ঢাকা শহরের এই এক অসুবিধা-জায়গা ছোট, লোক বেশী। মহল্লার ছোট ঈদগাটার বেলায়ও তাই ঘটেছে আজ। মাঠটা ভরে ফেলতে তিন-চারশ লোকই যথেষ্ট। মুসাল্লিতে গিজ গিজ করছে মাঠটা- সাদা টুপি মাথায় মুসাল্লি। এই এলাকারই একজনের শেষ কৃত্য হবে এখানে। সাদা আলখেল্লা পরে অনেক মানুষ এসেছে একজন লোকের জানাজা পড়তে। তারা কেউ এই মহল্লার, আবার কেউবা বাইরের। সাজিয়ে গুছিয়ে সাদা খাটিয়ায় করে মুর্দাকে রাখা হয়েছে মিম্বরের ঠিক সামনে। ইমাম সাহেব গলা খাখারি দিলেন। হাজেরানে মজলিসের উদ্দেশ্যে তিনি কিছু বলতে চান।
-মুসাল্লি ভাইয়েরা আফনেরা সবাই গায়ে গা লাগায়া একলগে খারান। দুই খামছা মাইনষের ভেতরে একখাল পরিমান ফারাক কইরা দারাইবেন না।
হুজুরের কথায় কাজ হলো। সবাই কাছাকাছি সরে দাড়ালো- কাতার বন্দী হলো। বাছ্‌ ঐ পর্যন্তই।
চোখের নিমেষে আবার যা তাই। আবার সেই এক খালের ফারাক।
নামাজীদের মুখোমুখী হলেন আবার ইমাম সাহেব। সবার দিকে তাকিয়ে একটা হালকা হাসি দিলেন- ইষত রাগ আর বিদ্রুপ মিশানো এক হাসি। যা বলার তিনি বলে দিয়েছেন। বদী নেকী সব মানুষের হাতে। গোনাহ হলে তাদের। তার কোন দায় নেই এতে।
-ভাইয়েরা, বুজছি আমনেরা এক হইবেন না। রাজনীতির একটা ব্যাপার আছে এইহানে। আমদল আর জামদলের হগ্গলে আইছেন জানাজায়, বালা কতা। তয় আমার কতা হইলো- নামাজের কাতারে হগ্গলে সমান।
ইমাম সাহেব কিছু সময় থামলেন। এদিক ওদিক তাকালেন। কি জানি খুজছেন তিনি। সামান্য দূরে ঈদগার সীমানায় ছাতিম গাছটার তলায় দেখতে পেলেন মজিদ মিঞার বিধবা বিবি চার পাঁচ বছরের দুটো বাচ্চা দুই হাতে ধরে বসে আছে। মহিলার চোখে শূণ্য দৃষ্টি, সেখানে শোকের চেয়ে অনিশ্চয়তার আতংক কাজ করছে বেশী- অনিমেষ তাকিয়ে আছে স্বামীর মৃতদেহের দিকে। হুজুর কি দেখলেন আর কি বুঝলেন তিনিই জানেন-শুধু মাঝারী সাইজের একটা দীর্ঘশ্বাস সাবধানে গোপন করলেন।
আবার ভাল করে ঝেড়ে কেসে গলা পরিষ্কার করলেন ইমাম সাহেব। আরও কিছু বলার আছে তার। হুজুর সুকন্ঠী নন। সত্য কথা বলতে পারেন তিনি সেই কন্ঠে। তাতে অনেকে নাখোশ হয় তার উপর। কিচ্ছু করার নেই। তিনি চিনির সুরুয়া মিশিয়ে কথা বলতে পারেন না, উচিত কথাটা মুখের উপরেই বলতে পছন্দ করেন। এজন্য অনেকে তাকে ‘কাইষ্টা’ হুজুর বলে। তা বলে বলুক। তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। নেকীর পথ অত সোজা না। সেই বেসুরো কন্ঠে সজোরে খাকারী দিলেন হুজুর। দুয়েকটা কথা বলা দরকার মুসাল্লিদের।
-ভায়েরা, আফনেরা জানেন আমি কারও জানাজা পড়ার আগে মোর্দার দুয়েকটা নেকী কাজ, তার কোন ভাল আকিদা থাকলে সেসব মুসাল্লিদের বইলা থাকি। আমাগো হুজুর সাল্লাল্লাহ এইডা করতেন।
আরেকবার সশব্দে গলা পরিষ্কার করলেন হুজুর। পানভরা গালে তর্জনীতে লাগানো কিছুটা চুন মুখে দিয়ে বাকীটা টোক্কা দিয়ে ছুড়ে দিলেন শূন্যে। পান চিবানো চলছে দ্রুত। জানাজার নামাজের আগে মুখ খালি করতে হবে। আল্লার রসুলের সুন্নতের ব্যাপারে কোন গাফিলতি নেই তার। আবার ওয়াজ শুরু করলেন হুজুর।
-শুনেন ভাইসব। আইজ যে মজিদ মিঞার দাফনের জন্য আপনেরা এই ঈদগায় জমায়েত হইছেন, তিনি এক অতি সাধারণ বান্দা আছিলেন। এজিবি অপিসের অতি সামান্য এক কেরানী আছিলেন তিনি। দিন আনি দিন খাই অবস্থা আছিল তার। বড় নেকী বান্দা তিনি- কোন দিন এক পয়সা ঘুষ খান নাই, খাইলে তার অবস্থা অন্যরকম হইতো। এই মাইনষের কোন শত্রু থাহনের কতা না। তারপরেও উনি মারা গেলেন অপঘাতে-রাজনীতির জনসভায় গুলি খাইয়া। এই অফিস করা আর পরিবারের দেহাশুনা করা ছারা ওনার আর কোন কাজ আছিল না। তয় ওনার চোখে একখান খোয়াব আছিল। প্রায়ই আমার লগে কতা হইতো তার এইসব নিয়া। উনি খোয়াব দেখতেন মানুষের স্বভাব-চরিত পরিবর্তনের, নিয়মকানুণ, সংসার, সমাজ বদলের। তার এই স্বপ্পন তৈরী হইছিল নেতা নেত্রীদের মেঠো বত্তৃতা শুইনা শুইনা। কোন রাজনীতির সভায় উনি গরহাজীর হইতেন না। নেতাদের কতা উনি গিল্লা খাইতেন, সত্য ভাবতেন সব কতা। আফনেরাই কন, নিতারা কি সব কতা সত্য বলেন? সব কতা কি রাখতে পারেন? এইহানে তো এই মহল্লার সবাই আছেন- আমদল, জামদল দুই দলেরই নেতারাই হাজির- আফনেরাই কন?
কেউ কোন উত্তর দেয়না। দিতে পারেনা। শুধু মাটির দিকে চোখ রেখে মাথা নীচু করে থাকে। মাথা নীচু করে থাকাটা কি কোন লজ্জা শরমের প্রকাশ, নাকি উদাসীনতা কিছুই বোঝা যায় না! ওয়াজ আবার শুরু করলেন ইমাম সাহেব।
– ভাইসব, মজিদ সাব কোন বিখ্যাত লোক আছিলেন না, ছিলেন ছাপোষা কেরানী। তার জানাজায় এত লোক হইবো এইডা আমি ভাবতেই পারি নাই। লোক বেশী হইছে বালা কতা, তয় কেমনে কি হইলো? রাতারাতি কেমনে তিনি বিখ্যাত হইলেন, এইডা আমার কাছে রহস্য লাগতাছে। বরো কতা হইলো- উনি বালা মানুষ আছিলেন। আল্লাহ উনার বেহেস্ত নসিব করুক আমরা সবাই এইটা চাই।
জানাজার নামাজ শুরু করলেন ইমাম সাহেব। তরিকা বাতলে দিলেন নামাজিদের-কিভাবে পড়তে হয় নামাজ।
ওদিকে মজিদ মিঞার বিধবা বউ, সালেহা বেগম ‘পোলাপান’ নিয়ে ছাতিম গাছের নীচে বসে অপেক্ষা করছে, কখন একনজর দেখতে পাবে সে তার মৃত স্বামীর মুখটা। মুসাল্লিরা তাকে দেখতে দেয়নি মোর্দার মুখ। মরার পরে নিজের স্বামী নাকি পরপুরুষ হয়ে যায়। মুখ দেখা তখন বেজায় গুনাহ- গোনায় কবীরা। সালেহা বেগম স্মরণ করে অতীত। এই এতটা বছর এই অদ্ভুত লোকটার সাথে ঘর করেছে সে, অথচ ভাল কোন ব্যাবহার তার সাথে সে করেছে বলে মনে পড়েনা তার। সেই দুঃখটা গুমরে গুমরে বুকের ভেতরটায় হাপরের মত উঠা নামা করছে। নিজেরে বড্ড বেশী অপরাধী আর ছোট লাগছে তার। তারপরেও তার চোখে কোন জল নেই। সব চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে। আগামীকাল এই দুটো বাচ্চাকে নিয়ে সে কোথায় দাড়াবে সেই চিন্তা পাথরের মত শক্ত হয়ে চোখের ভেতরে বসে গেছে সালেহা বেগমের। পাথরে পানি থাকে না। তাই তার কান্নাও নেই। মনে পড়ে তার- এই খেয়ালী মানুষটারে বিয়ে করেছিল সে ঠিকই। কিন্তু তার সাথে সাথে অভাবকেও বিয়ে করতে হইছিল তার। না করে কি করবে সে? ততোধিক অভাবী বাবাকে তো একটা স্বস্তি— দিতে হবে তার। ভাবে সালেহা বেগম-“সারাজীবন রাজনীতি রাজনীতি কইরা জীবনটা কাটাইয়া দিল মানুষটা, আর শেষকালে সেই রাজনীতি তারে খাইলো? জমের দুরারে পাঠাইলো তারে? কতদিন এই লোকটা অসুস্থ্য পোলাপান থুইয়া মাঠের বক্তৃতা শুইনা রাতে ঘরে ফিরছে। কতদিন বাজার না কইরা খালি হাতে ঘরে ফিরছে হুদা বক্তিমা মাথার ভেতরে ভইরা। পাগল আছিল লোকটা, এক্কারে পাগল।”
হঠাত করে লোকজনের কোলাহলে ঘোর কেটে গেল সালেহা বেগমের। ততক্ষনে জানাজা পড়া শেষ হয়ে গেছে। কি করছে ঐ মুসাল্লিরা? খাটিয়া ধরে অমন টানা হেচড়া করছে কেন ওরা? কিছু একটা ঘটছে ওখানে। দেখতে হবে কি ঘটছে তার স্বামীকে নিয়ে। মুহুর্তের ভেতরে সাহসী হয়ে যায় সালেহা বেগম, দুরন্ত সাহসী। ছেলে মেয়ে দুটোরে হাতে ধরে খীপ্র বাঘিনীর মত বিধবা লাফ দিয়ে এসে পড়ে মোর্দার সামনে- তার মৃত পরপুরুষের সামনে। মুখ দিয়ে আগুন ঝরে তার।
-বহুত অইছে। লাশ নিয়ে ছেলেখেলা খেলতে দিমুনা। মোর্দা কান্দে কইরা মিছিল দেওনের কাম নাই। ছারেন কইলাম, আমার সোয়ামীর খাটিয়া ছাইরা খারান।
খাটিয়া ধরে দড়াটানাটানিতে ব্যাস্ত আমদল আর জামদলের নেতারা খাটসহ মোর্দাকে মাটিতে নামিয়ে রাখে। জানবাজ বাঘিনী দেখে তারা মুহুর্তের জন্য ভড়কে যায়। পরবর্তী কর্মসূচী কি হতে পারে তা স্থির করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে, সময় কাটায় উভয় দলের লোকেরা, কর্মীরা।
এবার সশব্দ কান্নায় শব্দময় হয়ে উঠে বিধবা মহিলা। অশ্রুহীন সেই কান্নায় ভেঙ্গে না পড়ে আরও শক্ত মারমুখী হয়ে এগিয়ে আসে সে।
– এই মানুষটা সারাটা জীবন আমারে, আমার পোলাপানেরে কষ্ট দিছে। নিজেও এট্টু শান্তি পায় নাই। এই সবই করছে সে আফনেগো লাইগা, আফনাগো দলের লাইগা। রাতারাতি তারে আফনেরা মজিত মিঞা থেইকা মজিদ সাব বানাইছেন। এহন তারে বানাইতে চান নিজেগো দলের কর্মী? ভঙ্গ দ্যান, বহুত অইছে। নিজের শান্তি নষ্ট কইরা সারা জীবন সে বিনে পয়সায় আফনেগো লাইগা করছে। এহন আল্লার অস্তে তারে এট্টু শান্তি দ্যান। মাটির ভেতরে শান্তিতে এট্টু গুমাইতে দ্যান।
খালি পা দিয়ে মাটির উপরে বারবার আঘাত করতে থাকে বিধবা নারী, সাথে উচ্চকিত কান্নার অশ্রুহীন লাভা জ্বালিয়ে দেয় যেন আশপাশের কুটিল স্বার্থপরতার গলিত ভাগাড়। লোকজনের ভেতরে একটুখানি দয়ার মত কিছু একটা ফিরে আসে। খাটিয়া ছেড়ে তারা একটু দুরে এসে দাড়ায়। সম্ভবত রনে ভঙ্গ দিতে চায় তারা। আমদল, জামদল ভঙ্গ দিতে চাইলেও, চায় না শফি পাগলা। এই মহল্লার একমাত্র ভয়ংকর পাগল সে। কোথা থেকে উড়ে এসে দুই দলের মাঝখানে দাড়িয়ে যায় মালকোচা মারা উদোম শরীরের শফি পাগল। চোখ পাকিয়ে মুখ দিয়ে গরল ঢালতে থাকে সে বিরমহীন।
-যাহ, যাহ, দূর হ। মরা ভাইয়ের মাংশ খা। কুত্তার গোশতো খা। জাগন্নামের আগুন খা। পারবি না, পারবি না, মজিদ মিঞার গোশতো খাইতে পারবি না। সময় থাকতে পালা, নইলে কপালে কষ্ট আছে। যাহ, যাহ দূর হ।
শফি পাগলা তেড়ে আসে। মুসাল্লিরা আস্তে আস্তে সরে পড়ে যার যার কাজে। আমদল, জামদল তাদের স্বপ্ন ভঙ্গের দুঃখ বুকে চেপে সুড় সুড় করে অন্তঃরালে চলে যায় তাদের মত করে, নতুন কোন দুঃস্বপ্নের জন্ম দেবে বলে। ঈদগার মাঠ প্রায় নির্জন পড়ে থাকে। পায়ে পায়ে মুর্দার খুব কাছে চলে আসে বিধবা। আজ সে বিদ্রোহী। স্বামীর মুখের সাদা নেকাব সরিয়ে ফেলে সে। শেষবারের মত মৃত স্বামীর মুখ দেখার সাধ মিটলো তার। কিন্তু কি আশ্চর্য্য, এতটা নিশ্চিন্ত মুখ, এতটা পরিতৃপ্ত, আর সুখী মুখ সে তো আগে কখনও দেখেনি- সেভাবে দেখেনি। বুঝতে পারেনা বিধবা নারী, মজিদ মিঞার মুখে তার স্বপ্ন ছোয়ার আনন্দটা লেগে রয়েছে- পরিবর্তনের স্বপ্ন।