মীর আলী সাহেব সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের দোষে-গুণে ভরা ট্রিপিক্যাল স্বার্থপর একজন মানুষ। গোফ ছেঁটে দাড়ি রাখেন। মাসে একবার সেই দাড়িতে মেহেদী লাগান। সকালবেলা যখন প্যান্ট-শার্ট পরে অফিসে যান তখন ফজরের ওয়াক্তে পরা সবুজ সুতোয় বুনা টুপিটা মাথাতেই থাকে। গলায় টাই আর পালিশ করা চকচকে জুতো দেখে অফিসে বড় গোছের চাকুরেই মনে হয় তাকে। মীর আলী সাহেব একজন ব্যাংকার। কপালে নামাজ পড়ে কড় ফেলে দিয়েছেন। একজন সৎ অফিসার হিসেবে তার সুনাম আছে। সবাই জানে, মীর আলী সাহেব “হারাম পয়সা” খান না।
মীর আলীর সুখের সংসার। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি বড়, পড়ছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। বিদেশে পড়তে যাবার জন্য ইদানিং দৌড়াদৌড়ি করছে। এক্ষেত্রে আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়াই তার প্রথম পছন্দ। মেয়ে লোপা মেডিকেলে চান্স পেয়ে হোস্টেলে চলে গেছে গত মাসে। বাসাটা এ জন্য বড় খালি খালি লাগে। ছেলেমেয়ে দুটিই তার বড় আদরের। দুজনের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রীতিমত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনি বন্ধুর মত মেশেন। মীর আলীর সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা ছেলে-মেয়ে দুটি ইসলামী মাইন্ডের করে গড়ে তুলতে পেরেছেন। লোপা তো বাবা বা বড় ভাই বাসায় থাকলে ঘরের মধ্যেও হিজাব পরে! মা-মেয়ের হিজাব পরা দেখে প্রতিবেশী আরো অনেকে হিজাব পরা শুরু করেছে। গিন্নি যেমন সুন্দরী, মেয়েটিও হয়েছে মায়ের মত। হিজাবে তাদের সুন্দর ফর্সা মুখ, ইরানী কালো বোরখায় ঠিক যেন ইরানীদের মত লাগে! টেলিভিশনে আজকাল ইরানী সিনেমা দেখানোর বদৌলতে ইরানী মেয়েদের সাজপোশাক সবার জানা। তাদের চোখেই লোপাদের ইরানীদের মত দেখতে লাগে! এসব শুনে মা মেয়ে দুজনেরই খুব গর্ব হয়…।
মীর আলী সাহেব চিন্তা চেতনার দিকে দিয়ে মডারেটপন্থি মুসলমান। তিনি মনে করেন ইসলামই একজন মানুষকে সবচেয়ে বেশি আধুনিক বানায়। পাশ্চত্যের যে তথাকথিত আধুনিকতা- সেটা আসলে অবক্ষয়! উনি মেয়েকে ডাক্তারী পড়াচ্ছেন। মেয়েকে হলে রেখেছেন। একজন তাকে আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের ওয়াজের কথা উল্লেখ করে মেয়েকে ডাক্তারী পড়ানোর বিষয়ে বক্রোক্তি করেছিল। মীর সাহেব ভদ্রভাবে তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন ইসলাম আসলে কি। শফী সাহেব যা বলেছেন তা তার একান্ত নিজস্ব বক্তব্য। আলেম মানুষ ফতোয়া দেয়ার এখতিয়ার রাখেন। তবে সেটা সর্বজনীন মান্য হতে হবে। হতে হবে কুরআন-হাদিস সম্মত। ওয়াজের সব কথাই ইসলাম সম্মত হয় না। মীর সাহেব মনে মনে তাই সব সময় কৃতজ্ঞতার সহিত বলেন, আলহামদুরিল্লাহ! কোনটা ইসলাম আর কোনটা ইসলাম না সেটা বুঝার তৌফিক আল্লাপাক আমাকে দিয়েছেন!
মীর আলীর আল্লাপাকের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। ব্যাংকে চাকরি, দেশ-গ্রামে কয়েক বিঘে ধানী জমি। ব্যাংক ব্যালেন্স আর ঢাকা শহরে নিজের একটা বাড়ি- সব মিলিয়ে তিনি সন্তুষ্ঠ। ইদানিং তাই আল্লার পথে কিছু করার তাগিদ অনুভব করছেন। আল্লাপাক তো তাদের সব দিয়েছেন। তারা আল্লাপাককে কি দিয়েছেন? এবার আল্লাপাককে কিছু দেয়া প্রয়োজন। মহিলাদের একটা জামাত দল আছে ঘরে ঘরে যারা ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বেড়ায়, স্ত্রীকে সেই দলে ভিড়িয়ে দিয়েছেন। নিজে একটা মাদ্রাসার সঙ্গে আছেন। অফিস ছুটির পর আজ সেই মাদ্রাসাই হয়ে এসেছেন। মিটিং ছিল। মাদ্রাসার মাঠের উত্তর দিকের ফাঁকা জায়গায় দুতলা দালান তোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলো আজকে। মাশাল্লাহ মাদ্রাসা বড় হচ্ছে। প্রতি বছর শয়ে শয়ে আলেম বের হবে! পরকালের জন্য এই সামান্য কাজটুকু তো করতেই হবে। মীর আলীর জানাশোনা অনেক। সমাজের বড় বড় মানুষজন উনার ডাকে সাড়া দেন। মাদ্রাসার দোতালা বিল্ডিংয়ের কাজে হাত দিবেন শুনলেই অনেকে এগিয়ে আসবে। এসব নিয়েই কথা হলো আজকে। বেরিয়ে আসার সময় পিন্সিপাল মাওলানা ইদ্রিস সাহেব বললেন, মীর সাহেব, আপনার একতলাটা শুনলাম খালি আছে? ভাড়াটিয়া পেয়ে গেছেন?
-কেন বলেন তো?
-আমার একজন পরিচিত আছেন, তাদের যদি ভাড়া দিতেন…
-নিশ্চিয়, নিশ্চিয়, কেন না। পাঠিয়ে দিবেন।
-আমারই ছাত্র ছিল এক সময়। এখন হোসিয়ারী ব্যবসা করে। হুজুর মানুষ। ওরা দুই ভাই থাকবে শুধু। সারাদিন তো বাইরেই থাকবে শুধু রাতে এসে ঘুমাবে… আপনাদের কোন অসুবিধা করবে না।
-আরে আপনি বলেছেন সেটাই যথেষ্ঠ। পাঠিয়ে দিবেন।
একতলাটা খালি হয়ে গিয়েছিল গতমাসে। হিন্দু একটা ভাড়াটিয়া এসেছিল অফিসের এক কলিগের পরিচয়ে। মীর সাহেব অন্য কথা বলে এড়িয়ে গেছেন। হিন্দু তিনি ভাড়া দিবেন না। সন্ধ্যাবেলা এরা পূজার সময় ঘন্টা বাজাবে- মাগরেবের সময় তখন, তাছাড়া বাড়ির মধ্যে মূর্তিপূজাকে তিনি জায়গা দিবেন না! তিনি ভাড়াটিয়া পেয়ে গেছেন বলে তাদেরকে মানা করে দিযেছেন। আলহামদুরিল্লাহ, পিন্সিপাল সাহেব তারপরের দিনই ভাড়াটিয়ার সন্ধান দিলেন…।
কলিংবেল টিপতেই ছেলে রেজাউন এসে দরজা খুলে দিলো। ইসলামী রীতিতে বাবাকে দেখে সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো। এ বাড়ির এ রকমই নিয়ম।
-আসসালামু আলাইকুম আব্বু। আজকে দেরী হলো যে ফিরতে?
-ওলাইকুম আস সালাম…। একটু মাদ্রাসা ঘুরে এলাম বাবা। তুমি কখন আসছো?
-আমি তো দুপুরের পর থেকেই বাসায়…।
স্ত্রী এসে হাত থেকে ব্যাগ নিতে নিতে বলল, আসসালামু আলাইকুম…, দেরী হলো যে?
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে মীর আলী হাই তুলেন। সারাদিন পর এই সময়টুকুই খুব ভাল লাগে মীর আলীর। এখন হাত-পা ছেড়ে একটু আরাম করা। সারাদিনের কর্মমুখর দিন শেষে একটু বিশ্রাম…। হাই তুলতে তুলতে তিনি বাথরুমে যান। সামনের বছর হজে যাবেন বলে মনোস্থির করে ফেলেছেন। এখন বাথরুমে প্রবেশ করতেও দোয়া পড়েন, বের হওয়ার সময়ও দোয়া পড়ে বের হন। মীর আলী বিড়বিড় করে দোয়া পড়েন… আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযুবীকা মিনাল খুবুছি ওয়াল খাবাইস…। রোজ সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ও বিড়বিড় করে বের হন-। ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবন বিধান! মীর আলী সাহেব তার জীবনের সর্বক্ষণে ইসলামকে অনুসরণ করে চলতে চান। তিনি শুধু একা নন, তার পুরো পরিবার, তার মহল্লাবাসী সবাইকে নিয়েই…।
মেয়ে হোস্টেলে চলে যাওয়ায় এখন সন্ধ্যার পর চা খেতে খেতে বাপ ছেলেতেই আলাপ হয়।
-আব্বু, বিধর্মীদের মিডিয়াও মাঝে মাঝে সত্য কথা বলে দেখো! অথচ আমাদের মিডিয়া…
ছেলের হাতের মোবাইলের স্কিনে একটা বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের ছবি, মার্কিন সৈন্যদের হাতে মাধ্যপাচ্যের একজন নাগরিকের অত্যাচারিত হবার দৃশ্য।
-এসব অত্যাচারের যখন পাল্টা জবাব দেযা হয় তখন তাদের বলা হয় জঙ্গি! রেজাউন আন্তরিকভাবে দু:খিত হয়।
-কি করবে বলো, ইহুদীরা তো ক্ষমতায়। আর মিথ্যাচারে ওরা তো চিরকালই এগিয়ে।
-আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোও জঙ্গি জঙ্গি করে!
-মুসলমানরা যে আজ বিশ্ব জুড়ে মার খাচ্ছে এই জন্যই তো! মুসলমানরা ঐক্যের মধ্যে নাই।
-মুসলমানের মধ্যে যারা মুনাফেক ঐগুলিরেই আগে শাযেস্তা করা উচিত! আগে মুসলমানদেরকেই ঠিক করা উচিত।
-কুরআন থিকা মুসলমান দূরে আছে। তাদেরকে কুরআনের শিক্ষায় ফের ফিরতে হবে। তখন দেখবা মুসলমানরাই হবে দুনিয়ার শাসনকর্তা!
মীর সাহেব মনে মনে ফের আল্লাপাকের উপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, আলহামদুরিল্লাহ! ছেলেকে দেখে তিনি গর্বিত। এই যুগের ফ্যাসেনেবল ছেলে, চেহারা-সুতর পোশাকআশাক মডেলদের মত। কিন্তু এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা হয় না! আর দেখো কি রকম মুসলিম কওমের জন্য দু:খিত হয়! মুসলমানের সুদিনের জন্য কি রকম দিলের মধ্যে চোট পায়! মাশাল্লাহ! সুবাহানআল্লাহ!…
-তোমার বিদেশের কাগজপত্রের খবর কি? ছেলের কাছে জানতে চায় মীর আলী।
-হয়ে যাবে শ্রীঘ্রই। আসলে ইহুদীরা মুসলিম দেখলেই ভিসা দিতে চায় না। আমেরিকা চালায়ই তো ইহুদীরা!
-তা ঠিক। কিন্তু এ দেশে থেকে কি করবে। কোন ভবিষ্যত নাই। আমেরিকা না হোক, ইউরোপের কোথাও ট্রাই করে দেখো।
মীর আলী টিভিটা অন করেন। আইএস জঙ্গিদের নিউজ চলছে। মীর আলীর মতে আইএস ইহুদীদের অর্থায়ানে চালিত ইসলামকে সমালোচিত করার উদ্দেশ্যে গঠিত একটা সন্ত্রাসী দল। এরা সহি ইসলামী দল না। খুনোখুনি তো ইসলাম সমর্থন করে না! এই যে মন্ডু কেটে ধরে ছবি তুলছে- এসব তো ইসলামে নেই! আল্লাহর নবী কি এসব করেছেন নাকি?
রেজাউন মৃদু হাসে। সে জানে আব্বু পহরেজগার হলেও ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা কম। এটা যে কোন মুসলমানের বেলাতেই সত্য। ইসলামী খেলাফত ও এ সম্পর্কিত যে ইসলাম তার সঙ্গে রোজকার ধর্ম ইসলামের পার্থক্য আছে। আব্বুদের ইসলাম হচ্ছে ইসলামী শাসন যখন কায়েম হবে, যখন সারা দুনিয়াতে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চূড়ান্ত হবে তখনকার অবস্থা। কিন্তু মুসলমানরা এখন সাম্রাজ্য হারা। খিলাফত ভিন্ন মুসলিমরা আখিরাতে আল্লাপাকের কাছে কি জবাব দিবে?
-আব্বু, ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশীদেরও সন্ত্রাসী বলা হতো।
-কিন্তু আইএস যা করছে সেটা তো ইসলাম সম্মত না।
-শত্রুর মনে ভীতি সৃষ্টি করছে তারা। ওরা ফিডম ফাইটার…
ছেলের দিকে চেয়ে দেখেন মীর আলী। অস্পষ্টভাবে কেমন জানি একটু অস্বস্তি হয় তার। ছেলেকে বলেন, তোমার বড় মামা বেলজিয়াম থাকে এত বছর ধরে, তাকে বলি তোমার জন্যে। একটু চেষ্টা করে দেখুক…
হঠাৎই প্রসঙ্গ বদলে রেজাউন একটু বিব্রত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে হঠাৎ বেলজিয়াম আসল কোত্থেকে?
-না, আমেরিকারতেই হয়ে যাবে তুমি দেখে নিয়ো।
-ভাল কোন প্রতিষ্ঠান দেখো। চারদিকে এত বাটপার, কাকে যে বিশ্বাস করবে…
কথা আর এগোয় না। এশার আজান দিতে বাপ ছেলে দুজনই উঠে পড়ে। নামাজ পড়ে এসে রাতের ভাত খান দুজন একসঙ্গে বসে। এটা প্রতিদিনের রুটিন। রাতের খাবারটা পরিবারের সবাই একসঙ্গে খাওয়া। খাওয়া শেষে মীর আলী কিছুক্ষণ পত্র-পত্রিকা পড়ার অভ্যাস। একটা মাসিক পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক তিনি। “দারুল ইসলাম” কাগজটা তিনি মুখের সামনে মেলে ধরলেন। প্রথম প্রবন্ধটা লিখেছেন মুফতি ইয়াসিন মোল্লা। “বিধর্মী বিশ্ব থেকে উত্তরণে মুসলিম বিশ্ব”… মীর আলী পড়তে থাকেন। … মুসলিম বিশ্ব ব্যতিত আসলে ভিন্ন কোন সংস্কৃতির বিশ্ব হতে পারে না। মুসলিমরা এখন বাধ্য হচ্ছে তাগুদি তথা কাফের-অবিশ্বসীদের মনগড়া বিশ্বে বাস করার জন্য। কিন্তু হযরত আদম (সা:) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ পর্যন্ত প্রাপ্ত নির্দেশনাবলীকে বাস্তবায়নই হলো দারুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা…। পড়তে পড়তে চোখটা একটু লেগে এসেছিল, স্ত্রী এসে তখন জানালো নিচের নতুন ভাড়াটিয়া ছেলে দুটো এসেছে দেখা করতে।
-আসসালামু আলাইকুম। ড্রয়িংরুমে বসা ছেলে দুটো মীর আলীকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো। মীর আলী ভেবেছিলেন হুজুর লেবাসের কাউকে দেখতে পাবেন। এরা দুজনেই প্যান্ট-শার্ট পরে আছে। একজনের মুখে হালকা দাড়ি।
-বসো, বসো তোমরা। কেমন আছো…।
-আলহামদুরিল্লাহ। জ্বি ভাল আছি। আপনার শরীরটা ভাল?… আমরা আসলে এডভান্সের টাকাটা দিতে আসছি। দাড়ি মুখে ছেলেটি বলল বিনয়ের সঙ্গে।
-আরে না, না সেটার দরকার নেই। পিন্সিপাল সাহেবের সাথে আমার কথা হয়েছে। এসবের কোন দরকার নেই।…
ছেলে দুটি সোফায় বসল।
-তোমরা ইমামতির লাইন ছেড়ে ব্যবসায় চলে এলে যে?
-আমরা স্যার আল্লাহ পথেই আছি। জীবিকার জন্য ব্যবসাকে বেছে নিয়েছি মাত্র। ব্যবসাকে আল্লাপাক হালাল করে দিয়েছেন…। মুখে দাড়ি ছেলেটিই কথা বলছে। অপরজন চুপ করে আছে প্রথম থেকেই।
-তা ঠিক। তা ঠিক…। মীর আলী মাথা নাড়েন সম্মতির। ছেলে দুটিকে খেয়ে যেতে খুব চাপাচাপি করেন এরপর তিনি। কিন্তু তাদের জরুরী কাজ আছে বলে উঠে পড়ে। ওরা চলে যেতেই মীর আলীর ফের হাই উঠতে শুরু করে। এটাই তার ঘুমের সময়। রাত্রী দশটার সময় তার বিছানা যাওয়া চাই। তিনি একটা সুশৃঙ্খল নিয়ম মেনে জীবন কাটান। এর ব্যতিক্রম সচরাচর ঘটে না। স্ত্রী মশারী খাটিয়ে দিলে তিনি শুয়ে পড়েন। সারাদিনের শেষে এবার প্রশান্তির ঘুম। মীর আলী প্রকৃত সুখী মানুষ। তিনি শোয়া মাত্রই নাক ডাকতে শুরু করেন।…
২.
মাস দুয়েক পর মীর আলী অফিসে লাঞ্চ টাইমে একটু বিশ্রাম করছেন চোখ বুজে, বাসা থেকে এমন সময় মোবাইল এলো। স্ত্রী সালাম-টালাম না দিয়েই আতংকিত হয়ে হড়বড় করে বলতে লাগলো, তুমি বাসায় আসো এক্ষুণি! আমাদের বাসায় পুলিশ-র্যা বে ভর্তি! নিচের তলায় কাদের ভাড়া দিছো তুমি! এরা নাকি সব জঙ্গি! ঘরের ভিতরে বোম রাখছে! জিহাদী বই, কম্পিউটার…
মীর আলী সিএনজি নিয়ে তক্ষুণি ছুটে এলেন। টিভি ক্যামেরায় ছেয়ে গেছে বাসাবাড়ি। বাড়িঅলা আসছে শুনে সবাই ছুটে এলো তার দিকে। নিচতলার ছোকরা ভাড়াটিয়াদের নাকি র্যা ব এসে কোমড়ে দাড়ি দিয়ে বেধে রেখেছে। ইলেকট্রিকের তার, বোমা বানাবার সরঞ্জাম, আরো কি কি ঘর থেকে বের করে আনা হয়েছে। পুরো পাড়া ভেঙ্গে পড়েছে। কালো চশমা চোখে গোয়েন্দা বিভাগের একজন খানিকটা ধমকের সুরে জানতে চাইলো, ভোটার আইডি দেখে ভাড়া দেন নাই? এদের পরিচয় আগে জানতেন না?
মীর আলীর আসার পথে ফোনে উঁচু মহলে এরিমধ্যে কথা বলে ফেলেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পিএসকে ফোন করেছেন। সচিব পর্যায়ের একজনকে ফোনে সব জানিয়েছেন। তার বাড়িতে জঙ্গিরা যদি ভাড়া নিয়েও থাকে তাতে তিনি তো জড়িত না।…
মীর আলীর সারা জীবন মনে থাকবে এই দু:সময়ের কথা। কাগজে আর টিভিতে কভারেজ করতে করতে তার বাড়িটি তখন টক অব দ্যা কান্ট্রি! কিছুদিন অগ্যাত বাসে চলে গেলেন তিনি। উপর মহলের একজন পরামর্শ দিয়েছিল, কিছুদিন চুপ করে থাকুন, মিডিয়ার সঙ্গে ভুলেও যেন যোগাযোগ না হয়। নতুন কোন ইস্যু দেশে আসার আগ পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান…। মীর আলী তাই করেছিল। সত্যি সত্যি এরপর সরকারের এক মন্ত্রীর এক ঝামেলা নিয়ে গোটা দেশ মেতে উঠলো। মীর আলী হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। খবরের কাগজের ফলোআপও বন্ধ হয়ে গেলো। একতলাটা আর ভাড়াই দিবেন না জেদ করে ফেলেছিলেন। কাউকে বিশ্বাস হয় না। মাওলানা ইদ্রিস তার পরিচিত বলে দুটো জিহাদীকে ভাড়া দিয়েছিল তার বাসায়! ভোটার আইডি দেখেই বা কি ছাতা হবে? নীলক্ষেতে ৫ মিনিট লাগে একটা ভুয়া আইডি তৈরি করতে।…কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মাস শেষে দশ হাজার টাকার মায়া কম না। এ সময় অফিসের সেই কলিগ তার পরিচিত সেই হিন্দু ভাড়াটিয়ার কথা ফের তুললেন। মীর আলী আর মানা করলেন না। গাজীপুরের মত নিড়িবিলি জায়গাকে জঙ্গিরা বেছে নিয়েছে তাদের রুট হিসেবে। ভাড়াটিয়া তো অচেনাই হবে, সেক্ষেত্রে হিন্দুই নিরাপদ! আর যাই হোক জিহাদী তো হবে না! মীর আলীর সেই ঘটনার পর আতংক যায়নি। পুলিশি ঝামেলা কি জিনিস তা তিনি হাড়ে হাড়ে জেনেছেন। হিন্দু ভাড়াটিয়াকে ডেকে প্রথমদিনই বলে দিলেন, উলু ধ্বনি আর পূজার ঘন্টা যেন শব্দ করে বাজানো না হয়…। ভাড়াটিয়া তাতেই সম্মত…।
৩.
রেজাউনের ভিসা হয়ে গেছে! আগামী মাসেই তার ফ্লাইট। মীর আলী খুশির খবরটা জনে জনে বলেও তৃপ্তি পাচ্ছেন না! সোজা কথা ছেলে আমেরিকা যাচ্ছে! শপিং করতে করতেই এক মাস চলে যাবে। ছেলেটা আছে আর মাত্র ক’টা দিন- ভাবতেই কেমন লাগছে…। অফিস ছুটির পর সন্ধ্যাবেলা ছেলের জন্য কিছু টাই আর আন্ডার গার্মেন্টস কিনে বাসায় ফিরতে ফিরতে দেরী হয়ে গেলো। তিনি গলিতে রিকশা থেকে নামতেই ককটেল ফাটার মত শব্দ হলো। কেঁপে উঠলেন তিনি। পরিচিত একটা দোকানে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারলেন না। দোকানি বলল, পোলাপানে পোলাপানে কথা কাটাকাটি নিয়া মারামারি লাগছিল। সেই জের ধরে একদল এসে বোমা মেরে গেছে…। মীর আলী বিরক্তিতে মুখ কুচকালেন। নষ্ট হয়ে যাচেছ এলাকাটা চোখের সামনে! ভালই হয়েছে রেজাউনের ভিসা হয়ে গেছে। এই দেশে মানুষ থাকে! অবশ্য তার ছেলে কোনদিনই এরকম আড্ডাচাটে জড়ায়নি। তবু নেক্সড জেনারেশনের কথা ভেবেই এদেশ ছেড়ে যাওয়া উচিত…। দেশটারই যে কি হলো আল্লা মালুম। কোত্থেতে যে এত নাস্তিক এসে ভরে গেলো! আশ্চর্য, তাদের সময়ে তো এত নাস্তিকের কথা শোনা যায়নি। আজকে দুপুরের পর থেকেই তো পুরো দেশ গরম হয়ে আছে- কোন এক নাস্তিককে নাকি কারা কুপিয়ে মেরে ফেলেছে! সেই নাস্তিক নাকি ইন্টারনেটে আল্লার রসূলকে নিয়া কুকথা লিখতো, ইসলামকে নিয়া আজে-বাজে কথা বলতো। মীর আলী ভাবতেই পারেন না কোন মুসলমানের পোলা কি এই কাজ করতে পারে? এইটা কোন হিন্দুর কাজ হবে! কিন্তু টিভিতে নাস্তিকটার যে পরিচয় বলল তাতে বুঝা যায় মুসলমানের পোলা।… এইসবই কিয়ামতের লক্ষণ। কিয়ামতের আগে ইহুদীদের বাড়বাড়ন্ত বৃদ্ধি পাবে। তাদের ছড়ানো টাকা-পয়সায় মুসলমানও ভ্রষ্ট হবে। এসব আল কুরআনের কথা, এ কি আর মিথ্যা হয়…।
মীর আলী ছেলের ঘরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখেন ছেলে মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কি যেন করছে। তিনি আর ডিস্টার্ব করলেন না। আস্তে করে শপিংয়ের প্যাকেটগুলো বিছানায় রেখে চলে এলেন। ছেলে ফিরেও তাকালো না।
মীর আলী খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লেন। শুতে শুতে ভাবছিলেন, মেয়েটা হোস্টেলে, ছেলেটাও চলে যাচ্ছে বিদেশ- বাসাটা একদম ফাঁকা হয়ে যাবে…। বেশিক্ষণ ভাবতে পারলেন না অবশ্য। শোয়া মাত্রই তিনি ঘুমে তলিয়ে যান। আজো তার বেতিক্রম হলো না…।
৪.
ভোর চারটায় স্ত্রীর প্রবল ধাক্কাধাক্কিতে মীর আলী ধড়মড় করে উঠে বসলেন। চোখ বড় বড় করে চেয়ে দেখেন স্ত্রী একনাগাড়ে হাত নেড়ে নেড়ে অপ্রকৃস্থ মত কিছু একটা বলছে যার এক বিন্দু তিনি বুঝতে পারলেন না। তার বুকটা ধপাস ধপাস করে এত জোরে শব্দ করছিল যে তিনি শুধু সেই শব্দটাকেই শুনতে পাচ্ছিলেন। নইলে শুনতে পেতেন স্ত্রী বলছিল, পুলিশ রেজাউনকে এসে গ্রেপ্তার করেছে! সে নাকি আজ দুপুরে একজন লেখককে কুপিয়ে খুন করে ফেলেছে! তার ঘরের বিছানার তলা থেকে রক্তমাখা চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে…।
মীর আলীর মনে হলো স্ত্রী পাখির মত চিঁ চিঁ করে যাচ্ছে। তার বুকের ভেতর ড্রাম পিটছে। হৃদপিন্ডটা যেন ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। মীর আলী অস্পষ্ট মত শুনতে পেলেন, পুলিশ… রেজাউনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে… পুলিশ… রেজাউনকে… পুলিশ আসছে… রেজাউনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে… রেজাউনকে… পুলিশ রেজাউনকে… ধরে দিয়ে যাচ্ছে…
মীর আলী আর কিছু শুনতে পেলেন না। সমস্ত শব্দ মুছে যাবার আগ পর্যন্ত বিছানায় বসা থেকে মেঝেতে নিজের পতনের শব্দটুকু ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলেন না…।
চরম দুঃসময়েও কিছু আশার আলো দেখানোর দায়িত্ব পালন করেছেন লেখক।
কলম চলুক।
যে পরিপ্রেক্ষিতে লেখকের লেখা, তাতে পূর্ণিমা রাতের ছায়া স্পঠ দেখা যায়। ভালো লেখার জন্য ধন্যবাদ। মাল্গাড়ী থেকে যাত্রী গাড়ী, তারপর মেল ট্রেন হবে।
ইহাই গতানুগতিক বাঙ্গালী জীবনধারা। পুলিশ রেজাউনদের ধরে নিয়ে যাবে। ৬ মাস পর জামিনে বের হয়ে ত্রিশাল/ হাটহাজারী ট্রেনিং সমাপ্ত করে বড় ধরনের অপারেশন করবে।
বাংলাদেশের পুলিশ কি সত্যিই রেজাউনদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়?
আমিও এই কথাটি ভাবছিলাম নীলাঞ্জনা? সেই সৌভাগ্য আমাদের দেশের মানুষের?
মোরাল অব দ্য স্টোরি..গোড়াঁমির সুফল…
গল্পের প্রচ্ছদে সমসাময়িক জীবন ও সামাজিক চিত্র। কৌশলটি চলুক।
@ গীতা দাস,
বাংলাদেশের সমসাময়িক জীবন ও নিত্যনুতন সামাজিক চিত্র দেখতেছি দিদি । মদিনা সনদী আওয়ামী লীগের কান্ড দেখেছেন ? গাধামীর আর সীমা রাখলোনা- মুত্রালয়ে আরবি ভাষা । ইসলামের প্রেমে মত্ত আওয়ামী লীগ পাগল হয়ে গেছে । আর বেশীদিন নয়, ঢাকার রাস্থায় আওয়ামী রাজনীতিবিদদের ট্রাউজায় খুলে লুঙ্গী উঁচিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যাবে। তারাও যে মুসলমান সেটা প্রমাণ করতে হবে তো ।
পুলিশ -র্যব সত্যিই কী সব জংগীকে চিরদিনের জন্য ধরে রাখে? আর নরকের কীটের মতো কিলবিল করে জন্ম নেওয়া নতুন জংগীরা?
গল্পটি খুব ভালো। চলুক
আমরা গোড়াঘরে হাত দিতে চাই না। তাই জঙ্গিরা জন্মাতেই থাকে… জন্মাবেই…
মীর আলীরা কি কখনই অভিজ্ঞতা থেকে শিখবে?
জন্ম থেকে যে অন্ধ, সেও নৈতিক মনোবলে যুদ্ধ করে অন্ধত্বের অভিশাপ মুক্ত হতে পারে; কিন্তু স্বেচ্ছায় হৃদয় ও মস্তিস্ক বন্ধক দিয়ে মডারেট মুসলিমরা সাগ্রহে যে অন্ধত্বকে বরন করে নিয়েছে, হাজার বছরের ধরে যে বিশ্বাস তাদের মনে গেঁথে বসে আছে, সে অচলায়তন ভেঙে বেরুবে কোন পথে?
এই জন্যই তো পতন!