যাত্রীরা হুঁশিয়ার
মীজান রহমান

কল্পনা করুন।
জ্যোছনাঢালা হেমন্তের রাত। আপনারা দুজন, ইহসংসারে আর কেহ নাই আপনারা দুজন ছাড়া, হাঁটতে বেরিয়েছেন নিরালা পার্কে। পায়ের নিচে ঝরাপাতার গালিচাঢাকা নীল পথ আপনাদের প্রাণের ছন্দে আন্দোলিত। হঠাৎ আবেগের বশে মন চাইল ওকে জড়িয়ে ধরে টেনে নেন ঠোঁটের কাছে, আপনার উষ্ণ নিঃশ্বাসের অন্তরংগ পরিমণ্ডলের মাঝে। এই কাজটি, এই যে অকস্মাৎ প্রাণের প্রবল জোয়ারে ভেসে যাবার, এবং সাথে সাথে সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার দুর্বার বাসনা, দেশে থাকলে কখনোই সম্ভব হত না আপনার পক্ষে। সেখানে নিরালা বলে কিছু নেই, আড়াল সেখানে কল্পনার বিলাস মাত্র, দৃশ্যমানের বাইরে থেকেও অসংখ্য চোখ সেখানে নিত্য নিবিষ্ট আপনার দিকে। কিন্তু আপনি যেখানে আছেন সেখানে মানুষের চোখ অন্য কাজে ব্যস্ত, আপনার সান্ধ্যবিহারের ওপর খবরদারি করার চাইতে হাজার মূল্যবান কর্ম নিয়ে তাদের চোখ ও মন নিত্য নিমগ্ন। এদেশে আপনি জন্মাননি, বাস করতে এসেছেন। স্বদেশের জীবন স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে আপনি এসেছেন নতুন জীবনের সন্ধানে, নতুন দেশেতে। এখানে আপনি, আমি, আমরা, সবাই, বহিরাগত, অভিবাসী। আমরা এখানে এসেছি আরাম করে শ্বাস নিতে পারব সে আকাংক্ষায়, সুস্থ বায়ু সেবন করতে পারব সে আশাতে, দেশের ওই সদাসন্দিহান চোখগুলোর নীরব শাসন এড়িয়ে যেতে পারব সে ভরসায়।
কিন্তু না। দাঁড়ান একটু। হঠাৎ করে একি হল? আপনি টের পাবার আগেই পেছন থেকে, টর্চলাইট জ্বালিয়ে, দুটি শ্মশ্রুসম্বলিত যুবক আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের পোশাক আপনার আমার মত নয়, এমনকি দেশী কায়দার পাজামা পাঞ্জাবীও নয়, পুরোপুরি আরবি তাঁবুবাসী যাযাবরদের মত, জোব্বাজাব্বা, মাথায় গোলটুপি, তাদের হাতে কি যেন লম্বা লাঠির মত কিছু একটা, আপনার গা হিম হয়ে গেল তাদের সম্মুখিন হয়ে। এরা কারা? ভাবছেন আপনি। আপনার সঙ্গিনী ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আপনার গায়ের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছেন—হয়ত আপনার বিবাহিত স্ত্রী, নতুবা যাকে আপনি একান্তভাবে কাছে পেতে চাইছেন এমন এক আরাধ্য মানুষ, কি আসে যায় তাতে, এটা তো সভ্য দেশ তাই না, এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে তাই না? কিন্তু না, সেসব জাহিলতি বুলি মানবার পাত্র নয় এই যুবকযুগল। তারা নতুন যুগের নতুন দেশের ধর্মপুলিশ—-শরিয়ার শাসন প্রতিষ্ঠা করার মহান দায়িত্ব দ্বারা অভিষিক্ত তারা, খবর পাননি বুঝি? আপনার এই পাড়াটিকে তারা শরিয়া পাড়া বলে ঘোষণা করে দিয়েছে, সেখবরও আপনার কানে যায়নি মনে হচ্ছে। জানি কি বলবেন আপনি—-এটা তো ইরাক নয়, পাকিস্তান-আফগানিস্তান এমনকি বাংলাদেশও নয়। এটা ক্যানাডা। শুনতে পাচ্ছ তোমরা? এটা ক্যানাডা, যেখানে আধুনিক সভ্যতা কায়েম হয়েছে কয়েক শতাব্দী ধরে, যেখানে কারো ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর তো নেইই, এমনকি এই যে বিশাল শক্তিশালী রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সবার মস্তকের ওপর, তারও নেই। তোমরা কোন মরুভূমি থেকে উঠে এসেছ বলত দেখি, আপনি হয়ত ভদ্রভাবে তাদের শুধাতে চাইবেন।
সৌভাগ্যবশত ঠিক অতটা খারাপ অবস্থায় এদেশটি পৌঁছায়নি এখনো। সেজন্যেই বললাম কল্পনা করুন। তবে পৌঁছানোর সমূহ সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তাহলে চলুন আপনাকে নিয়ে বিলেতটা ঘুরিয়ে আনি একটু। বিলেত মানে যাদের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না এককালে, যাদের বুটের তলাতে আপনার আমার বাপদাদারা পিষ্ট হয়েও নিজেদের ধন্য মনে করতেন, যাদের কাছে মাথা নত করে থাকাটাই ছিল বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়, যেখানে এখনো রাজারানীরা পরম দাপটের সাথে দুনিয়া ঘুরে বেড়ান, আমি সেই বিলেতের কথাই বলছি। অনেক বছর আগে আমি যখন বিলেতে গেলাম পড়াশুনা করে গাড়িঘোড়া চালাবার আশাতে, তখন রাস্তাঘাটে সাদা চামড়ার শ্রমিক দেখে আমি মহা বিস্ময়ে পাশের বন্ধুকে বলেছিলামঃ দেখ দেখ, সাদারাও আমাদের মত শাবল কোদাল নিয়ে কাজ করে। হ্যাঁ ভাই আমি সেই বিলেতের কথাই বলছি। কিন্তু আজকের বিলেত ঠিক আগেকার বিলেত নয়। আজকের বিলেতে সাদা মানুষের ভয়ে কালোরা কাঁপে না, আমি যেমন করে কেঁপেছি গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে, বরং উল্টো—-কালোদের ভয়েই নিত্য কম্পমান বিলেতের শ্বেতাংগ জাতি। কেমন করে হল এটা, জানতে চাইছেন আপনি? আমার ব্যক্তিগত মতানুযায়ী কারণ প্রধানত দুটি। এক, কর্মফল। দু’শ বছরের প্রভুভৃত্য-ভিত্তিক ঔপনিবেশিক শাসন, তার একটা প্রতিফল থাকতেই হবে। আজকে ব্রিটেনে প্রায় ৩০ লক্ষ মুসলমান, যাদের অধিকাংশ সেই উপনিবেশগুলো থেকেই আগত, কেউ বৈধভাবে কেউবা অবৈধ, বর্তমান যুগের ঘোলাটে পরিবেশে কি’ই বা আসে যায় তাতে। যেমন করেই হোক পশ্চিমের মাটিতে পা দেওয়াটাই হল মূল লক্ষ, তারপর আল্লা ভরসা। দু’নম্বর কারণ হল, পশ্চিমের অবাধ উদারতা। বাছবিচার না করেই যে-কাউকে ঢুকতে দেওয়া এবং ঢোকার পর তাকে থাকতে দেওয়া, ব্রিটেনের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তার কোনও ইতিবাচক ভূমিকা থাক বা না থাক। সমস্যাটা সেখানেই। সমসাময়িক কালের কিছু কিছু ঘটনা থেকে মনে হয় ইতিবাচক দূরে থাক, প্রচণ্ডরকম নেতিবাচক ভূমিকার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে থাকতেই দেওয়া হয়না কেবল, নিয়মিত সরকারি ভাতা দিয়ে তাকে ভরণপোষণ করা হয়।
ব্রিটেন তথা সমগ্র পাশ্চাত্য জগতের এই দুরবস্থার পেছনে আরো অনেক কারণ অবশ্যই আছে, যার জন্যে দায়ী প্রধানত পশ্চিম নিজেই, কিন্তু আমি সেসব খুঁটিনাটির ভেতর যাব না আজকের নিবন্ধে। আজকে আমার মূল আলোচ্য বিষয় হল উগ্র ইসলামবাদীরা কিভাবে পশ্চিমের সমাজকে কলুষিত করে তুলছে, এবং সাথে সাথে সাধারণ শান্তিপ্রিয়, উদারপন্থী, মধ্যবিত্ত মুসলিম অভিবাসীদের জীবনকেও চরম সংকট ও উৎকন্ঠার পথে ঠেলে দিচ্ছে।
ক্যানাডার নিরালা পার্কর চন্দ্রালোকিত পরিবেশে যে ভয়াবহ দৃশ্যটি আমি পাঠকের কল্পনার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম, সেটি কিন্তু বিলেতের পথেঘাটে কোনও অলস কল্পনার বস্তু নয় এখন, রূঢ় বাস্তবতায় পরিণত হবার উপক্রম। ইন্টারনেটে ব্রিটিশ সাংবাদিক সু রীডের দীর্ঘ বিবরণ পড়ে দেখবেন—-গায়ের রক্ত জমে যাবে। ভয়ে, আতঙ্কে, বিমূঢ়তায়। তার সাথে যোগ করে নিন সমসাময়িক কালের আইসিসজনিত বিভীষিকার খবরগুলো। এই তো গতকালই, কাগজ খুলে দেখলাম সাদাম জামাল নামক এক বীরপুরুষের কীর্তিকাহিনীর খবর। তিনি হলেন ইসলামিক রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সিরিয়ার শত্রুপক্ষের এক পরিবার প্রাণের ভয়ে একটা পোড়োবাড়ির ভেতর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। জামালের লোকেরা তাদের সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে। প্রথমে পরিবারের তরুন ছেলেগুলির পালা। জামালসাহেব নিজে বন্দুক উঁচিয়ে আটকে রাখেন বাবা-মা দুজনকেই। তারা চোখের সামনে দেখতে পেলেন, না, দেখতে বাধ্য করা হল তাদের, ছেলেগুলোকে একে একে ধরে এনে মুণ্ডচ্ছেদ করা হচ্ছে—-তেরো বছরের ছেলেটি প্রথম, তারপর ছোটটি, তারপর তার চেয়েও ছোটটিকে। শুধু তাই নয়। মুণ্ডগুলো তারা যত্ন করে তুলে এনে ঝুলিয়ে রাখে ওই বাড়িটার দরজার ওপর, যাতে বাবামায়ের সারাজীবনের শিক্ষা হয়, এবং গ্রামবাসীরাও বুঝতে পারে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা কারা। আপনি হয়ত বলবেন সাদাম জামালদের মত ছেলেরা আসলে মুসলমান নয়, তারা খুনি, নরপিশাচ, এবং সেটাই তাদের একমাত্র পরিচয়। হতে পারে যে আপনার ধারণাই ঠিক, তবে মনে রাখতে হবে যে এই নরপিশাচরাই বেহেশতের গ্যারান্টি দেয়, খিলাফত যুগের গৌরবময় প্রত্যাবর্তনের আশ্বাস দেয়, এবং তাতে আকৃষ্ট হয়ে আপনার আমার মত সাতে-নেই-পাঁচে-নেই জাতীয় নিরীহ মুসলমানদের জোয়ান ছেলেরা ওদের সঙ্গে যোগ দেবার জন্যে আঁইঠাঁই করতে থাকে।
কথা হল আমাদের বিলেত-আমেরিকাতেও কি সাদাম জামালদের মত ছেলেদের সমতুল বর্বরতার দৃশ্য দেখতে হবে একদিন? উত্তর আমেরিকাতে এমুহূর্তে তার সম্ভাবনা খুব নিকটবর্তী বলে মনে হয়না, তবে বিলেতের কথা বলা যায় না। সেখানে মুসলমানরা সংখ্যায় এতটাই ভারি, আর তাদের মূর্খ ইমামগুলোর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি এতই ব্যাপক যে বিলেতের কথা ভেবে আমার কেবল একাত্তরের বাংলাদেশের কথাই মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মৌলবিসাহেবরা, যাদের আমরা রাজাকার বলে অভিহিত করি, তারা ইসলাম রক্ষার খাতিরে পাকিস্তানী খুনিদের কাছে সাধারণ মুক্তিকামী বাঙ্গালিদের লেলিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি, ঠিক একই ভাবে বিলেতের মৌলবিরাও হয়তবা শরিয়ার শাসন প্রবর্তন করতে গিয়ে শরিয়া লঙ্ঘনকারি লোকেদের ধরে ধরে মুণ্ডচ্ছেদ করতে শুরু করবে—-সাদাম জামালদের মত জল্লাদদের কাছে লেলিয়ে দেবে। ধর্মের স্বনিযুক্ত পাণ্ডাদের পক্ষে সবই সম্ভব। এটা এক হাজার বছর আগে যেমন ঘটেছিল, এখনও ঠিক সেরকমই ঘটতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের এই ধর্মটিতে গত দেড় হাজার বছরের ভেতর বিন্দুমাত্র সংস্কার হয়নি, এবং আগামি দেড় হাজার বছরে হয়ত বিন্দুমাত্র হবেও না। আমার জানামতে আমাদের ধর্মটিই একমাত্র ধর্ম যাতে যুগের সাথে পা রেখে চলার যে গতানুগতিক ধারাটি পৃথিবীর সব জাতের সব মানুষই অনেকটা বেদবাক্য হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, তার ঠিক বিপরীতটাকেই মানা হয় ধর্মের অখণ্ডনীয় বিধান বলে।
এবার চলুন বিলেতের ভেতরের ছবিটা একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক। সেই যে বললাম, মুসলমানদের সংখ্যা সেখানে ত্রিশ লক্ষ বা তারও বেশি। উপরন্তু, মৌলবিসাহেবদের দাবি অনুযায়ী তার সাথে প্রতি বছরই যোগ হচ্ছে ৫,২০০ জন নতুন মুসলমান। না, তারা বাইরে থেকে আসা অভিবাসী মুসলমান নয়, ব্রিটেনেই যাদের জন্মবৃদ্ধি, একসময় খৃস্টান বা অন্য কোনও ধর্মাবলাম্বী ছিলেন, তারপর ধর্মান্তরিত হয়েছেন ইসলাম ধর্মতে, তেমন মুসলমান। এই ধর্মান্তরিতদের নিয়ে সনাতন ইসলামীদের গর্বের অন্ত নেই—-এবং সঙ্গত কারণেই। যদিও মানবচরিত্রের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষকদের কাছে এটা অত্যন্ত রহস্যময় মনে হতে পারে কি কারণে একটা উন্নত দেশের আপাত শিক্ষিত নাগরিক তার জন্মগতভাবে প্রাপ্ত একটি গতিশীল ধর্মকে পরিত্যাগ করে সাদরে বরণ করে নেয় একটি অপেক্ষাকৃত স্থবির ও বিবর্তনবিরোধী মতবাদকে। শোনা যায় যে এই ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মাঝে বেশির ভাগই হলেন নারী। সেটাও আরেক ধাঁধার সৃষ্টি করে আমার মনে। ইসলামিক শরিয়াতে নারীর মানমর্যাদা সম্বন্ধে আমার যেটুকু ক্ষুদ্র জ্ঞান তাতে তো মনে হয়না বাইরের কোনও লেখাপড়াজানা মেয়ে জেনেশুনে নিজের ধর্ম ছেড়ে শরিয়ার বিধান সগর্বে গ্রহণ করে নেবেন। কিন্তু তারা নিচ্ছেন, এবং সেখানেই আমার সাধারণ বুদ্ধি মার খেয়ে যায়। সাধারণ বুদ্ধি অসাধারণভাবে ব্যাহত হয় যখন শুনি ব্রিটেনের উগ্রতম ইসলামিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকেই এই ধর্মান্তরিতের মধ্য থেকেই উত্থিত হয়েছেন। যেমন ধরুণ আবু ইজ্জাডিন—-যিনি মুখ খোলামাত্র গনগন করে আগুন বেরুতে থাকে বিদ্বেষ, ঘৃণা আর ক্রুদ্ধ প্রতিহিংসার বাণী ধারণ করে। এই ৪০ বছর বয়স্ক ব্রিটিশ-মুসলিম মোল্লার জন্ম ব্রিটেনেই, জামাইকা থেকে আগত এক খৃস্টান পরিবারে। তাঁর খৃস্টান নাম ছিল ট্রেভর ব্রুক্স। ১৭ বছর বয়সে, অর্থাৎ স্কুলের বয়স পার হবার আগেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একসময় তিনি বৈদ্যুতিক কারিগর হিসেবে জীবিকা অর্জন করতেন। সেসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন তিনি ইসলামের সেবাতে আত্মনিয়োগ করেছেন। তাঁর ইসলামসেবার ধরণটাই হল শ্বেতাঙ্গ জাতিকে কিভাবে ঘায়েল করা যায়, কিভাবে তরুন মুসলিমদের ক্ষেপিয়ে তোলা যায় অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে, সর্বোপরি কিভাবে সমগ্র ব্রিটেন জুড়ে শরিয়ার শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই পথ খোঁজা। ইরাক এবং আফগান যুদ্ধের সময় তিনি প্রকাশ্যে তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই যুদ্ধে যেসব ব্রিটিশ সৈন্য অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের যেন কল্লা কাটা হয়। কল্লা কিন্তু সত্যি সত্যি কাটা হয়েছিল ব্রিটেনে, অন্তত একবার। লণ্ডনের ঊলিচ এলাকার খোলা রাস্তার ওপর লি রিগবি নামক এক ২৫ বছর বয়ষ্ক আফগানিস্তান-ফেরত সৈনিককে কসাইখানার গরুছাগলের মত কচুকাটা করেছিল দুই দুর্বৃত্ত, যারা নিজেদের জিহাদী বলে দাবি করে, বলেঃ তাদের আল্লা তাদের হুকুম করেছেন বলেই তারা গর্বের সাথে এই মহান কাজটি সম্পন্ন করেছে। এরা সেই ইজ্জাডিনের মতই অন্য ধর্ম থেকে আগত ইসলামের নবদীক্ষিত সৈনিক। এদের একজনের নাম মাইকেল আদেবলাজো, আরেকজন মাইকেল আদেবোওালি—–নাইজিরিয়া থেকে অভিবাস নিয়ে আসা খৃস্টান পরিবারে জন্ম দুজনেরই। তারাও ঠিক ইজ্জাডিনেরই মত ১৭ বছর বয়সে নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পাঠকদের সুবিধার্থে ঘটনার সনতারিখটি উল্লেখ করে দিচ্ছিঃ ২৩ শে মে, ২০১৩ সাল। ঊলিচের রাস্তার সেই ভয়াবহ দৃশ্যটি এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। মানুষ এত বর্বর হয় কি করে জানিনা। এপ্রসঙ্গে ব্লেই পাসকেল নামক এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও গাণিতিকের একটা চমৎকার উক্তি মনে পড়ে যায়ঃ “ Man never do evil so completely and cheerfully as when they do it from religious conviction”. (মানুষ তার ধর্মবিশ্বাসের প্রেরণাতে যতটা আত্মতৃপ্তি আর আনন্দের সাথে একটা চূড়ান্তরকম জঘন্য কাজ সম্পন্ন করতে পারে ততটা সে অন্য কোনও কারণে করে না)। আরকটা উক্তি আছে নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবার্গেরঃ “ Good people can do good and bad people can do evil. But for good people to do evil—–that takes religion.” ( ভালো লোকেরা ভালো কাজ করবে, খারাপ লোকেরা করবে খারাপ। কিন্তু ভালো লোকেদের জন্যে খারাপ করতে হলে দরকার ধর্মের উস্কানি।”) এমনকি মহাত্মা গান্ধীর মত একজন পরম ধার্মিক মানুষও মন্তব্য না করে পারেননিঃ “ The most heinous and the most cruel crimes of which history has record have been committed under the cover of religion or equally noble motives.” (আজ পর্যন্ত যতগুলো জঘন্যতম ও বর্বরতম অপরাধের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে ইতিহাসে তার সবগুলোই হয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়ে নতুবা অনুরূপ কোনও মহৎ মতবাদের অজুহাতে”।) সুতরাং লণ্ডনের রাজপথে যে বর্বরতার অবতারণা হয়েছিল গতবার, বা নেদারল্যাণ্ডে হয়েছিল তারও কয়েক বছর আগে (ভিন্সেন্ট ভ্যান গো’র পৌত্র থিও ভ্যান গো’র হত্যাকাণ্ডের কথা (২রা নভেম্বর, ২০০৪) হয়ত অনেকেরই মনে আছে), তার সঙ্গে ওপরের উক্তিগুলো অনেকটাই খাপ খেয়ে যায়।
লণ্ডনের প্রসঙ্গে একটু ফিরে যাওয়া যাক। আঞ্জেম চৌধুরি নামক আরো এক হুজুর, তাঁরও সেই একই কাহিনী—-বাবামা ছিলেন খাঁটি ব্রিটিশ খৃস্টান, এখন তিনি খাঁটি গোঁড়া মুসলমান। এমনই গোঁড়া যে ‘যুক্তরাজ্যের-জন্য-ইসলাম’ (Islam4UK) নাম দিয়ে একটা জঙ্গী প্রতিষ্ঠান তিনি গঠন করেছিলেন যার ঘোষিত লক্ষই ছিল জোর জবরদস্তি করে ব্রিটেনকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। ব্রিটিশ সরকার সেটিকে অবৈধ ঘোষণা করাতে আপাতত তার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে, অন্তত বাহ্যিকভাবে। তবে এঁরা শরিয়াতন্ত্র কায়েম করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন—-তিনি, ইজ্জাডিন, ও তাঁদের যাবতীয় চেলাচামুণ্ডারা। শরিয়ার জন্যে তারা জান কবুল করতে প্রস্তুত। মহাবিস্ময়ের ব্যাপার হল যে বিলেতের মুসলিম পরিবারগুলোর মতামত জানতে গিয়ে দেখা গেল অন্তত শতকরা ৪০ জনই শরিয়ার পক্ষপাতী। তাঁরা মনে করেন পশ্চিমের তথাকথিত মুক্ত সমাজ ও মুক্ত জীবনের সুযোগ নিয়ে ব্রিটেনে এখন চূড়ান্তরকম চারিত্রিক উচ্ছৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তরুন সমাজের ভেতর। মাদকাসক্তি, অবারিত নেশাসেবন, নির্লজ্জ বেশভূষা, অবাধ যৌনতা, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা, ধর্মকর্মের প্রতি চরম অবহেলা—-এ সবকিছুর পেছনেই পশ্চিমের অতিরিক্ত প্রশ্রয়নীতি। এবং তা রোধ করার একমাত্র উপায়, তাঁদের মতানুসারে, শরিয়ার মত একটা কড়া অনুশাসন চাপিয়ে দেওয়া। হতে পারে দেশটার নাম ব্রিটেন, এবং তাদেরও কিছু বলার থাকতে পারে এ ব্যাপারে। কিন্তু পাড়াগুলো তো কার্যত মুসলমান পাড়া হয়ে গেছে—-সুতরাং সেখানে শরিয়া ঢুকতে বাধা থাকবে কেন। শত হলেও এটা তো স্বাধীন দেশ, তাই না? ব্যক্তিস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এগুলো তো এদেশের সংবিধানেই লেখা আছে। অতএব তারা এতে বাধা দেবে কেন? বিড়ম্বনাটি লক্ষ করুন পাঠক। একটা দেশের উদার নীতিমালার সুযোগ নিয়ে আমাদের মুসলমান ব্রাদারগণ শরিয়ার মত একটি চরম অনুদার্যতায় ভরা নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। না, সব মুসলমানই তা চাইছেন সেটা আমি বলব না। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারের অনেকেই চাক্ষুশ দেখেছেন শরিয়ার শাসন মানুষের জীবনকে, বিশেষ করে মেয়েদের জীবনকে, কিভাবে ধংস করে দিতে পারে, কতটা দুঃসহ যন্ত্রনাময় জীবনের চরম সীমাতে নিয়ে যেতে পারে তাদের। শরিয়ার দেশে সাধারণ মানুষ ধর্মের পাণ্ডাদের আজ্ঞাবহ দাস ছাড়া কিছু নয়। এ অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে সৌদি আরবের উদাহরণ থেকে, ইরাণের মোল্লাতন্ত্রের উদাহরণ থেকে, এমনকি বাংলাদেশের মত অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী ইসলামের দেশেও হুজুরদের অত্যাচারে নির্ভয়ে কথা বলা বা শ্বাসপ্রশ্বাস নেবার সুযোগ নেই এযুগে। (জনাব লতিফ সিদ্দিকী কতগুলো ঐতিহাসিকভাবে সত্য কথা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে গিয়ে কি নিদারুণ বিপদে পড়েছেন দেখুন) সেই একই ভুক্তভোগী মুসলমান সম্প্রদায় অবশেষে ব্রিটেনের মত একটি উন্নত দেশে আশ্রয় গ্রহণ করার পর যদি আবারো শরিয়ার সম্মুখিন হয় তাহলে তার চেয়ে চরম বিড়ম্বনা আর কি হতে পারে। কিন্তু হয়, অবিশ্বাস্য হলেও তা হয়। ধর্ম এমনই এক যাদুকরি শব্দ যে তার উচ্চারণমাত্র মানুষ তার স্বাভাবিক বুদ্ধিশুদ্ধি হারিয়ে পোষা প্রাণীর মত লেজ নাড়তে শুরু করে তার প্রভু, অর্থাৎ সেই জোব্বাজাব্বা পরা হুজুরদের সামনে। স্বয়ং নেপোলিয়ান বোনাপার্ট একবার বলেছিলেনঃ সাধারণ মানুষকে পোষ মানাতে ধর্মের মত শক্তিশালী জিনিস আর নেই। তার প্রমাণ আমরা ইতিহাসের আদিকাল থেকেই দেখে এসেছি।
উত্তর আমেরিকাতে কি শরিয়া আসবে কোনদিন? আপনার কি মনে হয়? অতিরিক্ত ধর্মপরায়ন না হলে আপনি বলবেন, না, কক্ষনোই না। বলবেনঃ আমি গণতন্ত্র ভালোবাসি, ধর্মনিরপেক্ষতা ভালোবাসি, বাকস্বাধীনতা ভালোবাসি, তার চেয়েও ভালোবাসি আমার চিন্তার স্বাধীনতা। আমিও ঠিক একই কথা বলব। কিন্তু শরিয়া জিনিসটা আপনার-আমার মতামতের মোটেও তোয়াক্কা করে না। ওরা বলবেঃ শরিয়া হল আল্লার নিয়ামত—-এটা গণভোটের ওপর নির্ভর করে না। আসলেই তাই। তাকিয়ে দেখুন চারদিকে। আপনার বন্ধুবান্ধব, আমার বন্ধুবান্ধব। তারা যেখানে যায় সেখানেই জায়নামাজ নিয়ে যায় সাথে করে, জুম্মার নামাজে একশ’ হাজারবার সেজদা দেয়, রোজারমজানের দিনে তাদের বাড়িতে কেউ অন্নস্পর্শ করে না, দানখয়রাত তারা যথেষ্ঠই করে, তবে স্থানীয় কোনও খৃস্টান-ইহুদী-পৌত্তলিক ফাণ্ডে নয়, জাকাত আর ফেৎরাতে, তারা অর্থ উপার্জন করে বিধর্মীদের কাছ থেকে বটে, কিন্তু মজুত করে ইসলামিক ব্যাঙ্কে যাতে সুদ খেতে বা দিতে না হয়, সর্বোপরি তাদের ছেলেমেয়েরা আপনার-আমার বাচ্চাদের মত সাধারণ স্কুলে যায় না, যায় ইসলামিক স্কুলে যেখানে তারা ইসলামিক তরিকা শেখে, নামাজরোজা শেখে, ইসলামিক আহারবিহার আচার আচরণ আর পোশাকপরিচ্ছদের কথা শেখে। মুসলিম বাচ্চাদের খেলার মাঠেও সেই একই দৃশ্য। ছেলেরা আর মেয়েরা আলাদা আলাদা থাকবে। মেয়েরা মাথায় হিজাব পরবে, লম্বা হাতার জামা পরবে, লম্বা পাজামাও। অর্থাৎ যেসব দেশে এসে পৃথিবীর সব মানুষই একত্র হবার সুযোগ পায় ঠিক সেসব দেশেই আমাদের মুসলমান পরিবারের ছেলেমেয়েরা অন্যান্য লোকেদের কাছ থেকে একটা পর্বতপ্রমাণ ব্যবধান সৃষ্টি করে রাখে। রাখতে না চাইলেও তাদের বাবামায়েরা বাধ্য করেন তাদের। এবার বলুন তো আমাকেঃ এই ছেলেমেয়েগুলি যখন আরেকটু বড় হয়ে উঠবে তখন তারা কি চাইবে? পাশ্চাত্য গণতন্ত্র, না, শরিয়ার একনায়কত্ব?
কয়েক বছর আগে ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশে ইসলামবাদীরা জোর আন্দোলন চালিয়েছিলেন শরিয়া প্রবর্তন করার জন্যে। আমার যতদূর মনে পড়ে, এর জন্যে তারা আমার বা আমার জানাশুনা অন্য কোনও মুসলমানের মতামত নেবার চেষ্টা করেননি। তাদের চিন্তাটা নিশ্চয়ই এরকম যে শরিয়া হল আল্লার আইন, তার জন্যে আবার ক্ষুদ্র মানুষের মত চাইতে হবে কেন? সৌভাগ্যবশত অন্টারিওর বেশির ভাগ মানুষই শরিয়ার ব্যাপারটিকে খুব উৎসাহের সাথে সমর্থন করে নি, ফলে সেযাত্রায় আমরা অল্পতে রক্ষা পেয়ে গেছি। কিন্তু তারা চেষ্টা চালিয়ে যাবে, সেবিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ধারাই এই। তারা নাছোড়বান্দা। কাজ হাঁশিল না হওয়া পর্যন্ত তারা ছেড়ে দেবে না। সুতরাং আমি বলব, বিলেতের ঢেউ এল বলে ক্যানাডাতে। যুক্তরাষ্ট্রেও আসবে। অতএব যাত্রীরা হুঁশিয়ার। গর্দান কাটার ছড়াছড়ি এখানেও শুরু হয়ে যাবে একদিন। গত একমাসের মাঝে যে দু’দুটি ঘটনা ঘটে গেল, তা থেকেই তো কিছুটা অনুমান করা যায় কি ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি।

১৫ই নভেম্বর, ‘১৪
মুক্তিসন ৪৪