোগটা হয় না। হাতটাকে দেহের একটা অংশের মত ব্যবহার করতে গেলে প্রয়োজন ইলেক্ট্রনিক সার্কিটের সাথে নার্ভের এমন সংযোগ ঘটানো যাতে সার্কিট শুধু দেহের সিগ্যন্যাল মেনে হাতের নাড়াতে নয়, বরং হাত বস্তুর স্পর্শে যে প্রতিক্রিয়া বল অনুভব করছে তাও যাতে দেহকে তথা মস্তিষ্ককে জানাতে পারে। ব্যাপারটা সহজ কিছু নয়। পড়তে পড়তে দেখলাম, ইএমজি (ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাম- অনেকটা ইসিজি সিগ্যন্যালের মত, কেবল এইক্ষেত্রে হৃদপিন্ডের বদলে মাংশপেশী থেকে সিগ্যন্যালটা নেয়া হয়) সিগ্যন্যালটা পাওয়া যায় সহজেই, কিন্তু দেহকে ফিডব্যক সিগ্যন্যালটা দেয়া এখনও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। পুরোপুরি একটা অধরা জগতে হয়ে রয়েছে। কাঁচা হাতে দক্ষিন কোরিয়ার একজন প্রফেসরকে লিখে বসলাম এই বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছার কথা। লিখবার আগে উনার শিক্ষা বৃত্তান্তটা দেখে নিয়েছিলাম। তিনি নিজেও পড়েছেন মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ, কিন্তু স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করেছিলেন মানবদেহের বায়োমেকানিক্সে। আশায় ছিলাম, উনি হয়ত বুঝবেন আমার আগ্রহটা। ইলেক্ট্রিক্যাল বা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বায়মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ যাওয়াটা তুলনামূলক ভাবে সহজ ছিল, কিন্তু মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বায়োমেকানিক্স ছাড়া অন্য কোনকিছুতে কাজ করা বেশ কঠিন। তারপরো উনাকে মেইল করেছিলাম এই ভরসায় যেহেতু উনি নিজেও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন, তাই হয়ত বুঝবেন, আমার পক্ষে এইধরণের গবেষনা শুরু করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। উনি বুঝেছিলেন। টেলিফোনে ইন্টারভিউ নিয়েই বুঝেছিলেন বিষয়টা নিয়ে আমার আগ্রহ কতটা তীব্র!

ঘটনাচক্র-২

ছয়মাস পরে আমি যোগদান করি তার গবেষণাগারে! সেই সাথে শুরু হয় আমার নতুন একটা পৃথিবীকে আবিষ্কারের সূচনা! আমার এই অ্যাডভাইজার ডঃ গন খ্যাং-ই আমাকে শিখিয়েছেন, কিভাবে পড়তে হয়, কিভাবে গবেষনা করতে হয়। কখনও বলেননি, এটা কর, ওটা কর। সবসময় বলেছেন, আমাকে বুঝাও তুমি কিভাবে কাজটা করতে চাও। এই কাজটা হয়ত অনেকভাবে করা যেতে পারে, তুমি যেভাবে কাজটা করার চিন্তা করছ, কেন সেভাবেই করলে তুমি অন্য পদ্ধতির চেয়ে তুলনামূলক ভাবে ভালো ফলাফল পাবে? তোমার এক্সপেরিমেন্টের শক্তি কোথায় আর দূর্বলতা কোথায়? তোমার পরীক্ষণের ফলের নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু? যতক্ষণ তুমি বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে আমাকে এবং অন্যদের সন্তুষ্ট করতে না পারবে, ততক্ষন তুমি কাজের জন্য ফান্ড পাবে না। ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি আমার সাথে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক করেছেন। অন্য গবেষণাগারের প্রফেসররা লাঞ্চের সময় আমার অ্যাডভাইজারকে খুঁজতে এসে দেখতেন আমি আর আমার অ্যাডভাইজার হোয়াইট বোর্ডে নার্ভের ইলেক্ট্রফিজিওলজির সমীকরণ নিয়ে উত্তেজিত তর্ক করছি। হ্যাঁ, উনি আমাকে যুক্তি পছন্দ না হলে প্রফেসরকে সরাসরি বলতে শিখিয়েছেন- তোমার এই যুক্তিটা এই কারনে ভূল। বাংলাদেশ থেকে সারাজীবন পড়ালেখা করে যাওয়া একজন শিক্ষার্থীর জন্য যা স্বাভাবিক ছিল, স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ডের গবেষণাপত্র দেখলে মনে একটা সমীহের ভাব চলে আসা। উনি শেখালেন, স্ট্যানফোর্ডের যে ছেলেটি এই গবেষণা পত্রটা লিখেছে, সে তোমার মতই একজন গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। সে তোমার মতই ভুল করতে পারে, স্ট্যানফোর্ড বলে তার ভুলকে ঠিক ভাবার কোন কারণ নেই। আমাকে দেখাও, কেন তার হাইপোথিসিস তোমার হাইপোথিসিসের বিপরীতে যাচ্ছে। তোমার হাইপোথিসিস যদি ঠিক হয়ে থাকে, তার হাইপোথিসিসের দূর্বলতা কোথায় সেটা খুঁজে বের কর। দেখতে দেখতে আমাদের হাতে ইলেক্ট্রিকাল সিগন্যাল দিয়ে চাপ, সল্প-মাত্রার কম্পন, অধিকমাত্রার কম্পন, এবং ব্যাথার অনুভূতি তৈরী করে ফেললাম। আপনি আপনার হাতটি স্থির করে ধরে রাখুন, আমি সেখানে কোন চাপ প্রয়োগ না করেও একটুখানি ইলেক্ট্রিক স্টিমুলেশন দিয়ে আপনাকে চাপের অনুভূতি অনুভব করিয়ে দিতে পারবো। আমার অ্যাডভাইজার ঠিক এইভাবে একটু একটু করে গড়ে দিয়েছেন আমার আত্মবিশ্বাস। তিনি আমাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন- আমি পারি। এই ছোট্ট দুটো শব্দই আমি আজ শেখাতে চাই আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের! আমরা পারি। আমরা যতক্ষণ ভাববো- আমাদের যোগ্যতা ইউরোপীয়ান-আমেরিকানদের চেয়ে কম, ঠিক ততক্ষণ আমরা পিছিয়ে থাকব। বুদ্ধির চর্চাটা ঘটে মস্তিষ্কে, যা আপনার-আমার সবারই আছে উন্নত বিশ্বের মানুষগুলোর মত। আপনি নাহয় ফরমালিনের ভয়ে অরেঞ্জ জুস খেতে পারেন নি, কিন্তু লালশাক তো খেতে পেয়েছেন যেটা ওরা খেতে পায় নি। আপনি নাহয় নীলক্ষেতের ফটোকপি বই পড়ে পরীক্ষা দিয়েছেন, ওরা হয়ত একটা ঝকঝকে বই হাতে নিয়ে সোফায় আরাম করে বসে ধোঁয়া ওঠা কফি খেতে খেতে পড়েছে। কিন্তু তার আর আপনার বইয়ের বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। আপনি তখনই পিছিয়ে যাবেন, যখন দারিদ্রের অজুহাত দিয়ে যে বইটা পাওয়া যাচ্ছে সেই বইটাও পড়বেন না। আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা কতটা সৌভাগ্যবান, তা তারা জানেই না। আমাদের দেশের সরকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পড়ালেখা করার সুযোগ দেয়। আমেরিকান ছাত্রদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতি সেমিস্টারে সাড়ে ছয় হাজার ডলার ফি দিতে হয়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে প্রতি সেমিস্টারে বিশ হাজার ডলারের বেশী ফি দিতে হয়। ওরা যখন ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ করে বের হয়, তখন ওদের মাথায় বিশাল ঋণের বোঝা। ভাববেন না ওদের বাবা মা ওদের পড়ালেখার খরচ দেয়। এইখানে শিক্ষা যে পরিমাণ খরুচে ব্যাপার, বাবা মায়ের সাধ্য থাকে না তা বহন করার। সেইখানে আমরা প্রায় বিনে পয়সায় শিক্ষিত হবার সুযোগ পাই। যা হতে চাই ঠিক তাই হবার সুযোগ আমাদের আছে, কেবল যদি আমরা নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখি।

দক্ষিন কোরিয়া থেকে শুরু আমার নারী বিজ্ঞানীদের দেখা। আমার ল্যাবের সব’কজন গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী ছিল মেয়ে। নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর কনফারেন্সে গিয়েও দেখি সেখানে বেশ অনেকেই মেয়ে, যদিও তুলনায় ছেলে বেশী। কেন বেশী জানেন? কারন আমি তখনও পড়ছি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে – সারা বিশ্ব জুড়েই ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মেয়েদের সংখ্যা কম। প্রায় সমস্ত দেশেই সামাজিক ভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মেয়েদের কম উৎসাহিত করা হয়। আশার কথা হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষককে কখনো দেখিনি তার ছাত্র আর ছাত্রীকে কখনও আলাদা করে দেখেছে। বাংলাদেশে বাবা মায়েরা মেয়ে বড় হতে না হতেই বিয়ের চিন্তা করে, মেয়েরাও ভাবে তাদের দৌড় ওই শ্বশুড়বাড়ির রান্নাঘর পর্যন্ত, স্বামী ভালো হলে হয়ত কিছু সমাজ স্বীকৃত পেশা পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে, সেটাও ঐচ্ছিক বিষয় ভেবে রেখে দেয় অধিকাংশ মেয়েই। অধিকাংশ মেয়েই ভাবে আমার সহপাঠিনী তৃষিয়া নাশতারানের মত টেলিটকের প্রকৌশলী হতে হলে বুঝি হতে হয় অন্যরকম কেউ। কিন্তু বাস্তবতাটা আসলে অন্যরকম, ও নিজেকে বিশ্বাস করে বলেই বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজেও ওর পেশাগত দক্ষতা দেখিয়ে যেতে পারছে। সেই আত্মবিশ্বাসটা করতে শিখুন, আপনার পৃথিবীটাও বদলে যাবে।

ঘটনাচক্র-৩

আমার কর্মক্ষেত্র ক্রমেই রূপ বদলাতে থাকে। বায়মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার ডিগ্রী করার সময়েই আমি বুঝতে পারি আমার স্বপ্নটা আরো বিস্তৃত। ২০০৯ সালে রেবেকা সাক্সেনা নামের এক বিজ্ঞানীর টেড লেকচার শুনে মনে একটা অতৃপ্তির ঢেকুর উঠেছিল! মনে হয়েছিল, আহারে! যদি পারতাম নিউরোসায়েন্সটিস্ট হতে। সেইসময় একজন সদ্য পাশ করা একজন মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সাহসে কুলায়নি নিউরোসায়েন্সে পিএইচডি করার স্বপ্ন দেখার। কিন্তু আমার মাস্টার্সের অ্যাডভাইজার কিভাবে যেন আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের একটা ঝংকার তুলে দিয়েছিল। নিউরোসায়েন্সটিস্ট হবার স্বপ্নটা এইবার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম-ঈশান-নৈঋত থেকে অর্কেস্ট্রার মত একযোগে বাসনার সুরে মাতাল করে দিল আমাকে। মনে হল, একটাই তো জীবন, আধ একটু বাজি না ধরলে চলে? কোরিয়াতে নিউরোসায়েন্সের ল্যাব ছিল হাতে গোণা, কোথাও যোগাযোগ করে কাজ হল না। সারাজীবন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আসা একজন শিক্ষার্থীকে জীববিজ্ঞানের গবেষনাগারে নিতে তারা ভরসা পায় না। আমিও থেমে যাবার পাত্রী নয়। বিজ্ঞান নিয়ে আমার পাগলামীর সুখ্যাতি আছে, ব্যার্থতা আমাকে কখনও থামিয়ে দিতে পারে না। আমি মনোযোগ দিলাম কোরিয়া ছেড়ে বাইরে। ঠিক করলাম, প্রথমে আমেরিকায় প্রফেসরদের মেইল করব। সেখানে সফল না হলে ইউরোপে। যত জায়গায় যতভাবে চেষ্টা করা যায় তা করেই আমি ক্ষান্ত হব। শুরু হল আমার হামলা যজ্ঞ। প্রায় দুইশত প্রফেসরকে মেইল করেছি আমেরিকায়। উত্তর দিয়েছে প্রায় ২০ জনের মত। তাদের বেশীরভাগ উত্তর ছিল তাদের ল্যাবে এই মুহুর্তে কোন গবেষক নিচ্ছে না। তার মাঝেও কয়েকজনের কাছ থেকে ভাল উত্তর পেয়েছি। এর মধ্যে বোস্টন ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আমার আগ্রহের বর্ণানুভূতির বিজ্ঞানে নয়, গতি বিজ্ঞানে উনি আমাকে নিতে চান। বর্ণানূভূতি নিয়ে কাজ উনি বন্ধ করে দিচ্ছেন, ফান্ডিং এবং পাবলিকেশন দুটোই কঠিন বলে। তাছাড়া গতি নিয়ে কাজ করলে আখেরে ভালো সেই পরামর্শও দিলেন। কিন্তু আমার মন ভরল না, আমি মেইল পাঠিয়ে বসলাম আমেরিকার সেরা আটজন বর্ণবিজ্ঞানীর (Human color vision scientist) কাছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে উত্তরও পেলাম দুজনের কাছ থেকে। তাদেরই একজন মাইকেল ওয়েবস্টারের ল্যাবে পেয়ে গেলাম গবেষণার সুযোগ। ওয়েবস্টার ল্যাব ছিল স্বপ্নের মত! বর্ণান্ধতা নিয়ে গবেষণার সুযোগ পেলাম আর পেলাম ল্যাবভর্তি নারী বিজ্ঞানীদের সঙ্গ। আমাদের ল্যাবের সাতজন গবেষকের মধ্যে পাঁচজনই নারী। এই ল্যাবের গবেষকেরা যখন তাদের কাজ নিয়ে বক্তৃতা দিতে মঞ্চে ওঠে, ডিপার্টমেন্টের বাকিরা সাগ্রহে প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকে। বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে দম ফেলার সময় পাওয়াই কষ্টের হয়ে যায়। মাস দেড়েক আগেই দৃষ্টিবিজ্ঞানীদের একটা সম্মেলনে গিয়েছিলাম, আমরা যে সেশনে ছিলাম, আমাদের কাজ দেখতেই মানুষ এসেছে ওই সেশনটাতে। চার ঘন্টার সেশনে আমরা পানি খেতে যাবার সময়টুকু পর্যন্ত পাচ্ছিলাম না। এ তো বললাম কাজের কথা! কেমন এই নারী বিজ্ঞানীদের জীবন? ঠিক আপনার মতই হাসি কান্নায় ভরা। আমাদের এক পোস্ট ডক্টরাল ফেলো তার তিন কন্যাকে নিয়মিত সকার (ফুটবল) ট্রেইনিং দিচ্ছেন, ছোট্ট মেয়েটি এইবছর ওয়েট লিফটিং-এ জুনিয়র পর্যায়ে স্টেটকে রিপ্রেজেন্ট করতে যাচ্ছে। আরেক কন্যা গিফটেড চাইল্ডদের বিশেষ স্কুলে পড়ছে, আমেরিকানরা এই দিক থেকে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে, ওদের মেধাবী শিশুদের ওরা আলাদা করে যত্ন নেবার জন্য আলাদা স্কুলও করে রেখেছে। অতি মেধাবী যে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না সাধারণ স্কুলের কারিকুলাম, তাদের জন্য বিশেষ স্কুল – স্কুল ফর গিফটেড চাইল্ড, তাদের চাহিদামত ডিজাইন করা কারিকুলাম। এইখানে পড়তে পারাটাও একটা গর্বের ব্যাপার। এই এগারো আর চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়েদের একটা কথোপকথনের নমুনা শোনাই। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া আরভাইনের এক প্রফেসর, যিনি এই তিনকন্যার মায়ের ডক্টরাল অ্যাডভাইজার ছিলেন, তার সাথে আমরা ল্যাবের সবাই আর তিন কন্যা গিয়েছিলাম হাইকিং-এ। হাইকিং সেরে আমার অ্যাডভাইজারের বাসায় নৈশভোজের দাওয়াতে বসে এগার বছর বয়সী কন্যাটি আরভাইনের প্রফেসরকে শুধালো, সে ছেলেবেলায় কি হতে চেয়েছিল? তিনি বললেন, সে ফিলোসফার হতে চেয়েছিল। তখন সে জানতে চাইলো, ফিলোসফাররা কি করে? তার উত্তরে চৌদ্দ বছর বয়সী কন্যাটি বলল,

“They think about things.”

আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম, এতো চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর তো আমিও দিতে পারতাম না!

আরেক কন্যা স্পিচ প্যাথলজীতে আন্ডারগ্রাড লেভেলে পড়ছে। বর্ণে আনন্দে উচ্ছাসে ভরা এই মানুষটার তিন কন্যাময় জীবন-এর সাথে আছে তার গবেষণা। গবেষক মায়ের গবেষণায়-ও তারা ভীষণ উৎসাহী। যে মেয়েটি স্পিচ প্যাথলজীর ছাত্রী, সে আমাদের ল্যাব মিটিং থাকলে আমাদের সাথে এসে বসে থাকে, আমরা কি করি, কিভাবে গবেষণা করি, বসে বসে তাই দেখে। মাঝে মাঝে সে তার মায়ের গবেষণা-ও অল্পসল্প সাহায্য করার চেষ্টা করে। আর মা মেয়ের যে কি শ্রদ্ধা ভালোবাসার সম্পর্ক, তা দেখলে মনটা ভরে যায়। আমি মাঝে মাঝে গবেষক মায়ের সাথে তার কন্যার এই আলাপন দেখি আর ভাবি, এভাবেই বুঝি গড়ে ওঠে একজন সহজাত বিজ্ঞানী! ঘুম থেকে উঠে কখনোই অলস সময় কাটাবার সুযোগ পান না আমার সহকর্মী এই সকার-মম + গবেষক। সবচেয়ে অবাক হবেন তার বয়সটি জেনে। ১৯ বছর বয়সে প্রথম কন্যা সন্তানের জননী হয়েছিলেন তিনি, যিনি এখন ৩৬ বছর বয়সী গবেষক এবং একজন গর্বিত মা।

আমার আরেক সহকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পাশাপাশি তার জীবনসংগীর সাথে চালাচ্ছে ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান। এই মেয়েটিকে দেখে আমিই অবাক হয়ে যাই। একাধারে ভিজুয়াল নিউরোসায়েন্টিস্ট, ব্যবসায়ী, নিউরোসায়েন্সের অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ সামলে যাবার সময় পায় কোথায় মেয়েটা! সেইসাথে মহা অ্যাডভেঞ্চারাস সে। প্রতি বছর বার্নিং ম্যান ফেস্টিভালে- নেভাডার মরুভূমিতে এক সপ্তাহ ক্যাম্পিং করে আর সেইসাথে করে নানান শারিরীক কসরত (অনেকটা জিমন্যাস্টিক এর মত), সেইখানে সে যাবেই। অ্যাডভেঞ্চারের কোন সুযোগ পেলে সে ছাড়বে না কখনই। অপরজন, যে ল্যাবের সবকিছুর দেখভাল করে, সে পুরোদস্তুর অ্যাকাডেমিক মানসিকতার মানুষ। গবেষণায় মনটা যেন আটকে থাকে তার। চমৎকার পড়ায়ও সে। তার জীবনসংগীও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই কাজ করছে। দুজনের দারুন বোঝাপড়া। পরস্পর পরস্পরের কাজের ব্যাপারে দারুন সহযোগিতাপূর্ণ! এই যে যাদের কথা বললাম, তাদের কারোরই এলোমেলো চুল নয়, মোটা চশমার ফ্রেম পড়া দুনিয়া ভোলা মানুষ নয়। তারা আর দশটা মানুষের মতই পরিবার পরিজন নিয়ে জীবনযাপন করে, ভালোবাসার মানুষের জন্যও তারা যথেষ্টই সংবেদনশীল। আর আগেই বলেছি তাদের কাজ দেখার জন্য অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এতো আগ্রহ দেখায় যে তাদের কাজের ব্যাপারে দ্বায়িত্বশীলতার কথা বোধ করি আর বলার প্রয়োজন নেই। একেকজন পরিপূর্ণ মানুষ তারা। আমি এই ল্যাবে যা কিছু করতে শিখেছি, তা আমার অ্যাডভাইজারের হাত ধরে। তিনি আমাকে যেমনি হাতে ধরে সবকিছু করতে শিখিয়েছেন, তেমনি তাকেও কেউ একজন হাতে ধরে এসব করতে শিখিয়েছিল, তিনি ছিলেন একজন নারী বিজ্ঞানী। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলিতে দেখা হয়েছিল ডঃ কারেন ডিভলয়েসের সাথে, যিনি ১৯৯৩ সালে বর্ণের রেটিনাল প্রসেসিং-এর তত্ত্ব দিয়েছেন। আমরা বলি গ্রান্ডমা ডিভলয়েস। সেই সাথে দেখেছি প্রায় নব্বই বছর বয়সী এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব্যময়ী বিজ্ঞানীটিকে বক্তৃতা দিতে। অনেকটা রক্তের ধারার মতই জ্ঞানের ধারাও যে বহমান, সেদিন বুঝেছি আমার অ্যাডভাইজার মাইকেল ওয়েবস্টারের অ্যাডভাইজার কারেন ডিভলয়েসকে দেখে।

এই ল্যাবে আমার কাজের ধরণটা একটু বলি। আমাদের কাজের ধারাটা পড়ে কম্পিউটেশনাল নিউরোসায়েন্সে। ব্যাপারটা এক্সপেরিমেন্টাল আর থিওরিটিক্যাল নিউরোসায়েন্সের মিশেল। আমরা প্রথমে চিন্তা করি, আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ‍্য- যা আমরা বর্ণ হিসেবে চিনি, তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট কি করে মানুষের মস্তিষ্ক প্রসেস করে? দৃষ্টিবিজ্ঞানীরা জানে, আমাদের অনেক প্রসেসিং-ই হয় রেটিনাতে, আরো উচ্চতর প্রসেসিং- এর জন্য নির্ভর করা লাগে ভিজুয়্যাল কর্টেক্সের উপর। আমাদের বুঝতে হয় আলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রসেসিং মূলত রেটিনাতে হচ্ছে নাকি ভিজুয়্যাল কর্টেক্সে। হলে কিভাবে হচ্ছে? আমাদের একটা থিওরী বা তত্ত্ব দাড় করাতে হয়, কিভাবে প্রসেসিং হচ্ছে তার উপর। তত্ত্বটা যখন যৌক্তিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে হয়, তখন আমরা তত্ত্বটা পরীক্ষা করে দেখি। আমরা পরীক্ষা করি মানুষের উপরে। মানুষের উপরে পরীক্ষা করার কিছু নিয়মাবলী আছে, এমন ভাবে পরীক্ষা করতে হবে, যাতে কোনভাবেই মানুষের কোন ক্ষতি না হয়। অনথ্যায় হলে সারাজীবনের জন্য আমরা গবেষনা করার সুযোগ হারাবো। তাই যা কিছু পরীক্ষা করতে হবে, তা হতে হবে নন-ইনভেসিভ (অর্থাৎ কোন সার্জারী করা যাবে না, এমনকি একটা সুইও ফোটানো যাবে না) । নন-ইনভেসিভ পরীক্ষণের সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে কঠিন উপায় হল সাইকোফিজিক্স। পরীক্ষার ডিজাইন হতে হয় এমন যাতে আপনি মানুষটিকে কেবল কম্পিউটারের সামনে কিছু ভিজুয়্যাল ডিসপ্লে দেখিয়ে তার কার্যক্রমের পরিবর্তন থেকেই নির্ভরযোগ্য রিডিং নিতে পারেন। প্রয়োজন পড়লে, মাথায় হাই-ডেনসিটি ই.ই.জি. (ইলেক্ট্রো-এন্সেফালোগ্রাফি) ক্যাপ পড়িয়ে ম্যাসিভ নিউরাল অ্যাকটিভিটির রেকর্ড নিতে পারেন, অথবা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজনেন্স ইমেজিং মেশিনে তার নিউরাল অ্যাক্টিভিটির ইমেজ- মানে তার মস্তিষ্কের কোন অংশ কাজ করছে তা দেখতে পারেন। ব্যাস এই, এই থেকেই আপনাকে বুঝতে হবে আপনি মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালী নিয়ে যে তত্ত্ব দাড় করিয়েছেন, তা সঠিক নাকি ভুল। দারুন না?

ঘটনাচক্র-৪

ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গত মাসে আমাকে যোগ দিতে হল ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের নিউরোসায়েন্সে প্রোগ্রামে, নিউরাল প্লাস্টিসিটি গবেষণায়। এইবার আর মানুষ নিয়ে কাজ নয়, কাজ করব ইঁদুরের উপর। আগের ল্যাবে যে তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছিলাম, সেই তত্ত্বটাই ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখব, তার মস্তিষ্কের নিউরাল সার্কিট্রিতে কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। এইখানে কাজের সুবিধা হল, ইঁদুরের উপর একেবারে তাদের সেলুলার-মলিকুলার পরিবর্তন পর্যন্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা যায়, যা মানুষের উপর করা যায় না। যাই হোক, এই গবেষণার গল্প নাহয় আরেকদিন বলব, আজ বলি আমার সহকর্মীদের কথা। এইখানে আমার অ্যাডভাইজার একজন নারী। শুধু তাই নয় আমি সহ পাঁচজন গবেষকের চারজনই নারী। আমাদের ল্যাবের একেকজন একেদিকে এক্সপার্ট, কেউ ইলেক্ট্রোফিজিওলজীতে, কেউ সেলুলার-মলিকুলার ইমেজিং-এ, কেউ হিস্টোলজীতে, আর আমি ভিজুয়্যাল পারসেপশনের বিহেভিয়ারাল স্টাডিতে, আমার অ্যাডভাইজার সবদিকেই এক্সপার্ট। কেন আমি এই ল্যাবটার কথা বিশেষভাবে বলছি? চিন্তা করে দেখুন, এতোটা ডাইনামিক একটা কর্মক্ষেত্র, কি দারুন আত্মবিশ্বাসের সাথে চালাচ্ছে নারী বিজ্ঞানীরা! খোদ আমেরিকাতে, ডক্টরাল পর্যায়ে এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী নারী, কিন্তু মাত্র এক দশমাংশ নারীকে দেখা যায় ফ্যাকাল্টি পর্যায়ে। ঐ জায়গাটায় পৌঁছুতে হলে প্রতিটি পর্যায়ে নারী বিজ্ঞানীকে প্রমাণ করতে হয়, সে দক্ষ, যোগ্য। প্রমাণ করতে হয় যে কেবল বিজ্ঞানী হিসেবেই দক্ষ তাই নয়, দক্ষতা তার বিজ্ঞানী তৈরীতেও, দক্ষতা তার সামগ্রিক পরিচালনায়, এতোটা দক্ষ হতে হয় যাতে টিম হান্টের মত লিঙ্গ-বৈষম্যকারী কোন পুরুষ বিজ্ঞানীও যাতে তার দক্ষতা অস্বীকার করতে না পারে। কতটা সাধনায় তা তৈরী হয়, তা কেবল বুঝতে পারে আরেকজন নারী বিজ্ঞানীই। আমার অ্যাডভাইজার এমন একজন বিজ্ঞানীর ছাত্রী যাকে ভিজুয়্যাল প্লাস্টিসিটির সবচেয়ে কৃতী বিজ্ঞানী হিসেবে মনে করা হয়। এমন একজনের কাছ থেকে শিখতে পেরেছে বলে স্বাভাবিক ভাবেই যোগ্যতার মাপকাঠিতে এগিয়ে ছিলেন, হয়ত ফ্যাকাল্টি হবার পথটি তার কঠিন হয়নি, কিন্তু হবার পরও তাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়ছে। তিনি যা করতে চেয়েছেন তা করে দেখাতে হয়েছে। প্রায় ছয় বছর আগে তিনি অ্যাম্বলিওপিয়া যে নিরাময়যোগ্য তা বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিয়েছেন। অচিরেই অ্যাম্বলিওপিয়া নিরাময়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করবেন। আমি গর্বিত, এমন সব বিজ্ঞানীদের সাথে কাজের সুযোগ পেয়েছি, এমন সব নারী বিজ্ঞানীদের সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। আমি এদের কাছ থেকে দুটো জিনিস অর্জন করতে চাই, এক তাদের বিজ্ঞানবোধ, আরেক তাদের ব্যক্তিত্ব্য, যার শক্তিতে তারা আপাত পুরুষ প্রধান বিজ্ঞানের জগতে দৃপ্ত পদচারণা করে যাচ্ছেন।

এই লেখাটি লিখেছি সেইসব মেয়েদের জন্য, যারা পরিবার সমাজের ঋণাত্মক কথার চাপে প্রকৌশলী বা বিজ্ঞানী হবার স্বপ্নকে মাটিচাপা দিয়ে ফেলে, সেইসব ছেলের জন্য যারা সহপাঠিনী চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক না মেখে বিজ্ঞানের বই নিয়ে পড়ে থাকলে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। সেইসব বাবার জন্যে যারা মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ার হতে না দিয়ে বিয়ের জন্য ইঞ্জিনিয়ার পাত্র খোঁজেন। সেইসব মায়ের জন্য যারা মেয়ের বিজ্ঞানী হবার বাসনা শুনলে আতঁকে ওঠেন। সেইসব মানুষের জন্য, যারা ভাবেন মেধা থাকে পুরুষের লিঙ্গের ডগায়, মেয়েদের যেহেতু ওটা নেই, তাই মেয়েদের বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী হবার স্বপ্ন বাদ দিয়ে পুরুষ বিজ্ঞানী-প্রকৌশলীদের সাথে প্রেম-বিয়ের স্বপ্ন দেখাই নারীসুলভ। আর লিখেছি কিছু বঙ্গদেশীয় নামেতে ডক্টরেট ধারী গর্দভের জন্য যারা বিয়ে করে বউ-এর সেবাযত্ন পাওয়ার জন্য আর নিজেরা পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে কোন মতে একটা ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে লেকচার দেয় মেয়েদের দ্বারা গবেষণা করাটা খুব মুস্কিলের কাজ, তাদের উচিত তারা মা হবে না গবেষক হবে তা বুঝে নেওয়া। যারা স্ত্রীর কাধে সংসারের সবটুকু দ্বায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ভাবেন, পেয়েছি আমার সংসার দেখেশুনে রাখার জন্য একটা ফুলটাইম কাজের লোক, আমি পুরুষ, তাই চাকরী গবেষণাটা আমিই করব, এই মানসিকতার ডিগ্রীধারী অশিক্ষিতদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশী কিছু আশা করাই ভুল। আশা করি আমাদের দেশের মেধাবী মেয়েরা একদিন এইসব লিঙ্গবাদী পুরুষদের ভালো করে দেখে নেবে, যেমনি করে টিম হান্টকে এইবার নারী বিজ্ঞানীরা ভালো করে দেখে নিয়েছে।