‘রূপবান’ ম্যাগাজিনটির ২য় সংখ্যা (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৪, বর্ষ ১, সংখ্যা ২) বেরিয়েছে বলে আমি জেনেছি। এ ইস্যুটির জন্য আমার একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল। কিছুটা সংক্ষেপিত আকারে ছাপানো সাক্ষাৎকারটি  মুক্তমনা পাঠকদের জন্যও দেয়া হল:

সমকামিতা বইটির ব্যাপারে কিছু বলুন। বইটি লেখার কথা মাথায় আসলো কখন?

উত্তর: আসলে এ নিয়ে বই লেখার ইচ্ছে আমার প্রথম থেকে ছিল না। আমি নিজে একজন বিজ্ঞান লেখক। বিজ্ঞানের টুকিটাকি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বহু আগে থেকেই লিখতাম।  সেসময় একটি ব্লগ-সাইটের পোস্টে একজন মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সমকামিতা প্রাকৃতিক কোনোভাবেই হতে পারে না মূলত (নারী-পুরুষে) কামটাই প্রাকৃতিক’। বস্তুত এর উত্তর দিয়ে গিয়ে আমাকে কিছু বৈজ্ঞানিক যুক্তির অবতারণা করতে হয়, এবং এ নিয়ে আমি একটা পূর্ণাঙ্গ লেখা লিখি। তারপর ব্যাপারটাকে বিস্তৃত করতে গিয়ে আরো কয়েকটি পর্বের অবতারণা করতে হয়। লেখাগুলোর শিরোনাম ছিল – ‘সমকামিতা (সমপ্রেম) কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ? একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা’। দেখলাম যে, আমার লেখাগুলো পাঠকদের ভাল লাগছে। অনেকেই ভিন্ন বিষয় নিয়ে গঠনমূলক প্রশ্ন করেছেন। যে ব্যাপারগুলো রাষ্ট্রীয় মিডিয়াগুলোতে অনুপস্থিত ছিল, ঢেকে রাখা হয়েছিল অদৃশ্য কালো চাদরে, সেগুলোই এক ধরণের আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছে ব্লগগুলোতে। অনেকেই এ নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছেন, আমিও আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান এবং পড়াশোনা থেকে উত্তর দিতে সচেষ্ট হচ্ছিলাম।  বই প্রকাশের ক্ষেত্রটা তৈরি হয়েছিল সেসময়ই, যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম না, এই ‘ট্যাবু টপিক’ নিয়ে দেশের কোন প্রকাশক বই প্রকাশ করতে সম্মত হবেন কিনা।

এই ব্যাপারটা সহজ করে দিলেন শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর তরুণ প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল। আমাকে ইমেইল করে  উনি নিজে থেকেই আমার কাছে একটি বিজ্ঞানের বইয়ের পাণ্ডুলিপি চাইলেন। আমি বললাম, পাণ্ডুলিপি একটা আছে বটে, কিন্তু একজন সাহসী প্রকাশক লাগবে। উনি বিনীত ভাবে জানালেন, প্রকাশক হিসেবে তার সফলতা কতটুকু তা তিনি জানেন না, কিন্তু স্রোতের বিপরীতে বই ছাপানোর সাহস তাঁর আছে। উনি ‘সমকামিতা’ পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশের জন্য মনোনীত করলেন, এবং ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইটি প্রকাশিত হল ‘সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ শিরোনামে।  আর  বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে বইটির দ্বিতীয় (পরিবর্ধিত) সংস্করণ শুদ্ধস্বর থেকেই।

বইটার নাম ‘সমকামিতা’ দেবার আগে কি দ্বিতীয়বার ভেবেছিলেন?

উত্তর: অবশ্যই। একাধিকবার ভাবনাচিন্তা করেই বইটির নাম ‘সমকামিতা’ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।  আমার মনে হয়েছে ঠিক এ নামেই বইটি প্রকাশিত হওয়া উচিৎ।

 

‘সমকামিতা’ না হয়ে নামটা কি ‘সমগামী’ কিংবা ‘সমপ্রেমী’ হতে পারতো?

উত্তর: আগেই বলেছি আমার বইটি সমকামিতার উপর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। অর্থাৎ এমন একটি বিষয়ের উপর লেখা যেটাকে অচ্ছুৎ কিংবা ঘৃণিত বিষয় হিসেবে দেখতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অভ্যস্ত।  বইটি একটি নির্দিষ্ট  বিষয়ের উপর, কোন নির্দিষ্ট গ্রুপ কিংবা গোত্রের উপর নয়। তাই ‘সমগামী’ কিংবা  ‘সমপ্রেমী’ হতে পারতো না নিঃসন্দেহে ।

তবে বইটির শিরোনাম  ‘সমপ্রেম’ হতে হয়তো পারতো, কিন্তু যে বড় সড় ধাক্কাটা আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানসে দিতে চেয়েছিলাম বইটি প্রকাশের মাধ্যমে, সেটা আর হয়ে উঠতো না।  আমি জানি ‘সমকামিতা’ না হয়ে ‘সমপ্রেম’ হলেও বইটার বিষয়বস্তুর কোন পরিবর্তন ঘটতো না; কিন্তু সমকামিতা শব্দটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত সেটার বিপরীতে দৃঢ় পায়ে দাঁড়ানো হয়ে উঠতো না।  এই সামাজিক শৃঙ্খলটা ভাঙা দরকার ছিল।

তবে বইয়ের শিরোনামে সমপ্রেম স্থান না পেলেও বইয়ের  ভিতরে অসংখ্য জায়গায় ‘সমপ্রেম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া বইয়ের পরিশিষ্টে আলাদা ভাবে সমপ্রেমকে সংজ্ঞায়িত করে বলা হয়েছে –

‘সমপ্রেম হচ্ছে সমকামিতার আরেকটি প্রতিশব্দ। সমকামিতা শব্দটির মধ্যে কেবল কাম তথা কামনা, সম্ভোগ-প্রবৃত্তি এবং সম্ভোগ-লালসার ব্যাপারটিই মুখ্য হয়ে ওঠায় এর প্রতিশব্দ হিসেবে  বাংলা ভাষায় সমপ্রেম প্রস্তাব করা হয়েছে। মূলত যৌনসম্পর্কের অভিলাষ ছাড়াও যে কোন সম-লৈঙ্গিক প্রেমজ সম্পর্ককে এই প্রতিশব্দের মাধ্যমে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে’।

বিষমকামী সমাজের চাপিয়ে দেয়া মানসিকতার পুনরাবৃত্তির ব্যাপারটা বাদ দিলেও এমনিতেই ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘সমকাম’ কিংবা ‘সমকামী’ শব্দগুলোতে যেন সমপ্রেমী যুগলের প্রেমের ব্যাপারটি উহ্য থেকে কেবল কামের তাড়নাই যেন মুখ্য হয়ে উঠে। কিন্তু পুরো বিষয়টা তো কেবল কামকে ঘিরে নয়, বরং ব্যাপারটি এক তাদের একে অন্যকে ভালবাসার অধিকারের। ব্যাপারটি সংখ্যালঘু এই সব মানুষদের দাবী আদায়েরও। আজ খুঁজে দেখলাম, আমার বইয়ে অন্তত ষাট জায়গায় সমপ্রেম এবং সমকাম পরষ্পরপরিবর্তনীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা করেছি উল্লিখিত মূল্যবান যুক্তিগুলো মাথায় রেখেই। কিন্তু তারপরেও শিরোনামের ব্যাপারটি নিয়ে যখন আলাদাভাবে ভেবেছি, তখন  ‘সমকামিতা : একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ই সবচেয়ে সঠিক শিরোনাম বলে মনে হয়েছে।

 

বইটি লেখার পর এর প্রভাব কিংবা প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছে বলে মনে করেন?

উত্তর: ভাল।  বইটি যে বছর প্রকাশ করা হয়েছিল, তার পরের বছরই একটি পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘[শুদ্ধস্বরের] অনেক বইই পাঠক পছন্দ করেছে। সমকামিতা বইটি নিয়ে ব্যাপক পাঠকের আগ্রহ লক্ষ্য করেছি’।

বস্তুত আহমেদুর রশীদ পুরো সাক্ষাৎকারে একটি বইয়ের নামই উল্লেখ করেছেন, আর সেটি ছিলো আমার বই সমকামিতা। এর পর যতদিন গেছে আরো অনেক আশাপ্রদ ঘটনা ঘটেছে।  যেমন, বইয়ের প্রথম প্রকাশের পর বইটির ভাল কিছু রিভিউ আমার নজরে পড়েছে। প্রথম আলো পত্রিকায় ২০১০ সালের অগাস্ট মাসের ৬ তারিখে আলতাফ শাহনেওয়াজ ‘অবগুণ্ঠন সরে গেল’ নামের চমৎকার একটি শিরোনামে রিভিউ করেছেন বইটির। সমকামিতার মত ব্যাপার যা এখনো আমাদের সমাজে ‘অচ্ছুৎ’ বলেই বিবেচিত, সে ধরণের বিষয় প্রথম আলোর মত মূলধারার পত্রিকায় নিবন্ধিত হওয়া নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ এবং সেই সাথে প্রেরণাদায়ক। বইটির আরেকটি মূল্যবান এবং সুবিস্তৃত রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে সুসাহিত্যিক আহমদ মাযহার সম্পাদিত ‘বইয়ের জগৎ’ পত্রিকায়। অঞ্জন আচার্যের করা সেই রিভিউটির শিরোনাম ছিল – ‘বিজ্ঞানমনস্ক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমকামিতা’। বইটি প্রকাশের পর থেকেই একাডেমিয়াতে, ব্লগে কিংবা ম্যাগাজিনে আমার এই বইটিকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্লগে  এবং ফেসবুকেও বইটি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

 

সরাসরি কিংবা সামনাসামনি কারো প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?

উত্তর: ২০১২ সালে বইমেলা চলাকালীন  একদিন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং গবেষক সেলিনা হোসেনের সাথে দেখা হল।  সাথে সাথেই উনি বললেন যে আমার এই বইটি উনি আগাগোড়া পড়েছেন। উনি বইটির ভূয়সী প্রশংসা করলেন তখনই।  তাঁর মত স্বীকৃত একজন জেণ্ডার গবেষক এই বইয়ের প্রশংসা করছেন, এটা আমাকে লজ্জিতই করে ফেলেছিল সেসময়। কিন্তু পরে বেশ ভাল লেগেছিল, আর এই ভাল লাগার রেশটা আমার মধ্যে ছিল দেশ ছেড়ে আবারো চলে আসার পর অনেকদিন …

 

কোন বিরুদ্ধাচরণের সম্মুখীন হননি?

উত্তর: তা তো কিছু হবেই। তবে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে অনেক কম।

 

তারা ঠিক কি বলছে?

উত্তর: এ ধরণের প্রতিক্রিয়া যা হয় আরকি! এক এমবিবিএস পাশ করার দাবীদার ব্লগার বলতে শুরু করলেন আমি নাকি সমকামী!  যেন আমাকে সমকামী প্রমাণ করতে পারলে বইটির তথ্য মিথ্যে হয়ে যায়!  এ ব্যাপারে বলতে চাই,  সমকামিতার অধিকার নিয়ে লেখা মানে নিজেও সমকামী হয়ে যাওয়া নয়। আমি বিজ্ঞান এবং মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেই বইটি লেখার চেষ্টা করেছি। বইটিতে জৈববৈচিত্রের স্বপক্ষে  বিভিন্ন আধুনিক তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে, আমার জীবনের ঘটনা নয়। আমি মূলত একটি বিজ্ঞানভিত্তিক বই লিখতে চেয়েছি, আত্মজৈবনিক উপন্যাস নয়।  বইয়ের বহু জায়গায়ই বলেছি আমি নিজে সমকামী নই, কিন্তু সমকামী অধিকার নিয়ে কাজ করা বহু মানুষের এবং তাদের উপর নির্যাতনের ধারাবাহিক প্রতিফলনকেই আমি সন্নিবেশিত করেছি আমার লেখায়। এ জন্য আমার বহু প্রতিষ্ঠিত একাডেমিয়ান থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে বইটি রচনার জন্য। বাংলাদেশে যারা জেন্ডার ইস্যু নিয়ে গবেষণা করেন তাদের অনেকেই নিজ থেকে সাহায্য করেছেন। আমার বইটি সেসব কিছুরই গ্রন্থিত প্রতিফলন। কেউ হিজড়াদের অধিকার নিয়ে বই বের করলে, নিজেও হিজড়া হবেন এমন কোন কথা নেই। কোন সমাজ সচেতন লেখক যৌনকর্মীদের দুঃখ-বঞ্চনা এবং তাদের অধিকার নিয়ে লিখলে বা কথা বললে তাকেও যৌনকর্মী হতে হবে তা নয়।  আর হিজড়াদের উপর বই লেখা মানে হিজড়া হবার জন্য উৎসাহিত হওয়া নয়, ঠিক তেমনি আমি মনে করি সমকামিতা বইটির মাধ্যমে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হয়নি, বরং সমকামীরা যে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হচ্ছেন সেটার একটা সামাজিক প্রতিফলন বস্তুনিষ্ঠ-ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। আমি সমকামী হলে সেটা বলতে আমার কোন অসুবিধা ছিল না (বিশেষত আমি যেখানে সমকামী অধিকার সমর্থন করি)। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তা নই। যা আমি নই, তা কোন এক ব্লগের কেউ বললেই আমি হব কেন।  হুমায়ুন আজাদ নারীদের নিয়ে  ‘নারী’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন, তা বলে তো হুমায়ুন আজাদ নারী হয়ে যাননি!

 

 

অনেকেই বলেন, ‘বাংলাদেশে হাজারো সমস্যা। কিন্তু সব ছেড়ে আপনাকে সমকামিতা নিয়ে একটি বই লেখার দিকে যেতে হল কেন? অনেকেই মনে করেন, সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করার কিংবা তাদের বেদনার নিরসনের চাইতে কি অনেক বেশি প্রয়োজনীয় বিষয় রয়ে গেছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

উত্তর: প্রায় দুহাজার পাঁচশ বছর আগে সক্রেটিস নামের এক গ্রীক দার্শনিক উচ্চারণ করেছিলেন – “I am not a citizen of Greece or Athens; I am a citizen of the world.” আমি গ্রীসের কোন দার্শনিক নই, নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু আমিও নিজেকে সারা বিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে দেখতেই পছন্দ করি, তা আমি যেখানেই বসবাস করি না কেন। সারা বিশ্বের চলমান ঘটনা, রাজনীতি, অর্থনীতি, নিপীড়ন, নির্যাতন ইত্যাদি আপনার কিংবা অন্য দশজনের মতো আমাকেও স্পর্শ করে। সেজন্যই বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করার ক্ষুদ্র ‘অপচেষ্টা’।

এবার মূল প্রশ্নটায় আসি। সমকামীদের বেদনার নিরসনের চাইতে কি অনেক বেশি প্রয়োজনীয় নয় অন্য অনেক ব্যাপার নিয়ে সচেতনতা জাগানো? আমার চোখে এই গুরুত্বের বিষয়টা একেবারেই আপেক্ষিক। যে ইস্যুগুলোকে ‘সমকামীদের বেদনার চেয়েও বেশী প্রয়োজনীয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন, অতীতেও করেছেন ভবিষ্যতেও করবেন। যারা এই ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করছেন তাদের প্রতি আমার সবসময়ই পূর্ণ সমর্থন থাকে এবং থাকবে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, সবসময়ই কেবল ‘চর্বিত চর্বণ’ই করে যেতে হবে, নতুন কিছু যোগ করা যাবে না। বিভিন্ন নিরপেক্ষ গবেষণায় আমাদের দেশে ৬ থেকে ১২ মিলিয়ন সমকামী এবং রূপান্তরকামী জনগণের অস্তিত্বের কথা উঠে এসেছে। অথচ,তাদের অস্তিত্বই সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে অস্বীকৃত। তারা দেশের ‘অদৃশ্য সংখ্যালঘু’। আমি আমার বইয়ে দেখিয়েছি, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজ নারী অধিকার, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কিংবা বড়জোর পাহাড়ি কিংবা আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আজ কিছুটা সচেতনতা দেখালেও তারা এখনো যৌনতার স্বাধীনতা কিংবা সমকামীদের অধিকার নিয়ে একদমই ভাবিত নয়। আমি জানি না,’ বাংলাদেশে তো হাজারো সমস্যা’ বলে ইস্যুটিকে পাশ কাটিয়ে যেতে সচেষ্ট থাকেন, তারা  বিষয়টির কতটুকু গভীরে ঢুকে চিন্তা করেছেন, তবে আমার কাছে বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। খোদ ইরানেই ১৯৭৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪০০০ ব্যক্তিকে সমকামিতার অজুহাতে হত্যা করে হয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলো। ইরানে বছর কয়েক আগে (২০০৫ সালে) দুজন কিশোরকে সমকামিতার অপরাধে ফাঁসি দেয়া হয় তারপর সেই লাশ শহরের সারা রাস্তায় ট্রাকে করে ঘোরানো হয়। তালিবান নিয়ন্ত্রিত সময়কার আফগানিস্তানে ১৯৯৮ সালে কান্দাহারে তিনজন পুরুষকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতে হত্যা করা হয়। তাদের অপরাধ ছিলো সমকামিতা । ২০০৯ সালে ইরাকে গুপ্ত হত্যায় সাত মাসে বিরাশি জন সমকামী প্রাণ হারায় । সমকামিতা-কেন্দ্রিক বিভিন্ন নৃশংসতার ঘটনা মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সুদান, বাংলাদেশ সহ প্রায় প্রতিটি মুসলিম প্রধান দেশে অহরহই ঘটছে। ইরাকে সমকামীদের এভাবে রাস্তায় পিটিয়ে মারা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।  এমনকি খোদ আমেরিকাতেই ওয়াইয়োমিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ম্যাথু শেফার্ডকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।  সারা বিশ্বে ঘটা সহিংসতার প্রায় আঠারো ভাগ যৌনপ্রবৃত্তি কিংবা যৌন পরিচয়কে লক্ষ্যবস্তু করে সংগঠিত হয়, তা সময় সময় বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।  শুধু ভিন্ন যৌন প্রবৃত্তি থাকার কারণেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সামাজিকভাবে সমকামীদের উপর যে লাগাতার অত্যাচার চলেছে তা আসলে রূপকথাকেও হার মানায়। আমার বইয়ে আমি এ ধরণের বহু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছি।

পাশাপাশি আছে আত্মহননের ঘটনা। আমার বইয়ে আমাদের স্কুলে ছোটবেলায় একটা ছেলে পড়তো আমাদের সাথে সে রকম একজন ছেলের কথা লিখেছি। পরে ক্যাডেট কলেজে চলে যায়। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতাম ছেলেটি নাকি সমকামী মনোভাবাপন্ন। এর কিছুদিন পরেই মাসুদের আত্মহত্যার খবর পাই। আমি ছেলেবেলায় যে এলাকাতে বড় হয়েছি, সেখানে একটি ছেলে ছিলো, আমার চেয়ে দু চার বছরের বড়। ছেলেটিকে এলাকায় ‘একটু মেয়েলী’ বলে খোঁটা দেয়া হতো। ছেলেটি ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সাথে থাকতে এবং তাদের সাথে খেলাধুলা করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি ছেলেটি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। আমরা চক্ষু মুদে থেকে এগুলো ঘটনাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করি না কেন, এগুলো কিন্তু ঘটছেই। অন্যান্যরা না হয় অনেক বেশি প্রয়োজনীয় নয় অন্য অনেক ব্যাপার নিয়ে লিখুন, কিন্তু এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলো যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে কেবল ঢাকাই পড়ে না থাকে, সেজন্যই আমার এই ছোট প্রচেষ্টা।

 

সমকামিতা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই, এ কেবলই পশ্চিমা ব্যাধি বলে যারা চালাতে চায়,তাদের কি বলবেন?

উত্তর: আমি দ্বিমত করব। আমাদের সংস্কৃতিতে যে সমকামিতা সবসময়ই ছিল ইতিহাস থেকে তার অজস্র উদাহরণ পাই আমরা। বাৎস্যায়নের কামসূত্রের ষষ্ঠ অধিকরণের নবম অধ্যায়ে সমকামিতার উল্লেখ রয়েছে। এ ব্যাপারটা কেবল ‘পশ্চিমা ব্যাধি’ হলে  প্রাচীন সাহিত্য কিংবা পুরাণগুলোতে এর উল্লেখ থাকত না। সমকামিতার ইতিহাস আসলে অনেক পুরনো। প্রাচীন গ্রিসের ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণে সমকামিতার স্পৃহার কথা জানা যায়। ধর্মীয়ভাবে সমপ্রেম এখানে স্বীকৃত ছিল। ‘ভেনাস’ ছিলেন তাদের কামনার দেবী। এই দেবীই আবার সমকামীদের উপাস্য ছিলেন। এছাড়া ‘প্রিয়াপ্রাস’ নামেও আরেক দেবীকেও সমকামীরা আরাধনা করত বলে শোনা যায়।

তাহিতির বিভিন্ন জায়গায় সমকামে আসক্ত ব্যক্তিদের আরাধ্য দেবতার মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। আনাতেলিয়া, গ্রিস এবং রোমার বিভিন্ন মন্দিরে ‘সিবিলি’ এবং ‘ডাইওনিসস’-এর পূজা ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল। সিবিলির পুরোহিতেরা গাল্লি নামে পরিচিত ছিলেন। এরা নারীবেশ ধারণ করতেন। মাথায় নারীর মতো দীর্ঘ কেশ রাখতে পছন্দ করতেন। এরা সমকামী ছিলেন বলেও অনুমিত হয়। পরে এশিয়া মাইনর থেকে সিবিলি পূজা পারস্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। পারস্য সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে এ সমস্ত প্রথা পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়।

পারস্য সাহিত্যে অনেক কবি তাদের প্রেমিকাকে পুরুষ নামে ডাকতেন। তবে এটি সম্ভবত অঞ্চলভিত্তিক কোনো প্রথা। আরব সমাজে বয়স্ক পুরুষ এবং বালকের মধ্যে যৌন সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য তো বটেই, মধ্যযুগে (ইসলামের বিস্তৃতির সময়) বহুল প্রচলিতও ছিল। ‘সাকী’ বলতে এখন আমাদের চোখের সামনে সুরাপাত্র হাতে যে মোহনীয় লাস্যময়ী নারীর ছবি ভেসে উঠে, প্রাচীন আরবে তা বোঝানো হত না। গবেষকরা বলেন, ‘সাকী’ বলতে আরবে নারীর পাশাপাশি সুদর্শন কিশোরও বোঝানো হত। তারা শুধু পানপাত্রে দ্রাক্ষারসই পরিবেশন করত না, পাশাপাশি অন্যান্য পার্থিব সেবাও পরিবেশন করত। এর উল্লেখ পাওয়া যায় আরবের বহু সমকামী কবিদের রচনায়।

 

কিন্তু ধর্মীয় গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারেও তো কিছু প্রশ্ন আছে?

উত্তর: ইসলামে সমকামিতাকে হারাম বলে ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়, কিন্তু উর্দু এবং ফার্সি ভাষায় লেখা রচনা খুললেই সমকামিতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সমকামিতার উল্লেখ রয়েছে ইতিহাসের বহু মুসলিম কবিদের রচনাতেই। যেমন- আমীর খসরু, জিয়াউদ্দিন বারানি, জামশেদ রাজগিরি, মুত্রিবি, হাকিকাত-আল-ফুকারা, মুহম্মদ আকরাম, সিরাজ আব্দুল হাই, দরগাহ কুয়ালি খান, মীর তাকি, ইফতি নাসিম প্রমুখ। ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনামলে দিল্লিতে সমপ্রেমিকদের রাজদরবারে অবাধ গতিতে আসা-যাওয়ার কথাও ইতিহাসে আমরা পাই। সমান্তরাল যৌনতা এ সময় সাহিত্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে কবি মুকাররম বক্স ও মোক্কারোম এর প্রসঙ্গ। কবির মৃত্যুর পর ৪০ দিন তার প্রেমিক শোক যাপন করেছিলেন, বিধবার মতো। আর সুফিদের ব্যাপারে সকলই মোটামুটি অবগত। তাদের আধ্যাত্মিক গান ও সাহিত্য স্বর্ণ-স্তবক হয়ে আছে। এ ধরনের বহু উদাহরণই দেওয়া যায়।

 

পাশাপাশি হিন্দু ধর্ম এবং পুরাণ থেকেও কিছু উদাহরণের উল্লেখ করা যাক। সগরবংশীয় অংশুমানের পুত্র মহারাজা দিলীপ নিঃসন্তান হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জন্ম-রক্ষায় সমস্যা দেখা দেয়। শিব সে সময় আবির্ভূত হয়ে রাজার দুজন বিধবা স্ত্রীকে আদেশ করেন সন্তানলাভের জন্য পরস্পর দেহ-মিলন করতে। তাদের মিলনে সন্তান জন্মায় বটে কিন্তু সে সন্তান ছিল অস্থিহীন। পরে ঋষি অষ্টাবক্রের বরে সেই সন্তান সুস্থ এবং উত্তমাঙ্গ হন এবং ভগীরথ নামে রাজ্যশাসন করেন। রাম ও সুগ্রীব তাদের বন্ধুত্ব সুগভীর করার উদ্দেশে অগ্নি-প্রদক্ষিণ করে সাত-চক্কর দিয়েছিলেন, তার বর্ণনাও আছে।

এমনকি নর-নারীর ‘শারীরিক’ মিলন ছাড়াও সন্তান জন্ম নেওয়ার উপকথার সন্ধান মিলে রামায়ণ এবং মহাভারতের মতো বৈদিক সাহিত্যগুলোতে। এসব কাহিনিতে বর্ণিত বিভিন্ন চরিত্রের জন্মের ক্ষেত্রে কখনও-সখনও সমকামিতারও আভাস মেলে, আবার কখনও একেবারেই প্রকৃতি নির্ভর; যেমন, সীতার জন্ম মাটি থেকে আর দ্রৌপদীর জন্ম যজ্ঞের অগ্নি থেকে। জরাসন্ধের জন্ম হয় দুজন পৃথক নারীর গর্ভে জন্ম নেওয়া অর্ধ অঙ্গবিশিষ্ট পৃথক সন্তানের সংমিশ্রণে। ইন্দ্র এবং স্কন্ধের মধ্যে যুদ্ধের সময় ইন্দ্রের বজ্রাঘাতে স্কন্ধের দক্ষিণ পার্শ্ব হতে জন্ম হয় বিশাখের। কার্তিকের জন্ম হয় শিবের পৌরুষ অগ্নি পান করার ফলে। অয়াপ্পানের জন্ম হয় শিব ও বিষ্ণুর মিলনে। গণেশের জন্ম হয় আবার জন্মস্থলির বাইরে। দ্রোণ কিংবা কৃপ-কৃপী কারও জন্মই স্ত্রী-পুরুষের ‘স্বাভাবিক’ মিলনে হয়নি। বালখিল্য মুনিদের জন্ম হয়েছিল ব্রহ্মার লোম থেকে।

নারী সমকামিতার অনেক দৃষ্টান্ত আছে রামায়ণে। লঙ্কা পরিভ্রমণের সময় হনুমান রাবণের স্ত্রীগণের আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থা চাক্ষুষ দেখেছিলেন। সমকামিতার উল্লেখ ছাড়াও বৈদিক সাহিত্যে আমরা পাই লিঙ্গ-পরিবর্তনের কাহিনি। বিষ্ণুর মোহিনী অবতাররূপে ধরাধামে এসে শিবকে আকর্ষিত করার কাহিনী এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মহাভারতের শিখণ্ডী ও বৃহন্নলার কাহিনিও বোধ হয় সবারই জানা। দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী পূর্বজন্মে ছিলেন অম্বা নামের এক নারী। মহাদেবের বরে তিনি পুরুষ-বেশে আবার মর্তলোকে জন্ম নিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম যখন তাকে চিনতে পারলেন তখন ওর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে তিনি নারাজ হন। কারণ ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি নিরস্ত্র, ভূপাতিত, বর্ম ও ধ্বজহীন, বিকলেন্দ্রিয়, স্ত্রী কিংবা স্ত্রী নামধারী কারও সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না। শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন তার রথ পরিচালনা করেন এবং শরাঘাতে ভীষ্মকে ভূতলে ‘শরশয্যায়’ শায়িত করেন। আর এদিকে বৃহন্নলা হচ্ছে ক্লীবরূপী অর্জুন। এই ‘তৃতীয় প্রকৃতি’র রূপ অর্জুন পরিগ্রহ করেন যখন তিনি বনবাসে ছিলেন। তিনি বাইরে নারী, অন্তরে নর– আধুনিক ট্রান্সজেন্ডারের উদাহরণ যেন। এভাবেই তিনি বিরাট রাজের নগরে রাজকন্যা উত্তরা এবং অন্যান্য কুমারীদের জন্য নৃত্যগীতের শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই সময় তার কানে দীর্ঘ কুণ্ডল, হাতে শাঁখা আর সুবর্ণনির্মিত বলয় থাকত। দুর্যোধন বিরাটরাজ্য থেকে গো-হরণ করলে বৃহন্নলা সেই গো-সম্পদ পুনরুদ্ধার করতে উত্তরের সারথি হিসেবে যুদ্ধে যান। কিন্তু যুদ্ধের সময় এত বিপুল কুরু-সৈন্য দেখে উত্তর পালিয়ে যেতে চাইলে বৃহন্নলা তাকে নিবৃত্ত করেন এবং উত্তরকে তার সারথি করে নিজেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং গো-সম্পদ উদ্ধার করেন। এছাড়া বৌদ্ধ সাহিত্য (বিমলাকৃতিনির্দেশ), জৈন সাহিত্য এবং অন্যান্য সাহিত্যগুলোতেও সমকামিতার অজস্র উপকরণ পাওয়া যাবে। শুধু ধর্মীয় পুরাণ কিংবা গ্রন্থেই নয়, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যেও সমকামিতার প্রচুর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।

আসলে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই সমকামিতা সবসময়ই মানবসমাজে ছিল। গ্রিক, রোমান, চৈনিক, পাপুয়া নিউগিনি অথবা উত্তর আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতায় সমকামিতার অজস্র উদাহরণ আছে। সমকামিতা ছিল অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতায়। হিন্দু পুরাণেও উল্লেখ পাওয়া যায় পুরুষিনী অথবা তৃতীয় প্রকৃতির। বর্তমানে গুজরাটের সঙ্খলপুরে বহুচোরা মাতার যে মূর্তি আছে তা অনেকটা ‘সিবিলির’ আদলে রচিত। ভারতবর্ষে বৈষ্ণব ধর্মের একটি বিশেষ শাখা আছে। এরা একসঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের ভজনা করে থাকে। এদের অনেকে স্ত্রীবেশ ধারণ করে। এই সম্প্রদায়ের অন্যতম সাধক গদাধর গোস্বামী নাম নিয়েছিলেন রাধিকা। আবার গোবিন্দ ঘোষ রঙ্গদেবী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

মূল কথা হচ্ছে, সমকামিতা, রূপান্তরকামিতা, উভকামিতা- এগুলো কোনোটাই আধুনিক পশ্চিমাদের আবিষ্কার কিংবা বিকৃতি নয়, বরং এটি প্রাচীন সভ্যতা থেকে আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই ছিল; পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ইন্টারনেটের কারণে ব্যাপারগুলো সামনে চলে এসেছে।

 

অনেকেই ধর্মীয় কাহিনির উল্লেখ করে বলেন সমকামিতার জন্য দুটো নগরী ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল।  কাজেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমকামিতা গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে আপনার কি অভিমত?

উত্তর: এটার উত্তর আমাকে অসংখ্যবার দিতে হয়েছে। প্রথমত আমার লেখাটা বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের উপর লিখিত, কোন ধর্মীয় উপকথার নয়। হ্যাঁ, সমকামিতার কারণে সডোম এবং এবং গোমরাহ ধ্বংসের কাহিনী আমরা বাইবেলে পাই, এবং পরবর্তী ধর্মগুলো সেই উপাখ্যান ঘিরেই আবর্তিত। আমার মতে ওটা কেবল বাইবেলীয় উপাখ্যান, এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর সত্য বলে যদি ধরেও নেই, বহু বিশেষজ্ঞই মত দিয়েছেন সমকামিতার কারণেই নগরী দুটো ধ্বংস হয়েছিল তার কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ কোথাও নেই, বরং হয়েছিল তাদের লোভ, লালসা আর ধর্ষকামী মনোভাবের জন্য। এ প্রসঙ্গে  জন বসওয়েলের ‘Christianity, Social Tolerance, and Homosexuality’ গ্রন্থটি পড়ে দেখা যেতে পারে।  প্রসঙ্গত আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করি বাইবেল থেকেই। বাইবেলে বর্ণিত যিবূষ (Gibeah)নগরীতেও একইভাবে অতিথিবৎসল না হওয়া এবং ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ঈশ্বর এক সময় পুরো নগর ধ্বংস করে দিয়েছিলেন (Judges 19:22-30)। সেখানে গৃহকর্তার দাসী এবং উপপত্নীকে সারা রাত ধরে ধর্ষণ করা হয়েছিল। সমকামিতাকে সেক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও নগর রক্ষা পায়নি। কাজেই উদারপন্থী ধর্মতাত্ত্বিকেরা দাবি করেন, সডোমের ক্ষেত্রেও ঈশ্বরের কাছ থেকে শাস্তি এসেছে ধর্ষকামিতার কারণে, সমকামিতার কারণে নয়।

আর প্রাচীন ধর্মে কোনকিছু থাকলেই সেটা ভাল হবে সেটা মনে করার কোন কারণ নেই। পৃথিবী এগিয়েছে অনেক। অনেক প্রাচীন ধর্মেই বন্যা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুমারী উৎসর্গ করার বিধান ছিল; কেউ কেউ সদ্য জন্মলাভ করা শিশুদের হত্যা করত, এমনকি খেয়েও ফেলত। কোনো কোনো সংস্কৃতিতে কোনো বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে অন্য মহিলা এবং পুরুষদেরও তার সাথে জীবন্ত কবর দেওয়া হত, যাতে তারা পরকালে গিয়ে পুরুষটির কাজে আসতে পারে। ফিজিতে ‘ভাকাতোকা’ নামে এক ধরনের বীভৎস রীতি প্রচলিত ছিল যেখানে একজনের হাত-পা কেটে ফেলে তাঁকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেই কর্তিত অঙ্গগুলো খাওয়া হত। আফ্রিকার বহু জাতিতে হত্যার রীতি চালু আছে মৃত-পূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য। ভারতে সতীদাহের নামে হাজার হাজার মহিলাদের হত্যা করার কথা তো সবারই জানা। এগুলো সবই মানুষ করেছে ধর্মীয় রীতি-নীতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, অদৃশ্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করতে গিয়ে। এগুলো সবই সমাজে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামক আগাছার চাষ ছাড়া আর কিছু নয়। সমকামের প্রতি অহেতুক ঘৃণা-বিদ্বেষ তৈরিতেও অনেক ধর্মের বিশাল ভূমিকা আছে। কিন্তু ধর্মে কিছু আছে বলেই সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে তা নয়। এমনকি  ধার্মিকেরাও তা করেন না।  ধর্মের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিলে এখনো বাইবেলের কথা মত সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরতো, দাসত্বপ্রথা বিলোপ হত না, সতীদের পুড়িয়ে মারা হত কিংবা নারীদের রাখা হত শস্যক্ষেত্র বানিয়ে।

সমকামী অধিকার সমর্থন করলে সবাই সমকামী প্রবণতাকে উৎসাহিত করা হবে বলে অনেক ধারণা করেন, এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

উত্তর: এটা একেবারেই ভুল ধারণা। আমরা সমকামীদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার এবং সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকার পাওয়ার কথা বলছি, সমকামিতা,বিষমকামিতা, উভকামিতা কোন কিছুতেই উৎসাহিত কিংবা নিরুৎসাহিত করা নয়। আর এখানে উৎসাহিত করারও তো কিছু নেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি জৈবিকভাবে অঙ্কুরিত, এবং সেটা তৈরি হয় অনেক ছোটবেলা থেকেই।  এদের অনেকেই ছোটবেলা থেকেই তারা বিপরীতধর্মী লোকজনের প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করতো না। এটা শুধু সমকামী নয়, বিষমকামীদের বেলাতেও সত্য। যে ছেলেটির মধ্যে সেই ছোটবেলা থেকেই বিপরীত-লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, তাকে তো কেউ চাইলেই সমকামী বানিয়ে দিতে পারে না। সেটার দরকারও নেই। এই সুন্দর পৃথিবীতে যে যার মত অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে সেটাই প্রত্যাশা হওয়া উচিৎ।  সমকামীরা দুনিয়াশুদ্ধ সবাইকে সমকামী বনে যেতে কখনোই বলেনি, তারা কেবল নিজের পার্টনারকে ভালবাসার এবং একসাথে থাকার অধিকার চাইছে। যখন কালো মানুষদের সমানাধিকার মেনে নেয়া হয়েছিল তখন সব সাদা চামড়ার মানুষেরা দল বেঁধে কালো হয়ে যায়নি। সাদারা সাদাদের জায়গায় আছে, কালোরা কালোদের জায়গায়। কেবল তাদের আইনি এবং সামাজিক অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্বজুড়ে।  এই যে বাংলাদেশে ‘হিজড়া’র তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তা বলে কি নারী-পুরুষ সবাই দল বেঁধে ‘হিজড়া’ হয়ে যাচ্ছে? না তা হচ্ছেনা। কাজেই, সমকামীদের অধিকার দেওয়া হলে সবাই সমকামী হওয়া শুরু করবে, কিংবা এর মাধ্যমে সমকামী প্রবণতাকে উৎসাহিত করা হবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই।

 

‘সমকামভীতি’ শব্দটাকে আপনি কিভাবে দেখেন? আসলেই কি মানুষ সমকামীদের ভয় করে নাকি উলটো ভয় দেখায় যার ফলশ্রুতিতে অনেকেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়?

উত্তর: আসলে ‘সমকামভীতি’ বা ‘হোমোফোবিয়া’কে আমি যেভাবে দেখি তা হল, সমকামীদের প্রতি সুপরিকল্পিত উপায়ে এবং সাংগঠনিক ভাবে ঘৃণা ছড়ানোর প্রবণতাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের একটা অংশ সমকামিতাকে দেখতে চেয়েছে  মনোবিকার, মনোবৈকল্য বা বিকৃতি হিসেবে।  সমকামীদের অচ্ছুৎ বানিয়ে এদের সংস্রব থেকে দূরে থাকার প্রবণতা অনেক দেশেই আছে। শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার তো আছেই, কখনো এদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে আত্মহননের পথে। কখনো বা স্রেফ সমকামী হবার কারণে করা হয়েছে হত্যা। আর এগুলোতে পুরোমাত্রায় ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে ধর্মীয় সংগঠন এবং রক্ষণশীল সমাজ।  কখনো বা রাষ্ট্র স্বয়ং। হ্যাঁ, এখানে সমকামীদের ভয় করার ব্যাপারটা যতটা না আছে,  তার চেয়ে বেশি আছে সাংগঠনিক-ভাবে ভয় দেখিয়ে  তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা।

 

সামাজিক পরিবর্তনের চেষ্টা আগে হওয়া উচিৎ, নাকি  আইনগত দিকেও এখন চোখ ফেরানোর সময় এসেছে?

উত্তর: আমার মতে এ দুটো ব্যাপার ‘মিচুয়ালি এক্সক্লুসিভ’ কিছু নয়; বরং একসাথেই চলতে পারে। মন মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি, সভা সেমিনার করা যেমন প্রয়োজন,  তেমনি প্রয়োজন মান্ধাতার আমলের আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার মত সাহসী মানুষের।  অনেকেই হয়ত জানেন, বাংলাদেশের দেশের সংবিধানের পেনাল কোড ৩৭৭ নং সেকশনে  সমকামিতাকে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনতা’ হিসেবে অভিহিত করে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা আসলে দেড়শ বছর আগেকার ব্রিটিশ আমলের আইন (খোদ ব্রিটেনেই তা বাতিল হয়ে গেছে বহু আগে)। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার হিজড়া বলে কথিত উভলিঙ্গ মানবদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।  আমি আশা করব সমকামীদের অধিকারের ব্যাপারেও সরকার এখন চিন্তা করবেন, কারণ, এই পেনাল কোডের ৩৭৭ নং অনুচ্ছেদটি সংবিধানের মূলনীতি – ‘সকল নাগরিকের জন্য সমানাধিকার’ (Part II Article 19)  এবং ‘সকল নাগরিকের জন্য সমান আইন’ (Part III Article 27)-এর পরিষ্কার লঙ্ঘন। শুধু তাই নয় আজকের পৃথিবীর বিশ্বমানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি চরম অন্যায়। বাংলাদেশকে মানবাধিকারের প্রতি সংবেদনশীল আধুনিক একটি দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে আন্তর্জাতিক  আইনকানুন এবং রীতি নীতির প্রতি উদাসীন হয়ে থাকলে চলবে না।

 

কোন পরিবর্তন কি আশা করছেন বাংলাদেশে?

উত্তর: আমি আশাবাদী। একটা সময় রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনার কোন প্রেক্ষাপটই ছিল না। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। ফেসবুক, ব্লগ কিংবা টুইটারে মানুষ আলোচনা করছে। রাষ্ট্র চাইলেও সবার কণ্ঠরোধ করতে পারছে না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মেইনস্ট্রিম পত্রিকাগুলোর কয়েকটি এ ব্যাপারে লেখা ছাপাতে আগ্রহী হচ্ছেন, সেটাও দেখছি। সে লেখাগুলো দ্রুতগতিতে পাঠকদের হাতে পৌঁছেও যাচ্ছে।  আমি আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে  পরিস্থিতির অনেক উন্নয়ন হবে। সমকামীদের লুকিয়ে ছাপিয়ে থাকতে হবে না, হবে না অযাচিত আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে চলতে।

:line: