২০১২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অভিজিৎ রায় এবং অনন্ত বিজয় দাশ
ফেব্রুয়ারি, যে মাসটাকে আমি ভাবতাম ঢাকা শহরের সবচেয়ে প্রাণময় মাস সেই মাসটির ছাব্বিশ তারিখ রাতে ইসলামিক সেক্যুলার বাংলাদেশে আমার ভাইকে পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই সাথে কুপিয়ে আহত করা হয় আমার বোনকে, বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় তার হাতের আঙ্গুল, চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয় তার মাথায় এবং চোখের সামনে ধ্বংস করে দেওয়া হয় তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। অসহায়ের মতো আমার বোন হারিয়ে যেতে দেখলেন তার প্রিয়তমকে আর আমরা দেখলাম আমাদের প্রিয় দাদার মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে থাকা, শুনলাম আমার বোনের আর্ত-চিৎকার, আরও দেখলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের কেচিগেট। কেচিগেটের ওপারে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা আমার ভাই কিছুক্ষণ আগেই হাঁটছিলেন আমার বোনের হাত ধরে, হাজারো মানুষকে আপন ভেবে তারা এগিয়ে যাচ্ছিলেন সামনের দিকে, তখনও হয়তো তার মস্তিষ্কের নিউরনে লেখা হচ্ছিলো নতুন কোনো প্রবন্ধ, সমাধান হচ্ছিলো মুক্তমনার কারিগরি কোনো সমস্যা। আমার দাদা কিংবা বোন, আমার দেখা শ্রেষ্ঠতম মানুষ, তারা নিজেদের বদলে ভালোবেসেছিলেন তাদের দেশকে, ভালোবেসেছিলেন দেশের মানুষকে, আলোকিত করতে চেয়েছিলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজটিকে। কিন্তু আলো অন্ধকারের সবচেয়ে বড় শত্রু, কারণ আলো জ্বালালেই দূর হয় অন্ধকার। আলোকে চাপাতি দিয়ে অন্ধকারকে কোপাতে হয় না, গুলি করতে হয় না, ঘিলু ফেলে দিতে হয় না। অন্ধকারে আলো হাতে পথ চলাই ছিলো তাদের অপরাধ, আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজে এই অপরাধ সর্বোচ্চ অপরাধ, এমন অপরাধীদের আমরা পেছন থেকে এসে হত্যা করি। কারণ আমরা অন্ধকার চাই। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সে রাতে আলো হাতে গিয়েছিলেন আমাদের আঁধারের যাত্রী, কারণ তাকে বলা হয়েছিলো বিজ্ঞান লেখকদের সাথে আড্ডার কথা। যদিও সেখানে বিজ্ঞান লেখকদের সংখ্যার তুলনায় অনেক অনেক বেশি ছিল গুপ্ত ঘাতকেরা। যারা তাকে ডেকে নিয়ে অন্ধকারের সঁপে দিয়েছিলো, তারা সেদিন তার মৃত্যুতে একটুও আলোড়িত হয় নি, ক্ষুধা পেলে আমাদের যেমন খেতে হয়, তাদেরও সেরাতে খুদা মেটাতে বিরিয়ানি খেতে হয়েছে, কারও বা খেতে হয়েছে মার হাতের রাতের খাবার কিংবা অংশ নিতে হয়েছে র্যাডিসনের পার্টিতে। সব শেষে তারা শান্তির নিদ্রা দিতে পেরেছে, কারও কারও সেই নিদ্রা ভাঙ্গতে লেগেছে বিশ দিন।
২০১৫ সালের অমর একুশে বইমেলায় অভিজিৎ রায় এবং বন্যা আহমেদ
অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদ, কিংবা অনন্ত বিজয় দাশ তারা কেউই অনন্ত পরলৌকিক জীবনের ভ্রান্ত স্বপ্নে বিভোর ছিলেন না, তাদের কাছে জীবন ‘পেইল ব্লু ডট’। যদিও আশরাফুল মাখলুকাতদের কাছে জীবনটা ক্ষণিকের নয়, তাই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াইকারী আমরা পুরোটা জীবন ধরে একটা বই পাঠ করতে থাকি, শেষ করতে পারি না। বাস্তবতা যে জীবন সে জীবনকে অপচয় করে আমরা পরলৌকিক স্বপ্নের পেছনে ছুটি মাঝে মাঝে পেছন থেকে অভিজিৎ, অনন্তকে হত্যা করি, হত্যা করার সাহস না থাকলে সমর্থন দেই, বেহেশতস্কয়ারে পাঁচ কাঠা প্লট নিশ্চিত করতে। সেই প্লটের জন্য আমরা মানুষ বাদে সবকিছু হতে পারি, আমরা হতে পারি জামাত ইসলাম, হতে পারি হিজবুত তাহরির, হতে পারি আনসার বাংলা, হতে পারি আল-কায়েদা। কিন্তু আমাদের ভাগ্যটা ভালো আমরা সবাই আশরাফুল মাখলুকাত হলেও আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ অভিজিৎ রায়, কিছু মানুষ বন্যা আহমেদ, কিছু মানুষ অনন্ত বিজয় দাশ, কিছু মানুষ ওয়াশিকুর বাবু, কিছু মানুষ আহমেদ রাজিব হায়দার হয়ে যান।
ছবি: Madhu Mondol
২০০৯ সালে যখন প্রথম আমার দেখা হলো অভিজিৎ দা আর বন্যাপার সাথে তখন তাদের একমাত্র কন্যা তৃষা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী। অনেকদিন পর দেশে এসে বন্যাপা, অভিজিৎ দা তখন আনন্দে উদ্বেলিত। আমাকে বললেন, তৃষা ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, সব ছেড়ে তারা তখন চলে আসবেন প্রিয় বাংলাদেশে, কেরানীগঞ্জের সবুজের বুকে একটা ঘর বানিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবেন দেশে। ভবিষ্যতের সেই জীবনের দিকেই তাকিয়ে থেকে হয়তো তারা কাটিয়ে দিয়েছিলেন ২০০৯ থেকে ২০১৫ ছয়টা বছর। ২০১৫ তে বন্যাপা আবার এলেন অভিজিৎ দাকে নিয়ে। দেশে আসার পর প্রথম যেদিন দেখা হলো বন্যা আপার সাথে আমি আমার বোনকে ছয় বছর পর সামনে পেয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বন্যাপা বললেন, রায়হান সতেরো বছর পরে বইমেলায় আসলাম। সতেরো বছর! এরপরের বইমেলায় আসতে তাকে আরও কতো সতেরো বছর অপেক্ষা করতে হবে তা তখন আমিও জানতাম না, বন্যাপাও জানতেন না, জানতেন না অভিজিৎদা। কিন্তু ঘাতকেরা জানতো তারা আর কখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অপরাধীদের আসলে দেবে না বইমেলা নামক হরেক বইয়ের অপরাধ মেলায়। আশরাফুল মাখলুকাতেরা একটা বই পড়েই সব জেনে ফেলে তাই তাদের কাছে ভিন্ন-চিন্তা করা মানেই অপরাধ কারণ এক বই চিন্তা করতে নিষেধ করে, আর যেসব বই মুক্তচিন্তা করতে বলে সেসব বইয়ের লেখকরা তাদের কাছে অপরাধী, এতোটাই অপরাধী যে তাদের পেছন থেকে তারা হত্যা করে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে।
ঠিক যেমন করে আশরাফুল মাখলুকাতেরা কুপিয়ে চলছে আমাদের বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পর থেকে। আমরা বাঙালি মুসলমানেরা তাদের মৌন সম্মতি দিতে দিতে মহীরুহে পরিণত করেছি এবং ভোট দিয়ে বানিয়েছি দেশের শাসক। ২০০১ সালে সেনানিবাসের রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধিতাকারী দল জামায়াত ইসলামি ক্ষমতার মসনদে আহরণ করে আশরাফুল মাখলুকাতদের ভোটে। ক্ষমতার পর থেকেই তারা তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরিতে উঠে পড়ে লেগে যায়, গ্রামের পর গ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় হামলা চালাতে থাকে আশরাফুল মাখলুকাতেরা। হিন্দু নারীদের ধর্ষণের মাধ্যমে তারা তৈরি করতে থাকে শুদ্ধতম সমাজের, হত্যা করতে থাকে সমাজের অশান্তিদের, দেশ ছাড়া করতে থাকে শান্তির ধর্ম অনুসরণ যারা করে না তাদেরকে। সে সময় আমরা মৌন সম্মতি দিতে থাকি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কিন্তু ঐযে বললাম আমাদের মধ্যে সবাই আশরাফুল মাখলুকাত নন, আমাদের মধ্যে আছেন অজয় রায়, অভিজিৎ রায় আমাদের মধ্যে আছেন হুমায়ুন আজাদ। শান্তি প্রতিষ্ঠার সেই সময়েই মুক্তমনার প্রতিষ্ঠা।
২০০১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে-যখন সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার নিপীড়ন শুরু হলো, তখন এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে শুরু করেছিল এই মুক্তমনাই। আসলে শুধু ‘অত্যাচার’ আর ‘নিপীড়ন’ বললে বোধহয় ভয়াবহতার মাত্রাটা বোঝা যাবে না। নির্বাচনের পরবর্তী কয়েক মাসে ঠিক কী হয়েছিল, তা বোঝা যাবে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত জন ভাইদালের ‘Rape and torture empties the villages’ (জুলাই ২১, ২০০৩) একটি প্রবন্ধ পড়ে নিলেই। প্রবন্ধটিতে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে পূর্ণিমা রানীর মতো হতভাগ্যদের ওপর সেসময় কীভাবে গণ ধর্ষণের স্টিম-রোলার চালানো হয়েছিল। শুধু পূর্ণিমা রানীই একমাত্র শিকার নন, ভাইদালের মতে নির্বাচনোত্তর তিন মাসে ডজনকে ডজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, অন্তত এক হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে আর কয়েক হাজার লোকের জমিজমা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এধরনের রিপোর্ট শুধু গার্ডিয়ানে বা হিন্দুস্থান টাইমসে নয়, পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছিল ডেইলি স্টার, প্রথম আলো, সংবাদ, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজসহ দেশের সকল শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোতে। এমনকি মৌলবাদী আর সরকার সমর্থিত পত্রিকা ইনকিলাব আর সংগ্রামও একেবারে বাদ যায় নি। মুক্তমনার ঢাকা নিবাসী সদস্যরা ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যানারে বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হচ্ছে সেসব অঞ্চলে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বৈঠক করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা দেবার দাবী জানায়। ভোলা জেলায় অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে যারা সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলো তাদের আর্থিক ও মানসিকভাবে সহায়তা প্রদান করা হয় ‘দৃষ্টিপাত নামের একটি সংগঠনের সাথে মিলে।
শান্তি স্থাপনে বদ্ধপরিকর জামাত-বিএনপি সরকার মুক্তমনার এহেন কাজকর্মকে ভালো চোখে দেখে নি বলাই বাহুল্য। বক্তব্য দেওয়া হলো এই বলে যে, দেশের বাইরে এক ‘বাংলাদেশ বিরোধী কুচক্রী মহল’ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বেশ কিছু জ্বালাময়ী ভাষণও দিলেন। রটিয়ে দেওয়া হলো যারা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে তারা হয় ভারতের ‘র’-এর এজেন্ট, নয়ত ইহুদিদের ‘মোসাদ’-এর আর নাহয় আমেরিকার সি.আই.এর! সেসময় অভিজিৎ রায় মুক্তমনায় ‘যুক্তির আলোয় দেশের ভাবমূর্তি এবং দেশপ্রেম’ নামের একটি প্রবন্ধ লেখেন, বাংলায়। সে প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরেছিলেন দেশপ্রেমের যৌক্তিক সংজ্ঞা। তিনি বলেছিলেন, দেশ মানে দেশের মাটি নয়, দেশপ্রেম মানে কখনোই দেশের মাটির প্রতি বা প্রাণহীন নদীনালা আর পাহাড়-পর্বতের জন্য ভালোবাসা হতে পারে না। দেশপ্রেম মানে হওয়া উচিত দেশের মানুষের প্রতি প্রেম; লাঞ্ছিত, বঞ্চিত অবহেলিত গণ-মানুষের প্রতি ভালোবাসা। রাষ্ট্রের একটি প্রধানতম উপাদান হলো জনসমষ্টি। এই জনসমষ্টিকে বাদ দিয়ে শুধু কতকগুলো প্রাণহীন নদীনালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত আর মাটির প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিকে আর যা-ই বলা হোক, ‘দেশপ্রেম’ বলে অভিহিত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন ‘সনাতন দেশপ্রেম’ও শেষ পর্যন্ত কিন্তু একটা ডগমাই। মুক্তমনার অন্যান্য সদস্যরাও এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। দেশপ্রেম নিয়ে মুক্তমনাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেসময় সচেতন মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো সরকারের অন্ধ আনুগত্যই দেশপ্রেম নয়। দেশে অরাজকতা, হত্যা নিপীড়নের কাহিনী যেকোনো মূল্যে কার্পেটের নিচে পুরে রেখে দেশকে আকাশে তুলে রাখার নামই দেশপ্রেম নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলাটাও দেশপ্রেমের অংশ। সংকীর্ণ দেশপ্রেমের সংজ্ঞা থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তিবাদী দৃষ্টি দিয়ে ‘দেশের ভাবমূর্তি’ দেখবার এই মানসিকতার উত্তরণ একদিনে হয় নি। তবে শুরুটা করেছিলো মুক্তমনাই।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রচারে মুক্তমনা সদস্যরা নেতৃত্ব দিয়েচ্ছেন প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে । বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখে অভিজিৎ রায় প্রথম লিখেছিলেন ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ যা বই হিসেবে বেরোয় ২০০৫ সালে। বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ সিরিজটিও বই হিসেবে বেরিয়েছে (২০০৭), সেইসাথে বেরিয়েছে ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ (২০০৭)। এছাড়া আরও বেরিয়েছে ‘স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’ (২০০৮), এবং ‘সমকামিতা : বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ (২০১০), পার্থিব (২০১১), অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১), মানুষিকতা (২০১৩), বিশ্বাসের ভাইরাস (২০১৪), শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৫) সহ বিশটির অধিক বই। প্রতিটি গ্রন্থের উদ্দেশ্য একই। বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার ও প্রসার। বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে বই প্রবন্ধ লিখে মুক্তমনাকে সমৃদ্ধ করেছেন ফরিদ আহমেদ, সিদ্ধার্থ, অপার্থিব, মেহুল কামদার, মীজান রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, তানবীরা, জাহেদ আহমেদ, জাফর উল্লাহ, অজয় রায়, বিপ্লব পাল, প্রদীপ দেব, আবুল কাশেম, আকাশ মালিক, শিক্ষানবিস, রৌরব, তানভীরুল, পৃথ্বি, ইরতিশাদ আহমদ, সংশপ্তক, স্নিগ্ধা, হোরাস, টেকি সাফি, শফিউল জয়, সৈকত চৌধুরী, আল্লাচালাইনা, রূপম, তামান্না ঝুমু, নিলয়, লীনা রহমানসহ আরও অনেকেই। এ লেখকদের থেকেই উঠে এসেছে ‘যুক্তি’র মতো ম্যাগাজিন, নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ‘মুক্তান্বেষা’ এবং ‘মহাবৃত্ত’। এই ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ ব্যাপারটি আমাদের কাছে সবসময়ই ভিন্ন অর্থ বহন করে। ‘বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার’ বলতে আমরা এটি বোঝাই না যে গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যুৎ পৌঁছিয়ে দেওয়া কিংবা উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করা। ওগুলোর প্রয়োজন আছে কিন্তু তা করার জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারই আছেন। আমরা বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার বলতে বোঝাই কুসংস্কারমুক্ত, প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমুখী সমাজ গড়ার আন্দোলন। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই সে ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ হয় না, হয় না আলোকিত মানুষ। তাই দেখা যায় এ যুগের অনেকেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেও বা বিজ্ঞানের কোনো বিভাগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেও মনে-প্রাণে বিজ্ঞানী হতে পারেন নি, পারেন নি মন থেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করতে। বাংলাদেশের এক বিখ্যাত ‘ইসলামি পদার্থ বিজ্ঞানী’ আছেন যিনি একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শতাব্দী প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে ‘আধুনিক বিজ্ঞানের’ সন্ধান পান, মহানবীর মিরাজকে ‘আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি’ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চান। ভারতের এক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আবার বেদ আর গীতার মধ্যে ‘বিগব্যাং’ আর ‘টাইম-ডায়ালেশন’ খুঁজে পান। এরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন ঠিকই, চাকরি ক্ষেত্রে সফলতাও হয়ত পেয়েছেন, কিন্তু মনের কোণে আবদ্ধ করে রেখেছেন সেই আজন্ম লালিত সংস্কারগুলো, আঁকড়ে ধরে রেখেছেন যুক্তিহীন ধর্মীয় ধ্যানধারণা। এই ‘বিজ্ঞানী’ তকমাধারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলোই বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে সবচেয়ে বড় বাধা। বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ‘বিজ্ঞানী’ নামধারী মানুষগুলোর কুসংস্কারের সাথে যেমন আমরা পরিচিত হয়েছি, ঠিক তেমনই আমাদের দেশে আরজ আলী মাতুব্বর বা রঞ্জিত বাওয়ালীর মতো স্বল্প শিক্ষিত, ডিগ্রিহীন, সংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী মানসিকতার নির্লোভ মানুষও আমরা দেখেছি।
১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বা জামাতিদের ভাষায় ঘাদানিকের কথা আমরা সবাই জানি। প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মৃত্যুবরণ করার পর থেকে বাংলাদেশে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতি বছরই জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক প্রদান করে থাকে। পদক থাকে দুটি। একটি দেওয়া হয় ব্যক্তিকে, আরেকটি দেওয়া হয় সংগঠনকে। ২০০৭ সালে জাহানারা ইমামের তেরোতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মারক সভায় ব্যক্তির জন্য বিবেচিত পদকটি পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার। আর সংগঠনের পদকটি পেয়েছিল মুক্তমনা। পদকটি মুক্তমনার পক্ষ থেকে গ্রহণ করেন অধ্যাপক অজয় রায়। পদকের স্মারক পত্রে বলা হয়েছে-
বাংলাদেশে মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মুক্তচিন্তার আন্দোলনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ‘মুক্তমনা’ ওয়েবসাইট। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশে ও বিদেশে কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সেক্যুলার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করণের পাশাপাশি তাদের বিজ্ঞানমনস্ক করবার ক্ষেত্রে ‘মুক্তমনা’ ওয়েবসাইটের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক অজয় রায়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের তরুণ মানবাধিকার কর্মীরা এই ওয়েবসাইটকে তাদের লেখা ও তথ্যের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ থেকে সম্মৃদ্ধতর করছেন। ২০০১ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ‘মুক্তমনা’ তখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনের পাশাপাশি আর্ত মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এবং ধর্ম-বর্ণ-বিত্ত নির্বিশেষে মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য ‘মুক্তমনা’ ওয়েবসাইটকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদক ২০০৭’ প্রদান করা হলো।
বাংলাদেশে এর আগে কোনো ওয়েবসাইট জাহানারা ইমাম পদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে নি। স্মারকপত্রের প্রথম লাইনটি গুরুত্বপূর্ণ। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবারের পদক প্রাপ্তির বিবেচনায় মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতার পাশাপাশি ‘মুক্তচিন্তার আন্দোলন’কেও গুরুত্ব দিয়েছে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্নটি এসে পড়ে-এই মুক্তচিন্তার আন্দোলনটি কী, কেন এটি অনন্য কিংবা নিজগুণে স্বকীয়? যে সমাজ আর সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী আমরা, তার সবটুকুই যে নির্ভেজাল তা বলা যায় না। এতে যেমন প্রগতিশীল বস্তুবাদী উপাদান রয়েছে, তেমনই রয়েছে আধ্যাত্মবাদ, বুজরুকি, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস আর অপবিশ্বাসের রমরমা রাজত্ব; রয়েছে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। এই অন্ধকার সুদীর্ঘকাল ধরে বংশ পরম্পরায় আমাদের চিন্তা চেতনাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে এই ‘চেতনার দাসত্ব’ থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়-বরং বাস্তবিকই কঠিন ব্যাপার। রাহুল সাংকৃত্যায়ন একবার তার একটি লেখায় বলেছিলেন-
মানুষ জেলে যাওয়া বা ফাঁসির মঞ্চে ওঠাকে বিরাট হিম্মত মনে করে। সমাজের গোঁড়ামিকে ভেঙে তাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, জেলে যাওয়া বা ফাঁসির মঞ্চে ওঠার চেয়ে ঢের বেশি সাহসের কাজ।
কথাটি মিথ্যে নয়। তাই ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা যায়, খুব কম মানুষই পারে আজন্ম লালিত ধ্যান ধারণাকে পরিত্যাগ করে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে, খুব কম মানুষই পারে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। খুব কম মানুষের মধ্যে থেকেই শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসে একজন আরজ আলী মাতুব্বর, আহমেদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়। আমাদের শাসক আর শোষকশ্রেণি আর তাদের নিয়ন্ত্রিত বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা কখনোই চায় না জনগণ প্রথা ভাঙুক, কুসংস্কারের পর্দা সরিয়ে বুঝতে শিখুক, জানতে শিখুক অজ্ঞতা, শোষণ আর অসাম্যের মূল উৎসগুলো কোথায়। জনগণের ‘জ্ঞান চক্ষু’ খুলে গেলেই তো বিপদ, তাই না! আর সেজন্যই জনগণকে অন্ধকারে রাখতে চলে বিজ্ঞানের মোড়কে পুরে ধর্মকে পরিবেশন, লাগাতার আধ্যাত্মবাদী প্রচারণা, পত্র-পত্রিকায় বড় আকারে রাশিফল, সর্পরাজ এবং আধ্যাত্মবাদী গুরু আর কামেল পীরের বিজ্ঞাপন, মন্ত্রী আর নেতা-নেত্রীদের মাজার আর দরগায় সিন্নি দেওয়া অথবা নির্বাচন উপলক্ষে হজে যাওয়া, মাথায় কালো পট্টি বাঁধা। মুক্তমনাদের লড়াই এই সামগ্রিক অসততার বিরুদ্ধে, অন্ধবিশ্বাস আর অপবিশ্বাসকে উস্কে দেওয়া এই সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে। এ লড়াই বৌদ্ধিক, এ লড়াই সাংস্কৃতিক। এ লড়াই সমাজকে প্রগতিমুখী করার ব্রত নিয়ে সামগ্রিক অবক্ষয় আর অন্ধকার ভেদ করে আশার আলো প্রজ্বলিত করবার লড়াই। এ লড়াই আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কাছে চেতনা মুক্তির লড়াই।
চিন্তার এ দাসত্ব থেকে মুক্ত করার লড়াইয়ের ময়দানটি একদিনে গড়ে উঠে নি। ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্বাস এবং যুক্তির সরাসরি সংঘাতের ভিত্তিতে যে সামাজিক আন্দোলন বিভিন্ন ব্লগ কিংবা ফোরামগুলোতে দানা বাঁধতে বাঁধতে জাতিকে ২০১২ সালের শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে করেছে স্পষ্ট বিভাজিত, আমাদের কাছে তা প্রাচীনকালের ব্রাহ্মণ-চার্বাকদের লড়াইয়েরই একটি বর্ধিত, অগ্রসর ও প্রায়োগিক রূপ। এ এক অভিনব সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বাঙালির এক নবজাগরণ যেন। আশরাফুল মাখলুকাতদের চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে আবির্ভাব হয়েছিল মুক্তমনার, প্রথমে ফোরাম হিসেবে, পরে রূপ নিয়েছিল সামগ্রিক একটি ওয়েব এবং পরবর্তীকালে ব্লগ-সাইটে। এর পরের কাহিনী তো ইতিহাস। মুক্তমনার অবদান যে কোথায় পৌঁছে গেছে তার উল্লেখ মেলে জাহানারা ইমাম পদকের স্মারক লিপিতে-‘দেশে ও বিদেশে তরুণ প্রজন্মকে সেক্যুলার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করণের পাশাপাশি তাদের বিজ্ঞানমনস্ক করার ক্ষেত্রে মুক্তমনা ওয়েবসাইটের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে।’
সে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে অভিজিৎ রায় বুঝেছিলেন এ সংগ্রামে আমরা মানুষ খুব কম। তাই তিনি লিখেছিলেন-
‘ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি।’ তিনি আরও লিখেছিলেন, পরাজয় নিশ্চিত জানলে মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধ শক্তি ‘সব সময়ই … শেষ কামড় দিতে চেষ্টা করে… এগুলো আলামত… তাদের অন্তিম সময় সমাগত।… বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী।’
আমি জানি না, বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী কিনা। তবুও প্রাণশংকা উপেক্ষা করে অভিজিৎ রায় লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছেন, নানা ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছিলেন অনন্ত বিজয় দাশ। শান্তিকামী অন্ধকারের সিপাইরা তাই আজ চাপাতি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের খুঁজতে, আমাদের প্রত্যেককে এক এক করে শেষ করে তারা প্রতিষ্ঠা করতে চায় অন্ধকারাচ্ছন্ন শান্তির। কিন্তু বন্যা আহমেদের ভাষায়- এরা তো সবসময়ই ছিলো-
কিন্তু ইতিহাস ও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে তারপরই মনে পড়ে যায় সে কথা, তোমরা তো সব সময় ছিলে। তোমাদের মতো ধর্মোন্মাদ অশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই এগিয়েছে মানবসভ্যতা। তোমাদের মতো হায়েনার দল সব সময় প্রগতিকে খুবলে খুবলে খাওয়ার চেষ্টা করেছে। বুদ্ধিবৃত্তি, বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, সবই তোমাদের আতঙ্কিত করেছে যুগে যুগে। তোমরাই তো প্রতিবার জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রগতি আটকাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছ। কিন্তু সামান্য কলমের আঁচড়ে তোমাদের কাঁচের ঘর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। তোমাদের দুর্বল ধর্মবিশ্বাস মুক্তচিন্তার হাওয়ায় নড়ে ওঠে। তলোয়ার নিয়ে, চাপাতি নিয়ে ছুটে আস, কল্লা ফেলেই শুধু তোমাদের ঈমানরক্ষা হয়।
তোমরা তো সব সময় ছিলে…
হাইপেশিয়ার শরীরের মাংস তোমরাই চিরে চিরে উঠিয়েছিলে। অসংখ্য নির্দোষ ‘ডাইনি’ পুড়িয়েছ তোমরা। সতীদাহে মেতেছ। ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে দানবীয় আনন্দ পেয়েছ। কূপমণ্ডূকের মতো গ্যালিলিওকে শাস্তি দিয়ে স্বস্তির ঢেঁকু্র তুলে ভেবেছ, এই বুঝি পৃথিবীর ঘোরা চিরতরে বন্ধ করে দিতে সক্ষম হলে!
না তারা কোনোকিছুই চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারবে না। এক অভিজিতের থেকে জন্ম নেবে লক্ষ অভিজিৎ। এক অনন্ত থেকে জন্ম নেবে লক্ষ বিজয়। অভিজিৎ কিংবা অনন্তকে আমরা কোনোদিন ফিরে পাবো না, এখন দুঃখ হয় চাপাতির আঘাতে লুটিয়ে পড়ার সময় আমাদের সেই দুঃখও আর থাকবে না। কিন্তু মুক্তমনা থাকবে, মুক্তমনার সংগ্রাম চলবে। কোনোদিন থামবে না। অভিজিৎ রায়ের তৈরি করা মুক্তমনা এবার ডয়েচে ভেলের দ্য ববস জুরি পুরস্কার জিতেছে, পুরস্কার প্রদানকারীদের ভাষায় এই পুরস্কার সমাজ পরিবর্তনের স্বীকৃতি। আর একদিন পরে আমাদের প্রিয় বন্যা আহমেদ সে পুরস্কার গ্রহণ করবেন কিন্তু আমি জানি, তার মন জুড়ে থাকবে অভিজিৎ, অনন্ত। সমাজ পরিবর্তনের যে যুদ্ধে প্রাণ দিলেন আমাদের অভিদা আর অনন্ত দা সে যুদ্ধ তো সবে শুরু। কবে শেষ হবে, কোনোদিন শেষ হবে কিনা তার উত্তর আমাদের অজানা। তবুও আমরা আশা করে যাবো, আমরা কলম হাতে আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবো, আর যখন খুব মন খারাপ হবে তখন অভিজিৎ দার মতো শুনবো সুমনের গান-
‘মানুষ জাগবে তবেই কাটবে অন্ধকারের ঘোর’।
অনন্ত বিজয় দাশের সৌজন্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে লাগানো মুক্তমনা ব্যানার
আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি বিজ্ঞানের নিত্য নতুন সব খবর বাংলায় অভিদার মতো আপনারা আরও যারা আছেন সমন্বয় করে আমাদের ক্ষুদা মেটাবেন। যাতে আমাদের চেতনা বিকশিত হয়।
অনেক ভাল লাগলো লেখাটি। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়ীকতার বিপক্ষে প্রগতিশীলতার এই লড়াইয়ে জয় অবশ্যম্ভাবী , এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
অভিজিত দা তুলনা হয়না। রায়হান ভাইকে ধন্যবাদ। আমরা আপনাদের কাছ থেকে অভিজিৎ দার মতো লেখা চাই। প্লিজ হতাশ করবেন না।
আশা করি হতাশ হবেন না।
হায় ছবি! তুমি শুধু ছবি!
.
উৎস সন্ধানের জন্য যে কৌতুহলী মন দরকার তা ক’জনার আছে? আর নিজের ঘরের মগজধোপা, মানে নিজ মা বাবারা; ধর্মের মত রুপকথা’কে শিশুর মাথায় ঢুকিয়ে দেয় এটিও তো সত্য। বেশির ভাগ মানুষ শেখে এই পরম আপন সর্ষেভুতেদের থেকে। শেখে ধর্মের মত গুরুত্বহীন ব্যপারকে প্রশ্নাতীত ভাবে গুরুত্ব দিতে। ঘরের ভেতর কালো হাতির উপস্থিতি অবজ্ঞা করে, দেখতে পায় না এত বড় সমস্যার উৎস। উৎস সনাক্তের মানসিক যোগ্যতাও খুব দরকারী। ধর্মবাজ শাসক শোষকরা আজ এতো শক্তিশালী হয়েছে মহা সংগঠিত হবার কারণে। বহুদিনের বোনা বিষাক্ত ফসল এখন ঘরে বসে খায় ওরা। নিয়ন্ত্রিত বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার প্রথা ভাঙতে আমাদের আরো একাত্ম হয়ে ভাবতে হবে; সংগঠিত হয়ে গ্রহযোগ্য দীর্ঘমেয়াদী ভাবনাগুলো মেলে ধরতে হবে নতুনদের কাছে। আজকের নতুনরা, যারা অভিভাবক তারা যেন তাদের শিশুর মগজধোলাই আর না করে, মুক্ত মনে বড় করে, অধিকার দেয় শিশুটিকে তার মত জীবন ভাবনায় বড় হতে।
অনেকদিন পর লিখেছেন। বুঝতে পারছি। সঙ্কট কেটে যাক। মুক্ত মনের সব মানুষ নিরাপদে থাকুক। শুভেচ্ছা।
এখন থেকে নিয়মিত লেখার আশা করি। অভিদার মৃত্যু এতোটাই স্তব্ধ করে দিয়ে গেছে আমাকে যে লিখতে বসতেই ইচ্ছা করতো না।
বুঝতে পারছি। আরো অনেকেই স্তব্ধ হয়ে আছে। আমরা আমরা সবাই ফিরবো, আরো অনেক বেশি শক্তি নিয়ে। আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি কাছাকাছি এখন। একে একে সবাই ফিরে আসুক। অপেক্ষায়।
আবারো কাঁদিয়ে দিলেন রায়হান। যতবার অভির সাথে বন্যার ক্লোজ ছবি দেখি একই অবস্থা হয় প্রতিবারই। স্ত্রীর চোখের সামনে, স্ত্রীর হাতে ধরা স্বামীকে কোপাচ্ছে খুনীরা আহা, জীবনে এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? হায়রে মানুষ। তোরা নিজেকে সৃষ্টির সেরা দাবী করিস কোন মুখে? আর অনন্ত? না’ থাক। সব কথা বুকে জমা হয়ে পাথর হয়ে যায়, কিছুই আর বলা হয় না।
লেখাটার প্রথম ও শেষ দিকটা দারুণ হয়েছে মাঝখানে কিছুটা ছন্দ পতনের মত মনে হয়েছে বিশেষ করে আশরাফুল মখলুকাত শব্দের অত্যাধিক ব্যবহারে। আর একটা জায়গায় কিছুটা দ্বিমতও আছে যেমন; এই স্কুল কলেজ পড়ুয়া যুবকেরা আপনার উল্লেখিত বইখানি পড়ে বুঝে, বই থেকে অনুপ্রাণীত হয়ে নির্দোষ মানুষ খুন করে কথাটা সর্বাংশে বোধ হয় ঠিক না। যদি ঠিক হতো তাহলে সকল খুনিরা হতো মাদ্রাসার মুতল্লী, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মাঠে ময়দানে, ইসলামী জলসায় ওয়াজ বয়ানকারী কোরানের তাফসিরকারি বড় বড় নামী দামী আলেম ওলামা পীর মাশায়েখরা। তারা দিব্বি সহি সালামতে আরাম আয়েশেই আছেন আর নির্বোধ পথহারা যুবকেরা নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে অপরের প্রাণ সংহার করে ইহলোক পরলোক দুটোই হারাচ্ছে।
বহুদিন পর আপনাকে দেখে ভাল লাগছে। সব সময় সতর্ক থাকবেন, সাবধানে থাকবেন। যতবার তার সাথে কথা হতো, অনন্তকে সব সময় এ কথাটা বলতাম। আমরা আর কাউকে হারাতে চাইনা।
লেখাটার প্রথম ও শেষ অংশটার ব্যাপারে আপনার সাথে আমিও একমত। তবে আমার বউয়ের ধারনা সম্পূর্ণ উলটা। আর মাঝে যেটা বললেন সেটার সাথেও আমি কিছুটা একমত। বিস্তারিত লিখবো সামনে।
পেছন থেকে কেউ মারতে আসলে হাজার সাবধানতাতেও কিছু হয় না আসলে। দেখা যাক।
আমাদের দেশ কখনো মুক্তচিন্তকদের দুঃসাহসিক পথ চলতে দেবে না। তবুও আমারা পিছোপা হবো না।
পিছপা হবার প্রশ্নই আসে না।
আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ অভিজিতদা। তার হত্যায় আমার এক বন্ধু বলেছিল, ‘আমি নিজে মরলেও এতটা কষ্ট পেতাম না।’ কথাটা আমার ক্ষেত্রেও খাটে। একেকজন মানবতাবাদী মুক্তচিন্তকে হত্যা করে উৎসব উদযাপন করা হয় বাংলাদেশে। এদেশে একজন হুমায়ুন আজাদ, একজন অভিজিৎ রায় আরো হাজার বছরে কি জন্মাতে বা তৈরি হতে পারবে?
উৎসব এখনও হয় না। মৌন উৎসব হয়। তবে কিছুদিন পরেই আনন্দ মিছিল হবে।