মূল : ডোনাল্ড আর প্রোথেরো*

‘যে সব লেখক প্রজাতির পরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাস করেন না তারা এটা বারে বারে বলে থাকেন ভূতত্ত্ব কোন সংযোগ তুলে ধরে না। এই উক্তি… নিতান্তই ভ্রান্ত…। ভূ-তাত্ত্বিক গবেষণায় যেটা উদ্ঘাটিত হয়নি তা হল, সকল বিলুপ্ত এবং বর্তমান প্রজাতিকে সংযুক্ত করে রাখা অসংখ্য বিভাজনের অস্তিত্ব।’
–চার্লস ডারউইন, অরিজিন অব স্পিসিজ

১৮৫৯ সালে ডারউইন যখন প্রথমবারের মত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে জীববিবর্তনের ধারণা প্রকাশ করেন, ফসিল রেকর্ডে তখন তার এই বক্তব্যের পক্ষে সামান্যই প্রমাণ ছিল। এমনকি ডারউইন তাঁর ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ বইয়ে সম্পূর্ণ দুটি অধ্যায় লিখেছেন ভূ-তাত্ত্বিক রেকর্ডের অসম্পূর্ণতা নিয়ে। (ভূ-তাত্ত্বিক রেকর্ডে অসর্ম্পূণতা নিয়েইে দুটি সম্পূর্ণ অধ্যায় লিখেছেন) ডারউইন যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ফসিলের এই সীমিত সংখ্যা তার ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রস্তাবনার অন্যতম দুর্বল কাঠামো হিসেবে প্রতীয়মান হবে। এরপর অবশ্য অরিজিন অব স্পিসিজ প্রকাশের মাত্র দুই বছর পরে ‘আর্কিওপটেরিক্স’র (Archaeopteryx) প্রথম নমুনা আবিষ্কৃত হয়, যাকে অনেকে পাখি ও সরীসৃপের মধ্যকার ‘মিসিং লিঙ্ক’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আবিষ্কৃত প্রচুর সংখ্যক ফসিল থেকে জানা গিয়েছে কিভাবে আজকের তেজস্বী ঘোড়াগুলো (৫৫ মিলিয়ন বছর আগের) কুকুরের সমান আকারের তিন আঙুল বিশিষ্ট এক ধরনের প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে। ওই সময়কাল থেকে ফসিলের ব্যাখ্যা বেশ ভালভাবে পরিমার্জিত হয়ে আসছে।

বিগত কয়েক দশক ধরে প্রচুর সংখ্যক ফসিলের আবিষ্কারের ফলে জীববিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ডিএনএ গবেষণা থেকে আরো স্পষ্ট হয়েছে কিভাবে এই রেকর্ডগুলো পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ প্রকাশ করে চলেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও অনেক মানুষ ভ্রান্তভাবে মনে করে ফসিল রেকর্ড থেকে এখনও কোনো জীবের ‘পরিবর্তনশীল কাঠামো’ (transitional forms) দেখা যায় না। বৃহৎ অর্থে বলা যায় এই ধরনের ভুল ধারণাগুলো আদতে সৃষ্টিবাদীদের দ্বারা ছড়ানো কিছু মিথ্যা প্রচারণা মাত্র।

এটা সত্য যে ফসিল রেকর্ডে এখনও পূর্ণাঙ্গতা আসেনি। ১ শতাংশেরও কম সংখ্যক প্রজাতি, যারা এই বিশ্বে কোনো না কোনো সময়ে বাস করেছে, আজ ফসিল হিসেবে সংরক্ষিত আছে বলে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন। স্বাভাবিকভাবে ফসিলের এই দুষ্প্রাপ্যতার কারণ হিসেবে বলা যায় আমাদের এই পৃথিবীতে কোনো মৃত জীবকে লক্ষ্যাধিক বছর টিকে থেকে ফসিলে রূপান্তরিত হওয়ার পরিবেশ অনেকটাই অস্বাভাবিক।

তারপরও এমন অনেক নমুনা পাওয়া গেছে যা জীবের বিভিন্ন গ্রপের মধ্যেকার ঘটে যাওয়া বড় ধরনের পরিবর্তনকে ফুটিয়ে তোলে। অনেক ফসিল থেকে দেখা গেছে কিরকম ‘অসংখ্য বিভাজন’ প্রজাতিগুলোকে সংযুক্ত করে। একটি ধারা এমন যে যদি কোনো ফসিলের ক্রমউত্তরসূরিদের মধ্যে একটি সরাসরি সংযোগ টানতে পারে (যার সম্ভাবনা অবশ্য কম) তবে তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক আছে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। ফসিল-বিজ্ঞানীরা বলেন যখন একটি ফসিল দেখতে পূর্বসূরির মত হয় তার অর্থ হল ওই ফসিলটির সাথে ওদের প্রকৃত পূর্বসূরির আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।

ঘোড়ার বিবর্তন এক্ষেত্রে ভালো একটি উদাহরণ। বিভিন্ন ফসিল যখন একসাথে সাজানো হল এবং এর মাধ্যমে ‘Eohippus’ থেকে Equus পর্যন্ত পূর্বসূরি ও উত্তরসূরির দাগাঙ্কন করা সম্ভব হয়ে গেল। যখন আরো কিছু ফসিল আবিষ্কৃত হল তখন ফসিলবিদরা ঘোড়ার এই সাধারণ বংশক্রমটিকে আরো স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারলেন। এই ফসিলগুলো এখন ঘোড়ার বিবর্তন সম্পর্কে বিভিন্ন পূর্বপুরুষের (যার অনেকগুলোই বিলুপ্ত হয়ে গেছে) অস্তিত্বের প্রমাণসহ বিবর্তনের ধারা সম্পর্কে আমাদেরকে স্পষ্ট চিত্র দেখাতে পারে। আমেরিকার নেব্রাস্কার একটি পাথর খনির শিলাখণ্ডে প্রায় ১২ মিলিয়ন বছর পুরানো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির ঘোড়ার ফসিল দেখা গেছে। একেবারে প্রথম দিকের প্রজাতির ঘোড়াদেরকে (যেমন Protorohippus যা ৫৩ মিলিয়ন বছর আগের ইওসিন যুগের প্রথম দিকের) বংশক্রমের শুরুর দিকের প্রজাতির ঘোড়াদের যেমন Homogalax থেকে আলাদা করা দৃশ্যত সম্ভব নয়। এই Homogalax থেকে আবার টাপির ও গন্ডারের উদ্ভবও হয়েছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে যখন আমি প্রত্নজীববিদ্যার স্নাতক পর্যায়ের ক্লাস করতাম তখনই আবিষ্কার করেছিলাম এই দুই প্রজাতির মধ্যে পার্থক্য করা অনেকটাই কঠিন কাজ।

ঘোড়ার বিবর্তনের চিত্র
ঘোড়ার বিবর্তনের চিত্র

এখনকার আবিষ্কারগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে চমকপ্রদ হল সেই ফসিলগুলো যেগুলো জলজ জীব তিমির সাথে তাদের ডাঙ্গার পূর্বসূরির সাথে সংযোগ প্রদর্শন করে। আপনি যদি ডলফিন, তিমি, নীল তিমিদের দিকে তাকান তবে এদের ডাঙ্গায় হাঁটার দৃশ্য কল্পনা করা আপনার জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। এখনও তিমির শরীরে, মেরুদণ্ডের নিচের মাংশপেশির ভিতরে হিপবোন এবং টেইল বোন বা লেজের হাড়ের চিহ্ন বহন করে। মাথার খুলি ও দাঁতের সকল বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে ফসিলবিজ্ঞানরী অনেক আগেই এটা জানতে পেরেছেন খুরওয়ালা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সাথে তিমি মাছের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু প্রায়শ সৃষ্টিবাদীরা তিমির ক্ষেত্রে ট্রাঞ্জিশনাল ফসিলের অভাবকে বিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চালায়।

ডারউইনযুগের পরিস্থিতির এখন পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ৫২ মিলিয়ন বছর পুরনো ইওসিন যুগের Pakicetus নমুনা পাকিস্তান থেকে সংগ্রহ করা হয়। যদিও Pakicetus এর শরীর ডাঙ্গার প্রাণীদের মতো। এর মাথা এবং দাঁত ছিল archaeocetes এর মত। archaeocetes ছিল তিমির প্রথম দিকের গোত্র। যারা আজ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর আগে মধ্য ইয়োসিন যুগের সমুদ্রে সাঁতার কেটে বেড়াত।

১৯৯৪ সালে Ambulocetus natans (যার আক্ষরিক অর্থ ‘যে তিমি হাঁটতেও পারে আবার সাঁতরাতেও পারে’) এর ফসিল আবিষ্কৃত হয় পাকিস্তান থেকে। এই প্রাণীটির আকার ছিল একটা বড় সী-লায়ন বা সিন্ধু ঘোটকের সমান। এর সামনের এবং পিছনের দুই পাখনাতেই চওড়া পা লাগানো ছিল। এ কারণে এই প্রাণীটি হাঁটতেও পারত আবার একইসাথে সাঁতরাতেও পারত। এছাড়াও এর পায়ের সাথে ছোট ছোট খুর যুক্ত ছিল। এদেরও মাথা এবং দাঁত ছিল archaeocetes -এর মত। উদ্ধারকৃত ফসিল থেকে অনুমান করা যাচ্ছে Ambulocetus সাঁতার কাটত অনেকটা ভোঁদড়ের মত পিঠকে উপর-নিচ করিয়ে। এটা বোধহয় তিমির লেজের পূর্বসংকেত। ১৯৯৫ সালে আরেকটি ট্রাঞ্জিশনাল প্রাণী Dalanistes -কে খুঁজে পাওয়া যায়। এর পা ছিল Ambulocetus অপেক্ষা ছোট, পায়ের পাতা ছিল চওড়া এবং আঙুলওয়ালা। আর ছিল লম্বা লেজ এবং বেশ বড় আকৃতির তিমির মত মাথা।

এতদিনে ডজনেরও বেশি তিমির ট্রাঞ্জিশনাল ফসিল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই ধরনের প্রাণীর ফসিল পাওয়া অত্যন্ত দুর্লভ। তাই উদ্ধারকৃত ফসিল রেকর্ডে এটা একটা চমৎকার নিদর্শন। জীবিত প্রজাতিগুলোর ডিএনএ থেকে পাওয়া সূত্র অনুসারে ধরে নেয়া হয় তিমিরা বিবর্তিত হয়েছে artiodactyls (আর্টিওডাক্টাইলস) নামক ক্ষুরবিশিষ্ট এবং সমান আঙুলওয়ালা পায়ের অধিকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী হতে। সহজ ভাষায় জলহস্তীর মত প্রাণী থেকে। নাটকীয়ভাবে এই অনুকল্পটি ২০০১ সালে দুই প্রজাতির তিমির মধ্যে গোড়ালির হাড় ‘double-pulley’ -এর আবিষ্কারের মাধ্যমে নিশ্চয়তা লাভ করে। কারণ এটা archaeocetes -এর বৈশিষ্ট্য।

শুধু তিমিই ডাঙ্গার প্রাণী থেকে বিবর্তিত একমাত্র জলচর প্রাণী নয়। আধুনিক সিরেনিয়ানরাও (Sirenian বলতে বোঝায় বৃহদাকার তৃণভোজী জলচর প্রাণীদের গোত্রের অন্তর্গত যে কোন প্রজাতি যেমন manatees বা dugongs) সহজে পোষ্য এবং সামনের উপাঙ্গে পাখনা থাকে কিন্তু পিছনের উপাঙ্গে থাকে না। ২০০১ সালে ওয়াশিংটন ডিসির হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক ফসিল বিশেষজ্ঞ ড্যারিল ডমনিং জ্যামাইকা থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর পুরনো Pezosiren portelli -এর একটি পূর্ণাঙ্গ ফসিল উদ্ধার করেন। এই প্রাণীটির সিরেনিয়ানদের মতই মাথার খুলি এবং দাঁত ছিল। এর পাঁজরও সিরেনিয়ানদের মত শক্ত হাড় দ্বারা নির্মিত ছিল যা প্রাণীটির ভারকেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। এর চারটি আঙুলসহ পা ছিল, তবে পাখনা ছিল না। অন্যান্য ট্রাঞ্জিশনাল ফসিলের মাধ্যমে সিল ও সি-লায়নদের সাথেও ভাল্লুকের মত কোনো পূর্বসূরির সাথে সংযোগ আমরা দেখতে পাই।

তিমির বিবর্তনের চিত্র
তিমির বিবর্তনের চিত্র

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উৎপত্তির ব্যাপারে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ আছে। স্তন্যপায়ী এবং এর বিলুপ্ত আত্মীয়রা Synapsida নামক এক বড় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই গোষ্ঠীর প্রথমদিকের প্রাণীগুলোকে ‘স্তন্যপায়ীর মত সরীসৃপ’ বলা হত, যদিও ওগুলো আসলে সরীসৃপ ছিল না। তারা আগেই প্রাণীকূলের আলাদা শাখা হিসেবে বিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল ২৮০ বছর আগের সবচেয়ে বড় খাদক (predator) Dimetrodon এর ঢেউয়ের মত পিঠ, বাচ্চাদের কাছে খেলনা ডাইনোসরের কারণে বেশ পরিচিত, যদিও এটা আদৌ ডাইনোসর ছিল না। Dimetrodon এর বড় ও ধারাল ছেদন দাঁত এবং স্তন্যপায়ীদের মত খুলিও ছিল।

পরবর্তী ৮০ মিলিয়ন বছরে Synapsida রা ভাল্লুক এবং নেকড়ের মত শিকারী প্রাণীর পাশাপাশি শূকরের মত তৃণভোজী প্রাণীতেও বিবর্তিত হয়। এই সময়ে তারা স্তন্যপায়ীদের আরও অনেক বৈশিষ্ট্য লাভ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চোয়ালের বাড়তি পেশি যা চাবানোর কাজে সহায়তা করে; মুখ ভিতরে অতিরিক্ত তালু যা তাদের একই সাথে খেতে এবং শ্বাস নিতে সাহায্য করে। একাধিক স্তরে সজ্জিত চর্বন দাঁত যা খাদ্য সরাসরি গিলে ফেলার আগে চাবানোর কাজে লাগে; বড় মস্তিস্ক এবং যথাযথ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য পাঁজরের চারপাশের পেশি। এদের দেহে লোম থাকার প্রমাণ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা নিশ্চিতভাবেই স্তন্যপায়ীদের বৈশিষ্ট্য। চীন, দক্ষিন আফ্রিকা ও টেক্সাসে পাওয়া ২০০ মিলিয়ন বছর আগের সত্যিকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীর ফসিলেও উপস্থিতির মাধ্যমে Synapsida -দের ঘটনা শেষ হয়।

বিভিন্ন প্রাণীর নিচের চোয়ালের ফসিল পর্যবেক্ষণের দ্বারা স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা যায়। সরীসৃপ ও আদি ঝুহধঢ়ংরফধ-দের বাম ও ডান উভয়পাশের নিচের চোয়ালগুলো হাড় দ্বারা গঠিত, যার কোনোটি আবার দাঁতকেও ধরে রাখে। Synapsida -দের বিবর্তনের সাথে চোয়ালের হাড়গুলো বড় হতে থাকে এবং শেষে মাথার খুলির সাথে সংযোগ স্থাপন করে। সরীসৃপদের চোয়ালের একটি হাড় সঙ্কুচিত হতে হতে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অন্য হাড় দুটি সরতে সরতে মধ্য কর্ণে চলে যায় যেখানে তারা নেহাই ও হাতুড়ির মত কাজ করতে থাকে। তারা কানের পর্দায় শব্দ উৎপন্ন করে যা স্টিরাপ হাড় হয়ে অন্তঃকর্ণে পৌঁছে যায়। আপনারা যদি সরীসৃপদের শব্দ শোনার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে না জানেন তবে হাড়গুলোর কাজের এমন পরিবর্তন আপনাদের কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে। সরীসৃপদের ক্ষেত্রে শব্দ নিচের চোয়াল থেকে মাথার খুলির মধ্য দিয়ে অন্তঃকর্ণে পৌঁছায়। কানের পর্দায় এসময় যে কম্পন অনুভূত হয় তা কোনো বস্তুকে যাচাই করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যান্য গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ‘মিসিং লিঙ্ক’ দেখা যায়। অনেক প্রজাতির ফসিল এখন ডাইনোসর থেকে পাখির বিবর্তনের চিত্রটি আরও স্পষ্ট করে। ১৫০ মিলিয়ন বছর পুরানো জুরাসিক যুগের ফসিল রেকর্ডে পাওয়া Archaeopteryx -এর উদাহরণ এখানে দেখানো যায়। চীনের Lower Cretaceous থেকে পাওয়া ১৪০ বছর পুরানো ফসিলেও পাখির বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন Sinornis এর ভাঁজ করবার মত ডানা ছিল, থাবা দিয়ে ধরবার উপযোগী পা ছিল, লেজের হাড়গুলো সব একসাথে মিশে একটি হাড়ে পরিণত হয়েছিল। দাঁতবিহীন ঠোঁট আমরা প্রথম দেখি Confuciusornis -এ। স্পেনের প্রায় ১৩০ মিলিয়ন বছর পুরনো Lower Cretaceous শিলা থেকে পাওয়া যায় Iberomesornis, যার বেশ মজবুত বুকের হাড় ছিল যা উড়ার জন্য ব্যবহৃত পেশিকে আটকে রাখত। এই প্রাণীটির আবার ডাইনোসরের মত আদিম প্রকৃতির মেরুদণ্ডও ছিল।

এই ধরনের পাখিদের ফসিলগুলোকে এখন আকাশে উড়ে না এমন ডাইনোসরদের তালিকায় যোগ করা হয়েছে। Microraptor বা Caudipteryx -এর ফসিলগুলোতে বেশ উন্নত ধরনের পালক দেখা গেছে। এ থেকে বোঝা যায় ওগুলো উড়বার উপযোগী হওয়ারও অনেক আগে আরও ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হত। [ দেখুন ‘Bird’s-eye View’ by Matthew T. Carrano and Patrick M. O’Connor, Natural History; May 2005, Vol. 114 Issue 4, p42]।

আরেকটি পটপরিবর্তন যার পক্ষেও এখন যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণাদি পাওয়া গেছে তা হল উভচর প্রাণীদের ডাঙ্গা বিজয় (অভিযোজন)। দশকের পর দশক ধরে মাছ ও উভচরদের মধ্যবর্তী একমাত্র ফসিলটি ছিল গ্রিনল্যান্ডে পাওয়া ৩৬০ মিলিয়ন বছর পুরনো ডেভনিয়ান যুগের Ichthyostega। উভচর প্রাণীদের সাথে Ichthyostega দের নানা সাদৃশ্য যেমন সুগঠিত পা, কাঁধে পূর্ণাঙ্গ কটিবন্ধ, মেরুদণ্ডের সাথে যুক্ত নিতম্বের হাড় থাকা সত্ত্বেও এদের মুখের উপর পানির ভিতরের বস্তুকণা চিহ্নিত করার জন্য মাছের মত কানকো ছিদ্র এবং মাছেদের মতই পাখনাওয়ালা লম্বা লেজ ছিল।

সাম্প্রতিক আবিস্কারগুলো যেমন একই অঞ্চলে পাওয়া Acanthostega, এই চিত্রটিকে আরও জটিল ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। Acanthostega এর কানের হাড়ও ছিল যা পানির ভিতরে শব্দ শোনার উপযোগী ছিল। Ichthyostega অপেক্ষা বড় পাখনাযুক্ত লেজ Acanthostega এর দেহে দেখা যায়। উন্নততর কানকোর কারণে Acanthostega, Ichthyostega এর চেয়ে আরও বেশি আদিম ও আরও বেশি জলজ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। Acanthostega দের চার পায়ের প্রতিটিতে ৫টির স্থলে ৮টি করে আঙ্গুল ছিল যা আদিমকালের চতুষ্পদী প্রাণীদের ক্ষেত্রে আদর্শ ছিল। এর উপাঙ্গগুলো সাঁতার কাটার পাশাপাশি জলাশয়ের তলদেশের উপর দিয়ে হাঁটার উপযোগী ছিল, ডাঙ্গায় হাঁটার উপযোগী নয়। উভচরদের পা বিবর্তিত হয়েছে ডাঙ্গায় চলার জন্য (পুকুর শুকানো এড়াতে বা খাদ্যের নতুন উৎসের সন্ধানে), প্রচলিত এমন কাহিনীর সাথে এটা সাংঘর্ষিক যে পা বিবর্তিত হয়েছে পানির নিচ দিয়ে হাঁটার জন্যে (বেশিরভাগ স্যালাম্যান্ডাররা আজও যা করে চলে)। তারপর তারা ডাঙ্গায় চলার উপযোগী হয়ে উঠে কারণ সেই ক্ষমতা তারা পেয়ে গিয়েছিল।

এখন সেই বিবর্তনের কথায় আসি যা আমাদের প্রজাতি Homo sapiens গঠনে ভূমিকা রেখেছে। কিছু দিন আগেও মানব গোত্রের ফসিলের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত ছিল। ১৯১২ সালে পিল্টডাউন ম্যান নামে পরিচিত এক প্রবঞ্চনামূলক ফসিলের কারণে সবকিছুতেই অনিশ্চয়তা ও বিভ্রমের এক মায়াজাল তৈরি হয়। কিন্তু গত তিন দশকে সকল আবিষ্কারই আলো নিয়ে এসেছে। আফ্রিকার শাদে ৬ থেকে ৭ মিলিয়ন বছর পুরনো Sahelanthropus এর ফসিল আবিস্কৃত হয়। ইথিয়োপিয়ায় ২ থেকে ৫ মিলিয়ন পুরনো রেকর্ডে নতুন গণ Ardipithecus Australopithecus -এর নতুন দুইটি প্রজাতির (A. anamensisA. bahrelghazali) ফসিলও বের করা সম্ভব হয়। আমাদের নিজেদের প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পুরনো গণ ঐড়সড় এরও বেশ কিছু প্রজাতি চিহ্নিত হয়েছে।

সংক্ষেপে বলা যায় মানুষের ফসিল রেকর্ড এখন অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও সম্পূর্ণ। নতুন উদ্ধারকৃত নমুনাগুলোর অনেকগুলো আবার বেশ বিস্ময়কর। যেমন পুরনো নৃবিজ্ঞানীদের কথার বিরোধিতা করে ফসিলগুলো আমাদের দেখায় দুই পায়ে দাঁড়ানোর ঘটনাটা মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধির আগেই ঘটেছে। মানব বিবর্তনের অনেক পরের পর্যায়ে মস্তিস্কের আকারের বৃদ্ধি ঘটেছে।

মেরুদণ্ডীদের উৎপত্তির ব্যাপারে ফসিল রেকর্ডে একসময় হতাশাজনক ফাঁক রয়ে গিয়েছিল। জীববিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জীবিত প্রাণীকেই (যেমন, lancelets, sea squirts) অমেরুদণ্ডী ও চোয়ালবিহীন মাছের মধ্যকার সংযোগ বলে পরীক্ষা চালাতেন। যতদিন না সাম্প্রতিককালে ৪৮০ মিলিয়ন বছর পুরনো অর্ডোভিসিয়ান যুগের শুরুর দিকের বেশ কার্যকর কিছু ফসিল আবিস্কৃত হয়। তবে সেগুলো শুধু কিছু ভাঙ্গা হাড় আর প্লেট ছড়ানো অবস্থায় ছিল।

তবে চীন থেকে পাওয়া ৫১০ মিলিয়ন থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছর আগের মধ্য ক্যামব্রিয়ান যুগের কিছু ফসিল lancelet এর পূর্বসূরি হিসেবে শুধু বিবেচিত হয় নি, নরম শরীরের আরও কিছু নমুনা প্রথমদিকের মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। এর মাধ্যমে মেরুদণ্ডীদের পদাঙ্ক সেই ক্যামব্রিয়ান যুগেও পাওয়া যায়, যখন আধুনিক প্রাণীজগতের বিভিন্ন শাখার সৃষ্টি হয়েছিল।

ডারউইনের ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ বইয়ের যখন দেড়শ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, প্রাপ্ত ফসিলের নিদর্শনগুলো দেখলে মনে হয় ডারউইনের মনে দুঃখ বা অপরাধবোধ নয়, বরং গৌরব বোধ করতেন। বিবর্তনীয়-জীববিজ্ঞানীরা এখন আরো কিছু আবিষ্কারের দিকে তাকাতে পারেন। যার কতগুলি ছোট মস্তিস্কের দু পেয়ে হোমিনিডদের মত বিস্ময় জাগাবে, আবার কতগুলি বিবর্তনের ঘটনা সম্বন্ধে ফসিলবিদদের ধারণার মোড় ঘুরিয়ে দেবে। তাই ফসিল রেকর্ড জীববিবর্তন ব্যাখ্যার জন্য ডারউইনের সময়ের মত এখন আর বিড়ম্বনার কারণ নয়।

ডোনাল্ড আর প্রোথেরো
* ডোনাল্ড প্রোথেরো আমেরিকার অক্সিডেন্টাল কলেজের ভূতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক। ‘The fossils say yes!’ শিরোনামের প্রবন্ধটি লেখকের অনুমতিক্রমে Natural History ম্যাগাজিন (২০০৫, ১১৪ (৯): ৫২-৫৬) থেকে সংগৃহীত।