টুইন টাওয়ার যখন ধ্বংস হওয়ার সময় পুরো পৃথিবীতে হীমশীতল অবস্থা নেমে এসেছিল। তারই পরিণতি ইরাকের ওপর মর্মান্তিক হামলা। মানুষ কি তাহলে কর্পরেটদের পুতুল হবে, শুধুই ব্যবসার লাভক্ষতির গুটি। জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে উঠে আসতে পারবে না। তাহলে অনুভব আর ভালোবাসার সেইসব মগ্ন দুপুর অার সকালের কি হবে? সন্ধ্যার মায়াবী আলোয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন ঘিরে ধরে। মানবজাতি এগোবে। বহুদূর। নক্ষত্রের পথে। আমিও তার অংশ….এটা একটা চিঠি হয়তো কারো কাছে অথবা নিজের কাছে লেখা
এদা
এই চিঠি যখন লিখছি তখন পৃথিবী আরেকটি বাঁকের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই বাঁক হয়তো নিয়ে যাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জগতে, যেখানে বেঁচে থাকার কোন কৌতুহল কাজ করে না, অথবা নতুন বোধের জন্ম দিয়ে হ্রদের মতো স্বচ্ছ পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে যেখান থেকে মানবিকতার ঢেউ নক্ষত্রের বেলাভূমিতে আছড়ে পড়বে। উপকথার নগরী বাগদাদ, বাসরাকে ওরা ধ্বংস করে ফেলেছে, যা হালাকুখানও পারে নি। জ্বালিয়ে দিয়েছে ব্যাবিলন, নিনেভ, কিশ, উরে আর মায়াবী দজলা নদীর পাড়। মানবজাতির উন্মেষের সাক্ষ্য-প্রমাণ – মেসেপটেমিয় সভ্যতার নিদর্শন ওরা লুট, নষ্ট করতে প্ররোচিত করেছে। রেহাই পাইনি জাদুঘর। পুড়িয়ে ফেলেছে গ্রন্থাগার।
ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল মেসোপটেমিয়া- প্রাচীন ইরাক। যেখানে প্রথম নগর রাস্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল ৬-৭ হাজার বছর আগে, জন্ম নিয়েছিল নূহের মহাপ্লাবনের পুরান। তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম সংবিধান/অনুশাসন, রচিত হয়েছিল নিনেভের সেই বিশ হাজার মাটির গ্রন্থ আর ফিনিশীয় বর্ণমালার আবিষ্কার যা মানবজাতিকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়েছিল – এটি ছিল মানবসভ্যতার ধাত্রীভূমি।
মেসোপটেমীয় নগর সভ্যতারও আগে, হাজার হাজার বছর। এখানে বিকশিত হয়েছিল নবোপলীয় গ্রাম সংস্কৃতি : ইউবেইদ ও ইউরুক। এমন কী অন্ধকারযুগ বলে কথিত মধ্যযুগেও সভ্যতার সবচেয়ে উজ্জলধারা বহমান ছিল। আব্বাসীয় যুগে বিজ্ঞান-সাহিত্য শিল্পকলার এক তীর্থভূমিতে পরিণত হয় এই আরবভূমি। ধীরে ধীরে বিশ্ব সংস্কৃতির এক প্রাণকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয় বাগদাদ। পৃথিবীর এক স্বর্ণাজ্জল সময়ের ধ্বংস হয়ে যাওয়া জ্ঞানকে জড়ো করে, পুনরায় তা সাজিয়ে রেনেসা পর্যন্ত পৌছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করে আরবভূমি থেকে উঠে আসা পথিকেরা। এগুলোর উপর ভিত্তি করেই শুরু হয় ইউরোপীয় সভ্যতা। বারবার মানবজাতির পদযাত্রা এ জায়গায় থেকে বাঁক নিয়েছিল। অদ্ভুত সব ইতিহাসের স্রোত এখানদিয়ে বয়ে গেছে।
রাতটা ছিল সত্যিই গল্প বলার– রূপকথার রাজকন্যা আর ব্যাঙ্গামা-ব্যাঙ্গামীর রহস্যজাল। প্রচন্ড ঝড় আর ঝড়ো হাওয়ার রাত। বিদ্যুৎহীন এক রাত। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ইতিহাসের মোড় ঘোরাবার প্রচন্ড ঝঞ্চাবিক্ষুদ্ধ এক রাত। ঝড়ো হাওয়া পুরো পরিবেশটাকেই অন্যরকম করে দিচ্ছিল। সেইসাথে বারবার বিচ্ছিন্ন মাইক্রোওয়েভের টোকা। মানুষের অনুভূতিগুলো কী অদ্ভুতভাবেই-না অণুতরঙ্গের আকারে ছড়িয়ে পড়ে বহুদূরের আরেকজনকে স্পর্শ করে। ভাবছিলাম রাতের অন্ধকার ঝড়ো হাওয়ায় কতটা পথ অতিক্রম করে এই ডাক, কী নিঃসিমতা পেরিয়ে এসেছে। হঠাৎ করেই যেন নিজেকে খোলা প্রান্তরের কোনো দেবদারু গাছে নিচে অনুভব করলাম-
একদিন মান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পন্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নর কন্ঠ দেবদারু গাছে
দেখেছি অমৃত সূর্য আছে {সূদর্শনা, বনলতসেন, জীবনানন্দ}
আচ্ছা এভদা, মানবজাতি তার উঠে আসার পদচিহ্নকে এভাবেই ধ্বংস করে ফেললো? শুধুমাত্র প্রোফিটের জন্য। সে- অনেকদিন আগের কথা, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের মিসর। আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার- পৃথিবী স্বর্ণাজ্জল এক সময়, অন্য এক প্রেক্ষাপট। সভ্যতাকে আরেকটি বাঁক নিতে হয়েছিল। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল হাতে লেখা পাঁচ লক্ষ গ্রন্থকে, টুকরো টুকরো করে ছিড়ে জ্বলন্ত আগুনে হাইপেশিয়াকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ডুবে গিয়েছিল পৃথিবী দেড় হাজার বছরের অন্ধকারে। তাও বোধহয় এতটা নীতিহীন ছিল না। ওরা কী ওদের গন্তব্য জানে? ওরা জানে শুধু প্রোফিট। জাতি, রাস্ট্র, প্রশাসন ও সরকার সবকিছুকে অর্থহীন করে দেবে কর্পোরেট/বহুজাতিক ব্যবস্থাগুলো। মানুষকে শুধু প্রোফিটের ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যবহার করবে। পুতুল পৃথিবীর দিকে নিয়ে যাবে আমাদের। এভদা, মানবজাতি এক প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকালে উপনীত। তোমার ওই নিস্তব্ধ পরিবেশে, প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ার শব্দে তা-কী অনুভব করা যায়!
রাত ১টা, বিদ্যুৎ আসল। বার্তা পাঠালাম। এখন বৃষ্টি হচ্ছে, শোনা যাচ্ছে বাতাসের হাহাকারের শব্দ। আসলেই এটা ছিলো সূরময় এক রাত, আধোঘুম আর আধো জাগরণের রাত। এভদা, একাকী এই রাতে কী করছো, এই উত্তালরাতের সাথে মিশে গিয়ে নিজেকে ইতিহাসের স্রোত মনে হল। সেই স্রোত যেন সবকিছুকে ছুঁয়ে গেল, দেখলাম ভাবনারত সীমাহীন বিরান ভূমিতে হেটে বেড়ানো এক নারীকে, এক আশ্চর্য ভালবাসা নিয়ে নিজের পথে চলেছে। রাত তিনটে, কথা হল, মাইক্রোওয়েভে। অনুভব করলাম এক আশ্চর্য আবেগ, এক আবেশিত কন্ঠ। এই ঝড়ের রাতে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের আকারে আমার আকাঙ্খা যেন তা শুষে নিতে চাইছে। কী এভদা শুনতে পাচ্ছ, নিস্তব্ধ ওই পরিবেশে ঝড়ের প্রবল শো শো বাতাসের শব্দ, ইতিহাসের বার্তাগুলোকে নিয়ে কেমন ছুটে চলেছে মহাকালের পথে।
ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস নদীর পাড়ের সেই প্রাচীন পৃথিবীকে কখনোই দেখা হবে না। স্বপ্নের অবয়বে তা শুধু ধরা দেবে – উপকথার পাখী হয়ে ঘুরে বেড়াবে আমাদের মনে। শুধু জ্বীবাশ্ম জ্বালানী – তেল নির্ভর একটি সভ্যতা, কতটা বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতে পারে, এ ঘটনা তা জানিয়ে দিল।
এখন প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। ঝড়ের শব্দ শুনলে ভেসে ওঠে পানামা খাল আর লাপলাতার উপকুল। আর শোনা যায় ইত্থিয়ান্ডারের শাখের শব্দ। ছোট বেলায় পথ খুজে বেড়াতাম লাপলাতার উপকুলের যাওয়ার। হ্রদের মতো স্বচ্ছ এক পৃথিবীকে দেখতে চাইতাম। জীবনকে সমর্পনে ইচ্ছে করতো বিকেলের মায়াবী আকাশে। সেই বিকেলকেই বোধহয় তুমি দেখেছিলে যা ঝড়ো রাতে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গে তোমার স্পন্দনের শব্দে শোনা গিয়েছিল। তাই না! কেমন আছ?
রচনা কাল : ১৪ এপ্রিল ২০০৩
আসিফ
ডিসকাশন প্রজেক্ট
অনেকেই বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে দুই ভুবনের বাসিন্দা ভাবেন; কিন্তু একজন কবি ভাবনার জগতে যতক্ষণ বিচরণ করেন, ঠিক ততক্ষনই ডুবে থাকেন একজন বিজ্ঞানিও! তাই আমরা দেখি, আইনস্টাইনকে ভায়োলিন নিয়ে মেতে থাকতে, জামাল নজরুল ইসলাম তন্ময় হয়ে থাকেন গিটারে, আর আমাদের আসিফ ভাইয়া ঝড়ো রাতে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গে কারো স্পন্দনের শব্দ শুনে জিজ্ঞাসা করেনঃ “কেমন আছ?”
পোস্ট (Y)
চিন্তার এবং বোঝার অনেক কিছুই আছে যা আমরা দেখতে চাইনা বুঝতেও চাইনা। তবুও ঘটনা প্রবাহ আর মহাকাল কারো জন্য অপেক্ষা করেনা; বয়ে চলে আপন গতিতে।
ভালো লিখেছেন (Y)
বর্তমান সভ্যতা ধব্বংস করা অনেক কঠিন,কিন্তু আমার মনে হয় আমরা যদি আলোর পথে না ছুটি তাহলে ধব্বংস হওয়া কোন ব্যাপার না!
একেকটা মানবসভ্যতা গ’ড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, লক্ষ লক্ষ বছরে, মানবজাতির চেষ্টা পরিশ্রম ও সাধনায়। আবার তা মুহূর্তে ধ্বংসও হয়ে যায় মানবজাতির হাতেই।