সত্তরের নির্বাচনের পরেই পাকিস্তানিরা বুঝে গিয়েছিল, বাঙালিদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। এরা নিজেদের অধিকার আদায় করেই ছাড়বে। ঠিক তখনই পাকিস্তানের নেতা ইয়াহিয়া, ভূট্টোরা বাঙালি নিধনের নীল নকশা করে। ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ পর্যন্ত হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও প্রচুর গোলাবারুদ বাংলাদেশে (পূর্ব-পাকিস্তান) আনা শুরু হয়।
২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের উপর ভয়াল আঘাত শুরু করে পাকিস্তানিরা…
২৫ মার্চ, ১৯৭১, বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা বন্ধ করে সন্ধ্যায় পাকিস্তানের জানোয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করে পশ্চিম-পাকিস্তান চলে যায়।
এই পাকি-জানোয়ারের আদেশে ওইদিন রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে শুরু করে ‘অপারেশান সার্চলাইট’ আর এর সাথেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সর্ববৃহৎ গণহত্যা ও জাতিগত ধোলাই।
এশিয়া টাইমস ‘অপারেশান সার্চলাইট’ সম্পর্কে বলে-
‘সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে “তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।’
.
অপারেশান সার্চলাইটের উদ্দেশ্য ছিল গণহত্যা, গণধর্ষনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিকে দমিয়ে দেয়া।
পরিকল্পনা ছিল, বাঙালী ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবি-আন্দোলনকারী-পুলিশ-ইপিআর-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পাইকারী হত্যা করা।
খুবই পরিকল্পিতভাবে এই গণহত্যা ও জাতিগত ধোলাইয়ের প্রস্তুতি নেয়া হয়।
* গণহত্যার খবর যেন বিশ্বে প্রচার না পায়, সে উদ্দেশ্যে ২৫ মার্চের আগে একে একে সব বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বের করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
* গণহত্যার মূল টার্গেট ছিল- বাঙালী ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকোশলী, আইনজীবি, আন্দোলনকারী, পুলিশ-ইপিআর-সামরিক বাহিনীর সদস্য।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো দিয়ে সূচনা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী-নিধন কর্মসূচী শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল পাকিস্তানী আর্মির বিশেষ টাগের্ট। বিশেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের হল জগন্নাথ হলকে পুরোপুরি মৃত্যুপুরী বানানোর পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সারি করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা ও বেয়নেট চার্জ করে মৃত্যু নিশ্চিত করার ভিডিও ধারণ করেন বুয়েটের শিক্ষক নূরুল উল্লাহ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার ভিডিও:
http://www.youtube.com/watch?v=sMg9Ly9nK0g
পরিকল্পনা অনুসারে পাকিস্তান সরকার বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্ব-পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়েছিল কিন্তু তারপরও আমেরিকান সাংবাদিক বাংলাদেশ ও বাঙালীর অকৃত্রিম বন্ধু সাইমন ড্রিং নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে পাকিস্তানীদের হাতে বাঙালীদের পাইকারী গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন।
সাইমন ড্রিংকের প্রতিবেদন:
http://www.pdfhost.net/index.php?Action=Download&File=a9f1f83444caa97b4ec7b962532cd5cb
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল অনুসারে, অপারেশান সার্চলাইটের শুরু হবার কয়েক ঘন্টার মাঝে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা সহ সারাদেশে পাকিস্তান আর্মি ৫৮,০০০ বাঙালি হত্যা করে।
ওইদিন রাতেই বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে।
গ্রেফতার হবার আগে বাঙালি গণহত্যা শুরু হবার পর বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ, ১৯৭১, প্রথম প্রহরে (রাত ১২ টার কিছু সময় পর) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।
ঘোষণাটি ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ সারাদেশের বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতাকে ফোন করে ও চট্টগ্রামে অবস্থিত ই.পি.আর-ট্রান্সমিটার ও ওয়্যারলেস স্টেশনে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাটি ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশন হতে চট্টগ্রামের নন্দনকানন অফিসে পাঠানো হয়।
বার্তাটি গ্রহন করে ওয়্যারলেস অপারেটর মাহাতাব উদ্দিন একটি চিরকুটে ঢাকা থেকে আগত ওয়্যারলেস বার্তার খবর চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি এম. আর. সিদ্দীকির কাছে পাঠিয়ে দেন এবং ওই (২৬ মার্চ) রাতেই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ১৯টি জেলায় স্বাধীনতার ঘোষনার বার্তা প্রেরণ করেন।
স্বাধীনতা ঘোষনার পাঠক চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা মো: আব্দুল হান্নান (এম, এ, হান্নান)
২৬ মার্চ, ১৯৭১, চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা মো: আব্দুল হান্নান (এম, এ, হান্নান) বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে রেডিওতে সর্বপ্রথম পড়ে শোনান।
মাত্র দু’মিনিটের ভাষণ, সৃষ্টি হল বিপ্লব।
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় শুরু হল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পথচলা।
শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের আত্মপরিচয়-ন্যায়ের যুদ্ধ।
এদিকে, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা মাইকিং করে বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতার ঘোষনা’ করার বিষয়টি প্রচার করেন।
২৬ মার্চ দুপুরের দিকে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে থাকা ‘চট্টগ্রাম রেডিও’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ৩০ মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত এই বেতার কেন্দ্র থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় কিন্তু ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বোমা হামলায় বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস হয়ে যায়।
পরবর্তীতে, বেতার কেন্দ্রটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারতীয়-সীমান্তবর্তী অঞ্চলে স্থানান্তর করা হয়।
এই লেখাটি মুক্তমনায় প্রকাশিত হয়েছে ২৬ মার্চ, ২০১৪ তে…
আজ থেকে ৪৪ বছর আগে একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শুরু হয়েছিল পাকিস্তানিদের নৃশংস বাঙালি নিধন অভিযান “অপারেশান সার্চলাইট”।
একাত্তরের ঠিক এই সময়টাতে সারা বাঙলা হাজার হাজার বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়ে ছিল…
বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল শহীদ, বীরাঙ্গনা, যোদ্ধা ও নিপীড়িত বাঙালী; যাদের জন্য আজ আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি, আত্মপরিচয় পরিচয় পেয়েছি, তাঁদের সকলকে বুকভরা ভালোবাসা, আকন্ঠ কৃতজ্ঞতা, মস্তকাবনত শ্রদ্ধা জানাই।
জয় বাঙলা…
বেশ গুছিয়ে লিখেছেন; আপনার লেখাটি পড়ার সময় যেন ২৬ মার্চ নিজ চোখেই দেখছিলাম; মনে হচ্ছিল আমি সেখানে উপস্থিত।
রক্ত গরম হয়ে উঠছিল।
আপনার আগের লেখাগুলো আগেই পড়া ছিল; আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে আপনার লেখাগুলো আসলেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা নিয়ে দলিল সর্বস্ব লেখা আজকাল তেমন একটা দেখিনা।
এমন লেখা আরও চাই।
আপনাকে মন থেকে অভিবাদন 🙂
সাথে মুক্তমনায় স্বাগতম 🙂
@এম এস নিলয়,
আপনার মন্তব্যটি অনুপ্রেরণা হয়ে রইবে…
অসংখ্য ধন্যবাদ।
বিএনপির কিছু গোবাচু সমর্থক যেমন স্বাধীনতার অনেকের অবদানকে একেবারে সাদা চাদরে ঢেকে সব হাম্বা হাম্বা রবে সব বর্ণনা করে; তেমনই আওয়ামীলীগের কিছু গর্দভ সদস্য রাগিণী সৃষ্টি করতে প্রায় প্রয়াস নেয়!!! অনেকটা বামেরা যেমন স্ট্যালিন-মাওকে মহান মানব দরদী হিসেবে প্রকাশ করার চেষ্টা চালান……
আজকের স্বাধীনতা দিবসে, মুক্তমনায় ঢুকে এই লেখাটা পড়ে পুরাই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল… :-X :-X বিশেষ করে লেখার দ্বিতীয় অংশ যেভাবে রচায়ন হয়েছে তা যেন আমার মন্তব্যর প্রথম অংশকেই সমর্থন করছে!!! :clap :clap
স্বাধীনতা যুদ্ধের মত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের জন্য মনে হয় আমাদের আরও দুটি-তিনটি জেনারেশন অপেক্ষা করতে হবে!!! :-Y :-Y :-Y
@সংবাদিকা,
চাঁদে দ্বিতীয় কোন ব্যাক্তি পদার্পন করেছেন?
দেয়ার ইজ নো প্লেস ফর সেকেন্ড ইন হিস্ট্রি… 🙂
সমঝদারের জন্য ইশারায় যথেষ্ট… 🙂
২৪ মার্চে সোয়াত জাহাজের ঘটনায় যে বিশ্বাসঘাতকতা মেজর করেছিল, তার জন্য একশবার কবর থেকে তুলে জুতাপেটা করা দরকার।
@সাব্বির হোসাইন,
সহনশীলতা কাম্য। আক্রোশ নয় ইতিহাস উল্লেখ করুন বিস্তারিত ভাবে এবং তথ্যসূত্র সহ।
@দেব প্রসাদ দেবু,
আমি কিন্তু কাউকে আক্রমন করিনি।
আমার এই লেখাটি অপারেশান সার্চলাইট, স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্য প্রবন্ধ।
স্বাভাবিক কারণেই এখানে সেইসব তথ্য-উপাত্ত আসবে, যা প্রথমবারের মত ঘটেছিল।
মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তৃতীয় পাঠক, তার আগে আরো দুজন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন।
সুতরাং, স্বাভাবিক কারণেই মেজর জিয়ার নাম এই প্রবন্ধে রাখা হয়নি।
এছাড়া, একাত্তরের ২৪ মার্চ সোয়াতের ঘটনায় বাঙালি গণহত্যার দায় মেজর জিয়ার উপর বর্তায়, এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে তার অনেক বিতর্কিত ভূমিকা আছে।
এইসব কারণে ইতিহাস তাকে কতটুকু বীরের খ্যাতি দিবে, তা ভেবে দেখা দরকার।
@সাব্বির হোসাইন,
সংবাদিকার মন্তব্যের জবাবে আপনিও টেম্পার হারিয়েছেন, সেটাই শুধু নোট করেছি। লেখা বা এর বিষয়বস্তু নিয়ে নয়।
দেখুন-
ভিন্ন ভাবেও জবাব দেয়া যেতো বোধকরি। ধন্যবাদ আপনাকে।
@দেব প্রসাদ দেবু,
তা বটে।
তবে, জিয়া একাত্তরে সময়ের তাগিদে উত্থান হওয়া আত্মসেবায় নিয়োজিত একজন সেনা অফিসার ব্যাতীত ভিন্ন কিছু নয়।
ইতিহাস বর্ণনায় তাকে একজন সুবিধাবাদী বাদে ভিন্ন কিছু বলতে আমি নারাজ।
ধন্যবাদ।
@সংবাদিকা,
যেকোন লেখার সমালোচনা হতেই পারে। আপনি কি সমালোচনা করলেন নাকি ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন? ভাষা ব্যবহারে মার্জিত রুচিবোধ সকলের কাছেই প্রত্যাশা করি।
মুক্তমনায় স্বাগতম। গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
@অভিজিৎ দা,
অসংখ্য ধন্যবাদ।
মুক্তমনায় প্রকাশিত আমার লেখা আরো পাঁচটি লেখা আছে।
সেগুলো আমার প্রোফাইলে যুক্ত করে দেয়া যায় কি?
০১. একাত্তর ও নারী: আলেয়া ও লাইলী বেগমদের কথা
http://blog.mukto-mona.com/?p=31109
০২. স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল
http://blog.mukto-mona.com/?p=36929
০৩. স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল-পর্ব দুই
http://blog.mukto-mona.com/?p=37695
০৪. একাত্তরে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড
http://blog.mukto-mona.com/?p=38360
০৫. পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা হোক
http://blog.mukto-mona.com/?p=38561