“প্রিয় সম্পাদক মহোদয়,
গত ৩৫ বছরে আমি চব্বিশ ধরণের কাজ করেছি। গৃহরক্ষক, পাচক, ঝাড়ুদার, গাড়ি চালক, মায়ের সহায়তাকারিনী, কুকুরের পরিচর্যাকারী, ধোপা, পসাক-পরিচ্ছেদের পরিচারক, বুট পালিশকারিণী, ঝাড়ুদার, দর্জি, কারপেন্টার, মালী, রাজমিস্ত্রী, রঙ্গমিস্ত্রী, শোভাকার, পানির মিস্ত্রী, মুদ্রাক্ষরিক, টেলিফোন গ্রহণকারী, অভ্যর্থনাকারী, হিসাব রক্ষক, সেক্রেটারি, ব্যাংকার, গাড়ি পার্কএর পরিচালক, ময়লাওয়ালা।

এসবই বিনা বেতনে করেছি একজন বসের জন্য; তিনি আমার স্বামী”

যুক্তরাজ্যের একজন বিবাহিত মহিলা ১৯৮৬ সালে এক পত্রিকায় এই চিঠি লেখেন। সত্যি বলতে এই ইংরেজ মহিলার কপাল ভালো তিনি যা করেছেন স্বামীর জন্য করেছেন আর দেশটা যুক্তরাজ্য। আমাদের দেশে মেয়েদের কাজের তালিকা একশ’র ঘর ছাড়াবে নিঃসন্দেহে। এই সমাজে এসেও শতাব্দী পুরনো মনুস্মৃতির কথাই বারবার ফিরে আসে আমাদের ভাগ্যে;

মনু বলেছেন
“কোন বালিকা, যুবতী বা বৃদ্ধাদের নিজের বাড়িতেও স্বাধীনভাবে কিছু করতে দেয়া ঠিক হবে না। বাল্যে নারী থাকবে পিতার নিয়ন্ত্রণে, যৌবনে স্বামীর, এবং স্বামী মারা গেলে পুত্রের।”

কিংবা ধরুন

সভ্যতা আমাদের দেখায় বেশীরভাগ সময়ই নারীরা শোষিত লাঞ্ছিত হয়েছে। শোষিতরা সর্বদাই শোষকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে মার্ক্সের এই বাণী নারীদের ক্ষেত্রে খাটেনি। এর কারণ মার্ক্স না, কারণটা নারী নিজে। যুগে যুগে আমরা যা দুঃসহ বৈষম্য মনে করেছি মেয়েরা সেটাকেই স্বাভাবিক মনে করেছে। এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ মনস্তত্ত্ব। পুরুষেরা এমন একটা সমাজ ব্যাবস্থা গড়ে তুলেছে যাতে মহিলারা নিজেদের আদৌ অত্যাচারিত মনে করেনি। কথাটা বলা যতটা সহজ বোঝাটা এত সহজ না। আসুন একটু বাখ্যা করি ব্যাপারটা।

“ঠিক মত পড়ালেখা না করলে বিয়া করাইয়া দিমু…”; কিংবা
“পইড়া লাভ কি বিয়ার পর তো জামাইর ঘরেই ঘানী টানবি…”
আপাত নিরীহ, খানিক বিদ্রূপাত্মক মন্তব্যের শিকার আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা বরাবরই হয়ে থাকে। মুখে নিরীহ হলেও কিন্তু এই বক্তব্যটা এক সময় মেয়েটা বিশ্বাস করতে শুরু করে। আমরা তখনই একটা জিনিস বিশ্বাস করি যখন তার নমুনা দেখি। একই ভাবে একটা মেয়ে যখন আশেপাশে সম বয়সীদের বিয়ে হয়ে যেতে দেখে, তখন নিজে থেকেই নার্ভাস হতে শুরু করে। “বাবা/মামা চাইলেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারে” এই বিশ্বাসটা মাথার ভেতর ঢুকে যায়। আর বিয়ের পরের আপাত অনিশ্চিত বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নিস্ক্রিয় জীবনটা মেয়েরা কখনোই কামনা করে না। আর তাই খেয়ে না খেয়ে পুরুষ প্রভুটির দাসত্ব শুরু করে।

”ভালোটা ভাইয়ের জন্য…”;
”কিছু বাঁচলে খাবি না বাঁচলে খাবি না…”;
”এই তুচ্ছ অসুখে ডাক্তার দেখানোর কি দরকার…”;
”মা’মনি একটু চা বানিয়ে খাওয়াও (হোক সেটা পরীক্ষার আগের দিন)…”;
“আজ স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই মেহামন আসবে…”

খুবই তুচ্ছ… সামান্য… প্রাত্যহিক ঘটনা এসব। কিন্তু একজন ছেলে কি কোনদিন এইসব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গিয়েছে? কোন পুরুষ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন “পুরুষ হয়ে আমি হীনমন্যতায় ভুগি” কিন্তু আপনি কি জানেন এই দেশের বেশীর ভাগ নারী তার নারীত্ব নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন? বিশ্বাস না হলে একটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। দশজন নারীকে জিজ্ঞাসা করুণ আরেকবার জন্ম নেয়ার সুযোগ পেলে পুরুষ হতে চান কি না; একই প্রশ্ন দশজন ছেলেকেও করবেন। নিভৃত নির্যাতনের স্বরূপ চোখে পড়বে হাতেনাতে।

এবার আসুন দেখি মেয়েরা নিজেরাও কিভাবে পুরুষতন্ত্রের প্রভাবে প্রভাবিত হন। ছেলেরা কন্নাকাটি করলে আমরা বলি ”মেয়েদের মত কাঁদছিস কেন…” সমান তালে এই কথাটা মেয়েরাও বলে। মেয়েরা ছিচকাঁদুনে, অল্পতেই চোখের পানি চলে আসে এই কথাটা মেয়েদের কানে তুলে দিয়েছে পুরুষরাই। আর নারীও প্রভুর কথা মেনে নিয়েছে নত শীরে। আবার ধরুণ “ঐ মেয়ের কেরেক্টার খারাপ…” এই ধরণের গিমিক নারী সমাজেই বেশী শোনা যায়। এটাও একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে ব্যাখ্যার জন্য। সদাপ্রভু পুরুষ আমাদের বোঝালো পৃথিবীতে একটাই খারাপ কাজ আছে আর সেটা প্রস্টিটিউশান তথা পতিতাবৃত্তি, একটা পুরুষ হাজারটা ধর্ষণ করুক আর শ’খানেক খুন করুক সেটার চেয়ে হাজার গুন খারাপ কাজ হচ্ছে দেহপসারনির ক্রিয়া। অথচ দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত নারী-পুরুষ সবাই বোঝে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কেউই শখ করে এসব পেশায় আসে না। প্রত্যেকটা গল্প নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করলে দেখা যাবে শেষমেশ পুরুষের ঘাড়েই সব এসে পড়বে। অথচ মুখরোচক এসব গল্পের ধারক হয় মেয়েরাই। “মেয়ে খারাপ…” আর “ছেলে খারাপ…” কথা দুটো পাশাপাশি দাঁড় করালেই সমাজের অবস্থাটা পরিষ্কার হয়।

শেষে আরেকটু বিশ্লেষন দিয়ে আজকের পর্ব শেষ করছি।

বিলবোর্ডে নারীর স্বল্পবসনে উপস্থাপন নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। কিন্তু সেই আপত্তির ফলে সমাজে বিতর্কিত হয় মেয়েটা কিন্তু পন্যের ক্রয়কারী আর উৎপাদনকারী থাকেন নিরাপদ। ব্যাপারটা এমন যে ফেয়ার এন্ড লাভলী কিংবা সানসিল্কের বিজ্ঞাপনে মডেল খুব খারাপ কিন্তু এই খারাপ বিজ্ঞাপন দেখে যিনি বস্তুটি কিনিলেন তিনি সাধু; আর যিনি এই কোম্পানির মালিক (সবাই পুরুষ) তিনি তো সাক্ষাত ফেরেশতা!!! মডেলের বাবা-মাকে দিনরাত আচ্ছামত বকে যাচ্ছেন কন্যাকে মানুষ করেনি বলে অথচ যে তাকে উন্মুক্ত হতে নির্দেশ দিলো তাকেই মাথায় তুলে রাখছেন। হয়ত সেই নারী এ কাজ করতে বাধ্য ছিলেন কিংবা হয়ত ইচ্ছুকই ছিলেন তবুও দোষটার সিংহভাগ সেই কোম্পানির মালিকেরই কারণ দিনের শেষে লাভের সিংহভাগ তার পকেটেই যায়।

আজকের আলোচনা শুধুই মধ্যবিত্ত স্বপ্নচারী শ্রেণীদের নিয়ে করলাম। একটু নিচে তাকিয়ে দেখুন নিম্নবিত্ত নারীদের অবস্থা। আমরা মধ্যবিত্তরা মেয়েদের মা আর বোনের বাইরে আরেকটা অবস্থায় দেখেই আনন্দ পাই সেটা একজন আবেগী প্রেমিকা অথবা স্ত্রি যে লুতুপুতু খাইসো… ঘুমাইসো… কথা বলবে আর সারাদিন উদয়ান্ত খাটবে। মধ্যবিত্ত মেয়েদের জন্য পারিবারিক বৈষম্যগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। পারিবারিক নির্যাতনের আছে শতাব্দীব্যাপী ইতিহাস আর ঐতিহ্য। মানে বলতে চাইছি আপনি যে বৈষম্যের শিকার নিঃসন্দেহে আপনার মা তার মা তার মা সবাই সেই একই বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন এই কথা ভেবে যদি আজ চুপ করে যান তবে বলি;

সতিদাহ প্রথাও কিন্তু কোন একদিন কোন একটা মেয়ের “না আমি স্বামীর চিতায় মরবো না…” কথার কারণেই বন্ধ হয়েছিলো।

না; সেই নারীটি হয়ত বাঁচতে পারেনি।
কিন্তু তার একটা প্রতিবাদের কারণে লক্ষ নারী পুনর্জন্ম পেয়েছিলো।

আজ আপনি রুখে দাঁড়ান,
কাল লক্ষ নারী পুনর্জন্ম পাবে