শিল্পী নভেরা আহমেদের প্রতিকৃতি, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
নির্বাসিত শিল্পী নভেরা আহমেদ, চিরকালের জন্য নির্বাসনে চলে গেলেন । ভাস্কর নভেরা আহমেদের মৃত্যুতে আমরা বাঙালিরা শোকাহত । দেশে বা প্রবাসে সবখানেই শিল্পী নভেরার মৃত্যুর শোকের চিহ্ন। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। তা সে পূর্ণ বয়সের মৃত্যুও হোক না কেনো । মানুষ কখনই তার প্রিয়জনকে হারাতে চায় না । আর সে যদি হয় অসাধারণ প্রতিভাবান কেউ তবে তো কথাই নেই । আপনজন কেনো, কাছের-দূরের কোনো মানুষই সেই চলে যাওয়াকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না । মানুষ চায় তার স্মৃতিকে অবিস্মরনীয় করে রাখতে । তার চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারলেও, সময়ের একটা কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সবাইকে । একমাত্র সময়ই পারে, সব কিছুকে ভুলিয়ে দিতে । সময়ের কথায় মনে পড়ে গেলো, নভেরার জীবনের বিভিন্ন সময়ের সমসাময়িক পারিপার্শ্বিকতার কথা। আমরা নভেরা সম্পর্কে কতটুকু জানতে পেরেছি আসলে?
শিল্পী নভেরা আহমেদ, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
বাস্তবে, শিল্পী নভেরা সম্পর্কে তেমন করে জানার উপায় নেই । যেমন করে আমরা বাংলাদেশের আর যে কোনো শিল্পী বা শিল্পকলা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে অজানা একটা অন্ধকারে বাস করে আসছি। শিল্পী নভেরা আহমেদের কথা আরো বেশী রহস্যময় এবং অন্ধকারে ঘেরা। কারণটা হয়তো কারো আর অজানা নেই। তিনি ছিলেন স্বেচ্ছায় নির্বাসিত। চার দশক সময় ধরে। চল্লিশটা বছর, কম সময় নয় মহাকালের হিসাবেও। ৮৫ বছরের দীর্ঘ জীবনের প্রায় অর্ধেকটা তিনি বাংলাদেশ থেকে দূরে। বাংলাদেশ বললে হয়তো ভুল হবে; তিনি বাংলাদেশের শিল্পী ছিলেন কি ; বা স্বাধীন বাংলাদেশ বললে হয়তো আরো সঠিক করে বলা হবে । তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কখনও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেননি। তিনি তাঁর নিজের জন্মভূমি থেকে ছিলেন স্বেচ্ছায় নির্বাসিত। সেই সময় যাকে সবাই ভারতীয় উপমহাদেশ বলে জানতো, পরবর্তীতে পূর্বপাকিস্থান! আমরা সেই অবস্থান থেকে আসলে তাকে কতটুকু আমাদের দেশের শিল্পী বলে দাবী করতে পারি আমার জানা নেই । তেমন করে তো আমরা বাংলাদেশের মাটিতে জন্মগ্রহনকারী সূচিত্রা সেনের মতো এবং আরো অনেকে আছেন তাদেরকে, আমাদের নিজেদের বলে দাবী করতে পারি। যিনি চল্লিশ বছর আগে আমাদেরকে পিছনে ফেলে চলে গিয়েছেন এবং ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেননি, তাকে আমাদের বলে অধিকার করবার অধিকার আমাদের আছে কিনা জানি না। মূলত কোন কারণে তিনি দেশ ত্যাগী হলেন সেটাও আমরা জানি না। আমরা কেনই বা জানতে চায় ? কারণ তিনি আমাদের দেশের (?) অর্থাৎ তৎকালীন পূর্বপাকিস্থানের শিল্পী ছিলেনএবং তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় মানুষ, সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ, তাঁর সম্পর্কে আমরা, সাধারণ মানুষেরা জানতে চায়বো সেটাইতো স্বাভাবিক । কিন্তু আমাদের হয়তো কখনও জানা হবে না, দেশ ছেড়ে যাবার পরেও, কেনো তিনি আমাদের প্রিয় দেশ, বাংলাদেশের মাটিতে কোনোদিনো ফেরার কথা ভাবেননি। বাংলাদেশের জন্মের আগেই তিনি নিজের জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমিয়েছেন এবং সেই দেশকে তিনি আপন করে নিয়েছেন।
শিল্পী নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
আমরা জানি, তিনি কোনো সুবিধা বঞ্চিত পরিবারের সদস্য ছিলেন না। তিনি বেশ ভাগ্যবতীও ছিলেন, যার এমন অনেক বন্ধুমহল ছিলো যারা তাঁকে, তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তাহলে তাঁর জীবনে মূলত বাধা বা প্রতিবন্ধকতাটা কোথায় ছিলো ? জীবনের প্রথমদিকে তিনি বেশ সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন, ইংল্যান্ড ও ইউরোপে শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছেন, সে সময় অনেকের জন্য যা ছিলো শুধুই স্বপ্নের মতো। অনেকের জন্য এখনও সেটা স্বপ্নই বটে। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পেয়েছেন প্রদর্শনীর সুযোগ । কিন্তু তাঁর পথচলাকে শেষ পর্যন্ত কেনো একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি তা আমাদের আর হয়তো জানা হবে না । কারণ শিল্পীর কাজ বা পথচলা সম্পর্কে যদি কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারে , সে হলো শিল্পী নিজে । আমাদের দেশে সেই সুযোগ অনেক ক্ষীণ । তার কারণ হিসেবে আমি বলতে পারি সহজেই; আমাদের প্রকৃত শিক্ষার এবং অভিজ্ঞতার অভাব, সর্বপরি আমাদের সততার এবং স্বচ্ছতার অভাব । তিনি তাঁর সেই অসাধারণ স্কুলিংকে ব্যাবহার করে তাঁর কাজকে আরো পরিশালিত করতে পারতেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো কে তিনি আরো অভিব্যক্তিময় করে তুলতে পারতেন ।
শিল্পকর্মের মাঝে শিল্পী নভেরা আহমেদ, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
তাঁর কাজের প্রতিবন্ধকতা বলতে যদি অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা বলে আমরা ধরে নেই তাহলেও সেটি খুব একটি যুক্তিযুক্ত হবার কথা নয়। কারণ, ষাটের দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত তিনি যদি ফ্রান্সের মতো পৃথিবীর ধনী দেশ এবং প্যারিসের মতো শহরে বসবাস করতে পারেন যেটা কিনা শিল্পকলার তীর্থ স্থান । সেখানে বিভিন্ন ভাবে অর্থনৈতিক সহোযোগিতা মেলা সম্ভব। আর সেটাও যদি না অর্জন করা সম্ভব তাহলে আমাদের সেটাকে চিহ্নিত কার উচিৎ শিল্পী হিসেবে যে, প্রবাসে বসবাসরত শিল্পীদের কাজের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত কি কি ধরনের বাধা বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হই । এবং সেখান থেকে আমাদের মুক্তির উপায় কি হতে পারে । অথবা যদি ধরে নেই তাঁর কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো ছিলো শারীরিক, তাহলে আমাদের স্পর্শকাতর একটা অবস্থান থেকে বিষয়টাকে বিচার করতে হবে। এবং এটাও আমাদের জানার মধ্যে রাখতে হবে যে পৃথিবীতে শিল্পী মূলত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই বেড়ে ওঠে । সোনার চামচ মুখে দিয়ে কেউ শিল্পী হয়ে জন্মায় না বা গোলাপের পাপড়ি বিছানো বিছানাতে শুয়েও কেউ শিল্পী হয়ে ওঠে না। শিল্পী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা কোনো ভাবেই মসৃন নয় । শিল্পীর সৃষ্টিই শুধু তার পরিচয় নয়, তার জীবন যাপনই একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। যেটাকে লাইফ স্টাইল বলা যায় ! সে ক্ষেত্রে নভেরার কথা আমরা যতদূর জানতে পারি তিনি শারীরিক ভাবে বিদ্ধস্থ ছিলেন । নানা দূর্ঘটনার কারণে তাকে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে । সে ক্ষেত্রে তিনি ভাস্কর্য ব্যাতিরেকে অন্য আরো অনেক সহজ মাধ্যমেও কাজ করতে পারতেন । হয়তো করেছেনও । আমাদের সঠিক করে জানা নেই ।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও তারঁ স্বামী গ্রেগোয়ার দো ব্রোয়ানস, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
আমাদের জাতীয় শহীদ মিনারে নকশাকে ঘিরে আরো যে নীলনকশার জন্ম হয়েছে, আরো যে ষড়যন্ত্র বা অন্ধকারের জন্ম হয়েছে, সেটার মীমাংসা করার দায়িত্ব তাদের ছিলো যারা এর সাথে শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন। আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে যদি সে সম্পর্কে কোনো ভুল তথ্য জানি, সে ক্ষেত্রে দোষটা আমাদের ঘাড়ে না দেয়াটাই উত্তম। আমাদেরকে ক্রমাগত ভাবে আমাদের অতীত ইতিহাসের থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সে কারণে আমরা ভবিষ্যত থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি জাতি হিসেবে । বর্তমান বলে তো কোনো কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই আমাদের। সব কিছু বায়বীয় । ভিত্তিহীন । শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে যে টানাহেচড়া চলছে; তাতে মনে হচ্ছে আমাদের পক্ষে আর কোনো নতুন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। আমরা কি পারি না নতুন করে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্তম্ভ গড়তে ; আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে । পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভের পাশাপাশি নতুন করে বা পরিবর্ধিত অবস্থায় কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে?
১৯৫৬ সালে প্রণীত শহীদ মিনারের আদি নক্শা ও মডেল, শিল্পী হামিদুর রহমান।চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
শিল্পী নভেরার এই চলে যাওয়াকে ঘিরে আমাদের বাংলাদেশীদের মধ্যে যে কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে তাতে করে আমরা আরো বেশী করে জানতে পারি ব্যক্তি নভেরা সম্পর্কে। আর্ন্তজালিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের পরিধিটা বেশ ব্যাপ্তি পাচ্ছে দিন দিন ; বিধায় আমরা আরো বেশী করে জানতে পারছি ব্যক্তি মানুষের কথা। কিন্তু আমাদের জ্ঞানের সীমানা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখনও সেই সংকীর্নতায় ঘিরে আছে , আছে অন্ধকার হয়ে। নভেরার শিল্পকর্ম সম্পর্কে বিশ্লেষণী কোনো আলোচনা বা সমালোচনার অবকাশ নেই খুব একটা।
বেশ কয়েক বছর ধরে অর্ন্তজালের সুবাদে নভেরা সম্পর্কে বেশ কিছু সমসায়িক এবং নিকট অতীতের খবর জানতে পারি । আর লেখক হাসনাত আবদুল হাই এর ‘নভেরা’ বইটির কথা তো মনে আছেই; যদিও বেশ কয়েক বছর আগের পড়া। সব মিলিয়ে শিল্পী নভেরার প্রতি আমাদের কোনো আগ্রহের কমতি ছিলো না কোনোদিনও । কিন্তু শিল্পী নভেরা কি আমাদের কথা ভেবেছেন কখনও । হয়তো ভাবতেন । তাঁর শাড়ী পরে ফরাসী স্বামীর সাথে ছবি দেখলেতো তাই মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি কেনো নিজে থেকে আমাদের জন্য দু লাইন লিখে রেখে জাননি ? কেনোই বা তিনি নিজের কাজেরও তেমন কোনো বর্ণনা দিতে আগ্রহ বোধ করেনি তাঁর জন্মভূমির মানুষদের জন্য, তাঁর শুভাকাঙ্খিদের জন্য ? আমরা আমাদের অবস্থান কে সুস্পষ্ট একটা রুপ দিতে ব্যর্থ হচ্ছি বারবার। ফলে ক্রমাগতভাবে আমরা ভ্রান্তিময় একটা জগৎ সৃষ্টি করে যাচ্ছি।
কর্মরত ভাস্কর নভেরা আহমেদ, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
তাঁর অভিমানের গভীরতায় মনে হয় তিনি গভীর ক্ষত (?) নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিলেন । তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের এক ফেইসবুক পোস্ট থেকে যেটা জানান যায় তাতে করে মনে হয় খুব বালখিল্য একটা কারণে তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন এবং পারিবারিক কারণে দেশ ত্যাগ করা আর রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে দেশ ত্যাগ করা ভিন্ন বিষয় । তিনি যদি ব্যক্তিগত কারণে দেশ ত্যাগ করে থাকেন সে ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে আমাদের অপরাধবোধে ভোগানোর কোনো অধিকার হয়েতো নেই । তবে দেশ ত্যাগের তাঁর সেই ক্ষতটুকুই যথেষ্ট ছিলো একজন শিল্পীর শিল্পচর্চার জন্য । একজন শিল্পীর পথচলার জন্য । ফ্রিদা কাহলোর কথা মনে হতে পারে আমাদের । তাঁর শরীরে সে কত যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে । তারপরেও তাঁর কাজের মধ্যে সে সব যন্ত্রণাকে সে অভিব্যক্ত করতে দ্বিধা বোধ করেনি । নভেরা আহমেদের কাজের মধ্যে তাঁর জীবনবোধের যন্ত্রণার সানাইয়ের সুর বাজতো কিনা আমি জানি না । আমি দেখিনি তাঁর চিত্রকর্ম নিজ চোখে । হ্যা অবশ্যই অতীতের কিছু ভাস্কর্য ছাড়া ; তবে তেমন কোনো গভীর বেদনাবোধ ধরা পড়ে না তাঁর কাজে ।
১৯৪৭ এ নির্মীত হেনরী মুরের ভাস্কর্য ফ্যামিলি গ্রুপ, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
শিল্পী বা ভাস্কর নভেরার কাজে ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরী মুর এবং বারবারা হেপওয়ার্থ এর প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট । বলাই বাহুল্য শিল্পী নভেরা পঞ্চাশের দশকে ইউরোপেই থাকতেন । তাঁর জন্য পৃথিবী বিখ্যাত সেই সব ভাস্করদের কাজের সান্নিধ্যে আসাটা খুব একটা কষ্ট সাধ্য বিষয় ছিলো না । যদিও বারবারা হেপওয়ার্থ কিংবা হেনরী মুরের ভাস্কর্যের ভলিউম বা ঘনত্বের সাথে নভেরার ভাস্কর্যের তেমন কোনো সাদৃশ্যতা নেই । সেখানে নভেরার ভাস্কর্যকে অনেক ক্ষেত্রে চ্যাপ্টা মনে হতে পারে । বেশীরভাগক্ষেত্রে তিনি ক্লোজড এবং অর্গানিক ফর্ম নিয়ে কাজ করতেন । পরিবারের প্রতি তাঁর যে একধরনের দূর্বলতা ছিলো সেটাও ফুটে ওঠে তাঁর কাজে ; যেমন হেনরী মুরের কাজেও দেখা যায় ।
বারবারা হেপওয়ার্থের ভাস্কর্য , ডুয়েল ফর্ম, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
শিল্পকলায় সারা পৃথিবীতে, রেনেসাঁর পরবর্তী সময়ে, ভাস্করদের থেকে চিত্রকরদের সংখ্যাই বেশী ছিলো । চিত্রকলা চর্চা ছিলো অনেক বেশী সহজ , ভাস্কর্য চর্চার থেকে । ভাস্কর্য চর্চার জন্য স্হান এবং নির্মান সরঞ্জামের যোগান একটা বিরাট চ্যালেন্জ সব সময় । সে ক্ষেত্রে ভাস্করদের সংখ্যা তুলনা মূলকভাবে কম ছিলো সারা বিশ্বে এবং নারী ভাস্করতো অবশ্যই কম । নভেরা আহমেদকে উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর বলা হয় । শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্যার যেমন উপমহাদেশের আধুনিক শিল্পকলার জনক । যার সূচনা হয় কবিগুরু রবিন্দ্রনাথের হাতে । কিন্তু আমাদের এই অর্জনগুলোকে আমরা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছি । এমনকি পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতও যখন এগিয়ে গিয়েছে তখন, আমরা দিনে দিনে পেছনের দিকে হেটে চলেছি …
সেই প্ঞ্চাশ-ষাটের দশকেই নভেরার কাজে আধুনিকতার ছোয়া দেখতে পান অনেকেই ; কিন্তু তারো বহু আগে ১৯১৭ সালে ইতিমধ্যেই ফাউন্টেন নামে একটি ফাউন্ড অবজেক্টের মাধ্যমে ফরাসী শিল্পী মার্শাল ডুশ্যাঁ কন্সেপচুয়াল শিল্পকলার যাত্রা শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন । সে ক্ষেত্রে শিল্পকলায় আধুনিকতার শুরু আমরা ইম্প্রেশনিজম সময় থেকেই ধরে নিতে পারি । নভেরা আহমেদ সেই সময় ইউরোপে বসবাসরত ছিলেন ; আধুনিক ভাস্কর্যের চরিত্র তাঁর কাজে আরো বিলষ্ঠ ভাবে ধরা পড়বার কথা ছিলো। যখন ভাস্কর্য জগৎকে আলোকিত করছিলো, হেনরী মুর, বারবারা হেপওয়ার্থ, আলেক্সান্ডার কেল্ডার, আলবার্টো জিওকোমেত্তি, কনস্টান্টিন ব্রাঙ্কুইসি এবং আরো অনেকে । ভাস্কর রঁদ্যারও তিনি ভক্ত ছিলেন, সেটা যে কোনো ভাস্কর মাত্ররই হওয়ার কথা । ২০০৮ এবং ২০০৯ এ নির্মীত কিছু ভাস্কর্যে তিনি ভাস্কর জিওকোমেত্তির মতো অমসৃন সমতল ব্যবহার করেছেন । একজন মানুষের প্রতিকৃতি মূর্তিতে দেখা নাক, কান বিহীন যেনো পরিচয়হীন, অনুভূতিহীন কোনো মানুষ। আবদ্ধ , বিস্মৃত । যথারীতি শিল্পী পিকাসোরও প্রভাব লক্ষ্য করা যেতে পারে তাঁর ভাস্কর্যে ।
শিল্পী নভেরার ভাস্কর্য , লো ব্যারন ফু, ২০০৯, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
কলোম্বিয়ান শিল্পী ডরিস সালসেদোর এর কাজেও আমরা দেখি স্বদেশ ত্যাগের যন্ত্রণার কথা। তিনিও দেশ থেকে নির্বাসিত । অনেক শিল্পীকেই দেশ থেকে নির্বাসিত হতে হয়েছে, আরমেনিয়ান শিল্পী আর্শাইল গোর্কি ; কিন্তু তাঁদের কাজে আমরা দেখি সেই যন্ত্রণার ছাপ, যা শিল্পী নভেরার কাজে বেশ অনুপস্থিত। গোর্কির চিত্রকর্মে মা ও মাতৃভূমি ত্যাগের বেদনা সুস্পষ্ট । নভেরার প্যারিসের রেট্রোস্পেকটিভ প্রদশর্নীর চিত্রকর্মগুলোর যে অস্পষ্ট ইমেজ আমরা দেখি অর্ন্তজালে, সেখান থেকে মনে হয়; সেগুলোকে পরাবাস্তব বা ফভিজমের মতো করে অনেক উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার করা হয়েছে এবং পাখির ও ফুলের মতো অনেক অর্গানিক ফর্মকে ব্যবহা করা হয়েছে; শিল্পকলার বিষয় বস্তু নির্বাচনে । স্ফিংসও দেখা যায় তাদের মধ্যে । যেগুলোকে দেখে সুরিয়েলিস্ট শিল্পী ম্যাক্স আর্নস্ট এর চিত্রকলার অদ্ভুত সব পাখিদের ফর্মের কথা মনে হতে পারে ।
শিল্পী নভেরার ভাস্কর্য, লা শেভ দো শাঁতেমেসল, ২০০৮, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
নভেরার স্বেচ্ছা নির্বাসনের সাথে ফরাসি ভাস্কর কামিল ক্লদেলের নির্বাসনের ইতিহাস যদিও মেলে না, তবুও তাদের মধ্যেকার ভাস্কর্যের প্রতি যে উন্মদনা আছে তাতে অনেক মিল পাওয়া যায় । তাদের জেদের মধ্যে মিল পাওয়া যায় । তাদের দুজনের জীবনের ঘটনাগুলোকে অনেক বেশী নিয়তি নির্ভর মনে হতে পারে । কামিল ক্লদেলকে আধুনিক ভাস্কর্যের একজন অগ্রদূত বলে মনে করা হয় । কামিল এবং রদ্যাঁ দুজনই শিল্পী মাইকেল্যান্জোলোকে ধারণ করেছেন তাঁদের কাজের মধ্যে । কামিলও একজন উপেক্ষিত ভাস্কর এবং রঁদ্যা যাকে ব্যবহার করে সুনাম কামিয়ে নিয়েছিলো সেই সময়ে । সেই কামিল ক্লদেলের জীবনীও কম বেদনাদায়ক ছিলো না । তিনিও তিরিশ বছর নির্বাসিত ছিলেন এক মানসিক হাসপাতালে ।
শিল্পী পিকাসোর ভাস্কর্য, মোমা : নিউ ইয়র্ক, ২০১২, আলোক চিত্র : আসমা সুলতানা
প্যারিসের রেট্রোস্পেকটিভ প্রদশর্নীর ব্রোশারে , প্রদশর্নীটির কিউরেটর প্যাট্রিক আমিন দাবী করেছেন যে, নভেরা কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন । তাঁর কাজের মধ্যে কবিগুরুর কবিতার কথা ফুটে ওঠে । নভেরা আহমেদ যে অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্ম গ্রহন করেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই । জীবনে অনেক সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবন সংগ্রাম কে এবং শিল্প সংগ্রমকে তিনি একটি সুনিপুন পর্যায়ে পৌঁছে নিতে ব্যার্থ হয়েছেন । কিন্তু কেনো ? তাহলে কি আমাদের উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থায় বিরাট কোনো ঘাটতি আজো রয়ে গেছে, সেই সময় থেকেই !
তিনি দেশকে কি মনে করতেন না, যে তাঁর কাজের মধ্যে আমরা স্বদেশ ত্যাগের বেদনার ভাষা খুঁজে পাই না। দেশকে তিনি মনে করবেন কিভাবে? ৪০ বছর তো কম সময় নয়, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবার জন্য । কিন্তু আরো কয়েকটি প্রশ্ন আমার সাধারণ শিল্পী মনে ভেসে ওঠে সেগুলো হলো ; কেনো একজন শিল্পীকে দেশ ত্যাগ করতে হয় ? শিল্পীরা কেনো দেশত্যাগী হন ? শিল্পীরা কেনো স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যান? দেশ কি চায় না তার প্রতিভাবান সন্তানকে জায়গা দিতে ? দেশ কি তার প্রতিভাবান সন্তানকে ফেরাতে চেয়েছে কখনও ? দেশ কি তার প্রিয় শিল্পীকে ফেরাতে চেয়েছে কোনোদিনও ? শিল্পী সমাজের ভূমিকা কতটুকুইবা ছিলো এক অভিমানী শিল্পীর অভিমান ভাঙ্গাতে ?
শিল্পী নভেরা আহমেদ, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
শিল্পী এস এম সুলতানও তো ছিলেন একঘরে, কে তাঁর খোঁজ রেখেছে ! আমরা তবে কেনো নভেরা আহমেদের ব্যাপারে এখন বেশ উচ্চবাচ্য করছি; তিনি ফ্রান্সের মতো ধনীদেশের বাসিন্দা ছিলেন বলে ? সুবিধাপ্রাপ্তদের একটু তোষণ করে চলবার সংস্কৃতি আমাদের চিরকালের । আমরা তো স্বাধীনতার পর থেকে বেশ একটা লম্বা সময় পেয়েছিলাম এই ঘোলাটে ঘটনাকে একটা সমাধানের আলো দেখানোর । এবং সব পক্ষের জন্যই সেই সময়টা ছিলো নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করবার । যাতে করে কাউকেই সেই দোষের বোঝাগুলো বয়ে বেড়াতে না হতো । নভেরা আহমেদ কে অনেকে কিংবদন্তীয় বলে আখ্যায়িত করছেন, কিন্তু আমরা জানি না সেই শব্দের অর্থ কি? নাকি আমরা শব্দের পরে শব্দ সাজাতে পচ্ছন্দ করি। যেমন রঙের পাশে রঙ বসিয়ে আপন মনে আমরা এঁকে যাই অর্থহীন যত চিত্রকর্ম । যার কোনো অর্থ হয় না ; যার কোনো ইতিহাস হয় না । যা শুধু হয়ে ওঠে প্রাণহীন এক শরীর; শিল্প হয়ে উঠতে পারে না কখনই ! তিনি নির্বাসনে ছিলেন বলেই কি তিনি কিংবদন্তী ! হয়তো বা আমাদের কারো কারো ক্ষেত্রে কিংবদন্তী খোঁজার মানসিকতা, কাউকে আইকনিক রুপ দেবার অতিআগ্রহ অনুৎসাহিত করে দেয় সব ধরনের বিশ্লেষণ প্রচেষ্টা। সামাজিক সেই অদৃশ্য কর্তৃত্বের চাপটি হয়তো তারা অনুভব করেন এই সিদ্ধান্তে পৌছাঁতে। কোনো কোনো ব্যক্তি বিশেষকে আমরা এমন একটা বিশেষ স্থানে বসিয়ে দিতে পচ্ছন্দ করি যেখান থেকে আসলে বিভ্রমের সৃষ্টি হওয়া ছাড়া তেমন কোনো অর্জন করা সম্ভব না ।
তবে সব কিছু বিশ্লেষণ করে আমরা যেটুকু বুঝতে পারি, সেটা হলো শিল্পী নভেরা আহমেদের মৃত্যু আমাদের মাঝে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেলো আবার …
১. কেনো একজন শিল্পীকে নির্বাসিত হতে হয় ?
এবং
২. কেনো বাংলাদেশ গুনী প্রতিভাধর মানুষকে তার যোগ্য স্থান দিতে ব্যার্থ হচ্ছে বারবার ?
উত্তরটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু ভয়ঙ্কর । রাজনীতি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রিয়তা, দলাদলি, সংকীর্নমন্যতা, আধুনিক শিক্ষারপ্রতি অনাগ্রহ শিল্পী সমাজের আটপৌরে জীবনের সঙ্গি । সেখানে কোনো সৎ প্রতিভাবানদের স্থান নেই !
কিন্তু একজন শিল্পী কি নিজের মেধা দিয়ে, শক্তি দিয়ে, সততা দিয়ে সেই যুদ্ধে জয়ী হতে পারেন না?
প্রশ্নটা কেনো আমি নিজেকে নিজে করছি না ?
শিল্পী নভেরার প্যারিসের প্রদশর্নীর একটি আংশিক চিত্র, ২০১৪, চিত্র সূত্র : অন্তর্জাল
নভেরা সম্পর্কে আরো জানা যাবে এখানে ।
ধন্যবাদ।
পুরো আলোচনা আর লেখা দুটোই উপভোগ্য ছিলো। অনেক কিছু জানলাম বিভিন্ন দিক থেকে। খুব ভাল লাগলো। একটা ইউনিক পোস্ট
মন্তব্যের কোনো নটিফিকেশন আসে না মেইলে তাই জানতে পারিনি আপনার মন্তব্যের কথা । দুঃখিত ।
আবারো অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে পোস্টটি পড়বার জন্য ।
উপরের দুটি লিংক দেয়া হলো। নভেরা ব্যাপারে তথ্য জানা যাবে
মন্তব্যের কোনো নটিফিকেশন আসে না মেইলে তাই জানতে পারিনি আপনার মন্তব্যের কথা । দুঃখিত ।
নভেরার বিষয়ে তথ্য দেবার জন্য ধন্যবাদ । আমি আমার অলোচনাতে স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করেছি আমাদের দেশের শিল্প জগতের দৈন্যতা । হয়তো ব্যার্থ হয়েছি ! একজন শিল্পীর শিল্পকর্মের পাশাপশি একটি “ আর্টিস্ট স্টেটমেন্ট“ থাকতে হয় , যাতে তাঁর কাজের একটা শাব্দিক অভিব্যক্তি থাকবে ।
নভেরার জীবদ্দশাতেই জানতেন এই ধুম্রজালের কথা ; কিন্তু নিজে কেনো কথা বলে যাননি । আমাদের দেশে হয়তো এইসব তৃতীয় পক্ষের কথার অনেক মূল্য রয়েছে, যার বেশীর ভাগেরই কোনো ভিত্তি নেই । কিন্তু শিল্পকলার জগতে, ইতিহাস সৃষ্টিতে শিল্পীর নিজের কথা সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ন । না হলে বাতাসের উপরে ভর আর যায় হোক সত্য ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয় ।
ধন্যবাদ আপনাকে । শুভকামনা ।
http://www.exporevue.com/magazine/fr/index_novera.html
http://www.veteranstoday.com/2010/11/22/legacy-of-a-real-world-war-2-hero-gleb-mikailovich-von-bruhn/
নভেরা আহমদের সমাধিকালে শিল্পী শাহাবুদ্দিন জানান, নভেরা ১৯৭৪ সালে প্যারিসে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। হারিয়েছিলেন তিনি সন্তান জন্ম দেয়ার অধিকার। দেশের প্রতি তার ছিল অসম্ভব টান। তার শেষ ইচ্ছা ছিল দেশে গিয়ে শহীদ মিনারে বসে ছবি আকার। কিন্থু সে সাধ আর পূরণ হয়নি। দুরারোগ্য অসুখ সে আশা আর পূরণ করতে দেয়নি।প্যারিসে নভেরার সাথে সাক্ষাত কালে দেশে যাবার জন্য অনুরুধ করেছিলেন শেখ হাসিনা। নভেরা ও তাতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্থু সময় ও সুযোগে তা আর হয়ে উঠেনি। তিনি কখন ও শাড়ি ছাড়া অন্য কোনো কাপড় পরতেন না।
নভেরা আহমেদের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৯ মার্চ, সুন্দরবন অঞ্চলে । বাবা সৈয়দ আহমেদ চাকরি সূত্রে তখন সেখানে ছিলেন। তবে নভেরার আদি বাড়ি চট্টগ্রামে। পরে যদিও তাঁর পরিবার কুমিল্লায় স্থায়ী হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই নভেরা ছিলেন স্বাধীনচেতা। সেই চেতনা ধরে রেখেছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত।
১৯৫১ সালে কৈশোর বয়সেই লেখাপড়া করতে নভেরা পাড়ি জমিয়েছিলেন লন্ডনে। ভাস্কর হওয়ার অদম্য স্পৃহায় নভেরা যোগ দেন সিটি অ্যান্ড গিল্ড স্টোন কার্ভিং ক্লাসে। পরে ক্যাম্পারওয়েল স্কুলে পাঁচ বছর পড়ে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা পেয়ে দুই বছরের জন্য যান ফ্লোরেন্সে। দেশে ফেরেন ১৯৫৭ সালে, শুরু করেন শহীদ মিনারের কাজ। সহযোগী ছিলেন শিল্পী হামিদুর রহমান। পরের বছরই ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সরকার নভেরাদের স্টুডিও ধ্বংস করে দেন। সে বছরই ঢাকায় প্রথম মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন নভেরা। দেশে ফিরে নভেরার ভাস্কর্যচর্চা শুরু করেন সুলভ উপকরণ দিয়ে। ১৯৬০ সালে এশিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘ইনার গেজ’ শিল্পকর্মের ভাস্কর্য প্রদর্শনী ছিল নভেরার শিল্পভাবনার ধ্রুপদ অভিজ্ঞান। এর মাধ্যমে ভাস্কর হিসেবে তিনি সমীহ অর্জন করেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন নারীর এ ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল শিল্পচর্চার জগতে অত্যন্ত বড় ঘটনা। এর আগে ১৯৫৯ সালে মিয়ানমার সফর করেন তিনি। পরে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়াও ঘুরে এসেছেন। ১৯৭০ সালে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের উদ্যোগে ব্যাংককে প্রদর্শনী করেন। লাহোরে একবার প্রদর্শনী করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পাড়ি জমান প্যারিসে। এরপর ইউরোপের বহু দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। শেষে থিতু হয়েছিলেন প্যারিসেই।
৪১ বছর পর গত বছরের জানুয়ারিতে সর্বশেষ প্যারিসে শিল্পকর্মের প্রদর্শনী করেন নভেরা। ১৯৬৯ থেকে ২০১৪ সাল- এ চার দশকেরও বেশি সময় সৃষ্ট নভেরার মোট ৫১টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছিল সর্বশেষ প্রদর্শনীতে। এর মধ্যে ছিল ৪২টি চিত্রকর্ম, ৯টি ভাস্কর্য। এর আগে ১৯৭৩ সালের জুলাইয়ে প্যারিসে গ্যালারি রিভগেসে তাঁর প্রদর্শনী হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে তিনি একুশে পদক পান।
নভেরা ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কিন্তু পাওনা যথাযথ কৃতিত্বটুকু দেওয়া হয়নি তাঁকে। তাঁকে ব্রাত্য করে রাখতে চেয়েছেন সংকীর্ণ মনের মানুষেরা। তাই হয়তো জীবনের বেশির ভাগ সময়ই দেশ ছেড়ে বহুদূরে অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন।
আসলে ব্যক্তি স্বার্থে বা কৃপনতার জন্য তাকে নিয়ে সঠিক ভাবে সঠিক খবর প্রকাশ করা হয়নি কখনো। যার জন্য তাকে নিয়ে এত ধুম্রজাল। এ ধুম্রজাল রয়েই গেল।
আপনাকে ধন্যবাদ এই লেখার জন্য, আমার নিজের মনে আসা অনেক প্রশ্নই আপনার লেখার মাঝে খুঁজে পেলাম। আমার মন্তব্যগুলি একান্তই আমার। কাউকে আঘাত করার জন্য নয়।
১) উনাকে নিয়ে উপন্যাসটি আমার ভালো লাগেনি, গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি। আরোপিত মনে হয়েছে, বিশেষ করে শেষের দিকের অংশ;
২) উনার কাজের উপর খুব বেশি আলোচনা হয়েছে কি ?
৩) বেগম পত্রিকায় উনার সম্পর্কে প্রথম পড়েছিলাম, এই ১৫/১৬ বছরেও নতুন কিছু আর জানতে পারিনি পত্রিকা মারফৎ
৪) নির্মোহভাবে আমরা যে কবে বিশ্লেষণ করতে শিখব, হুজুগে হুজুগেই সময় গেল। আপনার লেখাটি দারুন যুক্তি সম্বলিত। অনেকের ওয়ালে রেখে আসতে ইচ্ছে করছে; তাই আপাতত নিজের ওয়ালে শেয়ার দিলাম
৫) উনার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, ব্যক্তিগত আবেগের উর্ধে তিনি যেতে পারেননি সবসময়।
মন্তব্যের কোনো নটিফিকেশন আসে না মেইলে তাই জানতে পারিনি আপনার মন্তব্যের কথা । দুঃখিত ।
১. উপন্যাসতো উপন্যাসই …সেটা তো শিল্পকলার সমালোচনা বা ইতিহাস না । আর আমাদের দেশে কবি, শিল্পী বা লেখক বা অন্য সবাই নিজের হাতে সব অধিকার তুলে নেন, ছোটো খাটো ঈশ্বর বনে যান, কোনো রকম গবেষণা ছাড়াই মনগড়া কথা বলতে শুরু করেন ও কাজ করতে শুরু করেন । কোনো রকম বিশ্লেষনেরও প্রয়োজন বোধ করেন না ।
২. কাজের থেকে উনার ব্যক্তিগত জীবনের উপরে হয়েছে । যেটা সব সময় হচ্ছে আমাদের দেশে । তিনি কত বড় শিল্পী ছিলেন সেটা কে বিচার করা হয় তিনি কি পরতে পচ্ছন্দ করতেন ও খেতে পচ্ছন্দ করতেন । আলোচনাতে সেটাই উল্লেখ করেছি আমাদের জানার সুযোগ খুব কম এবং শিল্পীরাও তেমন করে জাননা ।
৩. বেগম পত্রিকার কথা বলেছেন, সেটাই আরো একটা বিষয় স্পষ্ট হলোযে আমরা স্বাধীনতার পর থেকে যে উল্টো দিকে হাটছি… আগে মেধার চর্চা হতো , জ্ঞানের চর্চা হতো । এখন হয় অন্ধাকারের চর্চা ।
৪. অনেক ধন্যবাদ ।
৫. সেই আবেগটা তিনি তাঁর শিল্পকর্মে ঢেলে দিতে পারতেন । শুধু শিল্পকর্ম যদিও বিশ্লেষণ করা হয় তবুও কিন্তু তেমন বিশেষত্ব কিছু চোখে পড়ছে না ।
খুবই শৈল্পিক লেখা। হবেই তো, এক শিল্পীকে নিয়ে আরেক শিল্পীর লেখা।
কলম চলুক।
কলম, তুলি চালাতেই হবে ; বন্ধ করা যাবে না কোনো ভাবেই । অনেক অনেক ধন্যবাদ । শুভকামনা ।
লেখা ও কমেন্টস সবই খুব ভাল লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ । অনুপ্রাণিত হলাম খুব 🙂
একজন শিল্পী যখন, আরেকজন শিল্পীকে তুলে ধরতে কলম ধরেন, তখন তার চেয়ে বেশি শিল্পময় আর কিছু হয় না।
ধন্যবাদ ফরিদ ভাই, আপনার মন্তব্য আমার অনুপ্রেরণা !
নভেরার বিষয়ে তথ্য বহুল নোট। ভাবতে অবাক লাগে, তাকে এক সময় যারা খুব ঘনিষ্টভাবে জানতেন,, তারাও তাকে ভুলে থাকতে চেয়েছেন, তাকে নিয়ে খুব লেখালেখি করেন নি। নাকি নভেরা নিজেই এ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, কে জানে? আহা রে অভিমানী মন!
আমরা বড় অদ্ভুত মানসিকতার জাতি। যে উপেক্ষা করে তাকে আকড়ে ধরি, যে আকড়ে ধরতে চায় তাকে উপেক্ষা করি ।
ধন্যবাদ বিপ্লব ভাই 🙂
তাঁর অভিমানের কারণটা খুবই অস্পষ্ট, এর চেয়ে ঢের বেশী অভিমান নিয়ে মানুষকে দেশ ছাড়তে দেখেছি। সম্ভবত বিষয়টি একান্ত পারিবারিক ছিল। জাতি তার অভিমান ভাঙ্গাবে এমন ভাবনা যখন যত্রতত্র উল্লেখিত হতে দেখি, তখন প্রশ্ন ওঠে এর উদ্দেশ্যটি কি? নাকি এসবই সার্ত্রের সেই আস-কনসাসনেস নাকি ফ্রমের অ্যানোনাইমাস অথরিটির কাছে নতি স্বীকার।
পঞ্চাশের দশকে তিনি যুক্তরাজ্যে যেখানে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি তার সেই কোর্সটিও শেষ করেননি। ১৯৬১ সালেই দেশ ছেড়েছেন, আর কখনোই সেখানে ফেরেননি। বাংলাদেশের জন্মই তো হয়নি তখন। আর তিনি আসলে কিভাবে নির্বাসিত হলেন সেটাও খুব অদ্ভুত — তিনি পাকিস্তানে ছিলেন, সমাজের উপরের স্তরের মানুষদের সহায়তা পেয়েছেন – একেবারে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যাননি। স্পষ্টতই ১৯৬১ থেকে পৃথিবী ব্যাপী বিচরণে তার কোন সমস্যাই হয়নি, শুধু বাংলাদেশ ছাড়া। তিনি কি তার ব্যক্তিগত সমস্যা এড়াতে চলে গিয়েছিলেন? দেশে ফিরে আসার প্রতি কোন বিধিনিষেধও তার উপর ছিলনা। তার দেশে না ফেরার কারণ যে জল্পনা কল্পনা হচ্ছে সেটি মলিয়ের এর কমেডির মত। পাকিস্তান ছেড়ে বাংলাদেশে পা দেবার সেই তীব্র আনন্দ থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত করেছেন। দেশতো তাকে একুশে পদক দিয়েছে। দেশ তার প্রতি কোন অন্যায় করেননি, অন্যায় তিনি করেছেন — যদি শব্দটি অন্যায় হিসাবে ব্যবহার করাই হয়।
তার ফ্যামিলি গ্রুপ মুরের কাজ এর সম্প্রসারণ আমি বলবো কপি। যাইহোক..একজন শিল্পী তার কাজের কোন ব্যাখা দিয়ে যাননি, যে ব্যাখ্যা আমরা আজো দিতে পারবো না। শহীদ মিনারের ডিজাইনের যে দাবী তিনি করেছেন পারে অন্যদের কাছে, সেটাও অদ্ভুত, তার ড্রইং কেন হামিদের কাছে থাকবে? তিনি কি নিজে কিছু করতে চাননি, তার বৌদ্ধ দর্শনের ব্যাখ্যাও তো খাপ খায় না ভাষা আন্দোলনের সাথে। তিনি ভাষা আন্দোলনের সেই ভাবনাটাই তাহলে বোঝেননি, হয়েতো বাংলা তার প্রিয় কোন ভাষাই ছিল না।
অনেক লেখককেই দেখলাম নানা জনের উপর জোর চাপাচ্ছেন, কিন্তু কেন? কেনই বা তিনি তার প্রশিক্ষণ শেষ করলেন না লন্ডনে। কেনই বা এতদিন দেশের সাথে যোগাযোগ করেননি। আর রেস্ট্রোস্পেকটিভ কিভাবেই বা হবে যদি ধারাবাহিকভাবে আমরা তার শিল্পকর্মের কোন প্রদর্শনী না দেখি। কোন সন্দেহ নেই তিনি প্রতিভাবান ছিলেন, আর সেই সাথে তিনি বহু শিল্পী যা কোনদিনও পাননি, সেই সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন, তাকে দেশের প্রথম এবং নারী ( যদি শিল্পীদের লিঙ্গ হয় না) ভাস্কর ( যদিও বলা উচিৎ আধুনিক) আখ্যা দেয়া হয়েছে.. তিনি কি আদৌ আমাদের বাংলাদেশের ছিলেন। আমার মনে হয় তাকে এই দেশের দাবী করাটা যুক্তিসঙ্গত হতো যদি তিনি তার অবস্থানে থেকেই নিজেকে বিকশিত করতে পারতেন, যেখানে তার কাজের একটি অন্তর্গত ভাবনায় আমরা আমাদের দেশকে খুজে পেতাম। এখন আমরা একটা মিথ এর পেছনের ঘুরছি। জয়নুল আবেদিন এর নাম আমরা শুনেছি এখানে, তিনি নাকি ভাস্কর্য বিভাগ খুলতে চাননি, জানিনা সত্যি কিনা। হয়তো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার পড়া শেষ না করে আসার কারণে এই সিদ্ধান্ত (যদি সত্য হয়) রাখতে পারে – আমি যতটুকু শিল্পাচার্য সম্বন্ধে জানি সেই ভরসায় বলতে পারি। এছাড়া তিনি যদি দেশে কাজ করতেই চাইতেন সেটি সম্ভব ছিল .. নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান খুলতে পারতেন। আমি অবশ্য ধারণা করতে পারি তিনি কেন দেশে ছেড়েছেন, আর সেই কারণগুলো হতে পারে অনুমিত, কিন্তু এর পর দেশে থেকে তার বিচ্ছিন্ন থাকার কারণ আমাদের একটি উপসংহারে নিয়ে যায় – নিজের স্বার্থেই দেশ ছেড়েছিলেন তিনি।
নাহ তেমন কিছু তিনি করেননি, তিনি তার মতই ছিলেন। তাকে আমরা অভিমানী বানিয়ে এখন নিজেদের দাবী করছি। মিথের আবেদন যেন কেউ কাটাতে পারছি না। আমাদের চিন্তার দৈন্যদশায় এখন হিরোর প্রয়োজন, নারী নভেরায় সেই হিরো হবার সব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান তাই অতিউৎসাহী আমাদেরও তা খুজে পেতে সময় লাগেনি। তিনি যেমন তার নিজের ইচ্ছামত বিশেষ কিছু মানুষের সাথে দেখা করতেন, তেমনি তার সম্বন্ধে বলা দেশের তথাকথিত শিল্পবোদ্ধাদের কথা শুনে মনে হয়, সব খামখেয়ালী সব মন্তব্য.. কারো কাছে তাদের উচ্চারিত বক্তব্যের পক্ষে স্বাক্ষ্যপ্রমান নেই। অস্পষ্ট মানুষটাকে এখন সবাই জিগশ পাজলের মত জোড়া লাগাচ্ছে।
জয়নুল আবেদীন স্যারও অনেক অভিমান নিয়ে চারুকলা ছেড়েছেন ; এখন তারঁ মাজারে (!!) ফুল দেয়া হয় ঘটা করে !
নভেরার এক আত্মীয় লিখেছেন, তাঁর মা তাঁকে মাছের ছোটো টুকরো দিয়েছিলেন খেতে বলে আর দেশে ফেরেননি । খুবই বালখিল্য এবং অদ্ভুত মনে হলো কথাটা ।
প্রবাসে বসবাসের কারণে আমাদের দেশের শিল্পীরা আন্তর্জাতিক হয়ে যান ; তেমনি অনেকে হয়ে যান, কিংবদন্তী !
নাটকীয়তা প্রিয় জাতি আমরা!
আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে নভেরা যে শুধু ইট, কাঠ, বালি, কাদামাটি নিয়ে খেলতেন তা নয়। তিনি নারীকে বসিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়।
লৈঙ্গিক বিচারে শিল্পীদের বিচার হয় না !
তিনি নারী কে কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন আসলে ? তার সব সুবিধা থাকার সত্ত্বেও তিনি নিজেকেই তেমন কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেননি। আর যদি দেশে বা দেশের বাইরে সংগ্রামী শিল্পীরা, যারা অনেক প্রতিভা নিয়ে বঞ্চিত হয়ে আছেন, সেই সম্বন্ধে ধারণা আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে শেখায় আমরা কি অাসলেই কাচের স্লিপার হাতে সিন্ডেরেলাকে খুজছি তার মধ্যে। জাতি হিসাবে আমাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব বড়ই প্রকট।
একমত !
নারী শুধুমাত্র নারী হবার কারণেই তাকে বিশেষ ভাবে মূল্যায়ন করতে হবে । কিন্তু একজন পুরুষকে যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে সে যোগ্য !
@ কাজী মাহবুব হাসান,
না, তিনি কাউকে দৃশ্যমান হিমালয় পর্বতের উপর বসিয়ে দেন্নি। তা সম্ভবও না। তবে সে আমলে প্রচলিত ধ্যান ধরনার উদ্ধে উঠে একজন নারী হয়েও তিনি নির্ভয় হাতে মাটির মূর্তি বানাতেন। হারাম মূর্তি। আমি জানিনা তখন কয় জন বীর পুরুষ এ কাজটি করতেন। খুব খেয়াল করে কিন্তু।
লৈঙ্গিক বিচারে শুধু শিল্পী কেন, কারো বিচার হওয়া উচিত নয়। তবে তথাকথিত পুরুষশাসিত সমাজে রিতিনীতি ভেংগে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেই। নভেরা তারই একজন @ আসমা মিতা।
নভেরা আহম্মেদ সম্পর্কে জানার খুব কৌতূহল ছিল অনেক দিন ধরেই, তার মৃত্যু সংবাদ জানার আগে থেকেই। লেখিকাকে ধন্যবাদ চমৎকার লেখাটির জন্য। এখানে তার কাজ এবং জীবনের একটি আংশিক এবং অপ্রতুল হলেও সংক্ষিপ্ত সমালোচনা উঠে এসেছে (অবশ্য তার জীবন আমাদের কাছে একটা প্রহেলিকা !)
‘ শিল্পী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা কোনো ভাবেই মসৃন নয় । শিল্পীর সৃষ্টিই শুধু তার পরিচয় নয়, তার জীবন যাপনই একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে।’
আসলেই তাই, একজন শিল্পীর জীবন তার সময় এবং সমাজ বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। তার জীবন মানুষের জীবনের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সংকটগুলর উপর আলকপাত করে, মানুষের প্রতিক্রিয়া, সংগ্রাম আরও অনেক কিছু উঠে আসে শিল্পীর জীবনীতে। নভেরা ছিলেন আমাদেরি একজন, তাই তার জীবনের অজানা অধ্যায় গুলো নিয়ে আমাদের প্রয়জনেই কাজ করা দরকার।
আমি মূলত এই লেখাতে শিল্পী নভেরার কাজ বা জীবন কোনোটাই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাইনি ; আমার মূল বক্তব্যটি ছিলো কেনো তিনি নির্বাসনে চলে গেলেন এবং কোনোদিনো বাংলাদেশে ফিরে আসার কথা ভাবেননি এবং কেনোই বা শিল্পীরা স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হচ্ছে এবং এখানে রাষ্ট্রের কি করনীয় ছিলো বা আছে এ বিষয়ে । মেহবুব আহমেদের শিল্পী নভেরার সম্পর্কে বিশ্লেষণী লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন । ধন্যবাদ ।
লিংকটি শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
হাসনাত আব্দুল হাইয়ের লেখা বইই ” নভেরা ” পড়ে নভেরা আহমেদ সম্নধে প্রথম জানতে পারি।হাইয়ের বইয়ের পড়া নভেরা আর আজ আপনার লেখার নভেরার মধ্যে অনেক প্রার্থক্য।
নভেরার নিকট আত্বীয়- স্বজনদের কাছ থেকে হয়ত তার অভিমান বা স্বেচ্ছানির্বাসনের বিষয়ে জানা যেত।
আচ্ছা, সামীম শিকদারের খবর তো আজকাল খুব একটা শুনতে পাওয়া যায় না!! ওনার বিষয়ে কি কিছু জানেন?
“ফ্রিদা কাউলো “আমার জীবনে সেরা আইকন। তার নিজের জীবনের উপর করা ডকোমেন্টারি দেখলে বুঝা যায় জীবন,জীবনের কত রং,প্রেম- ভালবাসা এবং তার রুপ,দিয়াগোর সাথে অনন্ত ভালবাসা এবং সেই ভালবাসা থেকে আঘাত পাওয়া,বাই-সেক্সুয়ালীটি,রাজনীতি এবং নিজে শোষনহীন রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত থেকে রাজনীতি করা,জীবনে আক্সিডেন্ট এবং যত ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন তার সবকিছু মূর্তরূপ নিজের শিল্পে রুপ দিয়েছিলেন।ডকোমেন্টারিটি যতবার দেখেছি ততবার নিজের অজান্তেই চোখ অশ্রুজলে প্লাবিত হয়েছে।
ফ্রিদার উপর কয়েক বছর আগে একটি বাণিজ্যিক ছবি করেছে।যদি কেউ না দেখে থাকেন দেখে নিয়েন।
সে-ই জন্যেই ফ্রিদা আজ সারা পৃথিবীজোড়া এক আইকনের নাম।এবং শিল্পকলা জগতের এক কিংব্দন্তীতে পরিনত হয়েছেন।
আপনার কাছ থেকে প্রাচ্য ও প্রাচ্যত্বের শিল্পকলা বিষয়ক নানা লেখা আশা করছি।
কলম যুদ্ধের দ্বারা আমাদের জং ধরা ভোতা মাথা চূর্ন-বিচূর্ন হয়ে যাক,,,,,,,,,,
ধন্যবাদ 🙂 মন্তব্যের জন্য । ফ্রিদা নিয়ে আপনার আগ্রহ দেখে ভালো লাগলো ; আমার আগের কিছু লেখা আছে ফ্রিদা কে নিয়ে এখানে এবং এখানে । সময় হলে পড়ে দেখতে পারেন ।
আসমা সুলতানা মিতা,
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার আগের ২টি ফ্রিদা কে নিয়ে লেখা আমাকে দেওয়ার জন্য।
ভাল থাকবেন।
সেটাই উল্লেখ করেছি লেখাতে, আমাদের দেশে শিল্পীদের সম্পর্কে জানাতে পারাটা প্রায় অসম্ভব । একজন প্রফেশনাল শিল্পী হিসেবে তো নিয়েমিত প্রদশর্নী করবার কথা, একটা ওয়েব সাইট, ব্লগ এবং ফেসবুক পেজ থাকার কথা । সে সব যেহেতু নেই আমাদের শিল্পী সম্পর্কে জানারও কোনো সুযোগ নেই । দু:খজনক !
আমাদের দেশে গুণীদের কদর নেই বললেই চলে। শিল্পীসমাজেরও হয়ত ঈর্ষা ছিল উনার প্রতি, অথবা কেউ মাথা ঘামাননি। নভেরাকে নিয়ে হাসনাত আব্দুল হাইয়ের উপন্যাসটি পড়েছিলাম। এর বাইরে আর কিছু জানতাম না উনার সম্মন্ধে। নভেরার সাথে সাথে আরো কয়েকজন শিল্পীর কাজের কথাও লিখেছেন প্রাসঙ্গিকভাবে; যা অজানা ছিল একেবারেই। লেখাটির জন্য ধন্যবাদ, মিতা। শিল্পকলা ও শিল্পীদের নিয়ে লিখুন না মাঝেমাঝে!
ধন্যবাদ । লিখতে আমিও চাই, কিন্তু সময় করতে পারি না ।
শিল্পী নভেরাকে নিয়ে আসলে সেভাবে অতিআগ্রহ দেখানো হচ্ছে তাতে করে মনে হয় না, কারো ঈর্ষা আছে । ৪০ বছর ধরে যে টানাপোড়ন চলছে সেটা সমাধানের জন্য দুই পক্ষই কোনো উদ্যোগ নেয়নি । আমি মনে করি আমাদের সেই সততাটা নেই নিজের অব্স্থানকে পরিষ্কার করার ।
হাসনাত আব্দুল হাই এর উপন্যাসটি একটি মিথ সৃষ্টি করেছে । তিনি কোনো শিল্পসমালোচক নন সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে ।
তিনি কোনো শিল্পসমালোচক নন সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে ।
এ বাক্যটির সাথে আপনার উপরের করা একটি মন্তব্য এর সাথে বেশ যাচ্ছে… বেশিরভাগ শিল্পীরই কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই তাদের নিজেদের শিল্পকর্ম সম্বন্ধে । কথাটা শিল্প সমালোচকদের ক্ষেত্রেও বুঝি প্রযোজ্য।
ব্যাখ্যা তাও ধারণা বা অনুমান করা যেত যদি ব্যক্তিমানুষের সাথে তার কাজের ভারসাম্যপূর্ণ মিল থাকত।
একদম !
নভেরা সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানতাম না। ওনার মৃত্যুর পর ইন্টারনেট ঘেঁটে যা তথ্য পেয়েছি তাতে মনে হচ্ছে উনি দেশের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখতে চাননি। যে দেশের শহীদ মিনারের নকশায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে, স্বাধীনতার পর সেই দেশটি একবার দেখতে তাঁর ইচ্ছে হয় নি, এটি সত্যিই অস্বাভাবিক ব্যাপার। একুশে পদক পাওয়ার পর উনি কি কোন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন?
আমি যতদূর জানি আমাদের বর্তমান শহীদ মিনারটি শুরুতে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার হিসাবে গড়া হয়েছিল। হামিদুর রহমান/নভেরার নকশায় কি অন্যরকম কিছু করার পরিকল্পনা ছিল? আপনিও নতুন স্মৃতিস্তম্ভের কথা বলেছেন; যদি এ-সম্পর্কে আরও কিছু বলতেন …
ঐতিহাসিক কারণেই বর্তমান শহীদ মিনারটিকে ধরে রাখতে হবে। তবে পুরাতন কাঠামোর সাথে মিলিয়ে নতুন স্থাপনার সংযোজন আর সেই সাথে এর আশেপাশের জায়গাগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার আর উন্নয়ন করলে গোটা কমপ্লেক্সটি আরও আকর্ষণীয় রূপ পাবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক পরিচিতি বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে এধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে।
আমার মত শিল্পকলায় অজ্ঞদের জন্য আপনার লেখায় অনেক কিছু জানার থাকে। লেখাটির জন্য, বিশেষ করে নভেরা আর সমসাময়িক শিল্পীদের কাজ নিয়ে যে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ সময় নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য ।
আমি মূলত সেটাই বলতে চেয়েছি আমার লেখায় যে, আমরা স্বচ্ছ কোনো ধারণা পাই না আমাদের শিল্পী ও তাদের কাজ এবং কাজের ধারাবহিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে। শিল্প সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই, শিল্প সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিল্পী বা শিল্পকলা বিশারদরা, সেই প্রক্রিয়াকে বর্ণনা বা বিশ্লেষণ করতেন । সেই ভাবেই সাধারণ মানুষ সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞাত হতো । কিন্তু আমাদের দেশে এই প্রক্রিয়াটি মূলত অনুপস্থিত । কারণ বেশিরভাগ শিল্পীরই কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই তাদের নিজেদের শিল্পকর্ম সম্বন্ধে । এটা ক্রমাগত একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া । এমন নয় যে একজন শিল্পী তার সারা জীবনে হাতে গোনা কয়েকটি শিল্পকর্ম সৃষ্টি করবেন এবং কোনো যাদুবলে বিখ্যাত হয়ে যাবেন । এমন অবাস্তব প্রক্রিয়া শুধু আমাদের দেশেই সম্ভব । যে কারণে কোনটা হামিদুর রহমানের সৃষ্টি এবং কোনটা নভেরা আহমেদের সৃষ্টি পৃথক ভাবে বলা সম্ভব নয় । তাদের যদি এমন অনেক বৈশিষ্ট্যসূচক শিল্পকর্ম থাকতো যে দেখা মাত্রই আমরা শনাক্ত করতে পারতাম তাহলে আমাদের জন্য বিষয়টা সহজ হতো । যেহেতু তারা দুজনই দাবী (অথবা তাদের পক্ষ হয়ে অনেকেই দাবী তুলছেন) করছেন যে, তারা আমাদের একুশের শহীদ মিনারের মূল নকশার প্রণেতা, সেহেতু বিষয়টা আজো অমীমাংসিত । আনা ইসলামের লেখা থেকে আমি কিছুটা তুলে ধরতে পারি “– হামিদ তো ভাস্কর নয়। সে কী করে ডিজাইন করে। আমি মিনারের একটি ছোট্ট মডেল করে দিয়েছিলাম। হামিদের কাছেই আমার করা ড্রইংসহ সমস্ত কাগজপত্র ছিল।”
সারা বিশ্বে নির্মীত স্মৃতিস্মারকগুলো অনেক বেশী গুরুত্ব বহন করে সেই দেশ ও সংস্কৃতির জন্য । আমরা বর্তমান শহীদ মিনারকে অপরিবর্তীত রেখে ই আরো অনেক নতুন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিাণ করতে পারি বা বর্তমানে যেটা রয়েছে সেটাতে নতুন কোনো ভাস্কর্য বা বর্ধিত কিছু ল্যান্ডস্কেপিং করতে পারি । সেটা কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হবে আমার জানা নেই। পশ্চিমা দেশে এই বিষয় গুলো অনেক সহজ, প্রক্রিয়াগুলো সাবার জানা, এখানে কোনো জটিলতা নেই। আমাদের দেশে তো দলীয় শিল্পীদের দ্বারা কাজগুলো করা হয় বলে, শিল্পকর্মের মান বলে কিছু থাকে না ; যেমন বছর দশেক আগে শিল্পী শামীম সিকদারের করা, ফুলার রোডের ভাস্কর্যটি ।
নতুন প্রজন্মের শিল্পীদেরও কিছু কাজ করবার সুযোগ করে দেয়া উচিৎ, কিভাবে দেবে সেটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব । যদিও আনা ইসলাম দাবী করছেন যে শিল্পী নভেরা নাকি বৌদ্ধ দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের শহীদ মিনারের নকশা নির্মাণ করেছেন ; কিন্তু শিল্পী নভেরা আহমেদের আচরণে আমরা বৌদ্ধ দর্শনের ( শান্তি বা ক্ষমা ) কোনো নমুনা পাই না । এমনকি ভাষা আন্দোলনের মূল ভাবনার সাথে নভেরার প্রণীত বৌদ্ধ দর্শনের প্রতিফলনে অঙ্কিত আমাদের শহীদ মিনারের নকশাটিও সামঞ্জষ্যপূর্ণ নয় ।