বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন :

‘আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। তবে তার চেয়েও হজ ও তাবলিগ জামাতের বেশি বিরোধী। এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার (জনশক্তি) নষ্ট হয। হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গিয়েছে। এদের কোনো কাম নাই। এদের কোনো প্রডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে। আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ খুব বুদ্ধিমান ছিল। সে চিন্তা করল এ জাজিরাতুল আরবের লোকেরা কিভাবে চলবে। তারা তো ছিল ডাকাত। তখন একটা ব্যবস্থা করলো যে আমার অনুসারীরা প্রতিবছর একবার একসাথে মিলিত হবে। এর মধ্য দিয়ে একটা আয়-ইনকামের ব্যবস্থা হবে।গড়ে যদি বাংলাদেশ থেকে এক লাখ লোক হজে যায়; প্রত্যেকের পাঁচ লাখ টাকা করে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়। তাবলিগ জামাত প্রতিবছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে। নিজেদের তো কোনো কাজ নেই। সারা দেশের গাড়িঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়।’

এসব বলার কারণে তাঁর মন্ত্রীত্ব চলে গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের মিছিল বেরিয়েছে রাস্তায়। তাঁর ফাঁসির দাবি করা হচ্ছে। তাঁর মাথার দাম পাঁচ লক্ষ টাকা ঘোষণা করা হয়েছে। নানা মহল থেকে তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও পিছিয়ে নেই। লতিফ সিদ্দিকীকে নাকি আর ঢুকতে দেওয়া হবে না দেশে। মিডিয়াও নানা কায়দায় তাঁকে অপদস্থ করছে। কিন্তু কী অপরাধ তিনি করেছেন? তিনি প্যারিচাঁদ চাটুজ্জের পুত্রকে কৃষ্ঞ চন্দ্র দাসের পুত্র বলেননি। তিনি আবদুল্লাহর পুত্রকে আবদুল্লাহর পুত্রই বলেছেন। এটা ঠিক যে মুহম্মদের নাম বলার পর লতিফ সিদ্দিকী ‘তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক’ বাক্যটি উচ্চারণ করেননি। শান্তি বর্ষণের আশীর্বাদ না করলেও তাঁর ওপর শান্তি বর্ষণ না হওয়ার কোনও কারণ নেই। আল্লাহতায়ালা তাঁর ওপর নিশ্চয়ই শান্তি বর্ষণ করবেন। তিনি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার পরম বন্ধু এবং ‘প্রেরিত পুরুষ’। তাছাড়া লতিফ সিদ্দিকী হজ্ব নিয়ে যা বলেছেন, তা ইসলামের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি, খুব মনগড়া কিছু বলেননি। মুশকিল হল, অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান কোরান এবং হাদিস সম্পর্কে খুব কম জানেন, এবং ইসলামের ইতিহাসও তাঁদের পড়া নেই। পাকিস্তানে শেখ ইউনুস নামের একজন ডাক্তার ছিলেন, তিনি একবার একটা বক্তৃতায় বলেছিলেন :

‘আমাদের নবী মুহম্মদ তাঁর চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত অমুসলিম ছিলেন, এবং শুধু তিনি নন, তাঁর বাবা-মাও মুসলিম ছিলেন না। কারণ তাঁর বাবা মা ইসলাম ধর্মের সূচনা হওয়ার আগেই মারা যান। নবী মুসলমান হন যখন তিনি ইসলাম ধর্মটির প্রবর্তন করেন তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে’।

এই সত্য তথ্যের জন্য শেখ ইউনুসের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। শেখ ইউনুসের দুর্দশাই প্রমাণ করে, সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে।

এ কেমন ব্যাপার, আমাদের ভদ্র হতে হবে, সুবোধ হতে হবে, পরিমিতিবোধ থাকতে হবে, যা কিছুই করি যুক্তি থাকতে হবে, এবং তাদের, ধর্মে যাদের বিশ্বাস আছে, বোধ শোধ কিছু না থাকলেও চলবে, তাদের কাজে যুক্তির য ও না থাকলে চলবে, তাদের উগ্র হলে ক্ষতি নেই, যে কারও মাথার দাম ঘোষণা করার অধিকার তাদের আছে, বর্বর এবং খুনী হওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু আমাদের সেই অধিকার নেই, আমাদের বলতে আমি ধর্মমুক্তদের কথা বলছি। ঈশ্বরে বিশ্বাস করা লোকেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা লোকদের চেয়ে সব সমাজেই বেশি সুযোগ সুবিধে পায়, যদিও তারা আজ অবধি তাদের বিশ্বাস যে ঈশ্বরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই ঈশ্বরের অস্তিত্বেরই কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

বাংলাদেশের নব্বই বা তারও বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম। অধিকাংশই বাবা মা যেহেতু মুসলিম সেকারণেই মুসলিম, কিছু মুসলিম ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে মুসলিম, স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন অথবা বাধ্য হয়ে গ্রহণ করেছেন। এই মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই দাবি করছেন লতিফ সিদ্দিকী ‘মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাত দিয়েছেন। মুসলিমদের বলতে সব মুসলিম অথবা মুসলিমের সমষ্টি, অথবা মুসলিম গোষ্ঠি বোঝানো হচ্ছে। অনুভূতি কিন্তু ব্যক্তির থাকে, সমষ্টির কোনও অনুভূতি থাকে না, গোষ্ঠির অনুভূতি বলেও কিছু নেই। বলা যেতে পারে, লতিফ সিদ্দিকীর কথায় কিছু ব্যক্তির অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। একজন ব্যক্তির যে কেবল ধর্মীয় অনুভূতিই থাকে তা নয়, নানা রকম অনুভূতিই থাকে। অন্য কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে তারা এত মারমুখী হন না, যত হন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে। প্রশ্ন করা যেতেই পারে, ধর্মীয় অনুভূতিই কি তবে অন্যান্য সব অনুভূতির মধ্যে সবচেয়ে ভঙ্গুর এবং বিপজ্জনক অনুভূতি, যেটি সহজেই ভাঙে, এবং যেটি ভাঙলে যে কেউ সভ্যতার স্তম্ভগুলোকে –গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতাকে ভেঙে ফেলার অধিকার রাখে? মানুষের সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকলেও ইসলামকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা আছে প্রতিটি দেশেই। আজ ইসলাম নিয়ে কোনও প্রশ্ন করলেই মৃত্যুদণ্ড, ফাঁসি, জবাই হয়ে যাওয়া , যাবজ্জীবন, দেশান্তর, হেনস্থা ইত্যাদি অবধারিত।
মুসলিম মৌলবাদীরা পাথর ছুড়ে নারীকে মারছে। এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডু কেটে ফেলে দিচ্ছে। ট্রাউজার পরলে মেয়েদের চাবুক মারছে, গাড়ি চালালে বেত্রাঘাত। সারা পৃথিবীর মানুষ দেখছে এইসব বর্বরতা। পৃথিবী জুড়েই এককালে বর্বরতা ছিল, কিন্তু বর্বরতাকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় সব দেশেই। কেউ স্বীকার করুক না করুক, আজ এ ঘটনা সত্য যে গত দু’ দশক ধরে মুসলিম মৌলবাদীর সংখ্যা এবং একই সঙ্গে মুসলিম সন্ত্রাসীর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আল কায়দা, বোকো হারাম, তালিবান, লস্করই তৈবা, মুজাহিদিন, হিজবুল্লাহ, আইসিস ইত্যাদি নানা ছোট বড় দল গড়ে উঠেছে। পুরো পৃথিবীটাকেই তারা ‘দারুল ইসলাম’ বানানোর স্বপ্ন দেখছে, যে দারুল ইসলামে কেবল মুসলিমরা বাস করবে, আর কেউ নয়। পিউ রিসার্চের রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের বেশির ভাগ মুসলিমই শরিয়া আইন চাইছে। আজ সারা বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে একটা বিবমিষা তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা। মুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা, মুসলিমদের চাকরি দেওয়া, মুসলিমদের সঙ্গে ব্যবসায়িক এবং সামাজিক সম্পর্ক রাখার ব্যপারে অনেক দেশের অমুসলিমরা অনীহা প্রকাশ করছে। মুসলিমদের প্রতি ভয়ংকর এক অবিশ্বাস জন্মেছে। পাশ্চাত্যের মানবাধিকার আইনটি এতই শক্তপোক্ত যে মুসলিমরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নিজেদের পছন্দমতো জীবন যাপন করতে পারছে, তাদের মেরে ধরে তাড়িয়ে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা কোনও দেশের নেই। পাশ্চাত্যের বর্ণবাদ এবং জাতিবাদকে পাশ্চাত্যই ঠেকায়।

গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে যায় যদি মানুষের বাক স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার না থাকে। সমাজ বদলাতে হলে নানান লোকের নানান অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কারও কোনও অনুভূতিতে আঘাত দিতে না চাইলে সমাজটাকে বদলানো যাবে না। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে গেলে বা নারীবিরোধী আইন দূর করতে গেলেও মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। ধর্মানুভূতিতে আঘাত না দিয়ে খুব বেশি ভালো কাজ আজ অবধি সমাজে হয়নি। ইওরোপ থেকে গির্জার দুঃশাসন বন্ধ করার সময়ও প্রচুর লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছিল। গ্যালিলিওর কথায়, ডারউইনের ভাষ্যে লোকের ধর্মানূভূতিতে আঘাত লেগেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কুসংস্কাচ্ছন্ন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কিন্তু তাদের আঘাত লাগবে বলে যদি আমরা মত প্রকাশ করা বন্ধ করে দিই, যদি আমরা বিজ্ঞানের আবিস্কার এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিই, সভ্যতার চাকাকে থামিয়ে রাখি, তবে সমাজটাকে স্থবির জলাশয় হিসেবেই রেখে দিতে হবে, একে আর স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতস্বিনী করে গড়ে তোলা হবে না আমাদের। অনেকে বলছে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, সুতরাং লতিফ সিদ্দিকীর বুঝে শুনে কথা বলা উচিত ছিল। মানুষের মন জুগিয়ে কথা বললে মত প্রকাশের অধিকারের বা বাক স্বাধীনতার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। বাক স্বাধীনতা একমাত্র তাদের জন্যই , যাদের মতের সঙ্গে অধিকাংশ লোকের মত মেলে না। যে কথাটা তুমি শুনতে চাও না, সে কথাটি বলার অধিকারের নামই বাক স্বাধীনতা। বাক স্বাধীনতা তাদের দরকার নেই যাদের মত শুনে কেউ মনে আঘাত পায় না। বাক স্বাধীনতার পক্ষে না থেকে যখন সরকার বাক স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষ নেয়, তখন নিজের দেশটার ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে।

ধর্মানুভূতি নিয়ে আজকাল ধর্মবাজ মৌলবাদীরা ভীষণ ভালো ব্যবসা করছে। এই ব্যবসায় বাংলাদেশে বরাবরই তারা লাভবান হচ্ছে। যতবারই তারা রাস্তায় নেমে চিৎকার করে ভিন্ন মতাবলম্বী কারওর ফাঁসি দাবি করে, জনগণের সম্পত্তি জ্বালানো পোড়ানো শুরু করে, ততবারই সরকার তাদের পক্ষ নিয়ে ভিন্ন মতাবলম্বীকে নির্যাতন শুরু করে। এতে ধর্মবাজদের শক্তি শতগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং সমাজকে শতবছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। আমার বেলায় ঠিক এই কাণ্ডই ঘটিয়েছিল সরকার। মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপোসনীতি অবিকল আগের মতোই আছে। খালেদা সরকার ফতোয়াবাজ সন্ত্রাসীদের পক্ষ না নিয়ে সেদিন যদি ওদের শাস্তির ব্যবস্থা করতো, তাহলে ওদের শক্তি এত এতদিনে এত ভয়ংকর হতো না। আমিও দেশের মেয়ে দেশে থাকতে পারতাম। মত প্রকাশের অধিকার বলে কিছু একটা থাকতো দেশে। বাংলাদেশের মৌলবাদীরা শুধু নয়, সরকারও ক্ষুদ্র স্বার্থে ভিন্নমতাবলম্বীর গণতান্ত্রিক অধিকার লংঘন করে। আজ যদি প্রধানমন্ত্রী হাসিনা লতিফ সিদ্দিকীকে তাঁর মন্ত্রী পদ থেকে বহিস্কার না করতেন, তবে তিনি দিব্যি দেশে ফিরতে পারতেন। সব তাণ্ডব ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যেতো। চতুর ধর্মবাজরা বুঝতে পারতো এই সরকারের আমলে ধর্মানুভূতির রাজনীতিতে বড় একটা সুবিধে হবে না। লতিফ সিদ্দিকীকে বহিস্কার করা মানে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের আগুনে মণকে মণ ঘি ঢেলে দেওয়া। তাদের অপশক্তি আবারও বেড়ে যাবে শতগুণ। দেশ পিছিয়ে যাবে আবারও শতগুণ।

লতিফ সিদ্দিকী সম্পর্কে নানারকম তথ্য প্রকাশ হচ্ছে আজকাল। মানুষটা নাকি বড্ড মন্দ ছিলেন। সরকার যখন কাউকে বিপদে ফেলে, তার বন্ধু সংখ্যা কমে গিয়ে শূন্যের কোঠায় চলে আসে। ঠিক আমারও এমন দশা হয়েছিল। আমাকে দেশ থেকে বের করার পর বন্ধু যারা ছিল, হাওয়া হয়ে গেল। আমার বিরুদ্ধে নির্বিচারে অপপ্রচারও শুরু হলো। লতিফ সিদ্দিকী সম্ভবত প্রচুর মন্দ কাজ করেছিলেন। আমি বলছি না তিনি খুব ভালো লোক। আমি শুধু তাঁর নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষ নিয়ে কথা বলছি। আমি লতিফ সিদ্দিকীর মত প্রকাশের অধিকারের যতটা পক্ষে, তাঁর বিরোধীদের মত প্রকাশের অধিকারের ততটাই পক্ষে। লতিফ সিদ্দিকীর মত পছন্দ না হলে তাঁর মতের বিরুদ্ধে লিখুন, বলুন, যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করুন তাঁর মত, কিন্তু তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করা, তাঁকে শারীরিক আক্রমণ করা, তাঁকে ফাঁসি দেবো, মৃত্যুদণ্ড দেবো, তাঁকে মেরে ফেলবো, কেটে ফেলবো, মুণ্ডু ফেলে দেবো – এইসব বর্বর হুমকির বিপক্ষে আমি।