আগে লিখে রেখেছিলাম এমন সবকিছু একে একে মুক্তমনাতে দিয়ে দিচ্ছি। অনেক কিছু একসাথে শুরু করা হয়ে গেছে বুঝতে পারছি। কোনটা শেষ হবে আর কোনটা হবে না জানি না। এ নিয়ে দুঃখ নেই, কারণ স্বয়ং লেওনার্দো দা ভিঞ্চিও যত কাজ শুরু করেছিলেন তার ১ শতাংশও শেষ করে যেতে পারেননি। এই লেখাটি মূলত William H. Cropper এর লেখা Great Physicists: The Life and Times of Leading Physicists from Galileo to Hawking বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের অংশাবশেষের অনুকরণে লিখিত।
পিসা’র তারকা
পৃথিবীর খুব বেশি বিজ্ঞানীকে নিয়ে লোকগল্প তৈরি হয়নি। প্রাকৃতিক দর্শনের গতিপথকে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালনকারী গালিলেও সেই গুটিকয়েক বিজ্ঞানীর একজন। গল্পটা বলে, ১৫৯১ সালের কোনো একদিন ইতালির পিসা নগরীর এক তরুণ উচ্চাভিলাষী গণিতের অধ্যাপক শহরটির হেলানো মিনারে উঠেছিলেন একটা পরীক্ষা করতে, আর তার পরীক্ষার ফলাফল উপভোগ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-শিক্ষককে। উঠার সময় সম্ভবত এক থলি কাঠের টুকরো ও সীসার বল নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার উদ্দেশ্যে ছিল এরিস্টটল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো একটি ধারণাকে ভুল প্রমাণ করা যে ধারণা বলত: কোনো বস্তুর ভূমিতে পতনের বেগ তার ভরের সমানুপাতিক, অর্থাৎ যে বস্তু যত ভারী সে তত দ্রুত মাটিতে পড়ে। গালিলেও একটি ভারী ও একটি হালকা বস্তু পিসা’র মিনারের উপর থেকে ফেলে দর্শকদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে তারা প্রায় একই সময়ে পড়ে, এরিস্টটলের কথামত আগে-পরে নয়। পরীক্ষাটা যদি একেবারে শূন্য একটা স্থানে করা হতো তাহলে নিশ্চিত তারা হুবহু একই সময়ে পড়ত, বাতাসের বাধার কারণে গালিলেওর বস্তুগুলো সামান্য আগে-পরে পড়লেও সেই পার্থক্যটা এরিস্টটলের অনুমানের চেয়ে নিশ্চয়ই অনেক কম ছিল। সুতরাং এমন একটা ঘটনা যদি ঘটেই থাকে তাহলে তাতে উপস্থিত ছাত্ররা যে খুব উৎফুল্ল হয়েছিল এবং দর্শনের প্রবীণ অধ্যাপকেরা যে ঘোর সংশয়ে মাথা নেড়েছিল তা বলাই বাহুল্য।
এই নাগরিক পুরাণের সত্যতা নেই বললেই চলে, কিন্তু সত্য হলেও ব্যাপারটা গালিলেওর চরিত্রের সাথে খুব একটা বেমানান হতো না। গালিলেও কখনোই প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষকে ছেড়ে কথা বলতেন না এবং তখনকার সবচেয়ে বড় যে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ এরিস্টটল, তার সমালোচনা করে গেছেন জীবনভর। তিনি যেকোনো তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে হাতে-কলমে প্রদর্শনকে খুব গুরুত্ব দিতেন। এরিস্টটলও আসলে মনে করতেন কোনোকিছুর জ্ঞানে পরিণত হওয়ার একটি শর্ত হচ্ছে তাকে প্রদর্শনযোগ্য হতে হবে যদিও প্রদর্শনযোগ্যতা’র সংজ্ঞা গালিলেও আর এরিস্টটলের কাছে এক ছিল না। তারপরও এটাকে আয়রনিই বলতে হবে যে, গালিলেওকে প্রদর্শনযোগ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এমন একজনের ভূতের সাথেই লড়তে হল যাকে অনেকে প্রথম বিজ্ঞানী মনে করেন।
পেশাদারী ও ব্যক্তিগত দুই জীবনেই গালিলেও তার রসবোধ, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষিপ্রতা ও তর্কপ্রিয়তার জন্য সুপরিচিত ছিলেন যা অবধারিতভাবেই পিসা’র অনেকের, বিশেষ করে হয়ত প্রবীণ দর্শন অধ্যাপকদের, ঠিক পছন্দ ছিল না। হয়ত এ কারণেই পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তার অধ্যাপনা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তা আর বর্ধিত করাটা উচিত মনে করেনি। গালিলেও অবশ্য দিন-দুনিয়ার হাল-হকিকত বেশ ভালই বুঝতেন; আরেকটা চাকরি জোটাতে তার খুব একটা কষ্ট হয়নি।
পাদোভা’র মহানায়ক
গালিলেও পিসা’র চাকরিটা পেয়েছিলেন এক কুলীনপদস্থ গণিতবিদ– গুইদোবাল্দো দেল মোন্তে– এর সহায়তায়। মেয়াদ শেষের পর তার চোখ পড়ে পাদোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি খালি হয়ে যাওয়া গণিতের অধ্যাপকের পদটির দিকে। এক্ষেত্রেও প্রথমে স্থানীয় প্রভাবশালী কুলীন– জানভিনসেঞ্জিও পিনেল্লি– এর দ্বারস্থ হন। পিনেল্লি’র পরামর্শ মতোই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের মন জয় করে নেন এবং ভেনিসের শাসকদের অনুমতিও আদায় করতে সফল হন। উল্লেখ্য তখন পাদোভা ভেনিস প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল যার রাজধানী ছিল বিশ মাইল পূর্বের শহর ভেনিস।
বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশের বিচারে পাদোভার সাথে পিসা’র তুলনাই হয় না। পাশাপাশি ভেনিস খুব কাছে হওয়াতে গালিলেওর পাদোভা’র জীবন ছিল বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের ও সুখের। ভেনিসে অনেক বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল এবং সেখানে অনেক অভিজাত বন্ধুও জুটিয়েছিলেন যাদের মধ্যে জোভান্নি ফ্রাঞ্চেস্কো সাগ্রেদো’র নামোল্লেখ না করলেই নয়। ক্ষিপ্রতা ও তর্কপ্রিয়তার কারণে গালিলেও ভেনিসের পানশালা গুলোতে বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন। তার রক্ষিতাও ছিল এই শহরের যার নাম মারিনা গাম্বা এবং যে ছিল– গালিলেওর জীবনীকার জেমস রেস্টন, জুনিয়র এর বর্ণনামতে– বদমেজাজী, সুডৌল, আবেদনময় এবং খুব সম্ভবত নিরক্ষর। মারিনা’র সাথে তার তিন সন্তান হয়েছিল যার মধ্যে বড় মেয়ে ভার্জিনিয়া ছিল বুড়ো বয়সে তার প্রধান সান্ত্বনা।
[mathjax]
পাদোভা’র আঠার বছরের (১৫৯২–১৬১০) জীবনেই গালিলেও তার বলবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করেছেন। খুব সতর্ক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এখানে থাকাকালে তিনি “কালের বর্গ” নামক সূত্রটি প্রণয়ন করেন যা বলে: উল্লম্বভাবে বা কোনো অবনত তল দিয়ে ভূমিতে পড়তে থাকা কোনো বস্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তা উক্ত সময়ের বর্গের সমানুপাতিক (আধুনিক গাণিতিক ভাষায় [latex]s=gt^2/2[/latex] যেখানে s অতিক্রান্ত দূরত্ব, t অতিক্রান্ত সময় এবং g অভিকর্ষজ তরণ; বর্তমানে একে “পড়ন্ত বস্তুর সূত্র” বলা হয়।) পিসা’র মিনারের কথিত পরীক্ষাটি তিনি এখানে সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে করেন। এই পরীক্ষায় একটি বল একটি টেবিলের উপর রাখা অবনত তল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে এবং একসময় টেবিলটি থেকে মাটিতে পড়ে যায়। গালিলেও লক্ষ্য করলেন বলটির প্রক্ষিপ্ত গতিকে যদি অনুভূমিক ও উল্লম্ব এই দুটি উপাংশে ভাগ করা যায় তাহলে পর্যবেক্ষণের ফলাফলের সাথে গাণিতিক হিসেবটা সবচেয়ে বেশি মেলানো সম্ভব। অনুভূমিক উপাদানটা নির্ধারিত হয় টেবিল ছাড়ার সময় বলটির বেগ দ্বারা এবং সুতরাং এটা সংরক্ষিত, অর্থাৎ পরবর্তীতে এর কোনো পরিবর্তন হয় না। অন্যদিকে উল্লম্ব উপাদানটি বলটির ওজনের কারণে কালের বর্গের সূত্র মেনে চলে।
অনেক বছর থেকেই গালিলেও সরল দোলকের গতি’র সারল্য ও নিয়মানুবর্তিতা দেখে মুগ্ধ ছিলেন। কোনো পেন্ডুলামের দোলনের ব্যাপ্তী যদি ৩০ ডিগ্রির কম হয় তাহলে তার পর্যায়কাল— এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত যেতে যে সময় লাগে— কেবল তার দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের পেন্ডুলামের পর্যায়কাল সবসময় ধ্রুব থাকে যা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্ররাই খুব সহজে হাতে-কলমে প্রমাণ করতে পারে। গালিলেওই প্রথম বিধিবদ্ধ পরীক্ষার মাধ্যমে পাদোভাতে বসে এই সূত্রটি প্রমাণ করেছিলেন এবং সেটা করতে গিয়ে সরল দোলকের গতির আরো সূক্ষ্ণ কিছু ব্যাপারও আবিষ্কার করেছিলেন।
পাদোভা ছাড়ার ঠিক আগের বছর গালিলেও হঠাৎ শুনতে পান যে, হল্যান্ডের চশমা নির্মাতারা এক অভিনব যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে যা দিয়ে দূরের বস্তু বড় করে দেখা যায়, পরবর্তীতে যার নাম হবে দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা দুরবিন। শোনার সাথে সাথেই গালিলেও এর মধ্যে সীমাহীন সম্ভাবনার আঁচ পান এবং সাথে সাথেই অনুরূপ একটা যন্ত্র তৈরির মিশনে নেমে যান। আলোকবিজ্ঞানে তার যতটুকু জ্ঞান ছিল তা দিয়ে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওলন্দাজরা উত্তল ও অবতল লেন্সের একটি সমন্বয় ব্যবহার করেছে। তার নিজের বর্ণনা মতে, সিদ্ধান্ত নেয়ার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষ লেন্স নির্মাতাদের সহায়তায় তিনি এমন এক দুরবিন বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন যার ক্ষমতা এর আগের সব ওলন্দাজ দুরবিনেরও চেয়েও বেশি। এই উদ্ভাবন দেখিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে প্রচুর অর্থকড়ি কামাতে পারতেন, কিন্তু তার কাছে পয়সার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল খ্যাতি ও প্রতিপত্তি। তিনি বিশাল আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভেনিসের দুকা (“ডিউক” এর ইতালীয় সংস্করণ) নিকোলো কোন্তারিনি কে ৮ বিবর্ধন ক্ষমতা বিশিষ্ট একটি দুরবিন উপহার দেন। রেস্টন এই অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, “ভেনিসীয় মেধার উদ্যাপন অনুষ্ঠান… হঠাৎ যেন একটি নল হয়ে উঠল পাদোভা’র শিক্ষার প্রতীক।” এর বিনিময়ে গালিলেও প্রচুর এককালীন অর্থ পান, তার নিয়মিত বেতন দ্বিগুণ করে দেয়া হয় এবং তার চাকরিটাও চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
জাগতিক জৌলুস থেকে চোখ ফিরিয়ে গালিলেও শীঘ্রই তার দুরবিন তাক করেন আকাশের দিকে, আর সাথে সাথে এমন বৈপ্লবিক কিছু জিনিস পর্যবেক্ষণ করেন যা তার জন্য খ্যাতি ও দুর্দশা দুটোই বয়ে এনেছিল। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে তিনি তার দৌরবীক্ষণিক চোখ দিয়ে দেখেন চাঁদের বন্ধুর পৃষ্ঠ, বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ, শুক্রের কলা, সৌরকলঙ্ক আর শনির বলয় যদিও এটা তার দুরবিন দিয়ে খুব একটা স্পষ্ট দেখা যায়নি। ১৬১০ সালে তার কিছু পর্যবেক্ষণ সিদেরেউস নুনকিউস ((মূল লাতিন নাম Sidereus Nuncius, ইংরেজি অনুবাদের নাম Starry Messenger.)) নামক বইটিতে প্রকাশ করেন যা অত্যুল্প সময়ের মধ্যে ইতালিসহ গোটা ইউরোপে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
কিন্তু গালিলেও’র চাহিদা ছিল আরো অনেক বেশি। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল তার কৈশোর-যৌবনের জায়গা তুস্কানি-তে প্রত্যাবর্তন যে অঞ্চলের রাজধানী ফ্লোরেন্স। তুস্কানি’র নতুন গ্রানদুকা (গ্র্যান্ড ডিউক) ছিলেন মেদিচি পরিবারের তরুণ কোসিমো দে মেদিচি যে আগে গালিলেও’র কাছে পড়েছিল। সুদৃষ্টির আশায় তিনি সিদেরেউস নুনকিউস গ্রানদুকা’র নামে উৎসর্গ করেছিলেন এবং এমনকি বৃহস্পতির উপগ্রহ চারটিকে মেদিচীয় উপগ্রহ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। তৈলমর্দণ গুলো একটুও বৃথা যায়নি এবং অচিরেই তিনি তুস্কানি থেকে এক অভূতপূর্ব প্রস্তাব পান: তার বেতন হবে রাজদরবারের সর্বাধিক বেতন ভোগীর সমান, আবশ্যক দায়িত্ব বা কাজ বলতে কিচ্ছু থাকবে না, এমনকি লেকচারও দিতে হবে না, এবং তিনি তুস্কানির গ্রানদুকা’র প্রধান গণিতবিদ ও দার্শনিকের পদবি পাবেন। মহানন্দে ফ্লোরেন্স যাত্রার সময় গালিলেও ভেনিস ও পাদোভাতে অনেকের ঈর্ষা ও ক্ষোভ জাগিয়ে গিয়েছিলেন।
ফ্লোরেন্স ও রোমে
তুস্কানিতেও সবচেয়ে অভিজাতদের মধ্যে গালিলেও বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী খুঁজে পান যাদের মধ্যে ফিলিপ্পো সালভিয়াতি’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গালিলেওরা প্রায় নিয়মিতই ফ্লোরেন্স থেকে পনের মাইল দূরে সালভিয়াতি’র বাড়িতে বেড়াতে যেত। কিন্তু গালিলেওর চাহিদা তখনও অপূর্ণই ছিল। এবার তিনি চান স্বয়ং রোম, পোপের দেশ, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, জয় করতে। ১৬১১ সালে গ্রানদুকা’র কাছে রোমে গিয়ে স্বয়ং পোপকে তার দুরবিন দেখানো এবং তার জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক কাজের গুরুত্ব বুঝানোর প্রস্তাব তুলে ধরেন।
রোম যাত্রা যে কুসুমাস্তীর্ণ হবে না সেটা গালিলেও জানতেন, কারণ তার কিছু পর্যবেক্ষণ স্পষ্টভাবেই ক্যাথলিক গির্জার অন্যতম প্রধান শিক্ষা, তথা পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং তার চারদিকে স্বর্গের সবকিছু আবর্তিত হয়, এই ধারণার বিরুদ্ধে যায়। টলেমি দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই ভূকেন্দ্রিক বিশ্বমডেল প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং ভ্যাটিকান একে তাদের একটি মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু গালিলেও নিজ চোখে দেখেছেন যে, বৃহস্পতির উপগ্রহগুলো পৃথিবী নয় বরং বৃহস্পতির চারদিকে আবর্তিত হয়, এবং আরো ঝামেলা বাধায় শুক্র গ্রহ যার কলা প্রমাণ করে যে সে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। এছাড়া ভ্যাটিকান বলত চাঁদ ও সূর্য সম্পূর্ণ নিখুঁত স্বর্গীয় বস্তু, আর গালিলেও দেখেছিলেন যে চাঁদের পৃষ্ঠ বন্ধুর ও পর্বতময় এবং সূর্যের গায়েও দাগ তথা কলঙ্ক রয়েছে। এর কিছুকাল আগে পোলীয় জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপারনিকাস টলেমীয় মডেলের বিপরীতে মহাবিশ্বের আরেকটি মডেল উপস্থাপন করেছিলেন যাতে সবকিছুর কেন্দ্রে পৃথিবীর বদলে সূর্যকে স্থান দেয়া হয়েছে। ১৬১১ সালে যখন গালিলেও রোম যান তখন তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর কোপারনিকান।
অবশ্য সে বছর অন্য অনেক কিছুর চাপে গালিলেওর পর্যবেক্ষণের বৈপ্লবিক দিকটা ভ্যাটিকানের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। রোমে তিনি স্বৈরাচার পোপ পল ৫ এর সাথে দেখা করেছিলেন এবং তার সফরটা মোটামুটি সফলই হয়েছিল। পরবর্তীতে পোপ তার প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক উপদেষ্টা রোবের্তো বেলারমিনো কে গালিলেওর আবিষ্কারগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে সে বিষয়ে ভ্যাটিকানের একটা অফিসিয়াল অবস্থান নির্ধারণের দায়িত্ব দেন। গালিলেও অবশ্য এমনটা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তার আবিষ্কারগুলো নিয়ে কথা বলুক জেসুইটদের কোলেজো রোমানো’র অভিজ্ঞ গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদরা যারা ইতিমধ্যেই চন্দ্রপৃষ্ঠে পাহাড়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিল, কিন্তু বৃহস্পতির উপগ্রহ ও শুক্রের কলা বিষয়ক পর্যবেক্ষণকে নির্ভুল আখ্যা দিয়েছিল।
রোমে গালিলেওর একজন খুব ভাল কুলীন বন্ধুও হয়েছিল, তার নাম ফেদেরিকো চেসি যিনি আকাদেমিয়া দেই লিঞ্চেই নামে একটা গোপন-সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সমাজটির আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য ছিল সত্যের অনুসন্ধান এবং প্রধান কাজ ছিল গণিত ও প্রাকৃতিক দর্শন চর্চা। লিঞ্চেই নামটি দ্বারা তারা লিংক্স (প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন বনবিড়াল) এর দিকে ইঙ্গিত করছিল এবং এই সমাজের অনেক তরুণ সদস্য প্রখর-দৃষ্টিসম্পন্ন ছিল বৈকি। চেসি গালিলেও’র সম্মানে খুব জাঁকজমক করে একটা অনুষ্ঠান করে এবং সেখানে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে একজন লিংক্স করে নেয়া হয়।
গালিলেও রোম ও ফ্লোরেন্সে প্রচুর প্রভাবশালী বন্ধু তৈরি করতে পেরেছিলেন, কিন্তু একইসাথে তার কিছু নিবেদিতপ্রাণ শত্রুও তৈরি হয়েছিল। ফ্লোরেন্সে তার প্রধান সমালোচক ছিলেন লুদোভিকো দেল্লা কোলোম্বে যাকে গালিলেও বিরোধীদের স্বঘোষিত নেতা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। ইতালীয় ভাষায় কোলোম্বে শব্দের অর্থ “পায়রা” এবং গালিলেও কোলোম্বে ও তার সমর্থকদেরকে ব্যঙ্গ করে বলতেন “কবুতর লীগ”।
১৬১১ সালের শেষদিকে নাটক জমে উঠে। কোলোম্বো গালিলেওকে একটা বৌদ্ধিক দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানান যার বিষয় হবে সব ভাসমান বস্তু, বিশেষ করে বরফ। পিসা’র এক অধ্যাপক আনুষ্ঠানিকভাবে গালিলেওকে দ্বন্দ্বযুদ্ধ টিতে আমন্ত্রণ জানান এবং গালিলেও সানন্দে রাজি হয়ে যান এই বলে, “যে কারো কাছ থেকে কিছু শেখার জন্য আমি সদা প্রস্তুত, তোমার এই বন্ধুর সাথে এ বিষয়ে যুক্তি সহকারে কথা বলার সুযোগ পেয়ে বরং আমি ধন্য।” যুদ্ধের ময়দান হিসেবে নির্বাচিত হয় মেদিচিদের বাসস্থান পিত্তি প্রাসাদ। বিতর্কের শ্রোতা হিসেবে সেদিন দুই জন কার্ডিনাল উপস্থিত ছিলেন— একজন গ্রানদুকা কোসিমো আর অন্যজন মাফেও বার্বেরিনি। এই বার্বেরিনিই পরবর্তীতে পোপ আরবান ৮ হবেন এবং গালিলেও নাটকের শেষ অঙ্কে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন কোসিমো’র মা গ্রানদুকেসা (গ্র্যান্ড ডাচেস) ক্রিস্তিনা দি লোরেনা।
বিতর্কে গালিলেওর বক্তব্য ছিল, বরফ ও অন্যান্য যেসব কঠিন বস্তু পানিতে ভাসে তাদের এই আচরণের কারণ তারা যে পানির উপর আছে তার তুলনায় হালকা। কোলোম্বে’র বক্তব্য ছিল এরিস্টটলেরটি, অর্থাৎ তাদের ভাসার কারণ তাদের বিশেষ আকৃতি। গালিলেও যথারীতি হাতে-কলমে প্রদর্শনের মাধ্যমে তার যুক্তি পরিষ্কার করেন। যখন দেখান যে খুব সরু আকৃতির আবলুস কাঠে টুকরাও পানিতে ডুবে যাচ্ছে কিন্তু বরফ ডুবছে না তখন দর্শকরা গালিলেওর সাথেই একমত হয়, এমনকি কার্ডিনাল বার্বেরিনিও।
ঝড়ের পূর্বাভাস
বিতর্কে জেতার পরদিনই গালিলেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আরোগ্যের জন্য সালভিয়াতি’র বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুস্থ হওয়ার পরপরই ভাসমান বস্তু নিয়ে তার ধারণার সারকথা লিখে ফেলেন এবং তারপর সালভিয়াতিকে নিয়ে সৌরকলঙ্ক পর্যবেক্ষণে মন দেন। সূর্যের বিষুবীয় অঞ্চলের বড় কলঙ্কগুলোর পশ্চিম থেকে পূর্বাভিমুখি গতি তারা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এরপর ১৬১২ সালে খবর আসে যে গালিলেওর একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর উদয় হয়েছে যে আপেলেস নামটি ব্যবহার করে। পরবর্তীতে জানা গেছে যে ইনি জার্মানির বাভারিয়ার গণিতের জেসুইট অধ্যাপক পাদ্রি ক্রিস্টোফার শাইনার। তো শাইনার, ওরফে আপেলেস, দাবী করেছিল যে, তিনি গালিলেও’র-ও আগে সৌরকলঙ্ক দেখেছেন এবং তার মতে এগুলো আসলে সূর্যের সামনে দিয়ে অতিক্রমণরত তারা। গালিলেও এতে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কারণ একে তো সে গালিলেওর কাছ থেকে আবিষ্কারের কৃত্তিত্ব ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে তার উপর সেই আবিষ্কারটাকে ব্যাখ্যাও করছে ভুলভাবে। তিনি কড়া ভাষায় আপেলেসকে কিছু চিঠি লিখেন এবং চেসি’র সাথে পরামর্শ করে সেগুলো লিঞ্চেই একাডেমি থেকে প্রকাশেরও ব্যবস্থা করেন। এই চিঠিগুলোতেই প্রথমবারের মতো কোপারনিকাসের মডেলের প্রতি তার সমর্থন স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছিলেন। প্রমাণ হিসেবে তার গ্রহের পর্যবেক্ষণগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, “আমি বলছি, এমনকি শনি ও শুক্র গ্রহও কোপারনিকান জগতের সাথে সুন্দরভাবে ঐকমত্য পোষণ করে। এই জগতের দিকে এখন অনুকূল বাতাস বইছে। এত উজ্জ্বল একটা পথপ্রদর্শক এলোপাথাড়ি বাতাস আর ছায়ার খেলায় আক্রান্ত হতে পারে ভেবে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।”
এর অল্পদিন পরেই গালিলেও কোপারনিকান জগতে তার বিশ্বাস প্রকাশের আরেকটা সুযোগ পান। গালিলেওর প্রাক্তন ছাত্র বেনেদেত্তো কাস্তেল্লি— যিনি তখন পিসায় গালিলেওর পুরনো পদে অধ্যাপনা করছেন— একদিন তাকে চিঠির মাধ্যমে গ্রানদুকেসা ক্রিস্তিনা’র সাথে তার একটা আলোচনার কথা জানায় যেখানে ধর্মপরায়ণ গ্রানদুকেসা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ব্যবহার করে তার যুক্তি খণ্ডন করছিলেন। তার সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় ছিল জশুয়া অধ্যায়ের একটি বাণী যাতে বলা আছে যে, জশুয়ার শত্রুরা যাতে রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য ঈশ্বর সূর্যকে থেমে যেতে আদেশ করেছিলেন। এটাই কি প্রমাণ করে না যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে এবং কোপারনিকান মডেল মিথ্যা?
গালিলেও এতে একটু শঙ্কিত হয়ে উঠেন। কারণ গ্রানদুকেসা’র মতো এত শক্তিশালী একজনের সমর্থন হারানোটা অনেক বড় ব্যাপার। তাই এই প্রথমবারের মতো তিনি নিজের কোপারনিকান মনকে ধর্মীয় ব্যাপারে কথা বলাতে রাজি করান। প্রথমে কাস্তেল্লিকে একটা চিঠিতে লিখেন যে, বাইবেলের সব কথা সবসময় আক্ষরিক অর্থে নিতে নেই বরং বাইবেলকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে তা পর্যবেক্ষণের সাথে মেলে। তার ভাষায়, “প্রাজ্ঞ ভাষ্যকার সে-ই যে ধর্মগ্রন্থের সেই প্রকৃত অর্থটা উদ্ধার করতে পারে যা পর্যবেক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূণ।” তিনি এও বলেন যে ঈশ্বর টলেমীয় বিশ্বে জশুয়াকে যতটা সাহায্য করতে পারতেন, কোপারনিকান বিশ্বেও ঠিক ততটাই পারবেন।
কাস্তেল্লি’র কাছে লেখা চিঠিটা খুব একটা সাড়া ফেলেনি, এমনকি এক বছর পর্যন্ত এর কোনো সমালোচনামূলক জবাবও কেউ দেয়নি। এর মধ্যে গালিলেও চিঠির বক্তব্যটাকে আরো বাড়িয়ে এই মত উপস্থাপন করেন যে, যখন পর্যবেক্ষণ ও মতবাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসে তখন পর্যবেক্ষণকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। এই মর্মে তিনি এবার সরাসরি গ্রানদুকেসাকে একটা চিঠি লিখেন যাতে বলেছিলেন, “পবিত্র গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে ঈশ্বরের উপাসনা করানো এবং তাদের আত্মা রক্ষা করা, কিন্তু যখন প্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় তখন তা সমাধানের শুরুটা ধর্মগ্রন্থের কর্তৃত্ব দিয়ে করা উচিত নয়, বরং করা উচিত ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধি ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষা দিয়ে।” কার্ডিনাল কাইজার বারোনিউস-এর এই কথাটাও উল্লেখ করেন যে, “বাইবেল আমাদেরকে বলে কিভাবে স্বর্গে যেতে হবে, কিভাবে স্বর্গ চলে সেটা নয়।”
গির্জার ভেতর থেকে গালিলেওর উপর প্রথম সরাসরি আক্রমণ আসে তরুণ ডোমিনিকান পাদ্রি তোমাসো কাচ্চিনি’র কাছ থেকে। কাচ্চিনি জশুয়ার অলৌকিক ঘটনা নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধভাবে একটা সার্মন দেন এবং তাতে উল্লেখ করেন যে, প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় বাণীতে বিশ্বাস ছাড়া এমন মহিমাময় ঘটনাগুলো বুঝা অসম্ভব। এটা গালিলেওর জীবনের একটা সন্ধিক্ষণ ছিল। কারণ, তিনি তো কোনো যেন তেন মানুষ ছিলেন না। ইতালির সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তুস্কানি’র গ্রানদুকা’র রাজ-দার্শনিক, রোমের অনেক ক্ষমতাবান কার্ডিনালের বন্ধু গালিলেওকে এবার সরাসরি ধর্মদ্রোহিতার দোষে দায়ী করা হল গির্জারই ভেতর থেকে। কাচ্চিনি আরেক ডোমিনিকান পাদ্রি নিকোলো লোরিনি’র সাথে মিলে সরাসরি রোমান ইনকুইজিশনের কাছে গিয়ে গালিলেওকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত করেন, প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন কাস্তেল্লি’র কাছে লেখা তার চিঠিটাকে।
এই অভিযোগ গালিলেওর পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি চাচ্ছিলেন সরাসরি রোমে গিয়ে ইনকুইজিশনের সামনে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করতে। হাজার হোক, চার বছর আগে পোপের উপদেষ্টা কার্ডিনাল বেলারমিনো গালিলেওর গবেষণার ব্যাপারে ভ্যাটিকানের যে অবস্থান নির্ধারণ করেছিলেন তা তো তার প্রতি অনুকূলই ছিল। কিন্তু আবারো অসুস্থতার কারণে তিনি যেতে পারলেন না। অবশেষে সুস্থ হওয়ার পর ১৬১৫ সালের শেষ দিকে রোমে যান। ইনকুইজিটর দের সুবিধার্থে ভ্যাটিকানের একটি কমিটি কোপারনিকাসের তত্ত্বটি নিয়ে আগেই আলোচনা করে এবং জানায় যে, “এটা নির্বুদ্ধিতা, উদ্ভট এবং পুরোপুরি ধর্মদ্রোহি।” ১৬১৬ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি ইনকুইজিশন পোপ পল ৫ এর কাছ থেকে একটি আদেশনামা পায় যাতে বলা হয়, এই মতবাদ শেখানো ও সমর্থন করা গির্জাবিরুদ্ধ এবং কেউ করলে তাকে আটক করা হতে পারে।
পরদিন সকালে বেলারমিনো’র উপস্থিতিতে ইনকুইজিশন গালিলেওকে এই আদেশ পড়ে শোনায়। গালিলেও কোনো প্রতিবাদ না করে ভ্যাটিকানের অফিসিয়াল বিবৃতির অপেক্ষা করতে থাকেন। কয়েক সপ্তাহ পর যখন সেই বিবৃতি আসে তখন তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন যে, তা বেলারমিনো’র আগের অবস্থানের পুরো বিপরীত— বেলারমিনো গালিলেওর যে গবেষণাগুলো বিচার করে দেখেছিলেন সেগুলোর কোনো উল্লেখ না করে এতে কোপারনিকাসবাদের উপর একটা সাধারণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিবৃতিতে লেখা ছিল, “সম্প্রতি আমাদের নজরে এসেছে যে, সূর্যের স্থিরতা ও পৃথিবীর গতিশীলতা বিষয়ক যে পিথাগোরীয় মতবাদ নিকোলাস কোপারনিকাস শিখিয়েছে তা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের কথার পুরো বিপরীত এবং তা ইতিমধ্যেই অনেক ছড়িয়ে গেছে এবং অনেকেই তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। পাছে এই মতবাদ সুচতুরভাবে ক্যাথলিক সত্যের ক্ষতিসাধন করে, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, কোপারনিকাসের রচনাবলী সংশোধিত না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকবে।”
[টু বি কন্টিনিউড…]
বেশ আগে উইকিপিডিয়াতে পড়েছিলাম নিজ আগ্রহ থেকে। আজকে তোমার লেখা পড়তে পড়তে ভাবলাম কেন আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তকে মহান ব্যক্তিদের জীবনীতে, সক্রেটিস, ব্রুণো, গ্যালিলিওদের নাম যোগ করা হয় না! কেন পরিকল্পিতভাবে একটি ছাগু জাতি তৈরী করা হচ্ছে।
কয়েক বছর আগে রোমের সেন্ট্রাল ট্রেনস্টেশনের কাছে একটা গির্জায় গিয়ে দেখেছিলাম গ্যালিলিও’র জীবন নিয়ে একটা প্রদর্শনী চলছে। তার কিছুদিন আগে ভ্যাটিকান গ্যালিলিও’র ওপর যে অন্যায় অত্যাচার করেছিল তার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছে। তারই উদ্যাপন চলছিলো। তখন একটা কথাই মনে হয়েছিল যে ভয় দেখিয়ে বৈজ্ঞানিক সত্যকে কিছুদিনের জন্য আড়াল করা হয়তো যায়, কিন্তু মিথ্যাকে চিরদিন সত্য বলে চালানো যায় না। গ্যালিলিওর সেই কথাগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক – “বাইবেল আমাদেরকে বলে কিভাবে স্বর্গে যেতে হবে, কিভাবে স্বর্গ চলে সেটা নয়।”
শিক্ষানবিসের লেখা থেকে শিখলাম অনেক। লেখা চলুক।
সাবলীল এবং চমৎকার।
একবার ইউটিউবে একটা মুভি পেয়েছিলাম- উপস্থাপনাটা ছিল অনেকটা মঞ্ছ নাটকের মত, গ্যালেলিওর কর্মজীবন এবং নির্বাসনের উপরে। শেষের দিকে বেশ কষ্ট লেগেছিল, গির্জার শাসনে কাটাতে হয়েছে জীবনের শেষ সময় গুলো। গ্যালেলিওর ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়েছিল, গ্যালেলিওর কাছে প্রকাশ করেছিল তাদের রাগ, কেন তিনি অস্বীকার করলেন সূর্যকেন্দ্রিক জগতের কথা! গ্যালেলিওর সেই গৃহে কাউকে আসতে হলে গির্জার নিয়োগকৃত পাদ্রীর অনুমত নিতে হত, ছাত্রদের সাথে কথা বলতে পারতেন না। এমনকি কি বলছেন তার প্রত্যেকটা শব্দ পাদ্রী বসে বসে শুনত, তিনি বেফাঁস কিছু বলে ফেলছেন কিনা। শেষ দৃশ্যটা ছিল রাতের অন্ধকারে গ্যালেলিও তার পান্ডুলিপি তুলে দেন তার ছাত্রের হাতে, যে সেই রাতেই চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। দেখতে দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
আপনার পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। রেফারেন্সটা পেতে পারি?
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জীবনী এবং কাজের উপরেও নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র খুঁজছি। আপনার জানা থাকলে যদি জানাতেন, খুব খুশি হতাম।
বের্টোল্ট ব্রেশ্ট গালিলেওকে নিয়ে জার্মান ভাষায় একটা বিখ্যাত নাটক Life of Galileo (১৯৪৫) লিখেছিলেন, সেটারই চিত্ররূপ কি দেখেছিলেন ইউটিউবে? হতে পারে। ঢাকাতেও ব্রেশ্টের এই নাটকটির বঙ্গানুবাদ মঞ্চায়িত হয়েছে যেখানে গালিলেও চরিত্রে অভিনয় করতেন আলী যাকের (আসাদুজ্জামান নুরও করেছিলেন পরে।) আমার অবশ্য কোনোটা দেখারই সৌভাগ্য হয়নি। একটা ইউটিউব সাক্ষাৎকারে আলী যাকের এর গালিলেও অভিনয়ের অভিজ্ঞতা শুনে খুব ভাল লেগেছিল, এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না ভিডিওটা। গালিলেও কে তিনি নিঃসন্দেহে উনার জীবনের সেরা অভিনয়-অভিজ্ঞতা বলেছিলেন।
ভিঞ্চি সম্পর্কে ব্রিটানিকাতে লেখা আছে, “As he would throughout his life, Leonardo set boundless goals for himself; if one traces the outlines of his work for this period, or for his life as a whole, one is tempted to call it a grandiose unfinished symphony.” এটা পড়েই আমি তার procrastination সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। ভিঞ্চি তার নোটবুকে যে অজস্র যন্ত্রের নকশা এঁকেছিলেন, তার সবগুলোই তার বানানোর ইচ্ছা ছিল, কিন্তু অধিকাংশ শুরুই করতে পারেননি, ভুল যুগে জন্মানোর কারণে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিগুলোর একটি The Adoration of the Magi ও অসমাপ্ত।
হ্যাঁ, ব্রেশটের Life of Galileo এরই চিত্ররূপ। আপনি বলাতে মনে পড়ল, এবং ইউটিউবেও খুঁজে পেলাম।
প্রথম অংশঃ https://www.youtube.com/watch?v=HFqENXxbkdc
দ্বিতীয় অংশঃ https://www.youtube.com/watch?v=71eLGJ-cz_Q
ধন্যবাদ।
লিংক দুইটার জন্য ধন্যবাদ। দেখতে হবে সিনেমাটা।
গ্যালেলিও গ্যালেলির আবিষ্কার,তার শ্রম ও মেধার সার্থকতা আজ সারা পৃথিবীর মানব জাতি বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করছে অথচ তার সময়কালে তাকে খৃষ্টীয় ভন্ড পোপের মননের আগুনের রোষানলে পড়ে কি নিদারুণ শাররিক ও মানসিক নির্যাতনে নির্যাযিত হতে হয়েছিল।
ঠিক আজ ৪০০ শত বছর পরে এসেও আব্রাহামিক ধর্মের শেষ নপুংশকদের হাতের ধারালো চাপাতির অপআঘাতে আমরা বাংলার সোনালী আকাশের নক্ষত্র অভিজিৎকে হারালাম।
আজ যেমন মানব জাতি খৃষ্টীয় ভন্ডদের ঘৃণা করে তেমনি ইস্লামিক ভন্ডদেরকেও সেদিন আর বেশী দূরে নাই সেরকম ঘৃণাজনক দৃষ্টিতে দেখা হবে।যদিও তারা জীবকূলের মধ্যে সবচাইতে
মানসিকভাবে নিকৃষ্ট্র মননের যাপিত জীব।
খৃষ্ট্রীয় ভন্ডরা গ্যালেলিওকে কাপুরুষজনোচিতভাবে পিছনের দিক থেকে এসে কোপায়ে মারেনি অথচ ইস্লামের জঘন্য কীটরা তা-ই করল।
ধীক তোদের।এবং একদিন তোদের ভবিষ্যৎ বংশধররা তোদের মুখেচোখে ধলা ধলা থুথু দিয়ে ঘৃণা ও করুনার চোখে দেখবে।এবং ধিক্কার দিয়ে বলবে তোরা আমাদের উত্তারাধিকারের কলংক।কারন সত্যের যে মরন নাই।সত্য একদিন তারা জানবেই যেমন আমরা জানি হাইফোসিয়া,সক্ক্রেটিস,গ্যালেলিও ও জিওর দানো ব্রুনুকে।
অভিজিৎ নাই এটা মনে হলে সবকিছুতে যেন খেই হারিয়ে ফেলি।
ধারাবাহিক সিরিজটি চলুক,,,,
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের সাথে ধর্মের সংঘাতের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা এখন আমাদের সবার দায়িত্ব। আশাকরি সে দায়িত্ব আমরা পালন করতে পারব।
আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। ভালো লেগেছে।
আপনি মুক্তমনার আবারো নিয়মিত হয়েছেন দেখে আনন্দিত হয়েছি। আশা করি, ক’দিন পরপরই আপনার লেখা পড়তে পারব।
তৃষ্ণা বেড়ে যাচ্ছে…