[সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন Yarden Katz যিনি MIT এর ডিপার্টমেণ্ট অফ ব্রেইন এন্ড কগনিটিভ সাইন্স এর গ্রাজুয়েট ছাত্র। তার গবেষণার বিষয় স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ এবং ক্যান্সার বিস্তারে জিনের প্রভাব।] [মূল সাক্ষাৎকারের লিঙ্ক]
[সাক্ষাৎকার গ্রহনকারীর ভূমিকা]
মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জগুলোর যদি তালিকা করা হয় তাহলে সবার উপরে থাকবে মানুষের মন এবং মস্তিস্কের আভ্যন্তরিন গঠন, এদের কার্যপ্রনালী এবং কীভাবে এদের গঠনপ্রণালী জিনের সংকেতে লিপিবদ্ধ থাকে সেটা বোঝা। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চ্যালেঞ্জটি দর্শন থেকে মনোবিজ্ঞান হয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান আর স্নায়ু বিজ্ঞান সহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাই গ্রহণ করেছে। তবে তাদের মধ্যে সমস্যাটিকে নিয়ে কীভাবে এগোতে হবে সে বিষয়ে নানান মতভিন্নতা দেখা যায়।
১৯৫৬ সালে জন ম্যাকার্থি নামক একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী প্রথম বুদ্ধিমত্তার অপরিহার্য উপাদানগুলোকে কম্পিউটারে ইমপ্লিমেন্ট করে সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করার চর্চাকে নাম দেন “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স” বা “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা”। এভাবে মানুষের তৈরি যন্ত্রপাতির মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বানাতে পারলে বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমাদের বোঝা সম্পূর্ন হয়েছে বলে প্রমাণিত হবে। তখন এর অনেক ব্যবহারিক প্রয়োগও পাওয়া যাবে, বুদ্ধিমান যন্ত্রপাতি এবং রোবট তৈরীতে।
ম্যাকার্থির সমসাময়িকরা অবশ্য কম্পিউটারে ইমপ্লিমেন্ট করার বদলে আগে মানুষের (বা অন্য প্রাণীদের) মধ্যে বুদ্ধিমত্তা কিভাবে কাজ করে সেটা বোঝার চেষ্টায় বেশী আগ্রহী ছিলেন। সে সময় আরো অনেকের সঙ্গে নোম চমস্কি আমাদের অনুভব এবং অনুধাবন করার ক্ষমতার পিছনে যে মানসিক নিয়মকানুন কাজ করে সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন। এই চর্চাকে পরবর্তিতে কগনিটিভ সাইন্স বা চৈতন্য বিজ্ঞান হিসাবে নাম করণ করা হয়। এ কাজ করতে গিয়ে চমস্কিদের তখনকার প্রচলিত সবচেয়ে প্রভাবশালী তত্ত্ব (হার্ভার্ড মনোবিজ্ঞানী বি এফ স্কিনার কর্তৃক প্রণীত) বিহেভিয়ারিসম কে ছুঁড়ে ফেলতে হয়, যে তত্ত্বে প্রাণীদের আচরণকে স্রেফ কিছু কাজ আর তার ফলে প্রাপ্ত লাভ আর ক্ষতির মধ্যে সম্পর্ক হিসাবে সরলীকরণ করা হতো। ১৯৫৯ সালে চমস্কি স্কিনারের বই Verbal Behavior – যেখানে বাচনক্ষমতাকে বিহ্যাভিয়ারিস্ট নীতিমালার সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে- এর একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখেন। যেটা মনোবিজ্ঞানের উপর থেকে স্কিনারের প্রভাব বহুলাংশে হ্রাস করে।
স্কিনারের অ্যাপ্রোচে কোনো প্রাণীর প্রাপ্ত প্রণোদনা আর তার ফলে তার প্রতিক্রিয়াগুলোকে তার আচরণের ইতিহাসের সাপেক্ষে বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়। ব্যাপারটাকে অতীতের সাপেক্ষে ভবিষ্যৎ অনুমান করার একটা পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি হিসাবে দেখা যেতে পারে। অপরদিকে চমস্কির বিশ্লেষণে মানব জিনোমের অন্তর্গত জটিলতা কীভাবে উপযুক্ত তথ্যের উপস্থিতিতে একটা জটিল গণনাপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ভাষাজ্ঞান হিসাবে বিকশিত হচ্ছে তা অনুসন্ধান করা হয়। এ ধরনের জটিল বিকাশ স্রেফ সরল কিছু নিয়মের সমষ্টি হিসাবে প্রকাশ করা যায় না। এটা স্পষ্ট যে শুধুমাত্র বিহেভিয়ারিস্ট নীতিমালা মেনে ভাষার প্রাচুর্য ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। বিশেষ করে যদি ভাষার সীমাহীন সৃষ্টিশীল ব্যবহার আর কোনো শিশুর আশেপাশের পরিবেশ থেকে ভাসা ভাসা ভাবে শোনা শব্দ থেকেই পুরো একটা ভাষা শিখে ফেলার ক্ষমতাকে হিসাবে আনা হয়। চমস্কির মতে ‘ভাষার ক্ষমতা’ মানুষের দৃষ্টি শক্তি, শ্রবণ শক্তি, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা, পরিচলন তন্ত্র ইত্যাদির মত স্রেফ আরেকটা খাঁটি শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার যা মানুষ তার জেনেটিক উত্তরাধিকারসূত্রে পায়।
নিউরোলজিস্ট ডেভিড মার কোনো শারীরবৃত্তিয় ব্যবস্থা (যেমন মস্তিস্ক) কে বিশ্লেষণের একটা সাধারণ কাঠামো প্রণয়ন করেন তাঁর Vision নামক বই এ। চমস্কির ‘ভাষা ক্ষমতার’ বিশ্লেষণ এই বই এ প্রণীত কাঠামোতে পড়ে। মারের মতে কোনো জটিল শারীরবৃত্তীয় ব্যবস্থাকে তিন স্তরে বোঝা সম্ভব। প্রথম স্তর (গণনা স্তর) ঐ ব্যবস্থাটির ইনপুট আর আউটপুট নিয়ে আলোচনা করে, যা ঐ সিস্টেমটি আসলে কী করছে সেটা নির্ধারণ করে। যেমন দৃষ্টি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ইনপুট হচ্ছে আমাদের রেটিনাতে প্রক্ষিপ্ত ছবি আর আউটপুট হচ্ছে মস্তিস্কে সেই ছবির মাঝে উপস্তিত বস্তুগুলোর পরিচিতি। দ্বিতীয় স্তরে (অ্যালগরিদমিক স্তর) আলোচনা হয় কীভাবে এই ইনপুট আউটপুটে পরিণত হচ্ছে তার প্রক্রিয়া। অর্থাৎ রেটিনায় প্রক্ষিপ্ত ছবিটাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করলে গণনা স্তরে যে কাজের কথা বলা হয়েছে সেটা সম্পন্ন হবে তা। সবশেষে তৃতীয় স্তর (প্রায়োগিক স্তর) যেখানে আলোচনা করা হয় কীভাবে আমাদের জৈব কোষগুলো সম্মিলিতভাবে দ্বিতীয় স্থরের কাজগুলো সম্পন্ন করে।
আমাদের মন কীভাবে কাজ করে সেটা বোঝার জন্য চমস্কি আর মার যা করেছেন তা বিহেভিয়ারিজম থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। তাঁরা কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশে কোনো ব্যবস্থার অতীত আচরণের সাথে ভবিষ্যত আচরণের বাহ্যিক সম্পর্ক নির্ণয়ের বদলে ব্যবস্থাটি কোনো কাজ তার আভ্যন্তরীন গঠনের সাহায্যে কীভাবে সম্পন্ন করছে সেটা বোঝার চেষ্টা করেছেন। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবস্থাটির ‘ব্লাক বক্স’ খুলে দেখা। অনেকটা কোনো কম্পিউটার বিজ্ঞানী যেমন কোনো চমৎকার সফটওয়ারের প্রতিটি অংশের কাজ আলাদা ভাবে বুঝতে পারেন এবং চাইলে সেটি একটা ডেস্কটপ কম্পিউটারে চালাতেও পারেন, তেমন।
চৈতন্যবিজ্ঞানের বর্তমান ইতিহাস হচ্ছে স্কিনারের বিহ্যাভিয়ারিস্ট ধ্যান ধারনার বিপরীতে চমস্কির পদ্ধতির বিজয়ের ইতিহাস যাকে প্রায়ই ‘চৈতন্য বিপ্লব’ (cognitive revolution) অভিধা করা হয়। চমস্কি যদিও এই ‘বিপ্লব’ নাম দেবার বিরুদ্ধে। চৈতন্য বিজ্ঞান আর মনোবিজ্ঞানে বিহ্যাভিয়ারিস্ট ধ্যান ধানরানার কর্তৃত্ব খর্ব হলেও আনুসাংগিক কিছু শাখায় এই চর্চা এখনো বিদ্যমান। যেমন স্নায়ুজীববিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রাণীর (যেমন ইদুর) আচরণ বিশ্লেষণে বিহেভিয়ারালিজম নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত করে থাকে, মারের প্রস্তাবতি তিন স্তরের বিশ্লেষণ কাঠামো এখানে অবহেলিত।
ম্যাসাচুসেস্ট ইন্সটিটিউট অফ টেকনলজির (MIT) ১৫০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকি উপলক্ষ্যে “মস্তিষ্ক মন এবং মেশিন” এই শিরোনামে একটি আলোচনাসভা আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রথম সারির কম্পিউটার বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং স্নায়ুবিজ্ঞানীরা জড় হয়েছিলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অতীত ভবিষ্যৎ এবং স্নায়ুবিজ্ঞানের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে।
এই সম্মেলনটার উদ্দেশ্য ছিলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক চর্চার শুরুর প্রশ্নটা নিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনা। প্রশ্নটা হচ্ছে, বুদ্ধিমত্তা কিভাবে কাজ করে? আমাদের মস্তিষ্ক থেকে কিভাবে আমাদের চৈতন্যের উদ্ভব হয়, এবং এই চেতনা কি কোনো যন্ত্রের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
এই সম্মেলনে নোয়াম চমস্কির বক্তব্য অবশ্য সাম্প্রতিক অগ্রগতি নিয়ে অতটা আশাবাদী ছিলো না। তিনি প্রচলিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চাকে সমালোচনা করেন এই বলে, যে এটা যেন অনেকটা বিহেভিয়ারিজম এর পুনরুত্থান হয়ে গেছে, যা স্রেফ গণনার দিক থেকে একটু বেশি কৌশলী। চমস্কি বলেন এই ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে অত্যধিক উপাত্ত থেকে প্যাটার্ন খুজের বের করার যে চর্চা তা থেকে কোনো ব্যাখ্যামূলক অন্তরদৃষ্টি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মানে “নতুন AI” পরিসংখ্যানিক শিখন পদ্ধতি ব্যবহার করে তথ্যানুসন্ধান এবং অনুমানে গুরুত্ব আরোপ করায় এর পক্ষে বুদ্ধিমত্তা আর চৈতন্য সম্পর্কে কোনো সাধারণ নীতিমালা নির্ণয় প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এই সমালোচনার একটা বিস্তৃত প্রতিউত্তর লিখেছেন গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণার পরিচালক পিটার নরভিগ, যিনি পরিসংখ্যানিক পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন এই বলে যে AI এর এসব নতুন পদ্ধতি এবং সংজ্ঞা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার চেয়ে খুব বেশি ভিন্নতর নয়।
চমস্কি এটা স্বীকার করেছেন যে পরিসংখ্যানিক পদ্ধতির কিছু ব্যবহারিক মূল্য আছে যেমন এটা কার্যকর সার্চ ইঞ্জিন এবং বিপুল পরিমান তথ্য বিশ্লেষণে সক্ষম দ্রুতগতির কম্পিউটারের বিকাশে সাহায্য করেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে এ ধরনের অগ্রগতি অপ্রতুল এবং কিছুটা অগভীরও। আমরা কম্পিউটারকে “পদার্থবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন” কথাটার অর্থ আসলে কী তা এখনো বুঝাতে পারিনি, যদিও কোনো সার্চ ইঞ্জিনিনে কথাটা টাইপ করলে ঠিকই সংশ্লিষ্ট পাতাগুলো সে খুঁজে আনতে পারে।
দেখা গেছে জীববিজ্ঞানীদের মধ্যেও এ ধরনের দ্বন্দ কাজ করছে। বিশেষ করে যারা যারা চমস্কির ‘ভাষা ক্ষমতার’ মত কোনো শারীরবৃত্তীয় ব্যবস্থার কর্মকান্ড বুঝতে চেষ্টা করছেন। কম্পিউটারে গণনাক্ষমতার ব্যাপক বৃদ্ধি যেভাবে সুবিশাল তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে “নতুন AI” এর অগ্রগতির রসদ যোগাচ্ছে, তেমনি জিন সংকেত বিশ্লেষণের বিপ্লব আধুনিক জিনতত্ত্ব এবং সিস্টেম বায়োলজির মত ক্ষেত্রের উদ্ভব ঘটাচ্ছে। লক্ষ-লক্ষ্য DNA এর সংকেত দ্রুত এবং কম খরচে পাঠোদ্ধার করার উচ্চক্ষমতার জিনবিশ্লেষণ পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ায় ব্যায়বহুল এক যুগের কাজ এখন কম খরচে একটা সাধারণ গবেষণাগারেই করা সম্ভব। একটা জিনকে আলাদাভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করার বদলে আমরা এখন একদল জিনের একটা ব্যবস্থা কিভাবে একটা কোষের মধ্যে হাজার হাজার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় সম্মিলিতভাবে কী আচরণ করছে সেটা দেখতে পারি।
জিন সংকেত বিশ্লেষণের বিপ্লব মাত্রই শুরু হয়েছে এবং এর মধ্যেই বিপুল পরিমান উপাত্ত আহোরিত হয়ে গেছে। যার মাধ্যমে মানুষের নানান রোগের নির্ণয় ও নিরাময়ের আশা দেখাচ্ছেন অনেকেই। যেমন কোনো প্রচলিত ক্যানসার প্রতিরোধক ওষুধ যদি কোনো রোগীর উপর কাজ না করে তাহলে এর সমাধান হয়তো লুকিয়ে আছে রোগীর জিনের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মাঝে যা ঐ ওষুধটিকে কাজে বাধা দিচ্ছে। তাই এ ধরনের ক্যানসার রোগীদের বিপুল পরিমান জিনোম তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত জ্ঞান প্রয়োগে হয়তো এমন ‘ব্যক্তিগত ঔষধ’ প্রস্তুত করা সম্ভব হবে যেটা প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা আলাদা। অবশ্য এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে, যে উচ্চতর পরিসংখ্যানিক পদ্ধতি প্রয়োগে বিপুল পরিমান উপাত্ত থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যটি বের করে নেওয়া সম্ভব। যেখানে এই বিপুল উপাত্ত প্রায় অবোধগম্য শারীরবৃত্তীয় ব্যবস্থার থেকে পাওয়া যা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমিত।
চমস্কির মতে এ ধরনের ব্যক্তিগতকৃত ওষুধ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সফলতা এই জিন বিশ্লেষণের বিপ্লবের একটা উপজাত যা আমাদের “বিপুল অবিশ্লেষিত উপাত্ত” বিশ্লেষণের ক্ষমতার উপর দাঁড়িয়ে আছে। এর ফলে জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান এবং কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিতর্কের মত একটা বিতর্কের মাঝে পড়ে গেছে।
সিস্টেম বায়োলজির এই উন্নতি প্রাথমিক সংশয় ব্যাতিরেকে হয় নি। নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত জিনতত্ত্ববিদ সিডনি ব্রেনার সিস্টেম বায়োলজির ক্ষেত্রটিকে একসময় “low input, hight throughput, no output science” বলে বিদ্রুপ করেছিলেন। ব্রেনার, যিনি চমস্কির সমসাময়িক, একই AI বিষয়ক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং মস্তিষ্ককে বোঝার ব্যাপারে এই সিস্টেম অ্যাপ্রোচের ব্যাপারে একই ধরনের সংশয় প্রকাশ করেছেন। কানেকটমিক্স নামক একটি সিস্টেম যা ব্রেইনের প্রতিটি নিউরনের পুরো সার্কিটকেই ম্যাপ করে ফেলতে চায় সেটার ব্যাপারেও ব্রেনার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তিনি এভাবে অগ্রসর হওয়াকে পাগলামি বলে উল্লেখ করেন।
সিস্টেম বায়োলজি নিয়ে ব্রেনারের সমালোচনা আর AI নিয়ে চমস্কির সমালোচনা যেন একই সূত্রে গাঁথা। দুটো ক্ষেত্রই একটা অতি জটিল সিস্টেমের অন্তর্গত রহস্য উদ্ঘাটন না করেই তার আচরণ বাইরে থেকে পুননির্মান করার চেষ্টা করা হয়। যেখানে, ধারাবাহিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সুবিশাল উপাত্ত ভান্ডার সৃষ্টি করছে যার খুব ছোট একটা অংশই আসলে কাজের। আমরা কি শক্তিশালী গণকযন্ত্র আর উচ্চতর পরিসংখ্যানিক পদ্ধতির উপর নির্ভর করে বিপুল এলোমেলো উপাত্ত ঘেটে অর্থবহ কিছু খুঁজে বের করবো নাকি আরো গভীর কোনো মৌলিক নীতিমালার অনুসন্ধান করবো। আর সুলভ হওয়ায় বেশি বেশি উপাত্ত সংগ্রহ করার প্রলোভনটা সামলানো মুশকিল যদিও কী ধরনের তাত্ত্বিক কাঠামোতে এইসব উপাত্ত বসবে তা আমাদের অজানা। এই বিতর্ক বিজ্ঞানের দর্শনের একটি সুপ্রাচীণ প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে: একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা ব্যাখ্যা কখন সন্তোষজনক হয়, এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সফলতা কীভাবে নির্ধারিত হবে?
এপ্রিলের এক বিকেলে নোয়াম চমস্কির সংগে বসি আমি। ফ্রাঙ্ক গেরির চোখ ধাঁধানো ডিজাইনের MIT স্টেটা সেন্টারের এক নিভৃত কোনে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চমস্কির সমালোচনা এবং এই ক্ষেত্রটা কেন ভুল দিকে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন সেটা আরো ভালোভাবে বুঝতে চাইছিলাম আমি। তার এই ধারণা নিউরো সাইন্স বা সিস্টেম বায়োলজির মত ক্ষেত্রেও কী প্রভাব ফেলে সেটাও বুঝতে চাচ্ছিলাম। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মত এসব ক্ষেত্রেও একটা জটিল ব্যবস্থাকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর চেষ্টা করা হয় এবং সেই প্রক্রিয়ায় প্রায়সই বিজ্ঞানীদেরকে এক সাগর উপাত্তের মধ্যে হিমসিম খেতে হয়। এই সাক্ষাৎকারের একটা প্রেরণা ছিল এই যে চমস্কিকে আজকাল বিজ্ঞান বিষয়ে খুব কমই জিজ্ঞেস করা হয়। সাংবাদিকরা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিমালা, মধ্যপ্রাচ্য, ওবামা প্রশাসন ইত্যাদি নিয়ে কিছু গৎবাধা প্রশ্ন করেন তাকে। আরেকটা কারণ হচ্ছে চমস্কি সেই দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির বুদ্ধিজীবি যারা দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। ইসাইয়াহ বার্লিনের সেই বিখ্যাত নিবন্ধটা প্রকাশিত হবার পর থেকেই একাডেমিকদের প্রিয় অবসর যাপন হয়ে গেছে বিজ্ঞানী এবং চিন্তাবিদদের ““হেজহগ আর শৃগাল গোত্রে ভাগ করা। যেখানে হেজহগ হচ্ছেন এমন একজন বিশেষায়িত কর্মী যিনি সুনিপুনভাবে অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ক্রমে অগ্রসর হন, অপরদিকে শিয়াল হচ্ছেন একজন ধারণা চালিত চিন্তাবিদ যিনি তার কৌতূহলকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে এক প্রশ্ন থেকে আরেক প্রশ্নে চলে যান এবং নিজের দক্ষতাগুলো কাজে লাগিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। চমস্কি আলাদা, কারণ তিনি এই দ্বিবিভাজনকে একটা পুরনো ক্লিসেতে পরিণত করেছেন। চমস্কির গভীরতার কারণে তাঁর ব্যপ্তিতে কোনো কমতি ঘটেনি, যদিও তিনি তাঁর কর্মজীবনের বেশিরভাগই ব্যয় করেছেন ভাষাতত্ত্ব এবং চৈতন্যবিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট এবং সুসংজ্ঞায়িত ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে। চমস্কির কাজ তাঁর নিজের ক্ষেত্র বাদেও কম্পিউটার বিজ্ঞান বা দর্শনের নানা শাখায় সুবিশাল অবদান রেখেছে। এবং তিনি তাঁর ধারণাগুলোর প্রভাব নিয়ে আলোচনা সমালোচনাও কখনো এড়িয়ে যাননি। ফলে সাক্ষাৎকার গ্রহনের জন্য চমস্কি একজন খুবই আগ্রোহদ্দীপক ব্যক্তি।
[এতক্ষণে প্রেক্ষাপটটি বোঝা গেল । মূল সাক্ষাৎকার পরের পর্ব থেকে]
{ছবি সূত্র উইকিমিডিয়া কমন্স। তুলেছেন jeanbaptisteparis}
খুব ভালো একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন,আমি Artificial Intelligence নিয়ে পড়তে ইচ্ছুক।
Apply করার আগে আপনার লেখাটা খুব কাজে দিয়েছে।
ভূমিকাটা আসলেই আগ্রহজাগানিয়া ছিলো। এরকম লেখাই মুক্তমনার সম্পদ, চলমান থাকুক।
কৌতূহল জেগেছে অনেক। সরাসরি দ্বিতীয় পর্বে চলে যাচ্ছি।
কলম চলুক।
আর একটা পরামর্শ। চাইলে পোস্টের একটা ফিচার্ড ইমেজ ঠিক করে দিতে পারেন, সেক্ষেত্রে নীড়পাতায় ছবিসহ পোস্টের সারাংশ আসে যা অনেক সময় সুন্দর লাগে। অবশ্য দেখলাম, ফিচার্ড ইমেজ ঠিক করার জন্য ছবিটা সরাসরি মুক্তমনাতে আপলোড করতে হয়, বাইরে থেকে লিংক দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ছবি সাইজে ছোটো করে নিয়ে তারপর আপলোড করা যায় মনে হয়।
ফিচারড ইমেজ সেট করার ব্যাপারটা জানতাম না। আগে সম্ভবত এমনিতেই আসতো। আসছেনা দেখে অবাক হচ্ছিলাম। পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। 🙂
কগনিটিভ সায়েন্স এর বাংলা হিসেবে চৈতন্যবিজ্ঞান টা পছন্দ হয়েছে। আপনিই বানাইলেন?
“সম্পূর্ণ হয়েছে” বলাটা বোধহয় কঠিন। এক্ষেত্রে লরেন্স ক্রাউসকে অনুযোগের সুরে ড্যানিয়েল ডেনেট যা বলেছিলেন (এই ভিডিওর ৫২:৪০ মিনিটে) সেটা মনে পড়ছে। তার কথা ছিল অনেকটা এরকম: “বিজ্ঞানীরা দার্শনিকদের খুব কঠিন কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে, প্রশ্নটিকেই এমনভাবে ঢেলে সাজিয়ে নেন যাতে তার উত্তর দেয়া সম্ভব হয়, আর সেই ঢেলে সাজানো প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর তারা মূল প্রশ্নটিরই উত্তর দেয়া হয়ে গেছে বলে ধরে নেন।” এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ডেনেট টুরিং টেস্ট এর কথা বলেছিলেন।
সি পি স্নো এর The Two Cultures পড়ে আগ্রহ পেয়েছিলাম, কিন্তু বার্লিনের এই সজারু-শিয়াল এর ধারণাটা একেবারেই জানতাম না। সাক্ষাৎকারের এই ভূমিকা থেকে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এই ধারণাটা। বার্লিনের প্রবন্ধটা পড়ে দেখতে হবে।
আর, Noam এর উচ্চারণ নোয়াম না হয়ে নোম হওয়া উচিত না? আমি ইউটিউবে মার্কিনদেরকে সেরকমই উচ্চারণ করতে শুনেছি।
সাক্ষাৎকার পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
চৈতন্যবিজ্ঞান পরিভাষাটা বানালাম (মানে আগে কোথাও ব্যবহার করতে দেখিনি)।
হ্যাঁ, এই “মেশিন বানাতে পারলেই বুদ্ধিমত্তা বোঝা হয়ে গেল” অনুমিতিটাতে আসলেই সমস্যা আছে। যেমন, ঐ কানেকটোম বা অন্য কোনো স্ট্যাটিস্টিক্যাল লার্নিং সিস্টেমের কথা ভাবা যাক। এমন কোনো সিস্টেম স্মার্ট আচরণ করলেও তার ভিতরটা একটা ব্লাক বক্স হয়ে যাবে। কারণ ভিতরটা আরেকটা ব্রেইনের মতই জটিল হয়ে যাবে যার গাঠনিক উপাদানগুলো কিভাবে প্রসিডিউরালি কাজ করছে তা আমরা বুঝি না। অপরদিকে চমস্কি চাচ্ছেন গভীরতর উপলব্ধি। কারণ চেতনাকে সেভাবে বুঝতে পারলে চেতন মেশিনও বানানো সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে চেতনা সম্পর্কিত কৌতূহলও নিবারণ হলো। এ নিয়ে মূল সাক্ষাৎকারে আরো গভীরভাবে আলোকপাত হবে।
মূল জটিল প্রশ্নকে সরলিকরণ করে একটা সরল ভার্সন উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করাটা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ভালো প্র্যাক্টিস। তাই সেই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমি না। কিন্তু ডেনেটের সাথে আমি এক মত। কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে কাজ করার কারণে প্রায়ই দর্শন আর বিজ্ঞান আর ফ্রি উইল সংক্রান্ত প্রশ্ন এসে হাজির হয় বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গেই। তখন সবাইকে এভাবে সিমপ্লিফাই করতে দেখি প্রশ্নটাকে। এবং প্রায় অবধারিতভাবেই সিমপ্লিফায়েট উত্তরটা খুঁজে পাবার পর সবাই সমস্যাটা ‘সমাধান হয়েগেছে’ টাইপ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে!
বার্লিনের মূল প্রবন্ধটা টলস্টয়কে নিয়ে। প্রবন্ধের শুরুতে একটা সেকশনে তিনি এই সজারু-শিয়াল ধারণাটা আনেন। (হেজহগ কিন্তু সজারূ না। তবে অনুবাদে সজারু ব্যবহার করলেই মনে হয় ভালো হতো।) লেখায় সেই অংশের একটা এক্সার্প্টের লিঙ্ক যুক্ত করেছি।
বাংলা পেপার পত্রিকায় সব সময় ‘নোয়াম চমস্কি’ লিখতে দেখি বলে সেভাবেই লিখলাম। একই নামের উচ্চারণ এবং ট্রান্সলিটারেশন একেক দেশে একেক ভাবে করে। তাই বাংলাদেশে যেটা প্রচলিত হয়ে গেছে সেটাকে আর জোর করে পাল্টাতে গেলাম না। চাইলে আমরাও ‘নোয়াম’ লিখে সেটাকে ‘নোম’ পড়তে পারি 😀
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এই বিতর্কে আগ্রহ পাচ্ছি। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
আগ্রহ পাচ্ছেন জেনে আমিও আগ্রহ পেলাম। 🙂