আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে একাত্তর জুড়েই পাক বাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা প্রচারিত হয়েছে, এর মধ্যে নির্বাচিত কয়েকটি উল্লেখ করছি।
“রাজাকাররা তাদের কর্মকাণ্ড এখন হত্যা ও চাঁদাবাজিতেই আটকে রাখেনি, এখন তারা বেশ্যালয়ও খুলেছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে তারা একটি শিবির খুলেছে যেখানে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েদের আটকে রাখা হয়েছে, রাতে পাকবাহিনীর অফিসারদের সরবরাহ করা হয় তাদের। এছাড়াও প্রতিদিনই অনেক মেয়ে অপহরণ করছে তারা নিজেদের জন্যও, এদের অনেকেই আর ফিরে আসেনি…”
-সানডে টাইমসঃ ২০ জুন ১৯৭১
“ ‘ওরা আমার বাবা মা কে মেরে ফেলে, দুজনকেই বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরেছে। এরপর মেঝেতে আমাকে চিৎ করে শুইয়ে তিনজন মিলে ধর্ষণ করেছে।’ এমনটা বলেছে পেত্রাপোলের উদ্বাস্তু শিবিরের এক ষোড়শী। একই প্রতিবেদনের ভাষ্য, ‘ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণভয়ে পালাতে থাকা পরিবারগুলোর মেয়েদেরও হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এরপর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে পাকবাহিনীর কাছে। অবশ্য পরিবারগুলো মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ছুটিয়ে নিয়েছে অনেককে। যারা পারেনি, তাদের ঠাই হয়েছে রাজাকারদের খোলা বেশ্যালয়ে।’
-টাইমসঃ ২১ জুন ১৯৭১
‘আগুনে পোড়া গ্রামকে পেছনে ফেলে দুই কিশোরী মেয়ে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পালাচ্ছিলেন চন্দ্র মন্ডল। কাদামাটির ভেতর দিয়ে। একটু পর সৈন্যদের হাতে ধরা পড়লেন। অসহায় চোখে তাকে দেখতে হলো তার মেয়েদের ধর্ষনের দৃশ্য। বারবার, বারবার, বারবার।’
-২ আগস্ট ১৯৭১ নিউজউইক
‘১১ এপ্রিল সৈন্যরা আমাদের গ্রামে এল। একদল এসে আমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেল কী যেন দেখাতে। ফিরে এসে দেখি আমার বোন নেই। আমার প্রতিবেশীর মেয়ে এবং এক হিন্দুর মেয়েও একইরকম নিখোজ। মে মাসের মাঝামাঝি আমার বোন আর প্রতিবেশিকে ওরা ছেড়ে দিল। কিন্তু হিন্দু মেয়েটার খোঁজ পাওয়া গেল না। ফিরে আসা দুজনই গর্ভবতী, বাচ্চা হবে। ওদের দিয়ে কাপড় ধোঁয়ানো হতো এরপর প্রতিদিন দু-তিনবার করে সৈন্যদের সঙ্গে শুতে হতো।’
-নিউইয়র্ক টাইমসঃ ১১ অক্টোবর ’৭১
‘সম্প্রতি পাকবাহিনী ডেমোরা গ্রাম চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব নারীকে ধর্ষন করে এবং ১২ বছরের ওপর সব পুরুষকেই গুলি করে মারে।’
-নিউজউইকঃ ১৫ নভেম্বর ’৭১
উপরের সংবাদ গুলোর কোনটিই কোন দেশী পত্রিকার নয়, সবগুলোই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পত্রিকার। যাদের ধারণা পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালী ধর্ষণ নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তাদের অবগতির জন্যই দেয়া। তবে আরেকটা কথাও বলে রাখি, এটা কেবল বরফের ভেসে থাকা অংশ। এরকম হাজারো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আমাদের দেশে, প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বময়, পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতনের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে।
প্রথম পর্বে মোটামুটি পরিস্কার ভাবে প্রমাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীদের ধর্ষণ ছিলো একটা উদ্দেশ্যমূলক সংঘবদ্ধ ক্রিয়া, কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যাটা আসলে কত ছিলো সেই বিষয়টিতে। বাংলাদেশের সরকারী হিসেবে সংখ্যাটা ধরা হচ্ছে দুই লাখ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দাবী করা হয় মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের হয়েছে প্রায় দুই লাখ। এখন একটু খতিয়ে দেখা দরকার এই দুই লাখ সংখ্যাটা এলো কোথা থেকে। এটাই কি একমাত্র সংখ্যা, সংখ্যাটা কি এর থেকে বেশী বা কম হওয়া সম্ভব। হলে কেন।
সরকারী ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি ছিলো থানা ভিত্তির নিখোঁজ নারীর সংখ্যা অনুমান করে। ডঃ ডেভিস লিখেছেন;
“…অংকটা এরকমঃ হানাদার দখলদারিত্বের সময়কালে প্রতিটি থানায় প্রতিদিন গড়ে দু’জন করে মেয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। থানার সংখ্যা ৪৮০টি এবং দখলদারিত্ব স্থায়ী হয়েছে ২৭০ দিন। ৪৮০ কে ২৭০ ও ২ দিয়ে গুণ করে পাওয়া গেছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ জন। অন্যান্য কারণে মেয়েরা নিখোঁজ হয়েছেন ধরে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বোর্ড সংখ্যাটাকে রাউন্ড ফিগারে এনেছেন দুই লাখে! এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের এইটাই অফিশিয়াল ধর্ষিতার সংখ্যা।”
[দ্য চেঞ্জিং ফেস অব জেনোসাইড : ড. জিওফ্রে ডেভিস]
তবে এর পরপরই ডক্টর ডেভিস বলেছেন এই হিসাবটি তার মতে ত্রুটিপূর্ণ। তার কারণ হিসেবে তিনি কিছু যুক্তিও দেখিয়েছেন।
“১. সরকার আমলে নিয়েছেন শুধু নিখোঁজ রিপোর্ট পাওয়া মেয়েদের। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো চেপে গিয়েছেন তাদের মেয়েদের অবস্থান ও অবস্থা। অনেকটা লোক-লজ্জায়, সম্মানহানী ও প্রাণহানির ভয়ে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যাদের কাছে অভিযোগ করবেন তাদের কাছেই মেয়ে, অর্থাৎ রক্ষকই ভক্ষক।
সাধারণভাবে দেখতে গেলে এই বিশাল অংশটা যুদ্ধকালীন সময়টায় আটকবস্থাতেই ছিল যদ্দিন না পাকসেনাদের কাছে তারা বোঝা হয়ে পড়েছে। বোঝা বলতে শারীরিক ব্যবহারের অযোগ্য গর্ভবতী কিংবা যৌনরোগগ্রস্থ, কিংবা দুটোই। এরপর মেয়ে যদি মুসলমান হয় তাহলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে আর যদি হিন্দু হয় তাহলে মেরে ফেলা হয়েছে। অনেক মুসলমান মেয়েকেও হত্যা করা হয়েছে, অনেকে আত্মহত্যা করেছেন। এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার ও আত্মহত্যাকারীদের সঠিক সংখ্যাটা আন্দাজে বলাটা কঠিন।
২. সংখ্যাটায় পাকসেনাদের অস্থায়ী অবস্থানকে গোনায় নেওয়া হয়নি। মানে তারা একটা গ্রাম বা অঞ্চলে হামলা করল এবং গণহারে ধর্ষণ চালাল। পুরোপুরি ধংস হয়নি কিন্তু আক্রমণের শিকার এরকম গ্রামের সংখ্যা বাংলাদেশের তিনভাগের এক ভাগ। সুবাদেই ধর্ষণের সংখ্যাও ছিল অগণিত, যদিও সবক্ষেত্রেই গর্ভধারণ অনিবার্য ছিল না।
৩. রাজাকার ও পাকিস্তানের দালালরা উদ্বাস্তুদের ওপর হামলা চালিয়ে প্রচুর মেয়ে অপহরণ করেছিল (এ ব্যাপারে আগেও বলা হয়েছে)। অনুমান করা হয় ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল এক কোটি বাঙ্গালী, আর তাদের মধ্যে ১৫ লাখ ছিলেন নারী।
বাংলাদেশে আদমশুমারীর হাল বরাবরই করুণ, অনুমান নির্ভর। ১৯৭১ সালে বলা হয় সংখ্যাটা ছিল সাড়ে সাত কোটি এর থেকে এক কোটি লোক বাদ দিন, যারা পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে কিংবা শহর বা নগর বা ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয়ের খোজে গেছে। বাকি থাকে সাড়ে ৬ কোটি। এদের মধ্যে ধরি দশ লাখ তরুণী-যুবতী, যারা সন্তান জন্মদানে সক্ষম। এদের এক তৃতীয়াংশ যদি ধর্ষিতা হন তাতেও সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৩ লাখ। ৩% বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই দেশে নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায় এদের অর্ধেক গর্ভধারণ করেছেন। ধর্ষনের কারণের এদের একজনও যদি গর্ভধারণ না করে (যেটা অবাস্তব), তারপরও দেড় লাখ নারী রয়ে যান যারা গর্ভবতী।
এদের সঙ্গে (১) নং বর্ণনার মেয়েদের ২ লাখ যোগ করুন (এখানে নিশ্চিত থাকতে পারেন তাদের সবাই গর্ভবতী এবং তাদের ঘরছাড়া হওয়ার পেছনে এটাই ছিল প্রধান কারণ)। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, মেয়েদের সংখ্যা প্রতিদিন বদলাতো এবং গর্ভবতীরাই ছিল আশ্রয়হীনা। ধরে নিতে হবে দু লাখ একটা রক্ষণশীল সংখ্যা। গর্ভবতীদের ১০ ভাগ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এভাবে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ অবাঞ্ছিত গর্ভবতীদের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন লাখ। ঘটনার পরবর্তী প্রবাহের আলোকে ব্যাপারটা চমকপ্রদ।
যেসব জেলা আমি ঘুরেছি, এদের বেশিরভাগেই দেখা গেছে অবাঞ্ছিত গর্ভবতীদের সংখ্যা অনুমানের চেয়ে কম। হিসেবের মধ্যে নিতে পারেন ইতিমধ্যে প্রসব করা এবং আত্মহত্যাকারীদের। সংখ্যাটা ছিল গ্রাম পিছু ১০ জন করে! যেসব জায়গায় সামরিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল (গোটা দেশের অর্ধেক জনপদ), সেখানে যখনই কোনো গ্রামবাসীর সঙ্গে কারো মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি অবিশ্বাস্য এক ছবি পেয়েছি।
ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ থানা পিছু ছিল দেড়হাজার করে এবং জানুয়ারির শেষ নাগাদই গ্রামের দাই, হাতুরে ও হোমিওপ্যাথরা মিলে এদের বেশিরভাগেরই ব্যবস্থা করে ফেলে। রয়ে যায় অল্প কজনা। থানা পিছু দেড় হাজার করে ৪৮০টি থানায় (যেহেতু প্রশাসনিক ভবন, এখানে সামরিক অবস্থান দীর্ঘমেয়াদী হওয়াটাই স্বাভাবিক) ৩ লাখ ৬০ হাজার পোয়াতির সন্ধান পাওয়া যায়। অন্য যে কোনো পদ্ধতিতে হিসেব করলেও সংখ্যাটা এর ধারে কাছেই থাকবে।”
শেষ পর্যন্ত ডা. জিওফ্রে ডেভিস দেশজুড়ে তার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতায় এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় চালানো নমুনা জরিপের মাধ্যমে পরিসংখ্যান তৈরি করে জানান,
৪ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার নারী মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর অস্ট্রেলিও চিকিৎসক ডক্টর জিওফ্রে ডেভিস বাংলাদেশে আসেন। দেশ স্বাধীন হবার একদম পরপরই যাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছিলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুরোধে ১৯৭২ সালে। ধর্ষিত বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা এবং গর্ভপাতের জন্য। ‘দ্য চেঞ্জিং ফেস অব জেনোসাইড’ ড. জিওফ্রে ডেভিসের ডাইরি। এই ডাইরিতে উঠে এসেছে অজানা অনেক তথ্য। আজকের লেখার শুরুতে দেয়া পত্রিকার বিবরন গুলোও তাঁর ডাইরি থেকেই পাওয়া। ডাইরি প্রয়োজনীয় অংশটুকুর সরাসরি অনুদিত অবস্থায় অনলাইনে পেয়ে বিস্মিত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ওয়েব পোর্টাল ”জন্মযুদ্ধ ৭১” এবং অমি রহমান পিয়ালকে জানায় হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
পাকিস্তানের নথিপত্রে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ধর্ষণের ব্যাপারটি অস্বীকার এবং পাকিস্তানীরা কিভাবে ধর্ষণ প্রক্রিয়াকে হালাল করেছিলো এসব প্রসঙ্গে ডঃ ডেভিসের একটা সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরছি। যেটি পরবর্তীতে ডঃ মুনতাসির মামুনের ‘বীরাঙ্গনা১৯৭২’ বইতে গুরুত্বের সাথে উঠে আসে।
‘প্রশ্ন : তারা নারী ধর্ষণের ব্যাপারটা কীভাবে জায়েজ করার চেষ্টা করেছে?
জেফ্রি : ওরে বাপস! তাদের ওপর টিক্কা খানের এক প্রকার আদেশ বা নির্দেশই ছিল যে, একজন সাচ্চা মুসলমান তার বাবা ছাড়া আর সবার সঙ্গেই লড়াই করবে। কাজেই তাদের যা করতে হবে তাহলো যতটা পারা যায় বেশিসংখ্যক বাঙালী নারীকে গর্ভবতী করা। এটাই ছিল তাদের কাজের পেছনের তত্ত্ব।’
‘প্রশ্ন : পাকিস্তানের অসংখ্য নথিপত্রে এখনও বলা হয়, ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা অত্যন্ত বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। আপনি কি তাদের এ দাবি সত্য মনে করেন?
জেফ্রি : না, না… তারা ধর্ষণ করেছে। সম্ভবত তারা প্রকৃতই যা করেছে, তার তুলনায় অনেকগুণ কম সংখ্যা দাবি করা হয়। তারা যে পদ্ধতিতে শহর দখল করত তার বিবরণ খুব কৌতূহলোদ্দীপক। তারা তাদের পদাতিক বাহিনীকে পেছনে রেখে গোলন্দাজ বাহিনীকে সামনে নিয়ে আসত। তারপর হাসপাতাল, স্কুল-কলেজে গোলা ছুড়ে গুড়িয়ে দিত। এরফলে শহরে নেমে আসত চরম বিশৃঙ্খলা আর তারপর পদাতিক বাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে মেয়েদের বেছে বেছে আলাদা করত। শিশু ছাড়া যৌনভাবে ম্যাচিওরড সকল মেয়েকে তারা একত্রে জড়ো করত। আর শহরের বাকি লোকজনকে বন্দী করে ফেলত পদাতিক বাহিনীর অন্যরা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলা হতো। আর তারপর মেয়েদের পাহারা দিয়ে কম্পাউন্ডে নিয়ে এসে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া হতো। অত্যন্ত জঘন্য একটা ব্যাপার ছিল এটা। বিশ্বের কোথাও কখনও এমন ঘটনার নজির পাওয়া যায় না। তবুও, এমনটাই ঘটেছিল।’
হ্যাঁ, যুক্তির খাতিরে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের ৬৪ হাজার গ্রামে তো পাকিস্তানী সৈন্যরা যায়নি। কথাটা ঠিক, ৬৪ হাজার গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা যায়নি; কিন্তু যেসব গ্রামে গেছে সেখানেই তারা মেয়েদের সর্বনাশ করেছে। আমরা এখানে যে ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছি তাতে একটি প্যাটার্ন ফুটে উঠেছে। তাহলো : গ্রামে গ্রামে তারা সুনির্দিষ্টভাবে মেয়েদের জন্য হানা দিচ্ছে, শহরাঞ্চল থেকে মেয়েদের উঠিয়ে নিচ্ছে, সে এক ভয়াবহ অবস্থা। অনেক জায়গায় রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্যরা মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে। ধর্ষিতা নারীদের একটি অংশ আত্মহত্যা করেছে, মেরে ফেলা হয়েছে। একটি অংশের পরিবার-পরিজন ধর্ষণের কথা কখনও স্বীকার করেনি সামাজিক কারণে। ফলে সঠিক সংখ্যা কখনও জানা যাবে না। সরকারী কর্মকচারীরা তখন নানাবিধ কারণে ধর্ষিতার সংখ্যা কম করে দেখাতে চেয়েছে। এর পেছনে যে মানসিকতা কাজ করেছে তাহলো এক ধরনের অপরাধবোধ। কারণ, এই মেয়েদের রক্ষার দায়িত্ব আমরা যে কোন কারণেই হোক পালন করতে পারিনি। অনেকের কাছে এটি লজ্জার বিষয় মনে হয়েছে। এই মানসিকতার সমাজতাত্ত্বিক কারণ কি তা আমি জানি না। যে কারণে, এখনও নারী ধর্ষণের বিষয়টি পারতপক্ষে কেউ আলোচনায় আনতে চান না।
ডা. ডেভিস আরও উল্লেখ করেছিলেন, ‘হানাদার বাহিনী গ্রামে গ্রামে হানা দেয়ার সময় যে সব তরুণীকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাব রক্ষণে সরকারী রেকর্ড ব্যর্থ হয়েছে। পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব রক্ষিতা তরুণীর অন্তঃসত্ত্বার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে, নয়ত হত্যা করা হয়েছে।’
এবার একটু অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করি বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্লগিং পোর্টাল আমার ব্লগের সাড়া জাগানো পোস্ট “আমি, আমার আত্মার আত্মীয়দের কথা বলছি”এর দিকে। যেখানে সবিস্তর আলোচনা করা হয়েছে সুসান ব্রাউনমিলারকে নিয়ে।
যুদ্ধশিশু সম্পর্কে সারা পৃথিবী জুড়ে যে গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সুসান ব্রাউনমিলার অ্যান্থনির (জন্ম: ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৯৩৫) গবেষণা গ্রস্থ-নিবন্ধগুলো। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: ম্যান, উইম্যান অ্যান্ড রেপ। সাইমন এন্ড শুস্টার নামের প্রকাশনী থেকে বের হয় এই গ্রন্থটি। আজ পর্যন্ত ১৬ টি বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে এটি। বইটির কাজ যখন শুরু হয়- তখন বাঙলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, অর্থাৎ এটি ১৯৭১ সালের ঘটনা। সম্ভবত সে কারণেই বইটির একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী এবঙ তার আদলে যুদ্ধশিশু সম্বন্ধে আলোচনা। বইটির কিছু অংশের অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি-
….ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড আবিষ্কার করে যে, স্ত্রী রোগের সংক্রামণের মাত্রা ব্যাপক। একজন অস্ট্রেলিয় চিকিৎসক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন. “পরীক্ষা করে প্রায় প্রতিটি ধর্ষিতারই যৌনরোগ পাওয়া গেছে”।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদটি ছিলো গর্ভধারণ। সন্তান-সম্ভবা ধর্ষিতার সংখ্যা সঠিকভাবে নিরূপণ করা না গেলেও ২৫,০০০ জন ছিলো একটি গ্রহণযোগ্য সংখ্যা। ধর্ষিতা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের মনোভাবটি ছিলো কল্পনাতীত। সামান্য অংশই বাচ্চা ধারণ করতে আগ্রহী ছিলো। প্রায় জন্মদানের পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মেয়েরা অনাগত বাচ্চার ভবিষ্যত নিয়ে সামান্যই আগ্রহ প্রকাশ করতো। জোরপূর্বক ধর্ষণের ফসল হিসেবে বাচ্চাদের ভীতিকর আবির্ভাব উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনায়াসে অনুমেয় যে, বাঙলাদেশে ফরসা রঙের পাঞ্জবি বৈশিষ্ট্যের জারজ সন্তানেরা কখনোই বাঙালি সংস্কৃতিতে গৃহীত হবে না- এমনকি তাদের মায়েরাও না।”
গবেষক সুসান ব্রাউনমিলার ধর্ষণের সংখ্যাকে প্রায় চার লাখ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন-
During the nine-month terror, terminated by the two week armed intervention of India, a possible three million people lost their lives, ten millions fled across the border to India and 200,000, 300,000 or possible 400,000 women (three sets of statistics have been variously quoted) were raped. Eighty percent of the raped women were Moslems, reflecting the population of Bangladesh, but Hindu and Christian women were not exempt.
[Against Our Will : Men, Women and Rape; Susan Brownmiller; Page 81]
সুসান ব্রাউনমিলার আরও লিখেছেন;
“Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty… girls of eight and grandmothers of seventy-five had been sexually assaulted.”
বাংলাদেশীদের ওপর পাকিস্তানিদের ধর্ষণ প্রক্রিয়া শুধুমাত্র যৌন লালসা চিরতারথ করার জন্য ছিলো না। আট বছরের শিশু থেকে পচাত্তর বছরের নানি-দাদিরাও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আর পাকিস্তানীরা স্থানিকভাবেই শুধু ধর্ষণ করেনি, শত শত নারীকে মিলিটারি ব্যারাকে নিয়ে আটকে রেখেছে রাতে ব্যবহারের জন্য।
Some women may have been raped as many as eight times in a night. How many died from this atrocious treatment, and how many more women were murdered as part of the generalized campaign of destruction and slaughter, can only be guessed at.
এবারে একটু দৃষ্টিপাত করা যাক ওয়ারক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির দিকে। স্বাধীন বাংলাদেশে এইসব বিরঙ্গনাদের নিয়ে সবচেয়ে বেশী কাজ তারার করেছে। তারা একাত্তরের নারী নির্যাতনের একটি সামগ্রিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, এর মাধ্যমে জানা যায়-
১. স্পট ধর্ষণ, স্পট গণধর্ষণ ও বন্দী নির্যাতিতার সম্মিলিত সংখ্যা চার লাখ আটষট্টি হাজার (স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার তিন লাখ সাতা হাজার ছশ এবং বিভিন্নভাবে পাকিস্তানীদের নিকট বন্দী নির্যাতিত নারী এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’ নারী)।
২. চিহ্নিত স্থানে নির্যাতিতা নিহত ও অপহৃতসহ স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার- তিন লাখ ষাট হাজার। এঁদের মধ্যে শুধুমাত্র স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার প্রায় তিন লাখ সাতাশ হাজার যা মোট নির্যাতিতার সত্তরভাগ। এঁদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন প্রায় ত্রিশভাগ অর্থাৎ এক লাখ আট হাজার নারী।
৩. নির্যাতিত বন্দী নারী প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার (এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’) যা মোট নির্যাতিতার প্রায় ত্রিশভাগ। এরমধ্যে কারাগার, ক্যাম্প, বাঙ্কার প্রভৃতি স্থানে নির্যাতিতার সংখ্যা মোট নির্যাতিদের প্রায় আঠারভাগ।
এছাড়াও বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট, মার্শাল ল’ আদালত এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘর, অফিস আদালত, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে নির্যাতিত হন বারোভাগ (ক্যাটাগরি দুই-শতকরা পাঁচভাগ এবং ক্যাটাগরি তিন-সাতভাগ)।
৪. বন্দী নির্যাতিত নারীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা আশিভাগ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ছিয়াশি হাজার। এঁদের মধ্যে চল্লিশভাগকে হত্যা করা হয়েছে অথবা তাঁরা নিজেরাই আত্মহত্যা করেছেন।
[একাত্তরের নারী নির্যাতন : ইতিহাসের কৃষ্ণ অধ্যায়; ডা. এম এ হাসান; প্রসঙ্গ ১৯৭১ : মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, পৃষ্ঠা ৩]
ডা. এম.এ. হাসান তাঁর গ্রন্থে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে ধর্ষিতের সংখ্যা দুই থেকে চার লাখের কথা বলা হয়েছে। তাঁর নিজের জরিপের উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন,
‘১৯৯১-২০০২ সাল পর্যন্ত দেশের ৪২ জেলার ২৫টি থানায় পরিচালিত আমাদের গবেষণায় গৃহীত অসংখ্য সাক্ষাতকারের মধ্য থেকে নির্বাচিত ২৬৭ ব্যক্তির সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, একাত্তরে দু’লাখ দু’হাজার জন নারী ধর্ষিত হয়েছে ওই সব স্থানে।… সারা দেশে ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীর সংখ্যা সাড়ে চার লাখের ওপরে।
ডক্টর হাসান পরবর্তীতে লেখেন ‘যুদ্ধ ও নারী’। মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর নির্মমতা নিয়ে যারা সন্দিহান তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য এই বই। এই বইটিতে উদ্ধৃত হয়েছে এমন সব ঘটনা যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী মানুষকে অনেক চিন্তার খোরাক জোগান দেবে।
ডক্টর মুনতাসির মামুন ‘বীরাঙ্গনা একাত্তর’ শিরোনামে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বার একটি কলাম লেখেন। যা কয়েকটি খণ্ডে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে পত্রিকাটিতে। (রেফারেন্স অংশে লিঙ্ক সংযুক্ত করা হলো) পরবর্তীতে তাঁর কলামগুলো ‘বীরাঙ্গনা ১৯৭১’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। ডক্টর মুনতাসির মামুন লিখেছেন তাঁর মতে ডক্টর হাসানের বক্তব্যই বলে দেয়, এটি সারা দেশের জরিপ নয়, সাক্ষ্যও সম্পূর্ণ নয়। তবুও ধর্ষণের ব্যাপকতটা ডক্টর হাসানের বই থেকে বোঝা যায়।
মুনতাসির মামুন বলেছেন যে, ডক্টর হাসানের বর্ণনাকে আক্ষরিক অর্থে ধরলে তাঁর দেয়া সংখ্যাই ছাড়িয়ে যাবে। তিনি লিখেছেন, পূর্বতন সিলেটে ৩০ হাজার বীরাঙ্গনার সন্ধান পেয়েছেন। এ অঞ্চলের চা বাগানগুলোর মহিলা শ্রমিক, তাদের যুবতী ও কিশোরী কন্যাগণ, মনিপুরী ও খাসিয়া মহিলারা ব্যাপক হারে নির্যাতনের শিকার হন। সিলেট শহর, বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা, আদিত্যপুর, শ্রী রামসী, শেরপুর, পীরপুর, পীরনগর, করিমগঞ্জ সীমান্ত ও হাওড় এলাকা, সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকা, মৌলভীবাজার শহর, রাজনগর, সাধুহাটি, কমলগঞ্জ থানার শমসের নগর, মনিপুরীদের বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জসহ বিভিন্ন থানার গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে পাকিরা অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করে। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থানার ছাব্বিশাসহ বিভিন্ন গ্রাম, বরিশালের গৌরনদী থানার প্রায় সব গ্রাম, আগৈলঝাড়ার রাজিহার, চেতনার কোলা গ্রামসহ সমগ্র বরিশালে পাকিরা ব্যাপক নির্যাতন চালায়।’ এ ছাড়া তিনি ফরিদপুর জেলারও বিভিন্ন থানার বেশ কিছু গ্রামের নাম দিয়েছেন যেখানে ব্যাপকহারে ধর্ষণ করা হয়। একটি শহরের প্রতিটি বাড়িতে হানা দিলে ধর্ষিতের সংখ্যা কত দাঁড়ায়।
মুনতাসির মামুন লিখেছেন, আগে উল্লেখ করেছি- শুধু খান সেনারা নয়, তাদের সহযোগী রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনও ধর্ষণ করেছে। ব্রাউনমিলার সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করেছেন যেখানে বলা হয়েছে, রাতে পাকিস্তানী সৈনিক ও রাজাকাররা গ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেয়েদের তুলে নেয়। কাউকে কাউকে স্থানিকভাবে ধর্ষণ করা হয়। বাকিদের ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইন্টারন্যশনাল কমিশন অব জুরিস্টস জানিয়েছিল ‘জানা যায়, পাকিস্তানী সৈন্যরা ব্যাপক ধর্ষণ চালিয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং কম বয়সী মেয়েদের ওপর। অসংখ্য সূত্র থেকে ঘটনা সম্পর্কে স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ সরকার দাবি করেছে, ৭০,০০০-এর বেশি নারী এসব ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। সঠিক সংখ্যা যাই হোক না কেন, মার্কিন ও ব্রিটিশ শল্য চিকিৎসকরা গর্ভপাতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন জনগণকে এসব ধর্ষিত নারীকে সমাজে গ্রহণ করার প্রচারণায়। এসব অবস্থা সাক্ষ্য দিচ্ছে ধর্ষণের বিশাল সংখ্যার। পাকিস্তানী অফিসাররা এসব বর্বরতা সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে দায়মুক্ত থাকতে চায়। বহু ক্ষেত্রেই কিন্তু এসব সেনা অফিসার নিজেরা যুবতী মেয়েদের ধরে এনে আটক রাখত নিজেদের যৌন সন্তুষ্টির জন্য।’ যে সব সাংবাদিক তখন রিপোর্ট করেছিলেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাদের প্রতিবেদনেও প্রসঙ্গটি এসেছে বারবার এ রকম চারজনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করছি
নিউজ উইকের সাংবাদিক টনি ক্লিফটন উল্লেখ করেছেন, ‘আমি দেখতে পাই যে, আক্ষরিক অর্থে মানুষ বোবা হয়ে গেছে, যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের চোখের সামনে বাচ্চাদের হত্যা করেছে এবং মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে তাদের ভয়ঙ্কর যৌন পরিতৃপ্তির জন্য। পূর্ব পাকিস্তানে শত শত মাইলাই এবং লেডিসির মতো নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে সে ব্যাপারে আমার কোনই সন্দেহ নেই।’
নিউজউইকের সিনিয়র সম্পাদক এ্যারমাউড ডি ব্রোচ গ্রেভ : ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক বিদ্রোহীদের খুঁজতে আসার ভান করে ডেমরা গ্রাম ঘেরাও করে। তারপর ১২ থকে ৩৫ বছর বয়সী সকল নারীকে ধর্ষণ করে এবং ১২ বছরের বেশি বয়সী সকল পুরুষকে হত্যা করে।’
নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি এইচ, শ্যেনবার্গ : ‘পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই বাঙালী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে আটক রেখেছে। সৈন্যদের ব্যাংকারগুলিতে এসব মেয়েকে সারাক্ষণই নগ্ন অবস্থায় রাখা হতো। ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণের পর এসব নারীর অধিকাংশেরই ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।’
জন হেস্টিংস নামে এক মিশনারি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী সৈন্যরা… মেয়েদের যোনিপথে বেয়নেট ঢুকিয়ে তাদের হত্যা করেছে।’ মেয়েদের মসজিদে আটকে রেখেও ধর্ষণ করা হয়েছে। সাতক্ষীরার একটি গ্রামের মসজিদ থেকে বেশ কিছু নগ্ন নারী উদ্ধারের পর এ ধরনের ঘটনা নজরে আসে।
সবশেষে মুনতাসির মামুনেই সিদ্ধান্তে এসে উপনিত হনঃ
এ সমস্ত বিবেচনায় নিয়ে বলা যেতে পারে, ধর্ষিত নারীর সংখ্যা ছয় লাখের কাছাকাছি হতে পারে বা তার চেয়েও কিছু বেশি, কম নয়।
(উপরের আলোচনার সিংহভাগই ডক্টর মুনতাসির মামুনের বই ‘বীরাঙ্গনা একাত্তর’ থেকে সরাসরি পাওয়া।)
সুতরাং এই বিষয় পরিস্কার মুক্তিযুদ্ধে আক্ষরিক অর্থে নির্যাতিত নারীদের সংখ্যা আসলে ছয় লক্ষের কাছাকাছি কোন একটা সংখ্যা ছিলো। যদিও এসব দেশী এবং বিদেশী পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি কয়েকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিষকে এড়িয়ে গেছে। যারা খানিকটা আলোচনার দাবী রাখে বই কি;
১) মুক্তিযুদ্ধের প্রায় প্রতিটি দিনই কমপক্ষে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এদের অনেকে পরিবারের নারীরাই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার, আর এসব অসহায় পরিবার গুলোর একটা অংশ (বিশেষ করে হিন্দু ধর্মালম্বি) যুদ্ধের পর আর দেশে ফিরে আসেন নি। তাদের সংখ্যা নিরূপণ করা অসম্ভব।
এটা যে কোন অবান্তর কেইস না সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে সাজা প্রাপ্ত আল্লাম দেলোয়ার হোসেন সাইদীর ধর্ষণের ঘটনাটি। এই ঘটনায় মধুসূধন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামীকে সাইদী ধর্ষণ করে, এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর মানুষের অপবাদ আর গঞ্জনা সইতে না পেরে শেফালী ঘরামী ভারতে পালিয়ে যান। যেই ধর্ষণে সাইদীর অংশগ্রহণের প্রমাণও পেয়েছে আদালত।
২) শরণার্থী শিবিরে মারা যাওয়া এবং আত্মহত্যা করা নারীদের সংখ্যাও কম নয় এবং এদের সংখ্যাটা আমরা কখনোই জানতে পারবো না। জহির রায়হানের স্টপ জেনসাইডে এরকম ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশ থেকে নির্যাতিত হয়ে বাঙালী রমণী ভারতে পারী জমিয়েছে
৩) ব্রাউনমিলার লিখেছেন শতকরা দশজন মেয়েকে পাকিস্তানীরা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এখন সরাসরি ধর্ষণের শিকার বাকি নব্বুইভাগ মেয়েদের পরিবারের মধ্যে যেসব পরিবার রক্ষনশীল ছিলো তাদের একটা বড় অংশই ধর্ষণের ঘটনা সেরেফ চাপা দিয়ে নিজেদের আর সন্তানের সম্মান বাঁচিয়েছেন।
সেই সময় স্বাভাবিক ভাবেই এসব বীরাঙ্গনাদের সময়ের স্রোতের সাথে মিলে যাবার প্রবণতা ছিলো। এবং সেই কারণেই যেসব মেয়েরা শারীরিক ভাবে অপেক্ষাকৃত কম আঘাতপ্রাপ্ত ছিলো, তাদের একটা বড় অংশই পরিসংখ্যানের বাইরে থেকে গেছে।
উপরের তিনটা প্যারামিটারকে বিবেচনা করলে, এবং এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতনকে বিবেচনায় আনলে নিঃসন্দেহে একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের সংখ্যা দশ লক্ষের কাছাকাছি হবে বলে আমার বিশ্বাস।
কি সব ল্যাখছে হেতারা???
সবই ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ … :-s