[পর্ব – ০১] [পর্ব – ০২]

১৯২৫ সালে আইরিন সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল থিসিস জমা দিয়েছেন – ‘আলফা রে অব পোলোনিয়াম’ শিরোনামে। থিসিস উৎসর্গ করেছেন তাঁর মাকে – ‘টু মাদাম কুরি বাই হার ডটার এন্ড পিউপিল’। আইরিন থিসিস ডিফেন্ড করতে গেলেন একটা ঢিলেঢালা ব্যাগি ড্রেসের ওপর কালো একাডেমিক গাউন পরে।

অডিটোরিয়ামে প্রায় হাজার দর্শক উপস্থিত রেডিয়াম-কন্যার বক্তৃতা শোনার জন্য। আইরিন যদিও সমাবেশ পছন্দ করেন না, কোন ধরনের টেনশান ছাড়াই তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি যা জানেন তা এত ভালো জানেন যে সেটা নিয়ে কোনদিনই কোন উৎকন্ঠায় ভোগেন না। আইরিনের পরীক্ষকদের ওপর মানসিক চাপ পড়বে ভেবে মাদাম কুরি যাননি সেই অনুষ্ঠানে।

পরীক্ষকদের সবার ভূয়সী প্রশংসার ভেতর দিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন আইরিন কুরি। সরবোন থেকে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফিরেই চমকে উঠলেন আইরিন। সেখানে আইরিনের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করে ফেলেছেন ফ্রেড। ল্যাবরেটরির বিকারে করে শ্যাম্পেন পান করার মধ্য দিয়ে শেষ হলো সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।

এতদিন ধরে ফ্রেডের সাথে মেলামেশা করতে করতে আইরিনের ভেতর অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। জীবনে প্রেম-ভালোবাসার কোন স্থান ছিল না তাঁর। কিন্তু ফ্রেড যেন নতুন দরজা খুলে দিয়েছেন তাঁর জীবনে। তিনি ফ্রেডকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। ফ্রেড তো অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বিয়ে যদি করেন তো আইরিনকেই করবেন। ডক্টরেটের পর আইরিনকে নিয়ে মাদাম ব্রাজিলে গেছেন। ইনস্টিটিউটে গিয়ে আইরিনকে না দেখে কাজে মন বসাতে পারেন না ফ্রেড। তিনি আইরিনকে চিঠি লেখেন, “আমি এতদিন ভাবতাম গবেষণাকেই আমি বেশি ভালোবাসি। এখন তোমাকে না দেখতে পেয়ে বুঝতে পারছি আমি গবেষণার চেয়েও তোমাকেই বেশি ভালোবাসি। তুমি আছো বলেই আমার গবেষণা আছে। তুমি কাছে না থাকলে আমার সবকিছুই খালি খালি লাগে। তুমি যে আমার জীবনের সাথে মিশে গেছো তা কি তুমি জানো?”

চিঠি পেয়ে আইরিন ঠিক বুঝতে পারলেন না কী করবেন। তিনি সবসময় বস্তুনিষ্ঠ ব্যাপারে অভ্যস্ত। এরকম ভাবালুতার সাথে তাঁর পরিচয় নেই। ফ্রেড তাঁকে ভালোবাসে সেটা লিখেছে স্পষ্ট করে। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব তো এটা নয়। আইরিন বস্তুনিষ্ঠভাবে ভাবতে সাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। তিনি ভেবে দেখলেন ভালোবাসা যখন হয়েছে তখন বিয়ে করে ফেলাই ভালো। তাঁর মা একই সাথে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী আবার দুটো সন্তানের মা। মাদামের মেয়ে হয়ে আইরিনও নিশ্চয় বিজ্ঞান ও সংসার দুটোই সামলাতে পারবেন। তাছাড়া স্বামী হিসেবে খুব একটা খারাপ হবেন না ফ্রেড।

কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় ফ্রেডের সাথে খোলাখুলি কথা বললেন আইরিন।
“তোমার চিঠি আমি পেয়েছি।”
“কিন্তু চিঠির জবাব আমি পাইনি।”
“চিঠিতে একটি প্রশ্ন তুমি করেছিলে – আমি যে তোমার জীবনের সাথে মিশে গেছি তা আমি জানি কিনা। সে প্রশ্নের উত্তরে কী লিখতে হয় আমি জানি না। ফ্রেড, এই ব্যাপারগুলো আমার কাছে ভীষণ জটিল বলে মনে হয়। সরাসরি বলো – তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও?”
“হ্যাঁ চাই চাই চাই।”
“একটা শব্দ এতবার বলছো কেন?”
“আমার ইচ্ছের প্রাবল্য বোঝানোর জন্য বলছি মাদ্‌মাজেল। আমার মনে হচ্ছে আমি আজ চাঁদ হাতে পেয়েছি।”
“সবকিছুতে কেন যে তুমি চাঁদের উপমা দাও বুঝতে পারি না। আলফা পার্টিক্যলকে তুমি চাঁদে নিয়ে যাও। আজ বলছো তুমি চাঁদ হাতে পেয়েছো। চাঁদের আয়তন কত জানো?”
“তোমার বিজ্ঞান দিয়ে ভালোবাসা বোঝার চেষ্টা করো না মাদ্‌মাজেল। ওটা আমার হাতেই ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি চাঁদ হাতে পাওয়া বলতে কী বোঝায়” – বলতে বলতে গভীর আবেগে আইরিনকে জড়িয়ে ধরেন ফ্রেড। সময় থেমে যায়, চন্দ্রগ্রস্তের মত তিরতির করে কাঁপতে থাকেন আইরিন।

জুলিও-কুরি

পরদিন সকালে নাস্তা করার সময় মাকে বললেন আইরিন, “মি, আমি এন্‌গেজড।”
চমকে উঠলেন মাদাম কুরি – “হোয়াট?”
“আমি এন্‌গেজড। আমার বয়স এই সেপ্টেম্বরে আটাশ হবে। আমার এখন বিয়ে করা উচিত। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমি এন্‌গেজড হয়েছি।”
“কার সাথে?”
“মঁসিয়ে জুলিও”
“ফ্রেডেরিক জুলিও? কিন্তু তার তো কোন ডিগ্রি নেই। একজন ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্টের বউ হয়ে জীবন কাটাবি?”
“আমি তো তার ডিগ্রিকে বিয়ে করবো না মি। তাছাড়া এখন তার ডিগ্রি নেই, ডিগ্রি হবে। সে তার গ্র্যাজুয়েশানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
“ভালো” – বলে চুপ করে গেলেন মাদাম। তাঁর চোখেমুখে হতাশার চিহ্ন খেয়াল করলেন না আইরিন।

মাদাম কুরি কাউকে কিছু না বললেও ফ্রেড আর আইরিনের সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। ফ্রেডের চেয়ে শিক্ষায় পদমর্যাদায় সিনিয়র অনেকেই আছেন সেখানে। তাঁরা ফ্রেডের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বলাবলি করতে লাগলো – ফ্রেড রাজকন্যা আর রাজত্ব দুটোই দখল করার জন্য ইনস্টিটিউটে এসেছেন। আইরিনের এসবে কিছু এসে যায় না। কিন্তু ফ্রেড কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েন যখন সহকর্মীরা তাঁর পিঠ চাপড়ে দেন।

ফ্রেড নিজেকে সবদিক দিয়েই আইরিনের যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে সরবোন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ফ্রেড।

১৯২৬ সালে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন ফ্রেড ও আইরিন। জুন মাসের পাঁচ তারিখ ফ্রেডের মা মাদাম কুরির সাথে দেখা করলেন। মাদাম খুবই আন্তরিক ব্যবহার করলেন মাদাম জুলিওর সাথে। জুনের বিশ তারিখ আইরিন গেলেন ফ্রেডদের বাসায় সবার সাথে লাঞ্চ করতে। ফ্রেডের বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করলেন আইরিনকে। আইরিন কারো সাথে তেমন কোন কথা না বললেও তাঁর আন্তরিক সোজাসাপ্টা আচরণে সবাই বেশ খুশি হলেন।

২৪শে জুন কুরি পরিবার আর জুলিও পরিবার একসাথে ডিনারে গেলো। ফ্রেডকে খুবই পছন্দ হলো ইভের। তার মনে হলো আইরিনের শুষ্ক নীরস সাদাকালো জীবনের ক্যানভাস রঙে রঙে ভরিয়ে দিতে পারবেন ফ্রেড। কিন্তু মাদামের গাম্ভীর্য আইরিনের চোখে না পড়লেও ইভের চোখ এড়ালো না।
লা’কোয়েস্টে প্রতিবছর সামারে ছুটি কাটাতে যান আইরিন ও ইভ। এ’বছর ইভের বদলে ফ্রেডকে সাথে নিয়ে গেলেন আইরিন। লা’কোয়েস্টের ফিশিং বোটে ইচ্ছেমতো মাছ ধরলেন ফ্রেড। লা’কোয়েস্টের প্রায় প্রত্যেকের সাথেই পরিচয় হয়ে গেলো ফ্রেডের। জেলেদের সাথে তো রীতিমত বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তাঁর।

আইরিন তাঁর বিয়ের তারিখের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। লা’কোয়েস্ট থেকে প্যারিসে মাকে চিঠি লিখলেন আইরিন, “মি, আমাদের বিয়ের তারিখ এখনো তুমি ঠিক করে দাওনি। তোমার কোপেনহ্যাগেনে যাবার আগে বিয়েটা হয়ে গেলে ভালো হয়। কোপেনহ্যাগেন থেকে তোমার ফিরে আসার পরে হলে হয়তো আরো ভালো হতো, কিন্তু তখন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা চলবে। আমার মনে হয় অক্টোবরের নয় তারিখে বিয়ে হলে সবদিক দিয়ে ভালো হয়। তুমি তাড়াতাড়ি তোমার মত জানাও। আমি সেই মত টাউন হল বুকিং দেবো।”

আইরিনের কথামতোই সবকিছু ঠিক হলো। ১৯২৬ সালের ৯ই অক্টোবর দুপুরে বিয়ে হয়ে গেলো আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিক জুলিওর। খুবই অনানুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হবার কথা থাকলেও দেখতে দেখতে বেশ বড় অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। জুলিও পরিবারের সবাই, কুরি পরিবারের সবাই, সহকর্মী বিজ্ঞানীরা, সিটি মেয়র সহ বড় বড় সরকারি অফিসারের অনেকেই বিয়েতে এসেছিলেন। লাঞ্চের পর ফ্রেড আইরিনের সাথে আইরিনদের বাসায় গেলেন। তারপর সব অতিথিরা চলে গেলে নিজেও চলে গেলেন তাঁর নিজের বাসায়। আইরিন রয়ে গেলেন তাঁর মি’র সাথে।

পরদিন সকালে ইভকে নিয়ে মাদাম কুরি চলে গেলেন কোপেনহ্যাগেনে। ফ্রেড চলে এলেন আইরিনের বাড়িতে। সেখানেই শুরু হলো তাঁদের দাম্পত্য জীবন। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস ফ্রেড ও আইরিন মাদাম কুরির বাসাতেই ছিলেন।

আইরিনের বিয়ের পর মাদাম বেশ গম্ভীর হয়ে গেছেন। ফ্রেডকে তিনি সহজে মেনে নিতে পারছেন না। আইরিনকে মাদাম বলেছেন ম্যারেজ অ্যাগ্রিমেন্ট করিয়ে নিতে – কারণ তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না ফ্রেডের সাথে আইরিনের বিয়ে টিকবে।

পুরুষ-শাসিত ফ্রান্সের আইন অনুযায়ী স্ত্রীর সমস্ত সম্পদ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে স্বামীর হাতে। মেরির ধারণা ফ্রেড আইরিনকে ছিনিয়ে নিয়েছেন তাঁর নিজের কাছ থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে আইরিন হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অবলম্বন। কিন্তু মাদামের মনে হচ্ছে ফ্রেডের সাথে পরিচয়ের পর থেকে আইরিন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। অভিমানে মাদাম কতগুলো ছেলেমানুষী কাজ করতে শুরু করলেন।

যেমন একদিন আমেরিকা থেকে কয়েকজন বিজ্ঞানী এসেছেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। মাদাম তাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ইনস্টিটিউটের গবেষক ও অ্যাসিস্ট্যান্টদের সবাইকে মিটিং রুমে ডাকলেন। সবাই এসে পাশাপাশি দাঁড়ালেন। মাদাম একে একে পরিচয় দিচ্ছিলেন – “ইনি ডক্টর লুইস – আমাদের ল্যাব টু’র ডিরেক্টর, ইনি ডক্টর সল্‌সবেরি – মাস্টার্স প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, ইনি ডক্টর কুরি – রিসার্চ ইনচার্জ, ইনি মঁসিয়ে টেপার, ….” এভাবে যখন ফ্রেডের নাম বলার পালা এলো তখন এমন ভাব করলেন যেন ফ্রেডকে দেখতেও পাননি। ফ্রেডকে বাদ দিয়ে পরের জনের পরিচয় দিতে শুরু করলেন। কিন্তু ফ্রেডের উজ্জ্বল উপস্থিতি ভিজিটরদের চোখ এড়ায় না। যখন তাঁরা মাদামকে ফ্রেড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন – মাদাম দায়সারা ভাবে জবাব দেন – “ওই লোকটা? আইরিন ওই লোকটাকে বিয়ে করেছে”।

কিন্তু মাদামের অভিমান চোখেই পড়ছে না আইরিনের। তিনি তাঁর স্বামীর সাথে নতুন জীবন নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীর জন্য রান্না করতে গিয়ে আইরিন আবিষ্কার করলেন তিনি এত কিছু শিখেছেন জীবনে – কিন্তু রান্না শিখতে ভুলে গেছেন। তবে কোন সমস্যা নেই। দেখা গেলো ফ্রেড চমৎকার রান্না করেন। অবশ্য রান্না করার সময় রান্নাঘর এত অগোছালো করে ফেলেন যে অস্বস্তি লাগে। রান্না শেষে ফ্রেড ভয়ে ভয়ে গোছানোর চেষ্টা করেন। আইরিনের খুব মজা লাগে এসব দেখে। রান্নাঘর থেকে মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শোনা যেতে লাগলো যা এই বাসায় আগে কখনো শোনা যায়নি। ইভ বাসায় থাকলে সেও যোগ দেয় তাদের সাথে। কিন্তু মাদাম একেবারেই একা হয়ে গেলেন।

কয়েক মাস পর মাদাম আইরিনের হাতে একটা অ্যাপার্টমেন্টের চাবি তুলে দিলেন বিয়ের উপহার হিসেবে। তাঁদের বর্তমান বাসা থেকে কাছেই সরবোন অ্যানেক্সে একটা ছয়তলা ভবন কিনেছিলেন মাদাম কুরি, জাঁ পেরি আর ফ্রান্সিস বোরেল – এই তিন বন্ধু মিলে। প্রতি তলায় একটা করে অ্যাপার্টমেন্ট। তিন তলায় পাঁচ রুমের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেলেন আইরিন ও ফ্রেড। ছয় তলায় আইরিনের ছোটবেলার বন্ধু আলিনও থাকেন তাঁর স্বামী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। বেশ ভালোভাবেই শুরু হলো আইরিন ও ফ্রেডের সংসার।

কিন্তু বিজ্ঞান-সমাজে ফ্রেডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। আইরিন ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানী হিসেবে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। অনেকগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে গেছে তাঁর। কিন্তু ফ্রেড এখনো মাস্টার্সও পাস করেননি। অনেকেই প্রকাশ্যে বলাবলি করতে লাগলো এই বিয়ে ফ্রেডের ওপরে উঠার সিঁড়ি, ক্যারিয়ার বাগানোর জন্য আইরিনকে বিয়ে করেছেন ফ্রেড।

ফ্রেড রেগে যান এসব শুনে। বিয়ের পরেও আইরিন ‘কুরি’ নামে তাঁর পেপার প্রকাশ করতে থাকেন। মিডিয়াতে এই জুটি জুলিও-কুরি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আইরিনের সাথে কথা বলে ফ্রেড নিজের পদবীর সাথে স্ত্রীর পদবী লাগিয়ে ‘জুলিও-কুরি’ হয়ে যান।

মায়ের কাছ থেকে আলাদা থাকতে শুরু করার পর মাদাম কুরির মনের অবস্থা বুঝতে পারেন ফ্রেড। তিনি আইরিনকে বোঝান – “আমাদের কিন্তু প্রতিদিনই একবার মাদামের বাসায় যাওয়া উচিত, তাঁর সাথে ডিনার করা উচিত।”
“মি কি সেটা পছন্দ করবেন?”
“তুমি কি মি’র পছন্দ অপছন্দ বুঝতে পারো? তুমি কি বুঝতে পারছো যে তিনি এখন কতটা একা হয়ে গেছেন? তিনি ভাবছেন আমি তোমাকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছি। তোমার উচিত তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া যে এখনো তুমি তাঁরই আছো। তাঁর মেয়ে পর হয়ে যায়নি বরং মেয়ের মাধ্যমে তিনি একটা ছেলে পেয়েছেন।”
“সেটা তো ঠিকই, কিন্তু তাঁকে বোঝাতে হবে কেন? মি পৃথিবীর এত কঠিন কঠিন জিনিস বোঝেন, আর এই ব্যাপারটা বোঝেন না?”
“স্নেহ ভালোবাসার ব্যাপারটা হলো অনেকটা সঙ্গীতের মতো। শুধু মনে মনে গুনগুন করলে হয় না, মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গাইতে হয়।”

আইরিনও ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। ফ্রেডের কাছ থেকে অনেক মানবিক ব্যাপার শিখছেন আইরিন যা আগে তাঁর চোখেও পড়তো না। সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকদিনই মেরির সাথে ডিনার করেন ফ্রেড ও আইরিন। আস্তে আস্তে মেরি সহজ হতে থাকেন ফ্রেডের সাথে।

১৯২৭ সালে ফ্রেড সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর তাঁদের প্রথম সন্তান হেলেনের জন্ম হয়। নাতনির মুখ দেখার পর মাদাম কুরির সব অভিমান জল হয়ে যায়। তিনি নাতনিকে একদিন না দেখলে ছটফট করতে থাকেন।

মা হবার পর আইরিন যক্ষায় আক্রান্ত হলেন। ডাক্তার বললেন ‘কমপ্লিট রেস্ট’ নিতে হবে। এটাও বললেন যে ভবিষ্যতে আর মা হওয়া চলবে না। কয়েক সপ্তাহ রেস্ট নিয়ে শিশু হেলেনকে নার্সের হাতে দিয়ে ল্যাবে ফিরলেন আইরিন। ল্যাবে ডক্টরেটের জন্য পূর্ণোদ্যমে গবেষণা করছেন ফ্রেড। আইরিন সুপারভাইজ করছেন তাঁকে।

১৯৩০ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন ফ্রেডেরিক জুলিও-কুরি। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল, “ইলেকট্রোকেমিক্যাল প্রপার্টিজ অব রেডিওঅ্যাক্টিভ কম্পাউন্ডস অব পোলোনিয়াম”।

রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফ্রেড ও আইরিন যে বেতন পান তাতে ঠিকমত সংসার চলে না তাঁদের। মায়ের দেয়া অ্যাপার্টমেন্টটা না থাকলে তাঁদের অবস্থা যে কী হতো বলা যায় না। এতদিন ফ্রেডের একাডেমিক ডিগ্রি ছিল না। এখন ডক্টরেট হবার পর ফ্রেড ইন্ডাস্ট্রিতে চলে চাকরি নিয়ে চলে যাবেন ঠিক করলেন। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে গবেষণা করার তেমন সুযোগ নেই। সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে ফ্রেডের। জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট নাৎসিদের উত্থান ঘটছে। ফ্রেড সরকারি চ্যানেলে বোঝাতে সক্ষম হন যে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রচুর বাজেট না দিলে ভবিষ্যতে ফ্যাসিস্টদের ঠেকানো যাবে না। সরকার একটা বড় অংকের রিসার্চ গ্রান্ট দেয় ফ্রেডকে। ইন্ডাস্ট্রিতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ফ্রেড আইরিনের সাথে পূর্ণকালীন গবেষণা শুরু করেন।

ফ্রেড আর আইরিনের টিম-ওয়ার্ক খুবই ভালো চলছিল। ফ্রেড ফিজিসিস্ট হলেও তাঁর ডক্টরাল থিসিস ছিল কেমিস্ট্রিতে। আর আইরিন কেমিস্ট, কিন্তু তাঁর থিসিস ছিল পিওর ফিজিক্সের ওপর। ফ্রেড যেকোন ব্যাপারেই দ্রুত চিন্তা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আবার ঘনঘন সিদ্ধান্ত বদলানও। কিন্তু আইরিন সেরকম নন। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন বলে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর অনেক দেরি হয়। গবেষণায় সাফল্য এলে সকলের প্রশংসা পেতে পছন্দ করেন ফ্রেড, কিন্তু বিরাট সাফল্যেও কোন ভাবান্তর হয় না আইরিনের।

গবেষণারত আইরিন ও ফ্রেডেরিক

১৯৩০ সালে জুলিও-কুরিরা প্রতিযোগিতা করছিলেন পৃথিবীর অন্যান্য নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীদের সাথে। যে ক’জন বিজ্ঞানী তখন পরমাণুর নিউক্লিয়াস নিয়ে গবেষণা করছিলেন তাঁরা হলেন ইংল্যান্ডে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, বার্লিনে লিজা মেইটনার, এবং কোপেনহ্যাগেনে নিল্‌স বোর। তখন পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের ধারণা ছিল এরকম: পরমাণুতে শুধু ইলেকট্রন আর প্রোটন আছে। নিউট্রন সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না কারো।

আইরিনের মা পোলোনিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৯৮ সালে। রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম ছিল মেরি কুরির সন্তানের মত। আইরিন ও ফ্রেড প্রচুর পোলোনিয়াম উৎপাদন করেন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে। এই পোলোনিয়াম খুবই বিষাক্ত। ফুসফুস, প্লিহা ও যকৃতের খুব ক্ষতি করে এর তেজষ্ক্রিয় গ্যাস। ফ্রেড ও আইরিন ক্রমে ক্রমে এই বিষে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। ইতোমধ্যে তেজষ্ক্রিয়তার বিষে মাদাম কুরির শরীরের সমস্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি ভীষণ অসুস্থ। তারপরেও একটু সুস্থ বোধ করলেই তিনি ইনস্টিটিউটে চলে আসেন।

১৯৩২ সালে আইরিন রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের গবেষণা-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এসময় গবেষণাগারের জন্য একটা আধুনিক হফম্যান ইলেকট্রোমিটার কেনা হয় যার সাহায্যে বাতাসে তেজষ্ক্রিয়তার ফলে সৃষ্ট ইলেকট্রিক চার্জের পরিমাপ করা যায়। ফ্রেড দিনরাত খেটে এই ইলেকট্রোমিটার বসানোর কাজ করছেন। এদিকে ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও আবার মা হতে চলেছেন আইরিন।

এসময় জার্মান ফিজিসিস্ট ওলাল্টার বোথে’র একটা পেপার পড়ে খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠেন আইরিন। বেরিলিয়ামের সাথে আলফা কণার সংঘর্ষ ঘটানোর পর দেখা গেলো বেরিলিয়াম থেকে কিছু একটা বেরিয়ে দুই সেন্টিমিটার পুরু সীসার পাত ভেদ করে চলে গেলো। বেরিলিয়াম থেকে এত শক্তিশালী কী বেরোচ্ছে? এটা কি কোন নতুন ধরনের গামা রশ্মি? আইরিন অসুস্থ শরীরে এই নতুন ধরনের গামা রশ্মি পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। তিনি বেরিলিয়ামের পাশে তেজষ্ক্রিয় পোলোনিয়াম রাখলেন। দেখলেন বেরিলিয়াম থেকে শক্তিশালী রশ্মি বের হয়ে সীসার পাত ভেদ করে চলে যাচ্ছে। এবার সামনে নানারকম পদার্থ রেখে পরীক্ষা করা হলো। প্যারাফিন ওয়াক্স (মোম) রেখে দেয়া হলো। মোম কার্বন আর হাইড্রোজেনে ভর্তি – প্রোটনের সমৃদ্ধ উৎস। দেখা গেলো মোম থেকে প্রোটন বেরোল প্রায় আলোর বেগের এক দশমাংশ বেগে। এর কারণ কী? প্রোটনকে এত জোরে ছুঁড়ে দেবার কাজ করছে কে? আইরিন আর ফ্রেড মনে করলেন এটা নতুন ধরনের শক্তিশালী গামা রশ্মি। দ্রুত গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন জুলিও-কুরি।

তাঁদের পেপার পড়ে রাদারফোর্ড বুঝতে পারলেন ভুলটা কোথায়। গামা রশ্মির কোন ভর নেই। তাই গামার পক্ষে প্রোটনের মত ভারী কণাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া সম্ভব নয়। তার মানে নিউক্লিয়াসে প্রোটন ছাড়াও আরো কিছু আছে যা প্রোটনের মতোই ভারী।

ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে রাদারফোর্ডের ছাত্র জেমস চ্যাডউইক আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষাটা করে একই ফল পেলেন। কিন্তু ফলাফল ব্যাখ্যা করলেন সঠিকভাবে। আবিষ্কৃত হলো নিউক্লিয়াসের আরেকটি উপাদান – নিউট্রন। অল্পের জন্যই নিউট্রন আবিষ্কারের কৃতিত্বটা আইরিন ও ফ্রেডের হাত থেকে ফস্কে চলে গেলো জেম্‌স চ্যাডউইকের হাতে। [নিউট্রন আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন চ্যাডউইক।]

১৯৩২ সালে আইরিন ও ফ্রেডের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলো। আইরিন তাঁর বাবার নাম অনুসারে ছেলের নাম রাখলেন পিয়ের। হেলেন আর পিয়ের মাদাম কুরির চোখের মণি হয়ে উঠলো। সময় পেলেই মাদাম নাতি-নাতনিদের সাথে খেলতে চেষ্টা করেন। তাঁর কাজের অনেকটুকুই এখন আইরিন সামলাচ্ছেন। তবুও তিনি রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে যাওয়া থামাচ্ছেন না। ১৯৩৩ সালের সলভে কনফারেন্সে যোগ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

এদিকে পিয়েরের জন্মের পর আইরিন আরো দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই তাঁকে অনেক বয়স্কা মনে হচ্ছে। যক্ষা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। কিন্তু কোনকিছুই তাঁকে ঘরে আটকে রাখতে পারলো না। তিনি কাজে ফিরে গেলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ল্যাবে গিয়েই নতুন পরীক্ষায় হাত দিলেন।

নিউট্রন আবিষ্কৃত হবার পর ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের গবেষণায় বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। আইরিন ও ফ্রেড উইলসন ক্লাউড-চেম্বার ব্যবহার করে নিউট্রন নিয়ে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁরা দেখলেন ক্লাউড-চেম্বারে ইলেকট্রন-ট্র্যাকের পাশাপাশি নতুন ধরনের ট্র্যাক দেখা যাচ্ছে – যা শুধুমাত্র সম্ভব যদি ইলেকট্রনের চার্জ পজিটিভ হয়। আইরিন ও ফ্রেডের আগে এ পরীক্ষা আর কেউ করেননি এবং এই পজিটিভ ইলেকট্রনের অস্তিত্ব সম্পর্কেও কেউ জানতেন না। তবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক পজিটিভ ইলেকট্রনের সম্ভাবনার কথা প্রকাশ করেছিলেন। ডিরাকের পেপার আইরিন ও ফ্রেডের চোখে পড়েনি।

পজিটিভ চার্জের ট্র্যাক দেখে তাঁদের ফলাফল সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হলেন আইরিন ও ফ্রেড। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) কার্ল এন্ডারসন আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষাটা করে একই রেজাল্ট পেলেন এবং সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে এগুলো পজিট্রনের ট্র্যাক। আরো একটা যুগান্তকারী আবিষ্কারের কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হলেন আইরিন ও ফ্রেড। [পজিট্রন আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন কার্ল এন্ডারসন।]

পরপর দু’বার সঠিক পরীক্ষণের মাধ্যমে আইরিন ও ফ্রেড নিউট্রন ও পজিট্রন আবিষ্কারে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের কাছে আইরিন ও ফ্রেডের গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণ বেড়ে গেলো। ১৯৩৩ সালের সল্‌ভে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হলেন তাঁরা। সল্‌ভে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হওয়া মানে বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়া। মাদাম কুরি তো সল্‌ভে কনফারেন্সের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে সবগুলো কনফারেন্সেই আমন্ত্রিত হয়েছেন। আইরিন ও ফ্রেডের এটাই প্রথম।

কনফারেন্সে যাবার আগে অনেকগুলো পরীক্ষা করলেন তাঁরা। পোলোনিয়ামের সামনে অ্যালুমিনিয়ামের পাতলা পাত রেখে দেখেছেন পোলোনিয়াম থেকে আলফা পার্টিক্যল এসে অ্যালুমিনিয়াম পাতে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে নিউট্রন ও পজিট্রন বের করে দিচ্ছে। বার বার পরীক্ষা করে একই রেজাল্ট পেয়েছেন আইরিন ও ফ্রেড।

১৯৩৩ সালের সল্‌ভে কনফারেন্সে আইরিন ও মাদাম কুরি

১৯৩৩ সালের অক্টোবরে ব্রাসেল্‌সে সল্‌ভে কনফারেন্সে আইরিন ও ফ্রেডের পরীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করলেন ফ্রেড। আইরিন কথা বলতে পছন্দ করেন না, তাই তিনি চুপচাপ বসে আছেন অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে। কনফারেন্সে চল্লিশ জন আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীর মধ্যে বিশ জন নোবেল বিজয়ী। চল্লিশ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন নারী বিজ্ঞানী – মাদাম কুরি, আইরিন আর লিজা মাইটনার।

ফ্রেডের বক্তৃতার পর লিজা মাইটনার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি নিজে বেশ কয়েক বার এই পরীক্ষাগুলো করে দেখেছি, কিন্তু একবারও কোন নিউট্রন বের হবার প্রমাণ পাইনি। সুতরাং জুলিও-কুরির ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য নয়।”

লিজা মাইটনার বিখ্যাত পরীক্ষণ-বিজ্ঞানী। তাঁর প্রভাব অনেক বেশি। তাই অনেকেই নবীন বিজ্ঞানী আইরিন ও ফ্রেডের ফলাফল বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু নিল্‌স বোর ও উল্‌ফগং পাউলি ফ্রেড ও আইরিনের ফলাফলে খুবই খুশি। তাঁরা আইরিন ও ফ্রেডের কাজ খুবই সম্ভাবনাময় বলে মত দিলেন।

প্যারিসে ফিরে মাদাম কুরি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর গলব্লাডার অপারেশন করাতে হলো। পজিট্রনের দুঃখ ভুলতে আইরিন একটা বই লিখলেন – ‘লা ইলেকট্রন-পচিটিফ’ বা ‘দি পজিটিভ ইলেকট্রন’। ১৯৩৪ সালের শুরুতে আইরিন ও ফ্রেড পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন পোলোনিয়াম আর অ্যালুমিনিয়ামের পাত নিয়ে। তাঁরা দেখতে পেলেন পোলোনিয়ামের আলফা পার্টিক্যল অ্যালুমিনিয়ামের সাথে বিক্রিয়া করে নতুন ধরনের তেজষ্ক্রিয়তা তৈরি করছে। কীভাবে হচ্ছে?

অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাঁরা নিশ্চিত হলেন যে পোলোনিয়াম থেকে আলফা পার্টিক্যল বের হয়ে অ্যালুমিনিয়ামের নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষ ঘটায়। তাতে অ্যালুমিনিয়ামের নিউক্লিয়াস থেকে একটি নিউট্রন বেরিয়ে আসে – ফলে অ্যালুমিনিয়াম নিউক্লিয়াস রূপান্তরিত হয় একটি তেজষ্ক্রিয় ফসফরাস নিউক্লিয়াসে। কয়েক মিনিট পর এই তেজষ্ক্রিয় ফসফরাস থেকে একটি পজিট্রন বের হয় – ফসফরাস নিউক্লিয়াস তার তেজষ্ক্রিয়তা হারিয়ে পরিণত হয় একটি সিলিকন নিউক্লিয়াসে। তার মানে তাঁরা কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তার সন্ধান পেয়েছে!

ফ্রেড তো খুশিতে আত্মহারা। আইরিনও খুশি – তবে তাঁর তেমন কোন উচ্ছ্বাস নেই। ফ্রেড ছুটে গিয়ে মাদামকে খবর দিলেন। আবার ছুটে এসে আইরিনকে চুমু খেয়ে ছুটলেন ইপিসিআইতে পল লাঁজেভিকে খবর দিতে। একটু পর লাঁজেভিকে সাথে নিয়ে ল্যাবে এসে দেখলেন মাদাম ইতোমধ্যে আইরিনের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন কী কী ঘটেছে।

আইরিন ও ফ্রেড পুরো পরীক্ষাটা আবার করলেন মাদাম কুরি আর পল লাঁজেভির সামনে। পল লাঁজেভি আইরিন ও ফ্রেডকে অভিনন্দন জানালেন। আর মাদাম কুরিকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, “এবার আরো দুটো নোবেল পুরষ্কার আসছে কুরি পরিবারে”।

পরের বছরই পল লাঁজেভির কথা সত্যি হয়েছে। কিন্তু মাদাম কুরি তা দেখে যেতে পারেননি। কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পর আইরিন ও ফ্রেড স্কি করতে স্যাভোই পাহাড়ে যাবার সময় মাদাম কুরি ছেলেমানুষের মত বায়না ধরলেন মেয়ের সাথে যাবার জন্য। কিছুতেই বোঝানো গেলো না ৬৬ বছর বয়স্কা শিশু মেরিকে। স্কি না করলেও বরফঢাকা পাহাড়ে উঠে হাঁটাহাঁটি করলেন তিনি এবং আছাড় খেয়ে পড়লেন। প্যারিসে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো তাঁকে।

একটু সুস্থ হয়ে বাড়িতে এসে মে মাসে শুধু একবারের জন্য ইনস্টিটিউটে পা রেখেছিলেন মেরি। তারপর আর হাঁটাচলা করতে পারেননি। ইভ সব কাজকর্ম ছেড়ে বাড়িতে মায়ের সেবা করতে লাগলেন। ত্রিশ বছর বয়সী ইভ বেশ কয়েকটি ভালোবাসার সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আইরিন ও ফ্রেড হেলেন ও পিয়েরকে নিয়ে প্রতিদিনই মাকে দেখতে আসেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মা ইনস্টিটিউটের সব খবর জানতে চান।

অনেক ডাক্তার এসে মেরিকে দেখে যাচ্ছেন। রোগ নির্ণয়ে নানারকম মতামত দিচ্ছেন। এখন বলা হচ্ছে তিনি মারাত্মক যক্ষায় আক্রান্ত। বাড়ির চেয়ে হাসপাতালেই ভালো থাকবেন। বিজ্ঞানী হিসেবে মাদাম যতটা ভালো রোগী হিসেবে ততটাই খারাপ। তিনি ডাক্তারের কোন পরামর্শ মেনে চলেন না। দুই বোন অনেক জোর করে মা-কে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ক’দিন পর ডাক্তাররা বললেন তাঁর ফুসফুসের চেয়েও বড় সমস্যা তাঁর রক্তে। রক্ত পরীক্ষা করার পর ধরা পড়লো – লিউকেমিয়া। মাদাম কুরির তৃতীয় সন্তান রেডিয়ামের প্রতি ভালোবাসার ফল তাঁর ব্লাড ক্যান্সার।

আইরিন প্রতিদিনই অফিসে যাচ্ছেন, সব কাজ করছেন ঠিকমত। কিন্তু মায়ের জন্য তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে। নিজের কষ্টের কথা বলার অভ্যাস নেই বলে কাউকেই বলতে পারছেন না মা তাঁর জীবনে কতখানি। জুলাইয়ের তিন তারিখ মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। তিনি কাউকে আর চিনতে পারছিলেন না। ১৯৩৪ সালের ৪ঠা জুলাই সকালে মাদাম কুরি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মাদাম কুরির মৃত্যুর পর রেডিয়াম ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব নেন আইরিন। গবেষণার সাথে সাথে প্রশাসনিক কাজও বেড়ে যায় অনেক। ফ্রেডের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় এখন অনেক বেশি বিস্তৃত। জার্মানিতে নাৎসিদের উত্থান ঘটেছে। আইনস্টাইন সহ অনেক বিজ্ঞানী জার্মানি ছেড়ে চলে গেছেন। ফ্রেড কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছেন।

[শেষ পর্ব]