১১ বছর আগে প্রথাবিরোধী নাস্তিক লেখক হুমায়ুন আজাদকে কোপানো হলো। তিনি মারা গেলেন তার কিছুদিন পরে। আমরা মানবিক মানুষেরা সবাই আর্তনাদ করলাম, বিচার চাই, বিচার চাই। প্রায় এক যুগ কেটে গেল। বিচার হলো না। হবার সম্ভাবনা দেখি না। দুই বছর আগে নাস্তিক ব্লগার রাজীবকে তার বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। আমরা মানবিক মানুষেরা সবাই মিলে আবার আর্তনাদ করতে লাগলাম, বিচার চাই, বিচার চাই। বিচার তো হলো না। একমাস আগে নাস্তিক লেখক অভিজিতকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো বইমেলার কাছেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভেতরেই। পুলিশ নির্বিকার দাঁড়িয়ে ছিল আদূরেই। আমরা আবার আর্তনাদ করতে লাগলাম – বিচার চাই, বিচার চাই, বিচার চাই। বিচার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা তো দেখছি না। অভিজিতের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। একমাস গেল মাত্র। কুপিয়ে হত্যা করা হলো আরেক নাস্তিক ব্লগার ওয়াশিকুর বাবুকে। বাবুর খুনীরা ধরা পড়েছে। সরকারী বেতনভুগী নির্বিকার পুলিশেরা ধরেনি খুনীদের। ধরেছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। যারা বাংলাদেশে অত্যন্ত ঘৃণ্য তাদের প্রাকৃতিক লিঙ্গের কারণে।

হুমায়ুন আজাদের রক্তাক্ত ছবি দেখেছি। রক্তঝরা মুখ, রক্তমাখা হাত। কী ভয়াবহ সেই দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এভাবে কোপাতে পারে? হ্যাঁ, পারে। ধর্মের কারণে, বাজে ধর্মগ্রন্থগুলির কারণে। রাজীবকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে তার বাড়ির সামনে। জবাই করা, গলাকাটা নিথর রাজীব পড়ে আছে মাটিতে। রক্তে ভেসে গেছে রাস্তা। সেই বিভৎস দৃশ্য দেখেছি। মানুষ মানুষকে এভাবে জবাই করতে পারে? হ্যাঁ,পারে। পৃথিবীর জঘন্যতম প্রাণী ধর্মগুরুরা যে ব’লে গেছে ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললেই মানুষকে হত্যা করতে। তাদের অনুসারীরা তাই করে থাকে। নিরপরাধ অভিজিৎ বইমেলায় এসেছেন কত শখ করে। নিজের লেখা দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে এ বছর। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এসেছেন দেশে, নিজের মাতৃভূমিতে। বইমেলা থেকে ফেরার পথে, মেলা থেকে দুই-পা দূরেই কুপিয়ে হত্যা করা হলো তাকে। রক্ত ভেসে যাচ্ছে। অভি পড়ে আছে ফুটপাতে। অভির মজগ পড়ে আছে, বন্যার আঙ্গুল পড়ে আছে। অভির ও নিজের রক্তে মাখা বন্যা সাহায্য চাচ্ছে মানুষের কাছে। বিজ্ঞান যুক্তি মুক্তবুদ্ধির কথা লেখার জন্য মানুষ মানুষকে এভাবে খুন করতে পারে কি? হ্যাঁ, পারে। ইসলামের নবী নিজে বিধর্মীদের হত্যা করে গেছে। তার রচিত কোরানেও তাই নির্দেশ দিয়ে গেছে। তাদেরকে যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করো,জোড়ার জোড়ায় হত্যা করো, একপাশের হাত ও অন্যপাশের পা কেটে ফেলো ইত্যাকার ঘৃণ্য কথা দিয়েই সে তার বাজে কেতাবটি ভরিয়ে দিয়ে গেছে।

বাবুর লেখাগুলি খুব ভালো লাগতো আমার। দৃষ্টিভঙ্গি ও তার প্রকাশ এত সুন্দর স্বচ্ছ। শুধু ধর্ম বলে নয়, অন্যান্য বিষয়েও তার চিন্তাচেতনার প্রকাশ মুগ্ধ করতো আমাকে। বন্ধুদের সাথে মাঝেমাঝে বলতাম, এই ছেলেটি লিখে চমৎকার। সেই বাবুকে কুপিয়ে মেরে ফেলা হলো। ‘নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব’ নামে একটা সিরিজ লিখছিল সে ধর্মকারীতে। ১০৩ নাম্বার কটূক্তিতে সে লিখেছিল,
কটূক্তিঃ নাস্তিকরা ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করলে মুমিনরা কেন তাদের কতল করে, কেন ফাঁসির দাবী তোলে? কেন আল্লাহর ওপর বিচারের ভার ছেড়ে দেয় না?
.
দাঁতভাঙা জবাব:
যারা ইসলামের নামে ইসলামের রসূলের নামে কটূক্তি করে বেড়ায়, ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে, তারা ইসলামের শত্রু। এর চেয়ে জঘন্য অপরাধ আর হতে পারে না। এই অপরাধের শাস্তি দেওয়া প্রতিটি মুসলিমের ঈমানি দায়িত্ব।

হায়রে বাবু! মুছলমানের ঈমানি দায়িত্বের শিকার হয়ে গেলে তুমিও।

স্বাভাবিক মৃত্যু হলে হুমায়ুন আজাদ লিখতে পারতেন আরো অনেকগুলি বছর। বাংলা সাহিত্য আরো কত যে সমৃদ্ধ হতো তাঁর লেখায়। কত বড় অফুরন্ত ক্ষতি যে করলো তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের, তা কি মূর্খ নবীর মূর্খ উম্মতেরা বুঝবে? রাজীব লিখে যেতো আরো অনেকগুলি বছর। অভিজিৎ লিখে যেতো আরো অনেকগুলি বছর। বাংলা ভাষায় তার মতো করে বিজ্ঞান তো এ পর্যন্ত আর কেউ লিখেনি, লিখতে পারেনি। বাবুর তো বয়েস মাত্র শুরু। লিখতে পারতো আরো অনেক অনেক বছর। কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করা হলো এতগুলি অমূল্য নিরপরাধ জীবন। বিচার চাই বিচার চাই বিচার চাই করে আমরা আর্তনাদ করতে করতে একেকজন খুন হয়ে যাচ্ছি। বিচার তো আজ অবধি হয়নি। বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের বেঁচে থাকাটাই আজ এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। খুন হয়ে যাওয়াটাই ন্যায্য। মুক্তচিন্তার মানুষ এখনো যারা বেঁচে আছে তারা কেন বেঁচে আছে? তাদের বিচার চাই।