.

প্রবল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছেন তিনি।

যেটা শুনছেন, সেটা এতোই অবিশ্বাস্য যে হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো গতিই নেই। ঠিকমতো শুনেছেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ জাগা শুরু হয়েছে তাঁর মনে। সারা গা বেয়ে রাগের একটা তপ্ত স্রোত বয়ে যাওয়া শুরু হলো তাঁর।

‘কী বলছিলে, আবার বলো।’ সামনের দিকে ঝুঁকে এসে রাগী গলায় বলেন তিনি।

তাঁর ভয়ানক রাগ দেখে আরো কাঁচুমাচু হয়ে গেলো ছাগ-রক্ষক। সংকুচিত হয়ে মিশে যেতে চাইছে মাটির সাথে। দুই হাত পিছনে নিয়ে কচলাচ্ছে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।

‘কই, কথা বলছো না কেন?’ হুংকার দিয়ে উঠলেন তিনি।

হুংকার শুনে কেঁপে উঠলো ছাগ-রক্ষক। কথা বলতে গিয়ে তোতলাচ্ছে সে।

‘জ-জ-জমিদার স-স-সন্তোষ রায় আপনার একটা ছাগল কেড়ে নিয়ে গেছে হুজুর।’

‘সন্তোষ রায় তো বন্দী। সে কী করে আমার ছাগল কেড়ে নেবে আহাম্মক?’ গর্জন করে ওঠেন তিনি।

‘তিনি নিজে নেন নি। তাঁর হুকুমে চাকরেরা কেড়ে নিয়ে গেছে। হুজুর মা-বাপ, আমার কোনো দোষ নেই। আমি বাধা দিয়েছিলাম। ওরা আমাকে মেরে ধরে ছাগলটাকে নিয়ে গেছে।’ হড়বড় করে কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে ছাগ-রক্ষক। তাকে যে সত্যিই সন্তোষ রায়ের চাকরেরা মেরেছে, সেই মারের দাগ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

ছাগ-রক্ষকের দিকে বিন্দুমাত্র নজর নেই আলীবর্দী খানের। চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে মাথার ভিতরে। তাঁর রাজপ্রাসাদের পাশে, তাঁর বন্দী হয়ে, তাঁরই ছাগ-পাল থেকে ছাগল কেড়ে নিয়ে যাবার দুঃসাহস সন্তোষ রায়ের হয় কী করে?

এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন।

২. 

গত কিছুদিন ধরে মারাঠা দস্যুদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত আছেন তিনি। বাংলায় এরা রীতিমত ত্রাস সৃষ্টি করে ফেলেছে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে তারা। লুট-তরাজ, হত্যা-ধর্ষণ, হেন কোনো কাজ নেই যা করছে না এই মারাঠগুলো। এতো দিন শুধু ইংরেজদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। এই বদমায়েশ বণিকগুলোর মতিগতি মোটেও সুবিধার ঠেকে নি তাঁর কাছে। ব্যবসায়ী লোকজন ব্যবসা করবে, তা না এরা সারাক্ষণ নানা ফন্দি ফিকিরে ব্যস্ত। শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ছে, দুর্গ বানাচ্ছে। এগুলো তাঁর কাছে খুবই অস্বস্তিকর মনে হয়েছে। ইংরেজদের বাড় যাতে না বাড়ে, সেদিকেই তিনি মনোযোগ দিচ্ছিলেন বেশি।

এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে মারাঠা দস্যুরা। অতর্কিতে আক্রমণে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে তাঁকে। লড়াই করেছিলেন তিনি। কিন্তু, শেষমেষ টের পেলেন যে, এই যুদ্ধে তিনি জিতবেন না। মারাঠিদের সাথে শক্তিক্ষয়ে মূল লাভবান হবে শকুনের মতো ওৎ পেতে থাকা ইংরেজরা। এটা বুঝতে পেরেই চৌথ দেবার বিনিময়ে মারাঠা দস্যুদের সাথে সন্ধি করলেন তিনি। চৌথ মানে একরাশ টাকা। এমনিতেই মুর্শিদাবাদের ধনাগার প্রায় শূন্য হতে চলেছে। নানাবিধ অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ আর অপব্যয়ে ধনাগারের করুণ দশা। এর মাঝে আবার মারাঠিদের হাতে তুলে দিতে হবে প্রচুর টাকা। রাজকোষ প্রায় নিঃশেষিত।

রাজকোষকে চাঙ্গা করতে সহজ কাজটা ধরলেন তিনি। বকেয়া খাজনা আদায়ে মন দিলেন। জমিদার আর অধীনস্ত রাজা-রাজড়াদের উপরে চাপালেন করের ভার। এ বোঝা বহন করতে যাঁরা অস্বীকৃতি জানালেন, তাঁদের উপরে কোপ দৃষ্টি ফেললেন তিনি। ভয়-ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে যতো ধরণের চাপ দেওয়া যায় সব দেওয়া শুরু করলেন তিনি। বেয়াড়া দুই একজনকে বন্দীও করতে হলো কর আদায়ের প্রয়োজনে। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং অন্যজন হচ্ছেন জমিদার সন্তোষ রায়।

এঁদেরকে বন্দী করা হলেও, যথাযথ মর্যাদায় রাখা হলো মুর্শিদাবাদে। ফাই-ফরমায়েশ খাটার জন্য দেওয়া হলো চাকর-বাকর, পাক-সাকের জন্য পাচক। নবাবের ভাঁড়ার থেকে প্রতিদিন আসতো খাদ্য দ্রব্য। পাচক সেগুলি দিয়ে রান্না করে দিতো।

বন্দী হলেও খুব একটা খারাপ অবস্থায় তাঁরা ছিলেন না।

৩.

দরবার থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক সেই মুহুর্তেই প্রধান উজির থামালেন তাঁকে।

‘হুজুর, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আপনাকে তাঁর জমিদারী ঘুরিয়ে দেখাতে চান।’

‘কেনো?’ ভ্রু কুঁচকে তিনি বলেন।

‘তাঁর ধারণা আপনি তাঁর জমিদারী দেখলে নাকি বুঝতে পারবেন কেনো তিনি খাজনা দিতে অপারগ।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কাল বিকেলে আমি তাঁকে নিয়ে বের হবো। বজরা তৈরি করেন।’

 

দক্ষিণ গঙ্গা দিয়ে বজরা ভেসে চলেছে। ডেকের উপরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার দু’পাশের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছেন আলীবর্দী খান। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। পাশে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।

গঙ্গার দু’পাশ জুড়ে ঘন অরণ্য, গহীন জঙ্গল। সেদিকে আঙুল তুলে রাজা বললেন,

‘এটাই আমার জমিদারী নবার বাহাদুর।’

জঙ্গলের ভিতর থেকে বাঘের ডাক ভেসে আসে ক্ষণে ক্ষণে।

‘ও কীসের ডাক? কারা ডাকছে এমন ভয়ংকর গলায়?’ নবাব শুধান।

‘হুজুর, ওরা আমার প্রজা। আপনাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে।’ রাজা বলেন।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রসিকতায় মুচকি হাসেন আলীবর্দী খান।

‘তাই বুঝি?’  পরিহাসের সুরে তিনি বলেন।

‘জ্বী। এই প্রজাদের কাছ থেকে কেমন করে খাজনা আদায় করি বলেন তো?’

আলীবর্দী খাঁ গোঁফে তা দিতে দিতে হাসেন।

‘বুঝেছি। আপনি মুক্ত। বাড়ি যেতে পারেন যখন খুশি।’

.

‘আপনি নাকি আমার একটা পাঁঠা ছিনিয়ে এনেছেন?’ দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে আলীবর্দী খান বলেন।

সন্তোষ রায় কেনো তাঁর ছাগ-পাল থেকে ছাগল কেড়ে নিয়েছে, এই বিষয়টা মাথা থেকে নামাতে পারেন নি তিনি। সন্ধ্যে বেলাতেই হাজির হয়েছেন সন্তোষ রায়ের বন্দীখানায়। নামেই বন্দীখানা, আসলে অত্যন্ত খোলামেলা একটা বড়সড় বাড়ি। খাজনা দেয় নি বলে আটকে রেখেছেন, ব্যক্তিগত কোনো রেষারেষি তাঁদের নেই। কাজেই, সন্তোষ রায়ের যাতে কোনো অসম্মান না হয়, কষ্ট না হয়, সেদিকে যথেষ্ট পরিমাণে খেয়াল রেখেছেন আলীবর্দী।

সন্তোষ রায় বিশালদেহী, বিশাল বপুর লোক। আলীবর্দীকে দেখেই ঘাবড়ে গেছেন খুব। দরদর করে ঘামছেন  তিনি।

‘হ্যাঁ।’ মাটির দিকে তাকিয়ে সরল স্বীকারোক্তি করেন তিনি।

দাঁড়িতে হাত বুলানো থেমে যায় আলীবর্দী খানের।

‘হঠাৎ করে ছিনতাই, রাহাজানি, লুটতরাজে নামলেন যে? ঘটনা কী? এরকম বদ অভ্যাসতো আপনার কখনো ছিলো না। ভালো মানুষ বলেইতো জানতাম আপনাকে।’

সন্তোষ রায় কোনো উত্তর দেন না। মাটির দিকে তাকিয়ে নীরব থাকেন তিনি।

‘পাঁঠা চুরি করে কী করেছেন? বাজারে বিক্রি? আপনার টাকার প্রয়োজন ছিলো আমাকে বললেই হতো। পাঠিয়ে দিতাম। এই সব চুরি চোট্টামির দরকার ছিলো না।’

‘টাকার দরকার ছিলো না। বিক্রি করি নাই।’ বিড়বিড় করে সন্তোষ রায় বলেন।

‘তাহলে? কী করেছেন পাঁঠা চুরি করে তবে?’  অবাক হয়ে তিনি বলেন।

‘খেয়ে ছি হুজুর।’

‘খেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, হুজুর।’

আলীবর্দী শীতল চোখে তাকিয়ে থাকেন সন্তোষ রায়ের দিকে। এই খুনে চোখকে ভয় পায় না, এমন লোক বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাতে কেউ নেই।

‘আমার রাজভাণ্ডার থেকে প্রতিদিন আপনাকে খাবার পাঠানো হয়। আপনি ভোজন রসিক মানুষ। সেকারণে আপনার জন্য আমার বিশেষ বরাদ্দের হুকুম দেওয়া আছে। তারপরেও আপনার আমার পাঁঠা ধরে খেতে হয়?’

আলীবর্দীর ভৎর্সনায় কুঁকড়ে যান সন্তোষ রায়।

‘আপনার পাঠানো খাবারে পেট ভরে না। তাই একাজ করেছি।’

‘তাই বুঝি?’ ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি খেলে যায় আলীবর্দীর।

‘আজ আপনার এখানেই রাতের খাবার খাবো আমি। আপনার পাচককে বলেন পাঁঠার মাংস গরম দিতে। দেখি কেমন স্বাদ হয়েছে পাঁঠার মাংসের।’

‘পাঁঠার মাংস যে  আর নেই হুজুর।’ কুণ্ঠিত স্বরে সন্তোষ রায় বলেন।

‘নেই মানে? একবেলাতেই একটা আস্ত পাঁঠার মাংস শেষ হয়ে যায় কীভাবে? মেহমানদারীতে কার্পণ্য তো ভালো কথা নয় রায় মশাই।’

গলা খাকারি দেয় সন্তোষ রায়। তারপর পেটের উপরে একবার হাত বুলিয়ে আনেন। গভীর পরিতৃপ্তি তাঁর চোখে মুখে।

‘পুরোটাই আমি খেয়ে ফেলেছি হুজুর।’

প্রবল বিস্ময়ে সন্তোষ রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।

‘পুরোটাই একা খেয়ে ফেলেছেন?  আস্ত একটা পাঁঠা?’

হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়েন সন্তোষ রায়।

‘বটে।’ কীসের ইশারা খেলে যায় আলীবর্দীর চোখে-মুখে। দাঁড়ি চুমড়ে নেন তিনি। তা দেন গোঁফে। তারপর কটমট করে তাকান সন্তোষ রায়ের দিকে।

‘ঠিক বলছেন তো? মিছে কথা হলে কিন্তু বিপদে পড়বেন আপনি।’

‘মিছে কথা নয় হুজুর। সত্যি বলছি। অবিশ্বাস হলে হুজুর আমাকে আরেকবার খাইয়ে দেখতে পারেন।’

সন্তোষ রায়ের চ্যালেঞ্জটা লুফে নেন আলীবর্দী খান।

‘কাল আপনি আমার সাথে রাজমহলে খাবেন। তখন দেখবো আপনার কথা সত্যি না মিথ্যা। মিথ্যা হলে আপনার পরিণতি কী হবে আশা করি বুঝতে পারছেন।’

.

সন্তোষ রায়ের জন্য বিরাট ফরাশ পাতা হয়েছে রাজমহলের খাবার ঘরে। দুই পা গুঁটিয়ে আয়েশ করে পদ্মাসনে বসেছেন তিনি। মুখে আনন্দের হাসি। সামনে বিরাট একটা পিতলের থালা আর জল খাবার জন্য পাত্র।

বিশাল এক পাঁঠাকে কেটেকুটে রেজালা রাঁধা হয়েছে। বাড়তি হিসাবে কচি একটা পাঁঠার রোস্টও করা হয়েছে।

সন্তোষ রায় আস্ত পাঁঠা খাবেন, এই খবর চাওড় হয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই। আলীবর্দীর অমাত্যবর্গের প্রায় সকলেই হাজির হয়েছেন এই মজাদার দৃশ্য দেখার জন্য। পর্দার অন্তপুর থেকে অন্তপুরবাসিনীরাও কৌতুহলী চোখে রেখেছে সন্তোষ রায়ের উপরে।

সন্তোষ রায়ের পাশেই একটা আরাম কেদারায় বসে আছেন আলীবর্দী খান। কোলের উপরে বসা আদরের নাতি সিরাজ। সেও আব্দার করেছে এই ঘটনা দেখবে বলে। নানার কোলে বসে বড় বড় চোখে করে সন্তোষ রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

রোস্ট-রেজালা আসছে। পরম পরিতৃপ্তির সাথে সন্তোষ রায় খাচ্ছেন। আহা! কতদিন এমন খাবার জোটে নি তাঁর। খাওয়া ছাড়া আর কোনো দিকেই তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। এতো এতো কৌতুহলী মানুষের দৃষ্টি যে তাঁর দিকে, সেই বিষয়েও বিন্দুমাত্র ভাবান্তর নেই তাঁর।

সকলের অবিশ্বাস্য দৃষ্টির সামনে পরিতৃপ্তির সাথে দুই পাঁঠা খেয়ে শেষ করলেন সন্তোষ রায়। না একটু ভাত, না এক টুকরো মাংস, কিছুই পড়ে রইলো না তাঁর পাতে। যা ছিলো সব চেটেপুটে খেয়ে নিলেন তিনি। তারপর তৃপ্তির একটা ঢেকুর তুললেন।

‘খানাপিনাতে আপনি তো দেখছি আপনার উত্তরপুরুষ আদিল মাহমুদকেও হার মানাবেন। সমরেশ দাসের কাছে শুনেছি সে নাকি এক বসায় আস্ত একটা কাঁঠাল শেষ করে দিতে পারে।’ আলীবর্দী খান তরল গলায় বলেন।

সন্তোষ রায় এ কথার কোনো উত্তর দেন না। পাচক পাতে রাজভোগ দিয়ে গেছে। তিনি তার দুটো এক সাথে গালে পুরে দিয়েছেন। চোখ মুদে তৃপ্তির সাথে চাবাচ্ছেন সেগুলো। খামোখা কথা বলে খাবার আনন্দ মাটি করার কোনো মানে হয় না।

ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে যায় আলীবর্দী খানের। আঙুল দিয়ে সিরাজের মাথার চুল এলোমেলো করে দিতে দিতে বলেন,

‘এমন যাঁর আহারের বাহার, তিনি যে আমার রাজস্ব বকেয়া রাখবেন, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। আপনার বাকি খাজনা মওকুব করে দিয়ে আপনাকেই এখনই ছেড়ে দিচ্ছি আমি। আপনার যাতে কখনো আহারে টানাটানি না পড়ে, তার জন্য আলাদা একটা মহল লিখে দিচ্ছি। এ হবে আপনার খোরাকি মহল।’

নবাব বাহাদুর দেরি করেন না। ডায়মণ্ড হারবারের কাছাকাছি আবজাখালী নামে একটা মহল ছিলো সেকালে। সেই মহলটি ব্রহ্মোত্তর হিসাবে সন্তোষ রায়কে দান করে দেওয়া হলো।

লোকের মুখে মুখে এই মহলের নাম হয়ে গেলো খোরাকি মহল।