“আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা, কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক”
(শামসুর রহমান, আসাদের শার্ট)

“২৬ শে মার্চ কি হয়েছিল, বাবা?”
“এই দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই দিন থেকে বাংলাদেশ ছিল স্বাধীন।”
“কিন্তু তাহলে ১৬ ই ডিসেম্বর কি হয়েছিল, বাবা?”
“ভাল করে বোঝার চেষ্টা কর, ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আর ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর-রাজাকারদের হারিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছিল বাংলাদেশ, ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সূর্য। ”
“কিছুই বুঝতে পারছি না, বাবা। তাহলে বাংলাদেশ কবে স্বাধীন হয়েছিল, ২৬ শে ডিসেম্বর নাকি ১৬ই ডিসেম্বর? আচ্ছা, বাবা, তার আগে বলো তো, স্বাধীনতা মানে কি? স্বাধীনতা পেতে হলে কি করতে হয়? স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেই হয়? নাকি যুদ্ধও করতে হয়? মুক্তিযোদ্ধারা যেমন গেরিলা যুদ্ধ করেছে তেমন? অথবা হতে হয় শরণার্থী? নাকি শুধু যুদ্ধ করলেই চলে, দখলদার শত্রুকে না হারালেও চলে? ”

থাক, পিতা-পুত্রের এই কথোপকথন এই পর্যন্তই থাক। আর দীর্ঘায়িত করলে সবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে নিশ্চিত। তবু এটাও তো ঠিক, স্বাধীনতা দিবসের এই প্রথম প্রহরে সবাই স্বাধীনতা নিয়েই কথা কইবে, কথোপকথনে উঠে আসবে শুধুই স্বাধীনতা। তো এই সময়োচিত প্রহরেই এক বন্ধুকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতেই সে মুখ ঝামটা মেরে বললে, “কিসের স্বাধীনতা? এত দুঃখ, এত দারিদ্র্য, এত বঞ্চনা, এত দুর্নীতি, এত স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতা নিয়ে এত কামড়াকামড়ি- তারপরও বলবি আমরা স্বাধীন? হয়ত দেশটা স্বাধীন, কিন্তু আমরা পরাধীন।”

বন্ধুটির বক্তব্য নিয়ে অনেক ভাবলাম, অনেক মাথা চুলকলাম। কিন্তু আমার অবস্থা হল উপরে উল্লেখিত বালকটির মতই। মাথা ঘুরে ঘুরে শুধুই পাঁক খেতে লাগল “স্বাধীনতা কি? স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায়? স্বাধীনতা মানে কি?” বন্ধুটির কথা আগাপাছতলা সবই খুঁড়লাম, কিন্তু শুধু ডুবলামই কেবল, বেরুতে পারলাম না ঘূর্ণিপাক থেকে।

আচ্ছা, বন্ধুটি “আমরা পরাধীন” বলল কেন? সে কি “আমি পরাধীন” বলতে পারত না? তাহলে স্বাধীনতা কি কোন বহু-বাচনিক শব্দ? যেমন, একটি জাতি স্বাধীন হতে পারে কেবল? নাগরিক হতে পারে না? স্বাধীনতা কেবলই একটি জাতিগত শব্দ, কখনো নাগরিক নয়?

কিন্তু তা হবে কেন? স্বাধীনতা যদি শুধুই জাতিগত হয়, তাহলে মানতে হয় আসাদ স্বাধীন ছিল না, মতিউর স্বাধীন ছিল না, এমনকি ১৪ই ডিসেম্বর যে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-মুখ বেধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল না ফেরার দেশে, তারাও ছিল না স্বাধীন, কারণ ততক্ষণ পর্যন্ত তো স্বাধীনতার সূর্যখানি ধরা দেয়নি এই ধরাতে। অথচ আমরা তো জানি, আসাদ স্বাধীন ছিল, মতিউর স্বাধীন ছিল, বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীন ছিল, তাদের চিন্তা ছিল স্বাধীন, অবাধ ও মুক্ত। যদি তা নাই হত, তাহলে কি করে তারা পেরেছিল মুক্তির গান গাইতে, মানুষের মর্মে মুক্তি বীজ রোপে দিতে?

তাহলে নাগরিক হতে পারে মুক্ত, স্বাধীন, চিরকালই, চিন্তা ও মননে, যদিও বা দেশটা থাকে পরাধীনতার কঠিন নিগড়ে। তবে কি এই অনুসিদ্ধান্ত টেনে ফেলা সম্ভব, স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হল চিন্তা ও মনন, আর নাগরিকের চিন্তা ও মনন আছে বলে, সে চাইলেই স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু দেশের নেই বলে, সে পারে না?

কিন্তু না, এমনতরো অনুসিদ্ধান্ত সত্য হওয়া একান্তই বে-সম্ভব, কারণ দেশও যে স্বাধীন হয়, আর তার জন্য যেতে হবে না অন্য কোথাও, উনিশশো একাত্তরের পাতায় চোখ বুলালেই চলবে, যখন সারা দুনিয়াকে হতবাক করে দিয়ে বিশ্বের একটি আধুনিক প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীকে হারিয়ে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।

কিন্তু কথা হচ্ছে, চিন্তা ও মনন না থাকার পরও দেশ স্বাধীন হল কি করে? আসলে একাত্তরে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশে। প্রতিটি বাঙালির চিন্তা ও মনন ছিল স্বাধীনতার স্বপ্নে শান দেয়া, মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত। তাই ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়ে কারাবন্দী হলেও অসুবিধে হয়নি এতটুকু, কারণ তার আগেই সাত কোটি নাগরিকের চিন্তা ও মনন হয়ে যায় স্বাধীনতার সুরে এক তারে বাধা। এভাবেই কি তাহলে কোটি কোটি নাগরিকের স্বাধীন চিন্তা ও মনন যোগ করে পাওয়া যায় জাতীয় স্বাধীনতা? আর জাতীয় স্বাধীনতাকেই কি বলা যায় না (প্রকারান্তরে) দেশের স্বাধীনতা?

এখন কিন্তু একটি ঠিকঠাক অনুসিদ্ধান্ত টানা যেতেই পারে, আর তা হল, উনিশশ একাত্তরের পূর্বে দেশের অনেক নাগরিক স্বাধীন থাকলেও জাতীয় স্বাধীনতা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় একাত্তরের ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহর পর্যন্ত যখন থেকে সাত কোটি বাঙালি জানতে ও বিশ্বাস করতে শুরু করে, তারা আজ থেকে স্বাধীন। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙ্গালির জীবনে আসে তখনই আসে প্রথমবারের মত পরিপূর্ণ অর্থবোধক একটি স্বাধীনতা।

কিন্তু কথা থেকে যায়। স্বাধীনতা যদি এসেই যায়, তাহলে নয়মাস আবার যুদ্ধ করতে হল কেন? এর উত্তর এখন আর কঠিন নয়, কারণ আমরা আগেই দেখেছি, স্বাধীনতা বাস করে মানুষের চিন্তা ও মগজে। একজন মানুষ যদি স্বাধীন চিন্তা, চেতনা ও বোধের অধিকারী হয়, তাহলে তার উপর যতই চালানো হোক না কেন অত্যাচার, পরানো হোক না কেন পরাধীনতার শৃঙ্খল, সে স্বাধীনই থেকে যাবে আমৃত্যু। এই কারণেই আমাদের রবীন্দ্র-নজরুল স্বাধীন ছিল আজীবন, সূর্যসেন, তীতুমীর, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা।

আর একাত্তরে সাত কোটি বাঙ্গালিই হয়ে উঠেছিল তীতুমীর , সূর্যসেন, প্রীতিলতা। চিন্তায়-বোধে-মননে এমন স্বর্নসময় বাঙ্গালির আগে আর আসে নি, হাজার বছরের ইতিহাসে আর কখনো সাত কোটি বাঙ্গালিকে মনে হয়নি এতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সংকল্পবদ্ধ, দৃঢ়; মুষ্টিবদ্ধ হাত ছিল না এত উন্নত , রক্তে ছিল না এত তেজ, চিন্তায় ছিল না এত প্রখরতা, চোখে ছিল না এত প্রত্যয়, ছিল এত ভালবাসা, এত ত্যাগ, মহত ও পবিত্র! সত্যি এমন সময় আর কখনো আসে নি বাঙ্গালির জীবনে। তাই হাজার বছরের ইতিহাসে কোন কোন বাঙালি কখনো কখনো হয়ত ছিল স্বাধীন, কিন্তু পুরো বাঙালি জাতি স্বাধীন হয়েছিল সত্যি সত্যি একাত্তরেই, এই ২৬ শে মার্চেই।

আর একজন স্বাধীন ব্যাক্তিকে যেমন লড়তে হয় স্বাধীনতার শত্রুদের সাথে, তেমনি স্বাধীন বাঙালি জাতিকেও লড়তে হয়েছিল স্বাধীনতার শত্রুদের সাথে নয় মাস, ডিসেম্বরে ঘটেছিল যেই লড়াইয়ের চূড়ান্ত বিজয়।

কিন্তু স্বাধীনতা কি চিরস্থায়ী? অথবা স্বাধীনতার শত্রুর সাথে বিজয়?

একজন নাগরিকের স্বাধীন চিন্তা ও মনন কি মোড় নিতে পারে না পরাধীনতার নিগড়ে? মুক্ত চিন্তার একজন মানুষের কি পতন ঘটতে পারে না বদ্ধ চিন্তার গুমোট কুপে? বেশি দূরে যেতে হয় না কষ্ট করে, স্মৃতিকে সামান্য ঝাঁকাতেই কাঁচা পয়সার মত বেরিয়ে আসে একজন বঙ্গবীরের নাম, একাত্তরে দখলদার-রাজাকার সবার প্যান্ট খারাপ হয়ে যেত যার নামে, অনেকদিন তারই কিন্তু চলেছে নিয়মিত দর্শন এক অতি আদিম দিগন্তে।

আর যদি একজন নাগরিকের স্বাধীন চিন্তা ও মগজে ঘুণ ধরতে পারে, তাহলে কোটি কোটি নাগরিকের চিন্তা ও মনন যোগ দিলে ফলে যেই জাতীয় চিন্তা ও মনন, তা যে পরাধীনতার পানে ধাইবে না, তা নয়। সুতরাং, জাতির স্বাধীনতাও একেবারে চিরন্তন কিছু নয়। জাতীয় স্বাধীনতার আছে ক্ষয়, আছে ব্যয়!

প্রশ্ন উঠে, বাঙালি জাতি কি আজ স্বাধীন চৌচল্লিশ বছর আগের ঠিক সেই সেই জন্মের মুহূর্তটির মত করে? হয়নি কি কোন স্খলন? বেশিদূর যেতে হয় না, মার্চ মাসেই স্টেডিয়াম-ভর্তি হাজারো পাকিস্তানি পতাকার প্রদর্শন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, দেশে আজ একজন বঙ্গবীর নয়, রয়েছে হাজারো হাজারো, লাখো লাখো বঙ্গবীর যাদের ঐক্যবদ্ধ চিন্তা ও চেতনা একাত্তরের জাতীয় স্বাধীনতার সৌধে একের পর এক আঘাত হেনে যাচ্ছে। কিন্তু শুধুই পাকিস্তানি মানসিকতার চরম সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরাই কি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার হন্তারক? না, আসলে ভারতীয়, প্রাচ্য ও প্রতীচ্য – সব মানসিকতার মানুষেরাই তিলে তিলে গড়ে দিয়েছে আজকের জাতীয় স্বাধীনতার এমন ঘোর দৈন্যদশা।

কিন্তু আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, স্বাধীন চিন্তা ও বোধই পঙ্গু হয়েছে শুধু, নাকি আমাদের লড়াই স্বাধীনতার শত্রুদের সাথেও দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে একই সঙ্গে? আসলে স্বাধীনতা যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি স্বাধীনতার শত্রুদের সাথে লড়াইও কখনও শেষ হবার নয়। স্বাধীনতার আদি শত্রুরা বিলুপ্ত তো হয়নিই, বরং ফুলে ফেঁপে ব্যাপক বংশ বিস্তার করেছে; অন্যদিকে যোগ হয়েছে নতুন নতুন ধরনের, আকারের এবং আকৃতির শত্রু। আর কিছু নয়, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, সন্ত্রাস, স্বজনপ্রীতি, দল-প্রীতি ইত্যাদি হচ্ছে এই উত্তর একাত্তর স্বাধীনতার শত্রু, বলতে পারেন আমাদের স্বাধীনতার ভয়াবহতম শত্রু, যা একটু একটু করে মুছে দিচ্ছে স্বাধীনতার সবটুকু সাধ, নষ্ট করে দিচ্ছে স্বাদ।

এবার সর্বশেষ অনুসিদ্ধান্তটি টানা যাক। আর তা হল, আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা এখন আহত, স্বাধীনতার শত্রুর সাথে যুদ্ধও এখন নখ-দন্তহীন, কিছুতেই মেলানো যায় না একাত্তরের সেই মার্চের স্বাধীনতা এবং পরবর্তী নয় মাসের যুদ্ধের সাথে। তাহলে?

ফিরে যাই বন্ধুটির কথায়, “হয়ত দেশটা স্বাধীন, কিন্তু আমরা পরাধীন”। আসলেই আমরা পরাধীন। কিন্তু এর দায়টা কিন্তু আমাদেরই। আমরা যদি চিন্তা ও মননে আবার হতে পারি স্বাধীন, সবাই মিলে কইতে পারি এক সুরে কথা, এবং লড়াই করতে পারি সাম্প্রদায়িকতা থেকে শুরু করে দুর্নীতি, সন্ত্রাস- স্বাধীনতার সব শত্রুদের বিরুদ্ধে, একাত্তরের সেই সময়ের মত করে, তাহলে আমরা কি আর পরাধীন থাকব? স্বাধীন দেশে? এত্ত এত্ত আলোচনার পর উত্তরটি যে না হবে, তা বলাই বাহুল্য!

বলতে কি, আমাদের প্রত্যেকের হাতেই একটি করে স্বাধীনতার অমূল্য চাবি আছে, যতক্ষণ না সবাই মিলে সেই চাবি ঘোরাতে পারছি, ততক্ষণ অন্তত একা একা তো ঘোরাতে পারি, আমার বন্ধুটির মত হা-হুতাশ না করে।

“The free man will ask neither what his country can do for him nor what he can do for his country.
He will ask rather “What can I and my compatriots do through government” to help us discharge our
individual responsibilities, to achieve our several goals and purposes, and above all, to protect our
freedom?” (Milton Fridman)