রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ

আজ রানা প্লাজা’র মর্মান্তিক ঘটনার এক বছর হয়ে গেল।

সব মিডিয়ায় বেশ ফলাও করে এসেছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে জোরেশোরে লেখালেখি হচ্ছে, সে সময় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করা অনেকে সেই দিনগুলোর সৃত্মিচারণ করছেন।
আর আহত, স্বজনহারা ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মানুষরা চোখের জলে দিনটি পার করছে।

রানা প্লাজা ট্র্যাজিডিতে স্বজন হারাদের আর্তি

কি আছে এদের মনে?
শুধুই নিখাদ কষ্ট।

আচ্ছা, এই এক বছরে এই মর্মান্তিক ঘটনার শিক্ষা আমরা কতটুকু কাজে লাগিয়েছি, এই ধরণের দূর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা কতটুকু কাজ করেছি?
আসলেই কি আমাদের কোন সফলতা আছে?
রানা প্লাজার মত মর্মান্তিক কোন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, এর জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তায়, কর্মস্থলের পরিবেশের উন্নতির জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ

আমি পত্রিকা ঘেঁটে শুধু কিছু তদন্ত কমিটি গঠন আর এই ধরণের দূর্ঘটনা প্রতিরোধে কিছু সরকারি আদেশ জারির খবর পেলাম কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখলাম এগুলোর কোনটিরই কাজ ঠিকভাবে চলছে না।
ক্ষতিপূরণের কাজ কিছু হয়েছে; তবে, ক্ষতিপূরণ যাতে আর না দিতে হয়, সেজন্য স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে যত্মশীল হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তা হয়নি।

প্রাপ্তির মধ্যে শুধু আছে-
রানা প্লাজার মালিক রানা দেশ থেকে পালানোর সময় ধরা পড়ে। বর্তমানে তার বিচারকার্য চলছে।
রানার পক্ষ হয়ে কথা বলা স্থানীয় এমপি মুরাদ জং-কে এবারের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। মনোনয়ন ডাক্তার এনামকে দেয়া হয়েছে, যার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রানা প্লাজা ধসে আহতদের চিকিৎসার মূল ক্যাম্প ছিল। ডাক্তার এনাম হচ্ছেন ওই আসনের বর্তমান এমপি।

মূলত: রানা প্লাজার ঘটনার পর সরকারি পর্যায়ে যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছে, সেগুলো গত বিএনপি আমলের নৌ-পরিবহণ মন্ত্রীর “আল্লার মাল আল্লা নিছে” কিংবা, “মৃতদের পরিবারে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছাগল প্রদান কর্মসূচীর” সাথে তুলনীয়; বস্তুত: কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

আসলে, আমরা “সৃত্মিভ্রম ও সর্বংসহা রোগে” আক্রান্ত জাতি।
আমরা আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় ভুলে যাই, কষ্ট ভুলে যাই।

রানা প্লাজার নির্মম বাস্তবতা

বাস্তবতা হলো, রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনসের মত ঘটনাগুলো ঘটা কখনই বন্ধ হবে না।
এই ধরণের ঘটনাগুলো বার বার ঘটবে।
ঘটনাটিকে ফুল মিডিয়া কাভারেজ দেয়া হবে।
উদ্ধার তৎপরতা শুরু হবে।
সেই সময় দেশের আমজনতা আক্রান্তদের সেবাই ছুটে যাবে।
এনজিও, একটিভিস্ট ফোরাম, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই সমস্যা সমাধানে নানান উপায় বাতলে দেবে, নানান দাবি পেশ করবে, আন্দোলনে মুখরিত হবে চারপাশ।
সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করবে, কিছু সরকারি আদেশ জারি হবে, ক্ষতিপূরণ প্রদান কর্মসূচী শুরু হবে, কিছুদিন এই বিষয় নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর লম্ফ-ঝম্ফ করবে।
হাজার-লক্ষ-কোটি টাকা আক্রান্তদের সহায়তায় দেশ ও দেশের বাইরে থেকে তোলা হবে, তা মানবসেবায় খরচ করা হবে, আবার কেউ কেই সেই টাকা মেরে দেবে।
এরপর, আস্তে আস্তে সব স্থিমিত হয়ে যাবে।
আমরা সব ভুলতে থাকবো, এক সময় সবকিছু সয়ে যাবে।
এরপর, এক বছর পূর্তির দিনে আবার আমরা সবাই একটু নেড়েচেড়ে বসবো, ফেসবুক-সোশ্যাল নেটওয়ার্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, মিডিয়া-এনজিও-একটিভিস্ট ফোরাম-মানবাধিকার সংস্থাগুলো কয়েকদিন হৈ-চৈ করবে, সরকার হালকা পাতলা কাজ করবে বা, করার উদ্যোগ নিবে।
এরপর, আবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে, আমরা আবার সব ভুলে যাবো।
এর পর থেকে প্রতিবছর বর্ষপূর্তিতে আমরা সবাই একটু উঁহু-আহা করবো।
তারপর, আবার সব ঠান্ডা।
এভাবেই চলতে থাকবে, প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন দূর্ঘটনা ঘটতে থাকবে আর চক্রাকারে এই ঘটনাগুলো পুনরাবৃত্তি হবে।

এর শুধু একটিই প্রতিকার হতে পারে।
তা হলো- আমাদের সচেতন হতে হবে, সত্যিকারে আমাদের জেগে উঠতে হবে; তা না হলে এই অশুভচক্র থেকে কখনোই আমরা মুক্তি পাবো না, গর্ত থেকে কখনোই আমাদের উত্তরণ করা হবে না।

জনতা সত্যিকারে জেগে উঠুক, এই কামনা করি…
রানা প্লাজা সহ দেশের সব দূর্ঘটনায় নিহতের স্বজন, আহত ও ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতি অন্ত:স্থল হতে সহমর্মিতা রইল।