চৌদ্দ
রণাঙ্গন থেকে ঘরে ফেরা
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, শুক্রবার । সেদিনের আকাশ, বাতাস, সবকিছুই যেন অন্যরকম লাগছে । এমনকি সূর্যের আলোও যেন অধিকতর রক্তিমাভা ধারণ করেছে । আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে-বলে নাচতে ইচ্ছা করছে আলমের । রাস্তায়, রাস্তায় ও রাস্তার দু’পার্শ্বে বিভিন্ন ভবনের ছাদে মানুষের উদ্বাহু নৃত্য ও আনন্দ-উল্লাস, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত রাজপথ, জনতার অপ্রতিরোধ্য ঢল দেখতে দেখতে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় আলম। । এত লোকের ভিড়ে আলমকে তেমন কেউ চিনতে পারছে না। পরিচিত যাদের সাথে পথ চলতে তার দেখা হল, তাদের অনেকেই জানে না আলম মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে কিনা। পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে আসার আকুলতা দ্রুত পদবিক্ষেপে আলম কর্ণফুলীর তীরের রেল লাইন ধরে বাড়ির দিকে হেটে চলেছে-রাস্তায় কোন বাহন নেই। কখনো কখনো সে উল্লসিত জনতার মিছিলে মিশে যাচ্ছে। নৌ-ঘাটি থেকে ৯ নং হয়ে কৈল্লার হাটের রাস্তা ধরে আলম বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে পরিবেশ-পরিস্থিতির কী অদ্ভূত পরিবর্তন লক্ষ্য করে আলম । মাত্র একদিন আগেও গুপ্তখালের মুখে পানিতে কাঁটাতারের বেড়া, রাস্তার মুখে পাকসেনাদের চেকপোস্ট, বার্মা ইস্টার্ন লিঃ (বর্তমান পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিঃ ) এর হাউজিং কলোনীর খেলার মাঠে ভূ-গর্ভস্থ জল্লাদখানা, সব মিলিয়ে এ এলাকা ছিল ভয়ঙ্কর আতঙ্কের জনপদ। অথচ একদিনের ব্যবধানে কেমন যেন হয়ে গেছে সব। কোন ভয়ভীতি নেই আজ কারো মনে। পাকসেনাদের সকল চেকপোস্ট, গার্ডরুম, অস্থায়ী ক্যাম্প সবই শূণ্য পড়ে আছে। পড়ে আছে তাদের কিছুক্ষণ পূর্বে ব্যবহৃত তৈজসপত্র, আধপোড়া সিগারেট, বিভিন্ন পানীয়ের বোতল ।শুধু হাওয়া হয়ে গেছে পাকসেনারা। সবাই আশ্রয় নিয়েছে নিকটস্থ নেভেল বেইজে। কৈল্লার হাট অতিক্রম করে আলম যখন বার্মা অয়েল কোম্পানীর সংলগ্ন সড়কে ওঠল, তখন সে দেখতে পেল সামনে থেকে একটি মিছিল আসছে শ্লোগান দিতে দিতে। এরা আলমের এলাকার লোক। আলম ভাবল অনেক পরিচিত মুখ সে এখানে দেখতে পাবে। মিছিলটি যখন কাছে আসল, তখন আলম ঠিকই দেখল মিছিলে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলেই তার এলাকার অধিবাসী। সবচেয়ে পরিচিত লোকটি মিছিলে শ্লোগান দিচ্ছিল । আলমের দূর সম্পর্কের মামা। জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা, যার ভয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের আত্মীয় স্বজনেরা প্রায় তটস্থ থাকত। আলম মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য সে আলমের বাবাকেও বহু জেরা করেছে, ভয় দেখিয়েছে। তার কণ্ঠে বুলন্দ আওয়াজে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান আলমের কাছে কেমন যে বিসদৃশ লাগছে। শশ্রুমণ্ডিত আঝানুলম্বা আলখাল্লা পরা লোকটিকে কেমন যেন ভাঁড়ের মত দেখাচ্ছিল। আলম যত মিছিলের নিকটবর্তী হচ্ছিল, ঐ বৃদ্ধ শ্লোগান দাতার হস্ত সঞ্চালনের সাথে সাথে তার কণ্ঠের আওয়াজ ও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শ্লোগানদাতার চোখেমুখে অপরাধবোধের এক ধরনের ভয়ার্ত অভিব্যক্তি আলম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। এক সময় নাতিবৃহৎ মিছিলটি আলমকে অতিক্রম করে চলে গেল। বাড়ির খুব সন্নিকটে পৌছে আনন্দ বেদনার এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া আলমকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।
বাড়ির ঘাটায় পৌঁছতেই কে যেন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠল-আ-ল-ম এসেছে-রে। বাড়ির আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যেন এমন একটি মুহুর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। হৈ হৈ রৈ রৈ করে সবাই বাড়ির ঘাটায় এসে আলমকে ঘিরে ধরল। সর্বাগ্রে আলমকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠল আলমের বড় বোন। একে একে তার বাবা, মা, দাদী, ছোটবোন, ছোট ভাইসহ বাড়ির সবাই তার সাথে কোলাকুলি করল। ক্রমে এলাকার লোকজনও তাকে দেখার জন্য তার বাড়িতে জড়ো হতে লাগল। আলম জানতে পারল, তাকে ধরার জন্য তার বাড়ি ঘেরাও করে তার যে চাচাকে পাঞ্জাবীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তিনি এখনো ফিরে আসেন নি। তাই আনন্দ বেদনার এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার স্থানুর মত দাঁড়িয়ে কেবল অভ্যাগতদের সাথে কোলাকুলি করছে আলম।
স্বাধিকার আন্দোলনে পথ বেয়ে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি নৃতাত্ত্বিক জাতির পূনর্জন্ম-তার নিজস্ব একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্মপ্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, সদ্যজাত জাতিরাষ্ট্রকে ঘিরে বুকভরা একরাশ সোনালী স্বপ্ন কঁচি বুকে ধারণ করে আলম যেন তার জীবনের একটি প্রারম্ভিক অধ্যায় সফল পরিসমাপ্তি রচনা করল। কৈশোর পেরিয়ে যৌবণের অনুভূতি যখন আলমের শরীরে দোলা দেওয়া শুরু করেছে, তখন সে সদ্য যুদ্ধবিজয়ী এক মুক্তিযোদ্ধা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে স্বপ্নে বিভোর হওয়ার সময় তার। সে স্বপ্ন দেখে নিজেকে নিয়ে, নিজের সদ্য স্বাধীন দেশকে নিয়ে-যার স্বাধীনতার জন্য সে জীবন বাজি রেখেছিল। একটি স্বাধীন স্বদেশভূমি, একট গর্বিত জাতি, একটি উন্নত শোষণহীন সমাজ কাঠামো ইত্যাকার স্বপ্নে বিভোর হল আলম। তার সে স্বপ্ন কি পূরণ হবে আদৌ ? ভবিতব্য এর জবাব দেবে।চলবে—
পাদটীকাঃ (স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা নামক আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণ মূলক লেখাটি-যার ব্যাপ্তি সেই ১৯৬৫ ইং সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালীন সময় থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালীন সময় পর্যন্ত বিস্তৃত-দুই পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বের সমাপ্তি মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে-যার মধ্য দিয়ে এক অখ্যাত কিশোরের স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন ঘটে । অতঃপর তার সে স্বপ্নের বাংলাদেশ কি আজকের বাংলাদেশ ? সে প্রশ্নের জবাব এ লেখার দ্বিতীয় পর্বে।)
(Y)
আপনার রচনায় ঘটনা কাল ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সে সময় বার্মা ইস্টার্ন লিমিটেড, বার্মা ইস্টার্ন নামেই ব্যবসা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এই নাম ধারণ করে ১৯৬৫ সালেই।
১৯৭৭ এ বার্মা ইস্টার্ন লিমিটেড, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের অধীনে চলে আসে। ১৯৮৮ সাল থেকে এটি পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিমিটেড হয়েছে। তথ্য যাঁচাই এখানে।
@কাজী রহমান,
সঠিক তথ্য নির্দেশ করার জন্য ধন্যবাধ। তবে বার্মা ইস্টার্ন লিঃ, এমনকি পদ্মা অয়েল কোঃ নাম ধারণের পরও পতেঙ্গার সাধারণ লোক তাকে বিওসি হিসাবে ডাকে বা চিনে।
@কাজী রহমান,
তথ্যটি সংশোধিত হয়েছে।
@মোঃ জানে আলম,
ধন্যবাদ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখাগুলোতে যত কম তথ্য বিভ্রাট ঘটে ততই ভালো। মুক্তিযোদ্ধা আর প্রতক্ষ্যদর্শী সবাই মিলে চেষ্টা করলে লেখাগুলো সুন্দর হবে নিঃসন্দেহে। চট জলদি মনোযোগ দিয়েছেন দেখে ভালো লাগলো। আনন্দে থাকুন।
ব্লগাড্ডা বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে দিয়েছেন দেখে ভালো লাগলো।
বার্মা অয়েল কোম্পানী নাকি বার্মা ইষ্টার্ন অয়েল কোম্পানী। চাইলে এডিট করে দিতে পারেন কিন্তু।
ভালো কাজ হয়েছে।
ডিসেম্বরে বিজয়ের হপ্তা দুইয়ের কথা লিখেছিলাম এখানে।
@কাজী রহমান,
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। না, স্বাধীনতার পূর্বে আজকের পদ্মা অয়েল কোম্পানীর নাম ছিল BOC, বার্মা অয়েল কোঃ, তার পর BEL-বার্মা ইস্টার্ন লিঃ, সর্বশেষ স্বাধীনতার পর POCL। তবে স্বাধীনতার প্রাক্ষালে এলাকার মানুষের মুখে বিওসি নামে তা পরিচিত ছিল।
সর্বত্রই এই ভোল পাল্টানোর রাজনীতি। আর এরাই শেষে কি না সুবিধাবাদী রাজনীতির মাথায় পা রেখে গাড়িতে জাতীয় পতাকা পর্যন্ত উড়িয়েছে। হায় রে অভাগা দেশ! 🙁
একজন মুক্তিযোদ্ধার জবানীতে সেই উত্তাল দিনগুলোর বয়ান বেশ ভালো লাগছে। চলুক। (Y)
__
ছোট ছোট প্যারায় এবং প্রতি প্যারায় লাইন স্পেস দিয়ে লিখলে চোখের আরাম হবে।
@বিপ্লব রহমান,
লেখাটি পড়া এবং উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আপনার পরামর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করব।
১৯৬৫ সাল থেকে হলে তো বিশাল রচনা…
পুরোটা পড়ার জন্য ঝেঁকে বসলাম, অাপনার চোখে ইতিহাস দেখতে দেখবো।
২১ অার ২২ অক্টোবর, ১৯৭১ এর কোন সৃত্মি মনে অাছে অাপনার?
অামি একাত্তরের এই দুটো দিন একটা লেখা লিখছি।
অাপনার প্রোফাইলে দেখলাম, অাপনি চট্টগ্রাম শহরের গেরিলা ছিলেন।
সাথী দাদা, ডা: মাহফুজ চাচার সাথে অাপনার পরিচয় অাছে কি?
সবশেষে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটার জন্য।
জীবনী পড়তে খুব ভালো লাগে।
@সাব্বির হোসাইন,
লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। হ্যাঁ, ডা.মাহফুজ ভাই আমার খুব পরিচিত।তবে চট্টগ্রাম শহরের গেরিলা হলেও আমরা এক গ্রুপে ছিলাম না। আমার গ্রুপ নং ছিল ১৫৭।বুঝতেই পারছেন চট্টগ্রাম শহরে কতগুলো গেরিলা গ্রুপ কাজ করত।
@মোঃ জানে আলম,
(Y)
আপনার প্রতি শ্রদ্ধা ও সালাম রইল।
(Y)
@এম এস নিলয়,
পূর্বের মত অনুপ্রেরণা দেওয়ায় অশেষ ধন্যবাদ।