কথায় আছে গোল্ড ফিশ সেকেন্ড আগের স্মৃতি মনে রাখতে পারে না। এই থেকেই গোল্ড ফিশ মেমোরি নামক উপমাটির প্রচলন। আমাদের জাতির একই সমস্যা। আমরা গোল্ড ফিশ মেমোরিধারী জাতি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই আমাদের মস্তিষ্ক থেকে বিস্মৃত। আজ তেমনই এক ঘটনার কথা বলব। এই তো খুব বেশিদিন আগের না। ২৫ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু আমি নিশ্চিত অনেকেই ভুলে গিয়েছে সেই ঘটনা। সেই বিস্মৃত ঘটনা ইতিহাসের ধুলোঢাকা খাতা থেকে আবার তুলে আনছি আপনাদের সামনে।

 

এক

১৯৮৮ সালের ৭ই জুন বাংলাদেশের সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাশ হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের স্বীকৃতি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা ছিল এরশাদের একটি রাজনৈতিক চাল। দেশের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এক ধরণের খুশি করে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় থেকে এরশাদ এ কাজটি করেছিল। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যখন ছিল না তখনও মুসলিমদের ধর্ম পালন করতে কোন অসুবিধা হয় নি। এটি ছিল শুধুমাত্র একটি হীন রাজনৈতিক পদক্ষেপ।

আর শুরু হল বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন। যদিও আগে থেকেই নির্যাতন হচ্ছিল রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম  ঘোষণা করায় হিন্দুদের উপর হামলার লাইসেন্স যেন দিয়ে দেওয়া হয়।

১৯৮৯ সালের জানুয়ারির দিকে ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে খবর আসতে থাকে যে বাংলাদেশ থেকে হাজারে হাজারে হিন্দু মুসলিমদের হামলার শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছে। ১৮ জানুয়ারি পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীও শিকার করেন বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর ঢল বেড়ে গিয়েছে এবং তাদের বেশিরভাগই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার শিকার।

ভারতীয় মিডিয়া বাগেরহাট থেকে জমিজমা আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফেলে ভারতে চলে আসা শৈলেন্দ্র রায়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে। রায় বলেন, “বাংলাদেশে হিন্দুদের কোন নিরাপত্তা নেই। উগ্র ইসলামী দলগুলো হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে।” মাতৃভূমিতে সফল আইন ব্যবসায়ী চিত্তরঞ্জন মেধা চলে আসেন ভারতে। তার মতে এরশাদ সরকারের পুলিশ হিন্দুদের ক্রমাগত হয়রানি করছে। হিন্দুদের জমিজমা অর্পিত সম্পত্তি আইনের মত কালো আইনের মাধ্যমে সরকার যেকোনো সময় দখল করে নিচ্ছিল তখন। আর হিন্দুরা তাদের পূর্বপুরুষের ভিটা হারিয়ে নিরাপত্তার জন্য চলে আসছে ভারতে।

এমনই একজন খগেন্দ্র নাথ রায়। বাংলাদেশ তার জন্মভূমি। কিন্তু নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি ধর্মীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে। তিনি বলেন, “কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। হিন্দু নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। আমার বাড়িঘর দখল করে নেওয়া হয়েছে। আমার ভারতে চলে আসা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।”

অশ্বিনী কুমার রায় বলেন এরশাদ সরকার হিন্দু যুবকদের কারণ ছাড়া গ্রেপ্তার করছে। মাগুরায় নিজের জমি ছেড়ে চলে আসেন ভারতে এই গরীব কৃষক। তার সাথে চলে আসেন তার স্ত্রী এবং ছয় সন্তান।
হিন্দুদের এই গণদেশান্তরের ফলে তখন অনেকের কপাল খুলে যায়। ১৯৮৯ সালে দালালরা ১৯.২৫ ডলার সমপরিমাণ টাকা নিয়ে একেকজনকে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশে সহায়তা করে। অতিরিক্ত মালামাল বহনের জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। রাতের আঁধারে শরণার্থীদের ভারতে যেতে হত। ১৯৭১ সালে তারা পাক হানাদেরদের হাত থেকে পালাতে এই কাজ করেছে, ১৯৮৯ সাল দেখল নিজের দেশের সংখ্যাগুরুদের হাত থেকে বাঁচতে তারা এই কাজ করল।

বাংলাদেশ সরকার স্বভাবতই হিন্দুদের উপর নির্যাতনের কথা অস্বীকার করল এবং একে মিডিয়ার অপপ্রচার বলল।

১১ নভেম্বর ১৯৮৯, সংবাদ সংস্থা এপির রিপোর্ট

হিন্দু,বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ  নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু হিন্দুদের রক্ষায় তারা কোন কাজই করতে পারে নাই। বাংলাদেশী হিন্দুদের উপর এই অব্যাহত নির্যাতনের বিষয়টি বিশ্বমঞ্চে উপেক্ষিত রইল। ১৬ লক্ষ ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় বিশ্ব জাগ্রত কিন্তু প্রায় ২ কোটি বাংলাদেশী হিন্দুর কষ্ট হয়ে যায় নীরবে। বাংলাদেশে ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৮ ভাগ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের অব্যবহিত পরে তা শতকরা ২২ ভাগে এসে দাঁড়ায়। এরপর থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার এবং নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় দেশটিতে ক্রমশ হিন্দুদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৬১ সালে ১৮.৫%, ১৯৭৪ সালে কমে দাঁড়ায় ১৩.৫%, ১৯৮১ সালে ১২.১%, এবং ১৯৯১ সালে ১০% এ এসে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে হিন্দুদের শতকরা হার কমে ৮ ভগের নিচে নেমে এসেছে বলে অনুমিত হয়। এত বড় জাতিগত নির্মূলকরণের পরও তথাকথিত অসাম্প্রদায়িকতার বয়ান সত্যই হাস্যকর।

দুই

ভারতের অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের জায়গায় রামমন্দিরের শিলান্যাস ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে ইসলামিক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ২৯ অক্টোবর, ১৯৮৯ থেকে বাংলাদেশ জুড়ে তাণ্ডবলীলা শুরু করে। এই শ্রেষ্ঠত্ববাদী গোষ্ঠী বহু জায়গার হিন্দু বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রমণ করে পুড়িয়ে দেয়; বহু হিন্দু আহত হয়, কিছু সংখ্যক মারাও যায়। হিন্দু মন্দির এবং আশ্রমগুলোর ওপর ছিলো তাদের বিশেষ নজর। ৯ এবং ১০ নভেম্বর, ১৯৮৯ এই উন্মত্ততা চরম আকার ধারণ করে। অসংখ্য মন্দির ভেঙ্গে বা পুড়িয়ে দেয়া হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরো অনেক। দেব-দেবীর প্রতিমাতে ভাঙচুর চলে, সেগুলো ছুড়ে ফেলা হয় মন্দিরের বাইরে। পুরোহিতেরা মারধরের শিকার হন। পদক্ষেপহীন ২টি সপ্তাহ কাটাবার পর বাংলাদেশ সরকার অবশেষে এই হামলা বন্ধের তাগিদ অনুভব করে। বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে সরকার এক ডজন মন্দিরের মেরামতেরও ঘোষণা দেয়। নিচের তালিকাটি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ, ৫৩ তেজতুরি বাজার, ঢাকা, বাংলাদেশের প্রকাশনার সাহায্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে এটি একটি আংশিক তালিকা মাত্র।

 

নরসিংদীঃ
নভেম্বর, ১৯৮৯
১। মুসলিমদের হামলায় রায়পুর উপজিলার শ্রীরামপুর বাজারে মিলন কালী মন্দিরে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।

২। রায়পুর উপজিলার হাসিমপুর গ্রামে হিন্দু বাড়িগুলোতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে স্থানীয় মুসলিমরা।

১১নভেম্বর, ১৯৮৯
১।৪০০ বছরের পুরাতন ঐতিহাসিক চিনিশপুর কালী মন্দিরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালানো হয়।

২। ব্রাহ্মন্ডীতে শিব মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

৩। ভেলানগরের কালী মন্দিরে এবং বাজারের হিন্দু মালিকানাধীন দোকানগুলোতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

৫। নরসিংদী শহরের ভাগবত আশ্রমে লুটপাট চালানো হয়।

৬। উগ্র মুসলিমদের হাতে নরসিংদী শহরের কালী মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

টাঙ্গাইল:
১। ১০ এবং ১১ নভেম্বর, ১৯৮৯ এ টাঙ্গাইল শহরে বেশকিছু মন্দির আক্রান্ত হয় এবং তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বহু দোকানে লুটপাট চলে।

২। টাঙ্গাইলের নিকটবর্তী বাজিতপুর গ্রামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বহু সংখ্যক ঘরবাড়িতে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ চলে, মন্দির এবং বিগ্রহ ভেঙে ফেলা হয়।

৩। দেলদুয়ার উপজেলার অন্তর্গত পাকরাইল গ্রামের মন্দিরে আক্রমণের ঘটনা ঘটে, ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়।


৪। দেলদুয়ার ইউনিয়নের আরো বেশ কিছু গ্রামে মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করা হয়।


৫। টাঙ্গাইলের পাকুটিয়া গ্রামের একটি মন্দির আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়।


৬। বাজিতপুর গ্রামে ধর্মীয় সংখ্যালঘু তাঁতশিল্পীদের বাড়ি-বাড়ি আক্রমণ করে তাঁদের তাঁতযন্ত্র নষ্ট করে ফেলা হয়।

৭। টাঙ্গাইলের আকুয়া গ্রামে একটি মন্দির ধ্বংস করে এর ভিত্তি পর্যন্ত সরিয়ে ফেলা হয়।


৮। কালিঘাট গ্রামে একইরকম আরেকটি ঘটনা ঘটে।


৯। নভেম্বরের ১০ তারিখ বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ড্রাস্ট্রি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত মেঘনা টেক্সটাইল মিলস এর ডেপুটি চিফ মেডিকেল অফিসার বাবু দীনেশ চন্দ্র বসাক টঙ্গীতে মারা যান। মিল কর্তৃপক্ষ তাঁর মরদেহ সৎকারের উদ্দেশ্যে টাঙ্গাইল পাঠায়, কিন্তু সেখানে একদল দুষ্কৃতকারী মৃতদেহ বহনকারী গাড়িতে হামলা চালায়। তারা সৎকার পরিচালনাতেও বাধা প্রদান করে।

১৮ নভেম্বর ১৯৮৯, সংবাদ সংস্থা এপির রিপোর্ট


মৌলভীবাজার:


১। নভেম্বর ১০, ১৯৮৯ এ মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় রামকৃষ্ণ মিশন, মঙ্গলেশ্বরী কালীবাড়ি, দুর্গা বাড়ি, জগন্নাথ দেবের আখড়া, কালাচাঁদ মন্দিরসহ আরো বেশকিছু মন্দিরে আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ঐ সময় শ্রীমঙ্গল শহরের কোনো মন্দিরই রক্ষা পায়নি এই উন্মত্ততা থেকে।

২। একই দিনে মৌলভীবাজার শহরের রামকৃষ্ণ মিশনে আক্রমণ করে তা পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়।


৩। ঐ দিনই শ্রীমঙ্গল উপজেলার বেশকিছু হিন্দু বাড়ি এবং দোকানে হামলা হয়, ভাংচুর এবং লুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই ঘটে।


নওগাঁ:


১। ১০ নভেম্বর, ১৯৮৯ এ নওগাঁ শহরের বেশকিছু মন্দির আক্রান্ত হয়ে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।


২। শহরের কাছাকাছি হিন্দু গ্রামগুলোতে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বহু গ্রামবাসী প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়।


সিরাজগঞ্জ:


১১ নভেম্বর, ১৯৮৯ এর সন্ধ্যাবেলা রাইগড় উপজেলার চানাইকোনার এক মসজিদ থেকে এক বিশাল মিছিল বের হয়ে আসে। তারা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী শ্লোগান দিতে দিতে কাছাকাছি অবস্থিত দোকাম-পাট এবং বাসাবাড়িতে হামলা চালায়।


রংপুর:


১। ১০ নভেম্বর, ১৯৮৯, শুক্রবার বিকেল ৪টায় রংপুর শহরের এক মিছিল থেকে উত্তেজনাময় শ্লোগান দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে হামলা চালানো হয়।


২। একই দিনে বিখ্যাত রংপুর ধর্মসভা ভবন আক্রান্ত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।


৩। রংপুরের মূল কালী মন্দির – শ্রী শ্রী করুণাময়ী কালীবাড়ি হামলার শিকার হয়।


৪। কলেজ রোডের শ্রী শ্রী আনন্দময়ী আশ্রমে হামলা হয় এবং তা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

নেত্রকোনা:


নেত্রকোনা শহরের বড় বাজারস্থ কালী মন্দিরে হামলা হয়। সেখানে লুটতরাজ, ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।


মাগুরা:


৬ নভেম্বর, ১৯৮৯ তে মাগুরা সদর উপজেলার বাগিয়া ইউনিয়নের বাগিয়া ঠাকুর বাড়ির জগধাত্রী মন্দিরে পূজা চলাকালীন অস্ত্রধারীদের আক্রমণের ঘটনা ঘটে। রণজিৎ রায় এবং জগদীশ রায় মারা যান, প্রতিমা ভেঙে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়। গুরুতর আহত সমর রায় কে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।


বরিশাল:


১। নভেম্বরের ১৫ তারিখ বরিশাল শহরের চন্দন নগর পাড়ার মন্দিরটিতে হামলা ও ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।


২। নভেম্বরের ২ তারিখ উজিরপুর উপজেলার ধামুরা গ্রামের একটি কালী মন্দিরে হাজী মোবাশ্বের উদ্দীনের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র লোক হামলা চালায়। দেবীর প্রতিমা ভেঙে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় এবং মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

.
৩। নভেম্বর ১৭ তে বি. এম. কলেজের হিন্দু হোস্টেল আক্রান্ত হয়। কোনোরূপ বাছ-বিচার ছাড়াই শিক্ষার্থীদের মারধর করে হোস্টেল ছাড়তে বাধ্য করা হয়।


৪। নভেম্বরের ১৩ তারিখ সদর বেতাগী উপজেলায় মন্দির ভাংচুর এবং হিন্দু দোকান লুটের ঘটনা ঘটে। আগৈলঝরায় কালী মন্দির ধ্বংস করে দেবীর প্রতিমা সরিয়ে ফেলা হয়।


চট্টগ্রাম:


১। নভেম্বরের ১০ তারিখ চট্টগ্রাম শহরে মিছিল থেকে সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দেয়া হয়।


২। রাউজান উপজেলার জগতপুর আশ্রমে হামলা হয়।


৩। ঐতিহাসিক কৈবল্যধাম আশ্রমেও হামলা হয়।


৪। পটিয়া উপজেলার সাধনপুর এবং লঙ্কারচর গ্রামের প্রায় ২৫টি মন্দিরে হামলা করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, প্রতিমা ভাংচুর করা হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু ঘরবাড়ি এবং দোকান-পাটে লুটপাট চালানো হয়।


৫। রাউজান উপজেলার উত্তর সত্য ও ফতেহ নগর এবং ফটিকচর উপজেলার নানুপুর, বাদতাপুর, রসং গিরি ও আজাদী বাজার গ্রামের বেশ কিছু সংখ্যক মন্দির আক্রান্ত হয়।


৬। অক্টোবরের ২৯ এবং ৩১ তারিখে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উপর অবস্থিত পটিয়া উপজেলার উনাইনগর গ্রামে বাস থামিয়ে বৌদ্ধ এবং হিন্দু যাত্রীদের মারধর করা হয়। অনেক বৌদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধের প্রতিমা ভাংচুর করা হয়।


৭। রাউজান উপজেলার গুজরা গ্রামে অক্টোবরের ২৯ ও নভেম্বরের ৯ তারিখে জলকুমারী হাউস, রাধা-গোবিন্দ আশ্রম এবং অন্যান্য মন্দিরে হামলা ও বারংবার অগ্নিসংযোগ করা হয়।

৮। বাঁশখালী উপজেলায় কালী মন্দিরে হামলা হয়।


৯। নভেম্বরের ১০ তারিখ পতেঙ্গা কাঠঘাট এলাকার বহু হিন্দু পরিবার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। সন্দ্বীপ শহরের জগন্নাথ বাড়ি, কালী বাড়ি এবং চার-আনি সিদ্ধেশ্বরী কালী বাড়ির দেবপ্রতিমা ভাংচুর করা হয়।


কক্সবাজার:


কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলার বহু সংখ্যক মন্দির আক্রান্ত হয়।


নোয়াখালী:


হাতিয়া শহরে বেশ কিছু মন্দিরে হামলা হয়। বেগমগঞ্জ উপজেলায় বাজারের হরি মন্দির ধ্বংস করে দেয়া হয়।


জামালপুর:


জামালপুর শহরের বসাকপাড়ার মন্দির ধ্বংস করে দেয়া হয়।


চাঁদপুর:


নভেম্বরের ১০ তারিখ চাঁদপুর শহরের পুরানা বাজার এলাকায় বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়, শহরের উপকণ্ঠের অসংখ্য মন্দিরে হামলা চালানো হয়। হবিগঞ্জের রাজা লক্ষী-নারায়ণের মন্দির ধ্বংস করে দেয়া হয়।


নীলফামারী:


সৈয়দপুর এলাকায় বহু মন্দির আক্রান্ত হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।


ঝালকাঠি:


১। নভেম্বর ৯এ ঝালকাঠি শহরের প্রায় সকল মন্দির এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাসা ও দোকানে হামলা চলে।


২। চারণ কবি নামে খ্যাত মুকুন্দ দাসের বসতবাড়ি ও মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়।


নারায়ণগঞ্জ:


নভেম্বরের ১০ তারিখ রামকৃষ্ণ মিশন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন বেশ কিছু দোকানে হামলা হয়।


ঢাকা:


ধামরাই এবং সাভারে মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। নভেম্বরের ১০ তারিখের রাতে ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশন আক্রান্ত হয়। ডেমরায় এক প্রাচীন শ্মশান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লালবাগ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন বেলতলী ঋষি পাড়ায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট এবং ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।


লক্ষীপুর:


১৯৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর রাইনগাতি উপজেলার চর বদর, চর আলেক্সান্ডার, চর আলগি এবং হাজারীহাট ইউনিয়নের কম-বেশি ৩৬টি বাড়ি, দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। নারীরা ধর্ষিত ও নির্যাতিত হন। রামঠাকুরের মন্দির ও বুড়াকর্তার আশ্রমসহ ১১টি মন্দির অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করে দেয়া হয়।


সুনামগঞ্জ:

 

ছাতকে অবস্থিত ঐতিহাসিক মহাপ্রভুর আখড়ায় হামলা হয়। মহাপ্রভুর প্রতিমা ভেঙে ফেলা হয়।


খুলনা:


নভেম্বর ১৭, ১৯৮৯ এ খুলনা শহরের ধর্মসভা মন্দির, কয়লাঘাট কালী বাড়ি, বড়বাজার কালী বাড়ি সহ আরো অনেক মন্দিরে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। বড়বাজার এবং পিকচার প্যালেসের কোনাটিতে অবস্থিত হিন্দু মালিকানাধীন সকল দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুঠতরাজ চলে। হিন্দু অধ্যুষিত তুঁতপাড়া, বনিয়াখামার এবং বানরগতিতে সশস্ত্র হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়।


বাগেরহাট:


১৭ নভেম্বর, ১৯৮৯ তারিখে বাগেরহাটে সম্পূর্ণ রামকৃষ্ণ মিশন জুড়ে (হরি মন্দির সহ) হামলা হয়। অবকাঠামো এবং রামকৃষ্ণ দেবের প্রতিমাতে ভাংচুর করা হয়। এছাড়াও ফতেহপুর কালীবাড়ি, বেমতা কালী মন্দির, গিলেতলা হরি মন্দির ও কালী মন্দির, করপাড়া কালী মন্দির এবং পাতারপাড়া কালী মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। একটি বিখ্যাত শিবলিঙ্গ লুট করা হয়।

ময়মংসিংহঃ

মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি এলাকায় হিন্দুদের বাড়িতে প্রতিবেশী মুসলিমরা হামলা চালিয়ে লুটপাট করে।

ফেণীঃ

১। ৯ নভেম্বর ছাগলনাইয়া উপজিলার রাধানগর ইউনিয়ন এবং ১৪ নভেম্বর ধালিয়া ইউনিয়নের মন্দিরগুলোতে হামলা হয়।

২। দাগনভূঁইয়া উপজিলার হীরাপুরে কালীমন্দিরে ভাঙচুর হয়।

৩। সোনাগাছি উপজিলার চরসোনাপুর গ্রামে ১২ নভেম্বর হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মুসলিম জনতা। দেশেরহাট এবং সেমেরখিলের হিন্দু মন্দিরগুলোকেও একইভাবে গুঁড়িয়ে দেয় তারা।

 

৪। দৌলতপুর গ্রামে কালীমন্দির ভাঙচুর হয়।

৫। ছাগলনাইয়ার দক্ষিণেশ্বরীর মন্দিরে ভাঙচুর হয়।

ভোলাঃ ১৭ নভেম্বর ভোলা শহরে হিন্দুদের বাড়িঘর এবং মন্দিরে হামলা চালানো হয়। হিন্দুদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করা হয়।

 

কুমিল্লাঃ
১। ১১ নভেম্বর মুরাদপুরের একটি মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। রামগঞ্জ গ্রামে একই ঘটনা ঘটে।

২। একই দিনে কুমিল্লা শহরে রামঠাকুরের ভক্তদের উপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে মুসলিমরা।

৩। পরেরদিনে গহিনখালী গ্রামে কালী মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয় মুসলিমরা। রামচন্দ্রপুরবাজারের মুরাদনগর উপজিলায় একটি মন্দির সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াঃ নবীনগর উপজিলার শ্যামগ্রাম এবং শ্রীগ্রারনে কয়েকটি মন্দির ভেঙ্গে ফেলে মুসলিমরা।

মাদারীপুরঃ ১১ নভেম্বর শহরের পুরানবাজারে হিন্দু বিরোধী মিছিল থেকে হরি মন্দিরে হামলা চালানো হয়।

মুন্সিগঞ্জঃ বালিগঞ্জের কালী মন্দিরে হামলা চালানো হয়।

মানিকগঞ্জঃ সাতুরিয়া সদর এবং বুরিয়ারা গ্রামে হিন্দু মন্দিরে হামলা চালানো হয়।


হবিগঞ্জ এবং পাবনাতে হিন্দুদের মন্দির, বাড়িঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট চালানো হয়।

তিন

বাংলাদেশী হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনাগুলোর কথা উঠলেই কেউ কেউ বাবরী মসজিদের ঘটনার কথা টানেন। এক বাবরী মসজিদের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে কত হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয়েছে তার হিসাব করা যাবে না।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা মিডিয়ার কল্যাণে প্রতিবছর হাইলাইট হয় কিন্তু সেই ঘটনার আগে পরে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর যে পরিমাণ নির্যাতন হয়েছে তার কথা কৌশলে আড়াল করে দেয় এই উপমহাদেশের মিডিয়া।

আজ যারা বলে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের পর এই দেশের হিন্দুদের উপর কোন নির্যাতনই হয় নাই সেই ডাহা মিথ্যুকরা কি ভুলে গেছে ঐ এক মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯২, ১৯৯৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলে। আজ ২০০১ এর ঘটনাকেও অস্বীকার করা হয়। এক সময় ২০১২ এর রামু, হাটহাজারী, চিরিরবন্দর, ২০১৩ এর সাইদির রায় পরবর্তী সহিংসতা কিংবা ২০১৪ এর মালোপাড়া বা কর্নাই এর ঘটনাগুলোকেও ১০ বছর পর অস্বীকার করা হবে।

একটি অন্যায় দিয়ে আরেকটি অন্যায়কে কখনও জাস্টিফাই করা যায় না। কিংবা বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনাকে অস্বীকার করলেই তা মিথ্যা হয়ে যায় না। সত্য নিজের আলোতেই উদ্ভাসিত হয়।

কৃতজ্ঞতাঃ
১। Empire’s Last Casualty: Indian Subcontinent’s vanishing Hindu and other Minorities.  By Dr. Sachi Ghosh Dastidar.
২। http://www.mayerdak.com/root/destruction89.htm
৩।  Prolonged Partition and Its Pogroms: Testimonies on Violence Against Hindus in East Bengal 1946-64 [A. J Kamra, A.J. Kamra]