আমার দেশী ভাইবোনেরা আরেকদফা আলোচনাতে বসে গেছেন। এবারের আলোচ্য বিষয়ঃ সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন। গরম বিষয় সন্দেহ নেই। গোল টেবিলে গোল হয়ে বসে গরম গরম বক্তৃতা করার সুবর্ণ সুযোগ। পার্লামেন্টে গিয়ে র্যালি করতে পারলে তো আরো ভালো। এদুটি জিনিস আমরা ভীষণ ভালবাসি—-আলোচনা আর র্যালি। র্যালির একটা সুবিধা যে পত্রিকার লোকেরা আসে ক্যামেরা নিয়ে। তখন ছবি তোলা হয়। সেছবি জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়। ক্যানাডার মত উন্নত দেশের নামীদামী পত্রিকায় ছবি ছাপানোর অর্থ বোঝেন? সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে নাম ছড়িয়ে পড়া। নাম ছড়াতে ছড়াতে কতদূর গড়াতে পারে কে জানে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর, অর্থাৎ নির্বাচন নামক জাতীয় প্রহসনটি সংঘটিত হবার পরপরই, তুষের-আগুণের-মত-মিটমিট-করে-জ্বলতে-থাকা বিষয়টি নতুন তেজে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। আওয়ামি লীগের জয় হলে দোষটা ওদের কারণ ওরা দলবল নিয়ে ভোট দিয়ে এসেছে। সুতরাং ধর বেটাদের। ওদিকে বি এন পি জিতে গেলেও ওদেরই দোষ, কারণ ওরা বি এন পি’কে ভোট দেয়নি। অতএব ধর বেটাদের—-ঘাড় ধরে চালান কর ওপারে।
এবারের সমস্যাটি আরো জটিল। এবার নির্বাচন হয়েছে, প্রতিযোগিতা হয়নি। মানে জেনারেল এরশাদ নামক এক ঘূণেধরা, একদা-ধিকৃত, একদা-সর্বজনঘৃণিত, অশীতিপর ‘নেতা’র ততোধিক ঘূণেধরা পার্টিকে ধর্তব্যের কাতারে না রেখে অবশ্য। ধর্তব্যভাবে প্রতিযোগী হবার কথা ছিল যাদের তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেনি, কারণ তাদের নেতারা নেত্রীরা তাদের অন্য কাজে ব্যস্ত রেখেছিলেন। বাস পোড়ানো, রেললাইন উপড়ানো আর ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে ওঠানোর কাজ নিয়ে দারুণ ব্যস্ত—-১৬ কোটি মানুষের দেশটাকে ৪৮ ঘন্টা আর ৭২ ঘন্টাব্যাপী অচল করে দেয়া চাট্টিখানি কথা নাকি। কড়া নিষেধ ছিল সাধারণ ভোটারদের ওপরঃ সাবধান, ভোট দেবে না। ভোট দিলে বিপদ হবে। সংখ্যালঘুরা সে নিষেধ অমান্য করেছে। কতবড় সাহস তাদের। সেকারণেই ওদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তচনচ করে দেওয়া ওদের সর্বস্ব। সারাজীবনেও যাতে ‘ভোট’ দেবার কথা না ভাবে তারা সে ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এক ভয়ার্ত ভদ্রমহিলাকে ধাওয়া করে নদী পাড়ি দিয়ে প্রাণরক্ষা করতে বাধ্য করেছে তারা। তিনি ওদের হাতেপায়ে ধরে বলেছিলেনঃ বাবাগো, তোমরা আমার ভোটের অধিকার নিয়ে নাও। তবুও আমাকে বাঁচতে দাও। তাঁর নিজের দেশ এটি। তাঁর জন্মভূমি এটি। তাঁর বাবামা পিসিমা দিদিমা সবাই এদেশের মাটির উত্তরাধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ হয়ত এই দেশটির জন্যে প্রাণও দিয়েছিলেন ’৭১ সালে। জন্মসূত্রে যদি ‘সংখ্যালঘু’ না হতেন তিনি তাহলে হয়ত বীরাঙ্গনা উপাধি পেতেন রাষ্ট্রপতির নিজের হাতে। কিন্তু তিনি হিন্দু, অতএব ‘অপবিত্র’, অতএব এই পাকপবিত্র দেশটিতে বসবাসের অযোগ্য।
আরো একটি বীভৎস সংবাদ শুনলাম আজকে। গুটিকয় ক্ষুব্ধ যুবক, জামাত কি বি এন পি কি আওয়ামী তাতে কি আসে যায়, একটি আর্তকাতর ভীতসন্ত্রস্ত গৃহস্তের বাড়িতে ঢুকে বাবামাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মুখে্র ভেতর গুঁজে দেয় মোটা গামছা, যাতে টুঁশব্দটি করতে না পারে। তারপর বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করতে যাওয়া কিশোরী মেয়েকে পাঁজা করে নিয়ে আসে তারা বাবামায়ের সামনে। তারপর তারা কিশোরীটিকে ধর্ষণ করে, ঠিক যেভাবে ধর্ষণ করে গেছে একাত্তরের বর্বরেরা, ঠিক যেভাবে ধর্ষণ করে গেছে একাত্তরের রাজাকারেরা, আল-বদরেরা—-বিয়াল্লিশ বছর পর যাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে আজকে। কিন্ত আমাদের জাতি কি কখনো প্রশ্ন তুলবে ভবিষ্যতে, কখনো কি কোনও মমিন মুসলমান বুকের পাটা খুলে দাঁড়াতে সাহস পাবে জনগণের সামনে এই বলে যে আজকের হিন্দু পরিবারের এই অসহায় মেয়েটিকে যারা, যে পশুগুলি, বারবার, বার বার, একের পর এক, বাবামায়ের অভিশপ্ত দৃষ্টির সামনে, ধর্ষণ করে বেরিয়ে গেল বীরদর্পে, তারাও তো এযুগের নতুন রাজাকার বই কিছু নয়, এবং এদেরও একদিন ঝুলতে হবে ফাঁসির দড়িতে যেমন করে ঝুলেছে ৪২ বছর আগেকার বর্বর কাদের মোল্লা? বিগত যুগের ঘৃণ্য পশুদের শাস্তি দিয়ে যে প্রজন্ম আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেছে, তারা কি ঠিক এমনি কঠোর শাস্তির দাবি তুলবে ’১৩ সালের নব্য কাদের মোল্লাদের বিরুদ্ধে? না, আমার মনে হয়না। কারণ পুরনো কাদের মোল্লা হিন্দু-মুসলমান বাছবাছাই করেনি, ‘স্বাধীনতা’র পক্ষে হলেই হল—-কল্লা কাটো। কিন্তু এবার কল্লা যাচ্ছে কেবল ‘কাফের’দের। সুধীজনরা হয়ত বলবেন, এটা ‘দুঃখজনক’, কিন্তু মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডণীয় অপরাধ? নাহ, তা কি করে হয়। দুটো এক জিনিস হয় কি করে একটা ইসলামিক দেশে?
‘ইসলামিক’ দেশ শব্দটিতে কি পাঠক খুব আপত্তিকর কিছু দেখতে পাচ্ছেন? দেশের শতকারা আশিজনই হয়ত সোৎসাহে বলবেন, কেন আপত্তির কি আছে? আমরা কি ইসলামিক রাষ্ট্র নই? কিন্তু আপনি নিজেকে আধুনিক উচ্চশিক্ষিত ও নগরকেন্দ্রিক ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন। আপনি হয়ত বলবেনঃ না, আমরা ইসলামিক রাষ্ট্র নই, আমরা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশ। আমরা ‘সেকুলার’ স্টেট। প্রথমত সেকুলার আর ধর্মনিরপেক্ষ, আমার মতে, দুটি সমার্থক শব্দ নয়। ধর্মনিরপেক্ষ বলতে বোঝায়, সব ধর্মই আছে, সমান অধিকার নিয়ে, এবং রাষ্ট্রকর্মে সব ধর্মকেই সমান সম্মান দেওয়া হবে। আর সেকুলার শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলঃ ধর্মবিষয়ে পরিপূর্ণভাবে নির্লিপ্ত ও নিরাসক্ত। রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারটি সর্বাঙ্গীনভাবেই ইহজাগতিক। এবং ‘ইহজাগতিক’ দৃষ্টিভঙ্গী, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদিতে—-একেই আমি বলি সত্যিকার ‘সেকুলারিজম’, যা আমাদের দেশে নেই, কোনদিন ছিল না, কোনদিন হবে বলেও আমার মনে হয়না। সেকুলার স্টেটের অর্থই ভালো করে বুঝি না আমরা। এর মর্ম কেবল ফ্রান্স, নেদারল্যাণ্ডস, জার্মানীসহ গুটিকয় দেশ ছাড়া আর কেউই ভালো করে বোঝে বলে আমার মনে হয় না। ‘সেকুলার’ একটি বড়মাপের আইডিয়া, যা সাধারণ মানুষের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করতে বেশ কতগুলো যুগান্তকারি ঘটনার ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসতে হয় একটা জাতিকে, বেশ কতগুলো বিপ্লবাত্মক ঘটনা, যার ব্যাপ্তি কেবল রাজনীতিতেই নয়, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মতেও। এগুলোর কোনটাই আমাদের দেশে ঘটেনি, এবং ঘটবার সম্ভাবনাও খুব আশাপ্রদ নয়।
আমাদের রাজনৈতিক নেতানেত্রীগণ, এমনকি শিরোপাপ্রাপ্ত মহা মহা বুদ্ধিজীবীরাও, জোরগলায় দাবি করতে ভালোবাসেন যে আমাদের সোনার দেশটি সর্বতোভাবেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। আমি নিজেকে দারুণ কোনও বুদ্ধিজীবী বলে দাবি করিনা বলেই সমান জোরের সঙ্গে দাবি করতে প্রস্তুত যে আমার সোনার দেশটি সর্বতোভাবেই ‘অ-ধর্মনিরপেক্ষ’। এখন তো নয়ই, এমনকি সত্তুরের দশকেও ছিল না। ওই দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে দু’দুজন সামরিক নেতা, যাঁদের উভয়ই জাতির ওপর নিজেদের অক্ষয় পদচিহ্ন অঙ্কন করে গেছেন নিজ নিজ রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে, তাঁরা আগেকার প্রতিশ্রুত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের শিকড়টি আমূলে কর্তন করে সংখ্যাগুরুর ধর্মকে সেখানে কেবল প্রধান ধর্মই নয়, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন—একজন বলেছেন সংসদের প্রতিটি অধিবেশন শুরু হবে ‘বিসমিল্লা’ দ্বারা (যাতে করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ভণিতাটিও সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে যায়), আরেকজন বলেছেন তাঁর সোনার দেশটি এখন থেকে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ বলে পরিচিত হবে। সেই ‘বিসমিল্লা’ ও সেই ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ এখনো বলবৎ রয়েছে, এবং থাকবেও। একটি হতদরিদ্র রাষ্ট্রে যদি একবার সরকারি ভর্তুকি ঢোকানো হয় খাদ্যমূল্যতে তাহলে সে ভর্তুকি পরবর্তী কোন সরকারের পক্ষেই তুলে নেওয়া যেমন সম্ভব হয়না বড়রকমের কোনও বিপ্লব ছাড়া, ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের মত একটি ধর্মান্ধ পশ্চাদপদ দেশের সংসদ এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ক্রিয়াকাণ্ডে যখন একবার ‘বিসমিল্লা’ ঢোকানো হয়েছে তখন সেটাকে তুলে নেবার সাধ্য একমাত্র আল্লাপাক ছাড়া কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না। এবং আমাদের নেতানেত্রীদের লেবাস আবাস দেখে মনেও হয়না যে তাঁরা ‘বিসমিল্লা-আলহামদুলিল্লা-ইনশাল্লা’ প্রভৃতি আরবি অনুপ্রাসযুক্ত বাক্যব্যবহারের প্রবৃত্তি থেকে নিবৃত থাকার কোনরকম অভিলাস পোষণ করেন। সুতরাং আমার মমিন মুসলমান ভাই-ভগিনীরা, আর যা’ই করুন দয়া করে দেশটিকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলবেন না। ওটা বড় কর্কশ একটা গালির মত শোনায়। শুনেছি আমাদের সোনার দেশটি ধনেজনে বিষয়-বৈভবে এশিয়ার অন্য সকল দেশকে টপকে যাবার উপক্রম, আগামি ছ’সাত বছরের মাঝে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ধনী দেশসমূহের অন্যতম বলে পরিগণিত হবে বলেও ভবিষ্যদবাণী করেছেন জ্ঞানীগুণি পণ্ডিতজনেরা। এসব সুসংবাদ শুনে কার না দিল ভরে যায় খুশিতে। তখন শুধু একটা শব্দই বহির্গত হয় জবান দিয়েঃ ‘আলহামদুলিল্লাহ’। আল্লার কাছে হাজার শুকুর। এ-সবই আমি মানিতে রাজি আছি। কিন্তু ভাই, দয়া করে, দোহাই আপনার, আপনার কদম স্পর্শ করে ক্ষমা প্রার্থনা করছি আমি, আমাকে কোনক্রমেই উচ্চারণ করতে বলবেন না যে এই দেশটি একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র। আর যা’ই হই না কেন, হাজার ধনদৌলত থাকুক আমাদের, কিন্তু ধর্ম একটা জিনিস যা থেকে আমরা কস্মিনকালেও নিরপেক্ষ থাকতে পারিনা। আমাদের এদেশটিতে কোনকিছুই মানুষের ইচ্ছায় হয় না, সবই হয় আল্লার ইচ্ছায়, এবং এই আল্লা কোনদিনই চাইবেন না তাঁর পবিত্র নামটি, তাঁর পবিত্র লেবাসটি অন্তর্হিত হোক এখান থেকে।
আরো একটি বিশেষ্য প্রতিনিয়তই ব্যবহার করা আমাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম’টিকে নিয়ে—সহনশীলতা। আমার জানামতে, একমাত্র প্রাচীনধারার মূর্তিপূজকরা ছাড়া, অন্য কোন ধর্মেই যথার্থভাবে ‘সহনশীলতা’ বলে কিছু নেই। বিশেষ করে তিনটি বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, এগুলোতে তো নিজেদের ভেতরেই সহনশীলতা নেই, অন্য ধর্মের প্রতি সেটা থাকার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। আয়ারল্যাণ্ডের ক্যাথলিক আর প্রটেস্টান্টদের মাঝে যে কি সুমধুর সম্পর্ক সেটা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। কিম্বা প্রটেস্টান্টদেরই হাজারখানেক শাখাপ্রশাখার আভ্যন্তরীন কোন্দল, যার রক্তাক্ত ইতিহাস পড়ে পড়েই ছোটবেলায় আমরা পরীক্ষা পাস করেছি। ইহুদীদের খবর জানেন? ইজরায়েলের অন্দরমহলে একটু উঁকি মেরে দেখুন—দেখবেন কি তুমুল ঝগড়া সেখানে। যারা ইউরোপ থেকে এসেছে তারা কখনোই আফ্রিকা থেকে আগত ইহুদিদের সঙ্গে এক বাসনে খাওয়া দূরে থাক, এক টেবিলে, এমনকি এক পাড়াতে থাকতেও রাজি নয়। এবার আমাদের নিজেদের মহান ধর্মটি সম্বন্ধে শুনতে চান? পাকিস্তানে মসজিদ পোড়ানো হয় সেটা জানেন তো? বোমা মারা হয় নামাজীদের ওপরই, সেটাও কোন গোপন খবর নয়। এবং সেই বর্বরতাগুলো তারা অবলীলাক্রমে সাধন করে ধর্মের নামেই—-একদল হল শিয়া, আরেকদল সুন্নি। সৌভাগ্যবশত আমাদের ‘অপেক্ষাকৃত উদারনৈতিক, সহনশীল’ দেশটিতে শিয়ার সংখ্যা খুবই সামান্য, নইলে সেখানেও আরবি তৈলপুষ্ট কওমি মাদ্রাসার গরিব ঘরের বালকগুলোর হাতে হয়ত মারণাস্ত্র দেওয়া হত শিয়াদের উপাসনাগৃহ আক্রমণ করার জন্যে। এটা অবশ্য আমি সর্বান্তরণে স্বীকার করি যে বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত আরবি-পাকিস্তানী-আলকায়দা কায়দার বর্বরতা প্রবেশ করেনি পুরোমাত্রায়, তবে তার কারণ এই নয় যে আমাদের সুবোধ বালকেরা বা যুবকেরা সেধরণের পাশবিকতাতে সম্পূর্ণ অপারগ। অপারগ যে নয় তার প্রমাণ তো আমরা সাম্প্রতিক চালচিত্র থেকেই আহরণ করতে পারছি। তাছাড়া কয়েক বছর আগে, বি এন পি’র শাসনকালে, মৌলবিসাহেবরা যে ঘড়ি দেখে যুগপৎ গোটা ষাটেক বোমা ফাটালেন সারা দেশব্যাপী তাতেই তো প্রমাণ মেলে যে আল্লাচাহেত হুজুরদের কোনও হিম্মতের অভাব নাই—-হুকুম পেলেই হুজুরেরা জিহাদের প্রাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবেন অনায়াসে। অতএব, দয়া করে আমাকে ‘সহনশীলতা’র কথাও শোনাবেন না। সহনশীল আমরা তখনই হই যখন মাথার ওপর ডাণ্ডার ভয় থাকে—যেমন সামরিক শাসন, একনায়ত্ব। খেয়াল করে দেখুন মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশে গণতন্ত্র বলে কোন জিনিস নেই—-হয় রাজা নয় আমির নয় সামরিক শাসনকর্তা। বলতে পারেন, কেন, ইরাণে তো গণতন্ত্র আছে। হ্যাঁ আছে, নাম-কা-ওয়াস্তে। ক্ষমতার চাবিটা কিন্তু প্রেসিডেন্টের হাতে নয়, সেটা হল বড় হুজুরের হাতে—-তাঁর অঙ্গুলিনির্দেশে ঘড়ির কাঁটা ঘোরে, নতুবা ঘোরে না। ইরাণে গণতন্ত্র একটা গণধাপ্পা বই কিছু নয়। আমাদের দেশেও প্রায় একই অবস্থা দাঁড়িয়ে যাবার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত মতে আধুনিক গণতন্ত্র আর ইসলাম, দুটির সহাবস্থান সম্ভব নয়, বরং বলব একে অন্যের জাতশত্রু। আমরা যেন ভুলে না যাই যে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক দেশগুলিতে (এছাড়া অবশ্য অন্য কোনপ্রকার দেশ নেইও সেখানে) সবচেয়ে ঘৃণ্য যে-শব্দটি সেটি হল ‘সেকুলারিজম’। এটিকে তারা পশ্চিমের সকল দুষ্টরোগের সেরা দুষ্ট বলে মনে করে। এবং আমরা, পাকিস্তানি ইসলামের বর্বরতায় হারানো বহু লক্ষ প্রাণ ও বহু লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই স্বাধীন দেশটি, আবারো ঠিক সেই পথেই পূর্ণ বিক্রমের সাথে ধেয়ে চলেছি, সেই একই পাকিস্তানি পদ্ধতির ইসলামের সন্ধানে। তার সুস্পষ্ট লক্ষণ আজকের বাংলাদেশের সর্বত্র।
লোকে বলে বাংলাদেশের মুসলমান একেবারেই ধর্মান্ধ নয়। আমার মতে সেটি একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। আমাদের মত ধর্মান্ধ জাতি খুব কমই আছে পৃথিবীতে। ধর্ম আমাদের প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে। ধর্ম আমাদের অধরে উদরে গতরে বসনে ভূষণে, সর্বত্র। ধর্ম আমাদের হিজাবে নিকাবে গুম্ফে শশ্রূতে। ধর্ম আমাদের কর্মে চর্মে বর্মে, আমাদের অন্নে বস্ত্রে শিরস্ত্রানে। আমাদের হালাল খাদ্য না হলে চলবে না (যদিও হারাম রুজিতে উল্লেখযোগ্য অরুচি এখনো পরিলক্ষিত হয়নি), হালাল পানীয় না হলে চলবে না, হালাল বস্ত্র না হলে চলবে না। ধর্ম আমাদের শোবার ঘরে, আমাদের পাকের ঘরে, আমাদের শৌচাগারে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি আল্লার নাম। যেদিকে কান পাতি সেদিকেই শুনি আল্লার নাম। এমনকি আল্লার নাম নিয়ে আমাদের মমিন মুসলমানগণ প্রত্যহ উৎকোচও গ্রহণ করেন। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সরকারি তহবিল থেকে। লক্ষ কোটি মুদ্রা ধার করেন সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে, এবং সে ধার পরিশোধ করার যে ব্যাপার আছে একটা সেকথা বেমালুম ভুলে গিয়ে পবিত্র মক্কাশরিফে গিয়ে হজ আদায় করে আসেন, প্রতিবছর উমরাহ করেন, পীরের দরগায় গিয়ে লাখ দুলাখ টাকা সেলামি দান করেন। তা নাহলে, এত ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও, আমরা কেমন করে পরপর কয়েক বছর পৃথিবীর সেরা দুর্নীতিপরায়ন রাষ্ট্র বলে গণ্য হলাম আন্তর্জাতিক জরিপে। এবং আমাদের পর দ্বিতীয় আর তৃতীয় স্থানীয় দেশগুলিও কেমন করে হয়ে গেল মুসলিমপ্রধানই। নিশ্চয়ই ‘ইসলাম’এর সঙ্গে দুর্নীতির কোনরকম সম্পর্ক নেই, অতএব পেয়ারের সম্পর্কটা হয়ত ‘মুসলমান’এরই সঙ্গে। এই ধাঁধাটি এখনো ঠিক পরিষ্কার নয় আমার কাছে। বলতে পারেন যে এর কারণ ধর্ম নয়, দারিদ্র্য। হ্যাঁ সেটা একটা যুক্তি বটে। তবে কি জানেন, আফ্রিকার অমুসলমান দেশেও কিন্তু কম দারিদ্র্য নেই। ল্যাটিন আমেরিকা আর দক্ষিণ আমেরিকাতেও কম দারিদ্র্য নেই। কই, তারা তো দুর্নীতির মাপে আমাদের ধারেকাছে নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায় মনে হচ্ছে আপনার?
সম্প্রতি ‘সুধাংশু তুই পালা’ শীর্ষক একটা লেখা পড়লাম অনলাইন পত্রিকা ‘মুক্তমনা’তে। লিখেছেন অভিজিৎ রায়, অত্যন্ত উঁচুমানের একজন বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী যিনি তাঁর দেশকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন, অতীতের শতসহস্র বিপদ বিপর্যয় সত্ত্বেও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনোই তাঁর কথায় বা কলমে নৈরাশ্য প্রকাশ পায়নি। কিন্তু এবার পেয়েছে। এবার যেন তাঁর মনটা একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। তিনি লিখেছেন যে শামসুর রাহমানের প্রিয় কবিতাগুলোর একটির নাম ছিলঃ ‘সুধাংশু যাবে না’। ভীষণ ভালো লাগতো তাঁর এ-কবিতাটি, কারণ এর মধ্যে তিনি তাঁর নিজেরই আশাবাদী কন্ঠস্বর শুনতে পেতেন। তাইতো, সুধাংশু কেন যাবে? এদেশ কি তার দেশ নয়? এদেশের মাটি কি তাকে লালন করেনি যেমন করেছে টুপি-দাড়িপরিহিত মমিন মুসলমানদের? এদেশের আলোহাওয়া আকাশজমিন বৃক্ষলতার সমান অধিকার কি তাঁর নেই অন্য সকল দেশবাসীর মত? অবশ্যই আছে। কিন্তু তাই কি? সেই সংশয় থেকেই নির্গত হয়েছে তাঁর এই ব্যথাভারাক্রান্ত রচনাঃ ‘সুধাংশু তুই পালা’। তাঁরই এক বন্ধু, আলমগীর হুসেন নামক এক সহপাঠী, অনেকদিন আগে লিখেছিলেন শামসুর রাহমানের কবিতার প্যারডি। সেই প্যারডি আজকে ভীমাকার বাস্তবতা নিয়ে দেখা দিয়েছে।
অভিজিতের একটি পরিসংখ্যান খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে আমার। ১৯৪১ সালে, অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে, পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের সংখ্যা ছিল শতকরা ২৮ জন, ১৯৪৭ সালে সেটা নেমে যায় ২২ এ, ১৯৬১ তে ১৮.৫, ১৯৭৪ সালে ১৩.৫, ১৯৮১ তে ১২.১, ১৯৯১ এ ১০। এবং বর্তমান সংখ্যা ৮ এর নিচে নেমে এসেছে। সংখ্যাগুলো অর্থপূর্ণ, কারণ ক্রমাগত কমে যাওয়ার ধরণটি অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে বেশ মিলে যায়। যেন এরা সবাই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে যে মুসলমান ছাড়া অন্য কোন জাতিকে থাকতে দেওয়া হবে না দেশে। কার্যত তাই ঘটে যাচ্ছে সর্বত্র। আজকে খোলা মন নিয়ে যদি আপনি তাকান চারিদিকের মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাহলে কি চোখে পড়বে আপনার? মনে হবে সব শুকিয়ে গেছে। কেমন যেন মরুভূমির ধূধূ বালির হুহু হাওয়া বইছে চতুর্দিকে। যেন বিরাট এক শ্মশান—-মানবতার শ্মশান। একসময় মধ্যপ্রাচ্য ছিল খৃষ্টধর্মের জন্মস্থান। আজকে ভ্যাটিকেনের পোপ ফ্রান্সিস ঘোষণা না দিয়ে পারেন নাঃ “আমরা যেন স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে না নিই যে মধ্যপ্রাচ্যে খৃস্টান জাতির কোনও চিহ্ন থাকবে না”। ব্রিটেনের পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ধর্মমন্ত্রী ব্যারনেস সাইদা ওয়ার্সি নিজে মুসলিম হয়েও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে খৃস্টানমুক্তকরণের সঙ্ঘবদ্ধ উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেব ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত বছর তাঁর এক ভাষণে তিনি বলেছিলেনঃ “ আমার মতে, যে ধর্ন অন্য কোন ধর্মের অস্তিত্ব সহ্য করতে পারে না, সে ওই অসহিষ্ণুতার ভেতর দিয়ে নিজেরই আভ্যন্তরীণ দুর্বলতাটি প্রকাশ করে দেয়”। ব্যারনেস ওয়ার্সি এই খৃস্টান ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দেশছাড়া করবার অনতিপ্রচ্ছন্ন প্রয়াসকে একটি ‘বিশ্বসংকট’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর উক্তিটি যে অতিরঞ্জিত নয় মোটেও তার প্রমাণ তো সর্বত্র। বাংলাদেশে যেমন সংখ্যালঘুদের বিপদ আসে নির্বাচনের পরপর, তেমনি অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশে খৃস্টানদের মহা বিপদের সময় হল বড়দিন। এবছরই ইরাকে, বড়দিনের কেনাকাটার সময়, গির্জার প্রার্থনাশেষে বাড়ি ফেরার সময় অনেক ধর্মপ্রাণ খৃস্টান হতাহত হয়েছেন। কেনিয়ার মোম্বাসাতে দুটি গির্জায় বোমা ফেলা হয়েছে। ইরাণে বড়দিন উপলক্ষে আনন্দ উৎসব করার অপরাধে অনেক খৃস্টান গ্রেপ্তার হয়েছেন। সোমালিয়াতে তো সোজা বেআইনিই করে ফেলা হয়েছে বড়দিন পালন করা। এমনকি ফিলিপিনের মত অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী দেশেও চার্চ প্রাঙ্গনে বোমা ছোঁড়া হয়েছে। তারপর আমাদের মৌলবিসাহেবদের পেয়ারা দেশঃ পাকিস্তান। সেখানে তো হিন্দু বলে কোন জিনিসই নেই। এবার খৃস্টানও না থাকার দশা। পেশোয়ারে অল সেইন্টস এংলিকানদের একটা চার্চ আছে—-মানে, ছিল। এবছর উপাসকরা সেখানে গিয়ে উপাসনা করেননি, কেঁদেছেন কেবল। কেঁদেছেন গতবছরের কথা স্মরণ করে। ২,০১৩ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর সেই চার্চের উপসনালয়ে হলভর্তি লোকের উপস্থিতিতে, একটি আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে ৮৭ জন খৃস্টান নিহত হন, আরো ১২০ জন উপাসক হন আহত। ওই গির্জার চূড়ায় দাঁড়ানো ঘড়ির কাঁটাতে সেদিন ছিলঃ ১১ঃ৪৩। সে কাঁটা এখনো থিতু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক ঐ জায়গাতেই। পেশোয়ারের খৃস্টানদের জন্য সময় থেমে গেছে সেই অকল্পনীয় মুহূর্তটিতে। পাঠক হয়ত ভাবতে শুরু করেছেন, আমি কেবল খারাপ খবরগুলোই তুলে ধরছি। না ভাই, খারাপ খবর যখন একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রকল্প গ্রহণ করে, যখন প্রাণের ভয়, অপমানের ভয়, সম্পত্তি হরণের ভয় আর ধর্ষণের ভয় দিয়ে কুব্জ করে ফেলা হয় পুরো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তখন আর কোনও ভরসাই থাকে না যে সেজায়গাতে মনুষ্যত্ব নামক সূক্ষ্ম বিষয়টির কোনও মূল্য দেবার মত কিছু অবশিষ্ট রয়েছে। দুবছর আগে মিশরের তথকথিত ‘আরবি বসন্ত’ নিয়ে কতই না মাতামাতি হল সারা বিশ্ব জুড়ে। সে-বসন্তের বাতাস যে নতুন যুগের নতুন সভ্যতার বার্তা বহন করে আনেনি তার আভাস পেতে কি বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাদের? ‘আরবি বসন্ত’ আরবি রূপকথার মতই একটা সশব্দ রসালো গল্প ছাড়া কিছু নয়। যদি মৌলিক পরিবর্তনই হত ওদের সত্যিকার লক্ষ তাহলে আজকে যে সেখানে কপ্ট খৃস্টানদের দেশছাড়া করবার একটা অনতিসূক্ষ্ম প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে, মিশরী যুবকযুবতীরা নিশ্চয়ই চুপ করে চেয়ে থাকত না সেদিকে। কপ্টরা হলেন পৃথিবীর আদিমতম খৃস্টানদের একটি স্বতন্ত্র শাখা। প্রায় দুহাজার বছর ধরে তাঁরা বসসাস করেছেন মিশরে। গতানুগতিক খৃস্টানদের থেকে এতটাই স্বতন্ত্র তাঁরা যে তাঁদের নিজস্ব একজন পোপ আছেন। তাঁদের বড়দিনের উৎসব ঠিক একই সময় অনুষ্ঠিত হয়না। তাঁদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতি সবকিছুই আলাদা। তাঁদের দুহাজার বছরের ইতিহাসে কখনো কোনও সন্ত্রাসী বা আগ্রাসী চিন্তাধারার আভাস দেখা যায় নি। পরিপূর্ণভাবে একটি শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী, সেটি তাঁদের পরম শত্রুরাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করবে। অথচ, আজ মিশরের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বদোলার মাঝে অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে কেবল এই নিরীহ জাতিটিরই, যার একমাত্র কারণ তারা সংখ্যালঘু এবং তারা খৃস্টান। শুনছি তাঁরা দলে দলে দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মত করে।
এবার চলুন খলিফাদের দেশ তুরস্কে। ১৯২০ সালে ইস্তাম্বুল শহরে প্রায় ২০ লক্ষ খৃস্টান বাস করতেন। ১৯২৩ সালে খেলাফতের পতন ঘটে এবং বীর নেতা কামাল আতাতুর্ক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন একটি ‘সেকুলার’ রাষ্ট্র—-ইসলামি দুনিয়ার জন্য যা ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইস্তাম্বুল শহর থেকে খৃস্টান সম্প্রদায়ের বহির্মুখি গমন চলতে থাকলো অব্যাহত গতিতে। আজকে ইস্তাম্বুলের খৃস্টানসংখ্যা সর্বকূল্যে কয়েক হাজার! সেটা যে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মানুযায়ী ঘটেনি তা বোধ হয় কোন পাঠকের কাছেই অস্পষ্ট নয়।
সবার শেষে চলুন যাই মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রস্থল, সৌদি আরবের দেশে, যে দেশের প্রতি সেজদা দিয়ে আমরা প্রত্যহ নামাজ আদায় করি, যে দেশ পৃথিবীর প্রতিটি মুসলমানের অন্তিম গন্তব্য, যেদেশের কুয়ো থেকে দূষিত জল বয়ামে করে তুলে এনে আমরা দুরারোগে রুগ্ন প্রিয়জনদের নিরাময় আশা করি, সেই দেশের অপরূপ রূপের বর্ণনা শুনুন ধৈর্য ধরে। হজরত মোহম্মদ (দঃ) এর জন্মকালে সেদেশে মুসলমান পরিচয়ের একটি মানুষেরও অস্তিত্ব ছিল না। বেশির ভাগই ছিলেন হাজারো গোত্রভেদে বিভক্ত বেদুইন জাতি, আর ছিলেন প্রচুর পরিমাণ খৃস্টান আর ইহুদী। আজকে, সেই মুসলমানমুক্ত দেশে, দেড় হাজার বছর পর, সেখানে মুসলমান ছাড়া অন্য কোন জাতির স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার নেই। অমুসলমান, যাকে তারা ‘কাফের’ বা ‘বিধর্মী’ বলে অভিহিত করেন, তারা সেখানে শ্রমিক হিসেবে সাময়িক অনুমতি পেতে পারেন বাস করার, কিন্তু তারা যেন ভুল করেও নিজেদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা চেষ্টা না করেন। তাহলে বিপদ আছে। সেখানে হিন্দু আছে, কিন্তু হিন্দুমন্দির নেই। নিষিদ্ধ। সেখানে গুটিকয়েক খৃস্টানও আছেন, কিন্তু কোনও গির্জা নেই। নিষিদ্ধ। এবং তারা যেন ভুল করেও প্রকাশ্যে বড়দিনের উৎসব পালনের চেষ্টা না করেন। তাহলে তৎক্ষণাৎ শ্রীঘরে চলে যেতে হবে। সৌদিরা অপরাধীকে শাস্তি দেন কিভাবে জানেন তো? দুবছর আগে ন’জন বাংলাদেশীকে কিভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে জবাই করেছিলেন তারা সেটা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি কেউ। দয়ামায়া, আপীল আদালত, ওসব সূক্ষ্ম পশ্চিমা জিনিসের ধার ধারে না তারা। কেতাবে লেখা আছেঃ চোখের বদলে চোখ, জানের বদলে জান, ব্যস, তার ওপরে কথা নেই। তারা কেবল কল্লা কেটেই নিবৃত্ত হয়না, সেই মুণ্ডচ্ছিন্ন দেহটিকে হেলিকপ্টারে করে ঝুলিয়ে রাখে, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে অপরাধের শাস্তি কাকে বলে। এর চেয়ে বর্বর, গা-শিউরে-ওঠা, অমানুষিক কাজ পৃথিবীর সবচেয়ে অসভ্য জাতির পক্ষেও সম্ভব নয়।
অথচ কি আশ্চর্য, আমরা, স্বাধীন বাংলার স্বাধীন জাতি, পৃথিবীর অন্য সকল জাতিকে বাদ দিয়ে, সভ্যতার সকল ঐতিহ্যময় ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে, আধুনিকতার সকল প্রদীপ্ত আলোকবর্তিকা হতে মুখ ফিরিয়ে, অন্ধ পুজারীর মত, আবিষ্টভাবে, নেশাগ্রস্ত নাবিকের মত, ছুটছি ঠিক ওই সর্বনাশের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের পথে। আজকে আমাদের বিমানবন্দরে আরবি, দোকানের বিজ্ঞাপনে আরবি, রিক্সার পেছনে আরবি, গায়ের অন্তর্বাসে আরবি, টেলিভিশনের পর্দায় আরবি। এই বর্বর জাতির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি আচার, রীতিনীতি, রেওয়াজ, তাদের ‘আল্লা হাফেজ’, তাদের কথায় কথায় ‘ইনশাল্লাহ’ আর ‘আলহামদুলিল্লাহ’, তাদের পর্দা, বোরখা, হিজাব—-যাকিছু আরবি তা’ই পাকপবিত্র আমাদের চোখে। এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা—-বাহ্যিক দাসত্ব হয়ত এখন আর নেই আমাদের, একাত্তরে তার একটা মীমাংসা হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের স্বেচ্ছাকৃত মানসিক দাসত্বটি দূর করবে কে? এবং ভাগ্যের এমনই নিষ্ঠুর প্রহসন যে এই দাসত্বটি আমরা কোন আধুনিক সভ্য জাতির কাছে সঁপে দিই নি, দিয়েছি সবচেয়ে সভ্যতাবিবর্জিত যে-দেশটি, তারই কাছে। আজকে আমাদের সোনার দেশটিতে গিয়ে মনে হবে সৌদি আরবেরই একটা উপনিবেশ হয়ত হবে। তারা দখল করে নিয়েছে বহু লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত দেশটিকে, বিনা যুদ্ধে, কেবল অর্থের জোরে, আর ধর্ম নামক একটি নেশাদ্রব্যের জোরে। আজকে চারিদিকে কেবল আরবি অক্ষর। চারিদিকে আরবি পোশাক—এমন জোব্বাজাব্বা আলখোল্লা আমি জীবনেও দেখিনি বাঙালি পুরুষের গায়ে। এমন পাগড়ি আর এমন নুরানি, হেনারাঙ্গা, খুবসুরৎ দাড়িও দেখিনি আগে। এরা কারা? এই জীবগুলো কেমন করে দখল করে নিয়েছে আমাদের দেশটিকে?
সুতরাং আজকে যে হিন্দুদের সংখ্যা ৮ এর নিচে নেমে গেছে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। অচিরেই আমরা প্রভু আরবেরই মত হিন্দুমুক্ত রাষ্ট্র হয়ে জান্নাতে ফেরদৌসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছুতে সক্ষম হব। আমাদের দেশে হিন্দুর প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে বৌদ্ধের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই খৃস্টান-জৈন বা বাহাই-কাদিয়ানির। আমরা একটি মরুভূমি তৈরি করব এই দেশটিতে। যেখানে একদিন ধানের চাষ হবে না, হবে কেবল খেজুরের চাষ।
আজকে আমি শামসুর রাহমানের মত জোরগলায় ঘোষণা করতে পারছি নাঃ সুধাংশু তুমি যাবে না। আবার আলমগী্র হুসেনের মত তামাসার সুরে বলতেও পারছি নাঃ সুধাংশু তুই পালা। পালিয়ে তারা যাবে কোথায়? ভারত? সেখানে তো কেউ তাদের চেনাজানা কেউ নেই। সেখানে তাদের ঠাঁই হবেই বা কোথায়? জাতিসঙ্ঘের আশ্রয়শিবিরে? আফ্রিকার কোটি কোটি শরণার্থীর মত?
কেন? কেন তাদের পালাতে হবে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে? এই ‘কেন’টি কি সোচ্চার হবে একটু? একটু কি কন্ঠ পাবে কারুর? কোনও সাহসী যুবকের? কোনও ‘মুক্তিযোদ্ধা’র? একটু কি বিবেক নাড়া দেবে কারুর? একটিবার কি আমাদের তরুণসমাজ কাদের মোল্লাদের ফাঁসির দাবি মুলতুবি রেখে হিন্দুনিগ্রহের অভিযানকে রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করবে? এ যে আমাদের নিজেদেরই জীবনমরণের পরীক্ষা।
অটোয়া, ১৫ ই জানুয়ারি, ’১৪
(আপডেট : ১৯শে জানুয়ারি, ২০১৪)
মুক্তিসন ৪৩
(Y) অসাধারণ লেখা। বলা চলে প্রায় সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়ে গেছে।
আজকের পৃথিবীতে একটা জনগোষ্ঠী তাদের আদি নিবাস থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে বিতাড়িত হয়ে যাবে আর সবাই তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে এটা মনে হয় অতিকথন। রাজনৈতিক ভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে প্রতিশোধ নেবে অনেক ওৎ পেতে থাকা আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিগুলো। পাল্টা মার শুরু হয়নি মোটেও। হ্যাপী আওয়ার শেষ হলেই তো বুঝতে পারার কথা।
আমি আশাবাদী, এই সরকারই বাধ্য হবে হিন্দুদের বা সংখ্যালগুদের নিরাপত্তা বিধানে কঠোর আইন তৈরী এবং প্রয়োগ করতে। বাংলাদেশকে এখনো পরের সাহায্য নিয়ে চলতে হয়। অন্য শক্তির সাহায্য নিলেই সাথে সাথে শর্তও কিছু মানতে হয় (শর্ত ওয়ালারা কারা, অবশ্য তাদের মর্জিও দেখতে হবে বটে)। ভৌগোলিক দূর্বলতার কথাও ভুলে যাওয়া চলবে না। সম্ভাব্য ধর্মান্ধ আক্রমনের আগেই যদি আইন তৈরী আর প্রয়োগ না করা যায় তা হলে হয়ত সোনার বাংলা পাক-আফগান হওয়ার সূচনা হতে মাত্র কয়েক জুম্মা লাগবে। অন্য দিকে হিন্দুদের মার খাওয়ার প্রতিশোধ শুরু হয়ে গেলেও তো অবস্থা ভয়ঙ্কর হয়ে যাবে। পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে প্রথমেই ভাংচুর, ধ্বংস, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি জরুরী ভিত্তিতে বন্ধ না করতে পারলেও অবস্থা ভয়ানক।
ছোটখাট দুয়েকটি তথ্যগত ত্রুটি দেখলাম যার তেমন গুরুত্ব নেই, মূল কথা যা বেশীরভাগ লোকেই সরাসরি বলতে সাহস করেন না তা উচ্চারিত হয়েছে।
আমার সাথে যাদের কথাবার্তা হয় তাদের আমি বছর খানেক আগ থেকেই বলে আসছিলাম ওয়ে আউট দেখে রাখতে, এ দেশে নিকটবর্তী ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু বলে কিছু থাকবে না। যা বাস্তব তা মেনে নেওয়াই ভাল। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা এত প্রবল হয়েছে যে সেটা সরকারী আইন পুলিশ মিলিটারী, সদাশয় পাড়া প্রতিবেশীর পাহারা এসব দিয়ে নিয়ন্ত্রন সম্ভব নয়।
সংবিধানে বিসমিল্লাহ লেখা না লেখায় এখন আর কিছু যায় আসে না। আরবাঞ্চলে যেভাবে সংখ্যালঘু নিকেশ হয়েছে, পাকিস্তানে যেভাবে প্রায় শূন্যের কোঠায় যাচ্ছে আমাদেরও তেমনই হবে, ট্রেন্ডের বাইরে যাবে কিভাবে। আমরা সাম্প্রদায়িক নই, অল্প কিছু লোকে কেবল দাংগা করে এই জাতীয় মন সান্তনা দেওয়া হাস্যকর কথাবার্তা মূল সমস্যা চমতকারভাবে এড়িয়ে যেতে সহায়তা করে।
৭২ সালের সংবিধানে যাইই থাক, ‘৭৫ এর পট পরিবর্তন এসব অনেকে কারন চিহ্নিত করলেও আমার তেমন মনে হয় না। যা হবার তা হতই, ‘৭৫ হয়ত কিছুটা দ্রুত এই পরিস্থিতি আনতে সহায়তা করেছে এই যা।
ধর্ম, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ এমনিতেই হিংসা বিদ্বেষের এক ভাল সোর্স। তার সাথে দারিদ্র যোগ হলে সোনায় সোহাগা, আরো বোনাস হিসেবে বিশ্বজোড়া একই উন্মাদনার প্রনোদনা। আর কিছু লাগে?
@আদিল ভাই,আপাতত উদ্ধৃতি দিতে পারছি না, মাউসে সমস্যা দেখা দিসে সরি। আপনার শেষ বাক্যটার উত্তরে বলতে চাই যে আরেকটা জিনিস লাগে আর তার হল গনতন্ত্রকে বেদ জ্ঞানে পুজা( কোরানও বলা যেতে পারে)।
গনতন্ত্র ভাল জিনিস সন্দেহ নাই, কিন্তু কিছু কিছু দেশের এবং এইসব দেশের আবার গনতন্ত্র সয় না, অ্যালার্জী আছে।
আর তাই এই অ্যালার্জীর কারনেই জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে শুরু হয় গনহত্যা,আর পরবর্তী কালে এইসব হয় ভারতের দালালদের চক্রান্ত ( ২০০১) আর পরে হয় সরকারী ষড়যন্ত্র করে বিশেষ একটা দলকে ফাঁসিয়ে গনতন্ত্রের শর্বনাশ করা!!
অবশ্য এইসব লেখার আবার বিপদ আছে, যেহেতু গনতন্ত্রের প্রচলিত সংজ্ঞানুসারে এইসব চিন্তাভাবনা অগন্তান্ত্রিক, কাজেই এতে অনেকের বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী মহাপন্ডিতদের চুলকানি শুরু হবে, ফলে শুনতে হবে মুখ ঝামটা আর নীতি কথা , কারন এইসব অগণতান্ত্রিক কথাবার্তা ( স্বীকার করছি যে চিন্তাগুলি আমার মোটেই গনতান্ত্রিক নয়; তবে ক্ষুধা যেখানে সর্বগ্রাসী, নৈতিকতা সেখানে পরাজিত সৈনিক। জনতার সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়া বাংলাদেশের তথাকথিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এদেশে আবার হেরেছে) যা আমার মত কিছু হরিজন ( সব হরিজনরাই কিন্তু বাকশালী, যদি বাকশালের সমর্থন নাও করে ) বলে থাকে মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে আর বাস্তবতা উপলব্ধি করে, এইসব শুনে উনাদের অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয়। ইনারা অবশ্য বসন্তের কোকিল, মাঝে মাঝে দেখা যায়, সম্ভবত মুক্ত মনার কিছু চাষাভুষো ( বা ম্যানিক রোগীদের!) পাঠকদের শিক্ষা দিতে বা চিকিৎসা করতে আসেন।
@আদিল ভাই,
আপনার কথা থেকে যা বুঝলাম তা হল “১৯৭৫ সাল” এদেশের রাজনীতির বৰ্তমান অবস্থায় পৌছানতে খুব গুরত্বপূৰ্ন ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে নাই, যেভাবেই হোক বাংলাদেশ এই অবস্থায় পৌছাতোই। তাহলে তো বলতেই হয় জিয়া আর এরশাদ ভালই কাজ করেছে। এরা দুইজনই আসলে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করেছেন আর অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য রাজনীতি সহজ করেছে। সেই কারনেই মনেহয় এখন কিছু ধৰ্মান্ধের দল নিজেদের অরাজনৈতিক দল ঘোষনা করে রাজনীতির ময়দানে নামে। 😕
==> আমার মতে ১৯৭৫ সালের পট পরিবৰ্তনের প্রভাবেই বৰ্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির এই ভয়ংকর অবস্থা। এই বিষয়ে আমার একটা ধারনা হল পাকি সেনাশাসনের আমলেও এদেশের মানুষের একটা অংশ রাজার হালে ছিল(যাদের এখনো বলতে শুনা যায় যে তারা পাকিস্থান আমলই ভাল ছিল!)। কিন্তু স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমলে ঐ অংশটি ঝামেলায় পরে এবং বুঝতে পারে দেশের সম্পদ সাধারন মানুষের কাছে চলে যাবে, তারা একা এই সম্পদের মালিক হতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর জিয়া ও তার পরৰ্বতীতে এরশাদের আমলে ঐ অংশটি আবার পাকি সেনাশাসন আমলের স্বাদ পায় আর দেশের অৰ্থসম্পদ ঐ অংশটির কন্ট্রোলে চলে যায়।
অন্যদিকে দেখা যায় যে সাধারন জনগন সমঅধিকার আদায়ের লক্ষে পাকিদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে এই দেশ স্বাধীন করেছিল তাদের সে সমঅধিকারের স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যায়। আর সমাজের ঐ স্পেশাল অংশটি আওয়ামীলীগের আৰ্দশের বিপরিতে অবস্থান নেওয়া যত দল আছে সব দলেই ঢুকে যায়। ঐসব আৰ্দশহীন আওয়ামী বিদ্বেষী দলগুলোর থেকেই প্রতারিত সাধারন জনগনকে ধৰ্মের আফিম বিলানো শুরু হয়, কখনো সংবিধানে বিসমিল্লাহ ঢুকিয়ে আবার কখনো রাষ্ট্রকে খৎনা দিয়ে মুসলিম বানিয়ে। আবার অন্যদিকে জিয়া,এরশাদ,খালেদার আমলের সাথে শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থার কোন পাৰ্থক্য ছিল না। অন্যভাবে বললে বঙ্গবন্ধুর হত্যার ২১ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন রাষ্ট্রের প্রত্যেক লেভেলকে ইসলামায়িত(ভোগ দখলের রাজনীতির অংশ) করে দেওয়া হয়েছে যার ফলে শেখ হাসিনার ঐ জিয়া/খালেদার প্যাৰ্টান থেকে বাহিরে আসার আর কোন উপায় থাকে না।
@তারিক,
আপনি তো দেখি মিজান ভাই এর এই লেখা বাংলাদেশের যাবতীয় সমস্যার সাথে মিলিয়ে একাকার করে ফেলছেন। এখানে মনে রাখা উচিত যে আমার যে কথা আপনি কোট করে আপনার বিশ্লেষন করেছেন তাতে “এই অবস্থা” বলতে বোঝানো হয়েছে সাম্প্রদায়িকতাকে। কেন মুক্তিযুদ্ধের পর শোষিত মানুষ মুক্তি পায়নি……আওয়ামী লীগ বিদ্বেষ……পাকি আমলে ভাল ছিল বলে ঢেকুর তোলা……এ সমস্ত কিছু এখানে আনার তেমন যুক্তি নেই।
বাংলাদেশে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা চাংগা হবার জন্য কেবলমাত্র ‘৭৫ এর পট পরিবর্তনকে দায়ী করা বড় ধরনের এক চোখা বিশ্লেষন।
– এই অদ্ভূত ধরনের কথা আমার কথা থেকে কিভাবে বার করলেন বোঝা মুশকিল। ‘৭৫ এর পট পরিবর্তন না হলেও আজকের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আসতে এমন কিছু অসুবিধে হত না (যেটা আমার কথা ছিল) আর এ দেশের রাজনীতির ওপর ‘৭৫ এর গুরুত্বপূর্ন প্রভাব নেই কিভাবে একাকার করে ফেলতে পারলেন তা কিছুতেই বুঝলাম না।
পুরো মুসলমান বিশ্বে তাকিয়ে দেখুন, যে সমস্ত দেশই রাজতন্ত্র থেকে বের হতে পেরেছে বা গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে তার বলতে গেলে প্রতিটা দেশেই ধর্মকেন্দ্রিক মূল্যবোধগত চরম বিভাজন আছে। প্রতিটা দেশেই কম বেশী ধর্মীয় উগ্রবাদের কাছে রাজনীতি জিম্মী, যে দেশে রাজনীতিতে ধর্মের যত প্রভাব সেখানেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা থ্রেটেন্ড। এ সব দেশই ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাবস্থা এবং ইসলামী শাসন নামের জগাখিচূড়ী ব্যাবস্থার মধ্যে রোলার কোষ্টার খেলছে। তুরষ্কে কামাল আতাতুর্ক সেক্যুলার ব্যাবস্থা কায়েম করেছিলেন, আজ তুরষ্ক কোনদিকে যাচ্ছে? মিশরের শুধু বর্তমান নয়, সেখানে সেক্যুলার আমল থেকেই সংখ্যালঘুরা সর্বদা হুমকির মুখে। পাকিস্তান বাদই থাক, সেখানে বুঝলাম জামাতে ইসলামী আছে, স্বৈরশাসক জিয়াও আছে। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর সংখ্যালঘুদের কেন দলে দলে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, কোন জামাত শিবির জিয়া এরশাদের প্রভাব তাতে ছিল? আরব অঞ্চলে কি জিয়া এরশাদ জামাত শিবির গিয়ে সংখ্যালঘু অধিকার হরন শিখিয়ে এসেছিল, তার আগে তারা সকলে উদার মডারেট মুসলমান ছিল? এ সমস্ত দেশে কি ‘৭৫ সাল, জিয়া এরশাদ জামাত শিবির প্রভাব রেখেছে? বাংলাদেশ এই ট্রেন্ডের বাইরে যাবে তা কিভাবে আশা করা যায়? আন্তর্জাতিক প্রভাবও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লব থেকে শুরু হয়ে মধ্য ৯০ এর পর থেকে বিশ্বজুড়েই ইসলামী জ্বর আরো প্রবল আকার ধারন করেছে, ৯১১ এই জ্বরকে নিয়ে গেছে চরম শিখরে। মুসলমান সমাজের সাধারন প্রবনতাই হল যাবতীয় সব ঘটনা ধর্মের চোখে মূল্যায়ন করা, এ সমস্ত ঘটনা সেই প্রবনতা আরো উষ্কে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা, বিধর্মী বিদ্বেষ খোলাখুলিভাবে প্র্যাক্টিসের ন্যূনতম বাধাও দূর করা সহজ হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশে কখনোই কায়েম হয়নি। সব ধর্মের সমাধিকার মানে প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। সেটাও বাংলাদেশ হজম করতে পারেনি। ইসলাম সম্পর্কে যার ন্যূনতম ধারনা আছে সেইই জানে যে প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা (মানে ধর্ম ব্যাক্তিগত বিশ্বাস, শ্রেষ্ঠ এবং পরিপূর্ন জীবন বিধান নয় এটা কতটা অবাস্তব)। বংগবন্ধু নিজেই আপোষ শুরু করেছিলেন। পূর্নতা দিয়েছে জিয়া, এরশাদ আরো চরম করতে গিয়েছে কিন্তু ব্যাড ইমেজের কারনে সফল হয়নি। জিয়া এরশাদ সাম্প্রদায়িকতা তৈরী করেনি। তারা দেশের বড় সংখ্যক মানুষ কি পছন্দ করে তা ভাল করে জানত বলেই তার ব্যাবহার করেছে মাত্র।
ধর্মান্ধ গোষ্ঠীও নুতন করে জিয়া এরশাদ আগমের পর তৈরী হয়নি। তারা বহাল তবিয়তেই দেশে ছিল। কেবল ‘৭১ সালের পরাজয়ের পর গর্ত থেকে বার হতে কিছুটা স্বাভাবিক সময় নিচ্ছিল। দাউদ হায়দারকে বংগবন্ধু নিজেই নিরাপত্তা দিতে পারবেন না বুঝে দেশ থেকে বার করে দিয়েছিলেন। এই সমস্ত ধর্মান্ধ বলে যাদের গাল দেওয়া হয় তাদেরই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকে মাথায় করে রাখে। জিয়া এরশাদ এদের তৈরী করেনি। ধর্মান্ধ বা যাদের অরাজনৈতিক বলে গাল দিচ্ছেন তাদের দরগায় যারা দিনে অসাম্প্রদায়িকতার ফেনা তুলে ভোট তুলেন তারাও ধ্বর্না দেয়। জামাত শিবিরও আইনত প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ‘৭৫ এর পর আপাত চোখে ফিরে এলেও তাদের আবির্ভাব ঘটছিল তার আগেই, এবং অবশ্যই সেটা নানান ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল এসবের মোড়কে। এ কারনেই আমি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করাতেও এমন কিছু লাভ দেখি না। ইসলাম এমনই এক জিনিস, রাজনীতি এর সাথে এতই ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে অরাজনৈতিক ব্যানারেও দিব্ব্যী রাজনীতি করা যায়। হয়ত কেবল নির্বাচনে আসা যায় না, তাতে ফল হবে আরো খারাপ, এক সময় ঘটবে সেই বহুল কাংখিত ইরান আফগান ষ্টাইলের ইসলামী বিপ্লব।
এখানে অপ্রাসংগিক, কিন্তু আপনার কথা পড়ে মনে হয় যে আপনার মতে দেশে দুবৃত্তায়ন, গরীবের হক মেরে খাওয়া ইত্যাদী যাবতীয় কুকর্মের সাথে কেবল আওয়ামী বিদ্বেষী লোকেরাই জড়িত।
@আদিল ভাই,
এটাই মনে হয় মুসলিম সমাজের ব্যর্থতার বৃহত্তম উদাহরন, কি বলেন আপনি?তুরস্কের মত দেশকে আগে এই দেশের মৌলবাদী পত্রিকাগুলো কতই না নোংরা বিশেষণে বিশেষায়িত করেছে, সাধারন মানুষকে বলতে শুনেছি কত নোংরা কথা, অথচ আজ সেই তুরস্ক কোথায় গেল?
সব দেশের কমবেশি উন্নতি হয় গনতন্ত্র দ্বারা, কিন্তু মুসলিম দেশগুলোতে কেন হয় না? না হলে তুরস্কের বর্তমান দল তো পুরাপুরি জনতার ম্যন্ডেট নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল, এবং শুরু করেছে স্লো পয়জন।
অন্যদের মাথা এইভাবে কেন তেমনটা ধোলাই করা যায় না, যেটা মুসলিমদের ক্ষেত্রে যাচ্ছে?
@অর্ফিউস,
সবই জামাত শিবির করেছে রে ভাই।
তুরষ্কে জনতার ম্যান্ডেট নিয়েই বর্তমান দল এসেছে, তবে তারা স্মার্ট, স্লো পয়জন পদ্ধুতিতে এগুচ্ছে। জনতার ভোটে নির্বাচিত ব্রাদারহুড ভুল কর ফেলেছিল এখানেই, ফলে সাময়িভাবে তারা একটু সমস্যায় পড়েছে। বাংলাদেশে জামাতও যদি রাজাকারদের ছাড়তে পারতো, ৭১ এর ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করত তবে তাদের ভোট ব্যাংকও আজ ৫ এ সীমাবদ্ধ থাকতো না, অন্তত ২০ এর ঘরে যেত। যত যাইই হোক, যেইই ফাঁসীতে ঝুলুক, জামাতের সামনে সুদিন অবশ্যই আসবে।
গনতন্ত্র শুধু কায়েম করলেই হয় না। গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ ব্যাক্তি পর্যায়ে না থাকলে এর কোন মূল্য নেই। জেট প্লেন খুবই উন্নত যানবাহন সন্দেহ নেই। কিন্তু গরুর গাড়ির গাড়োয়ানকে আগে জেট প্লেন চালানোর ট্রেনিং না দিয়ে চালকের আসনে বসালে এই উন্নত বাহনই হয়ে যেতে পারে মারনাস্ত্র।
@আদিল ভাই, তাহলে কি মুসলিম সমাজের এই দশা থেকে মুক্তির কোন রাস্তাই আপনার নজরে আসছে না? আপনার কথাবার্তা শুনে তো বেশ হতাশ হয়ে যাচ্ছি, সত্যি কি এই দশা থেকে মানে ইসলামীকরন থেকে মুক্তি নেই? না থাকলেই তো শর্বনাশ, এই দেশে আর থাকা হবে কিনা কে জানে, মানে যদি হিন্দুদের মত সেক্যুলারদের কেও ধরে ধরে জবাই করা হয়।
খুবই ন্যায্য কথা, নাহ আগে অনেক দ্বিমত থাকলেও ইদানিং দ্বিমত করতে পারছি না। ভরসা উঠে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
সেতো বুঝি রে ভাই, আর তাইতো গণতন্ত্র নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগছি। কোনদিকে চিন্তা করব বুঝতে পারছি না। মানবাধিকারের কথা বললে গনতন্ত্র এই দেশে আপাতত বাদ রাখতে হয়, আর এই কথাটা বললেই সমালচনা আসে। আপনি দয়া করে একটু আমাকে দিক নির্দেশনা দিতে পারেন? আমি সত্যি শাঁখের করাতের মধ্যে পড়ে চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলার দশায় আছি, শ্যাম রাখলে কুল থাকে না, কুল রাখলে শ্যাম থাকে না। এই দেশে এখনো গনতন্ত্রের জন্য যদি চিল্লাই তবে হিন্দুরা মরতেছে ( কারা মারল সেটা ব্যাপার না), আর মানবাধিকারের কথা তুললে গনতন্ত্র থাকে না, কিযে করি 🙁 । দয়া করে একটা বিস্তারিত ব্যখ্যা দেন, আপনার বিশ্লেষণ শুনলে অনেকের মত আমিও মনে সাহস পাই।
@আদিল ভাই, আমার কাছে এদেশের সাম্প্রদায়িক ধবংসলীলার মূল সোৰ্স ধৰ্মভিত্তিক রাজনীতি। এই কারনে আমি আপনার কমেন্টের কোট করা অংশের “সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি” কে রাজনীতির সাথে হয়তঃ মিলিয়ে ফেলেছিলাম। আর আমার ঐ কমেন্টে ৭৫ পরবৰ্তীতে এদেশের রাজনীতি নিয়ে কিছু ক্ষোভ, কোন ব্লগ ও কি নিয়ে পোস্ট কেয়ার না করেই বলে ফেলছি, তাই আমি দুঃখিত।
বুঝলাম তুরস্ক, মিশর, ইরান, … এসব দেশের সাম্প্রদায়িকতা বিভিন্ন ধরনের হলেও এর মূল উৎস একই। আসলে এইসব দেশের রাজনীতির ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে খুব বেশি জানি না। কিন্তু আমার মনেহয় বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার সাথে তুলনা করতে হলে এই অঞ্চলের দেশগুলোর(যেমন: ভারত, পাকিস্থান) এর সাথে তুলনা করা বেশি যুক্তিসঙ্গত, কারন এই অঞ্চলের দেশগুলোর আর আমাদের রাজনীতির ইতিহাসের সূত্র একই । ভারতের দিকে তাকালে আমি দেখি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থা অনেক ভাল এবং এক পরিসংখ্যানে দেখেছিলাম তাদের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের মানুষ কি বাংলাদেশের তুলনায় কম ৰ্ধমান্ধ? কিংবা ভারতে কি কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠন নাই? কিন্তু তারপরেও দেখেন সেখানে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি খুব বেশি আক্রমনাত্বক না আর তাই সংখ্যালঘুদের অবস্থা বাংলাদেশ/পাকিস্থানের সংখ্যালঘুদের তুলনায় অনেক ভাল। বাংলাদেশ ও পাকিস্থান সংখ্যালঘুদের উপর এই নিৰ্যাতনের কারন কি তাহলে ঐ পাকি আৰ্দশের ধৰ্মভিত্তিক রাজনীতি না?
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্থান বিভক্ত হয়েছিল, সেই তত্ত্ব হতে ভারত অনেকাংশে অসাম্প্রদায়িকতার দিকে এগিয়ে গেছে কিন্তু পাকিস্থান ও পাকি ভাবাৰ্দশের বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হতে পারে নাই। তাই আমার ধারনা(ভুল কিনা জানি না?) দ্বিজাতি তত্ত্বের চেতনার বিপরিতে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙ্গালি স্বাধীনতা অৰ্জন করেছিল, সে চেতনায় যদি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশকে গড়ে তোলা যেত তাহলে বাংলাদেশের মানুষ যতই ৰ্ধমপ্রান হোক না কেন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বৰ্তমানের মত ভয়ংকর রূপ নিত না। মুক্তিযুদ্ধে ধৰ্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কুকৰ্মের ফল হিসেবে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশগড়ার উদ্দেশ্যে, বঙ্গবন্ধুর ধৰ্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরন গনতান্ত্রিক না হলেও সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার রোধের সৰ্বউত্তম পন্থা ছিল। বঙ্গবন্ধু ধৰ্মপ্রান হলেও অত্যান্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ ছিলেন। অশিক্ষা ও দারিদ্রতায় জৰ্জরিত জনগনের দেশের অগ্রগতির জন্য গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পৰ্যায়ে ধৰ্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে রাখাই উচিৎ। কারন এর মাধ্যমেই কেবল সংখ্যাগোরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে কোন সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ক্ষমতারোহন ও দেশকে মৌলবাদীদের আখড়ায় পরিনত করা হতে বিরত রাখা সম্ভব।
১৯৭৫ সালের পূৰ্ববৰ্তী সময় এদেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ছিল কিন্তু সেটা মনেহয় না এখনের মত এত বিশাল।
ঐসময়ে যদি বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বৰ্তমান সময়ের মত ৰ্ধমান্ধ থাকতো তাহলে ১৯৪৭ সালে যে সাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশভাগ হয়েছিল তার বিপরীতে ৭১ এর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধ কেন করেছিল? আমি জানি মুক্তিযুদ্ধের পিছনে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়া ছাড়াও আরো অনেক কারন ছিল, তবে এটা একটা বড় কারন ছিল।
বৰ্তমান সময়ে আওয়ামী বিদ্বেষী ও আওয়ামীপন্থী উভয়ই ভোগ দখলের রাজনীতি করছে কিন্তু আমি শুধু বলেছি এর শুরুটা হয়েছিল আওয়ামী বিদ্বেষীদের হাতেই।
@তারিক,
– ধরা যাক কথাটা পুরোপুরি ঠিক (যদিও বাস্তবে ব্যাপারটা অতটা সরল না যা হয়ত আরো পরে বোঝা যেতে পারে)। কথা হল ধর্মের ভিত্তিতে যে রাজনীতি করতেই হবে এই বাধ্যবাধকতা কোথা থেকে আসে? জিয়া এরশাদ সেটা প্রথম শিখিয়ে গেছে? তার আগে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির তত্ত্ব ছিল না? আপনি আসলেই বিশ্বাস করেন ‘৭৫ এর বিপর্যয় না ঘটলে আজকের বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জয়জয়কার পড়ত না?
অন্য কথায়, ইসলাম পূর্নভাবে চর্চা করে ধর্ম এবং রাজনীতি আলাদা করা সম্ভব? ইসলাম সম্পর্কে যার ন্যূনতম জ্ঞান আছে সেইই জানে এটা কতটা অসম্ভব। শুধু অসম্ভবই নয়, নানান ফতোয়া আছে যে যারা ইসলামকে ব্যাক্তিগত বিশ্বাসে আবদ্ধ রাখতে চায় তারা আদৌ মুসলমানই নয়। এ ধরনের ফতোয়ার আবির্ভাব, প্রচার রোধ শুধু সংবিধানের কাগুজে ধারা সংযোজন করে সম্ভব?
– আমিও খুব বেশী জানি না। তবে যেটুকু জানার দরকার তা সহজেই জানা যায়। এটা ঠিক যে সাম্প্রদায়িকতার মূল উতস সেই ধর্ম ভিত্তিক বিভাজন হলেও অঞ্চলভেদে মেকানিজমটা কিছুটা হলেও ভিন্ন। বাংলাদেশে মূল টার্গেট হিন্দু সম্প্রদায় (অন্তত এখনো), মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদী/খ্রীষ্ট্রান। ঘটনা ভারতে যে হিন্দু মৌলবাদ আছে তার সাথে আবার বাংলাদেশ/পাকিস্তানের মৌলবাদের বড় পার্থক্য আছে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদ অনেকটাই রাজনৈতিক, বাংলাদেশ পাকিস্তানে এটা রাজনৈতিকের থেকেও বড় হল ধর্ম ভিত্তিক। এ কারনে বাংলাদেশে পাকিস্তানে এর মাত্রা আরো ভয়াবহ। এখানেও ইসলাম ধর্মের কোর ভ্যালুর ইউনিক বৈশিষ্ট্যর অবদান আছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাক না থাক সেই কোর ভ্যালু (বাদবাকি সব ধর্ম বাতিল, আমরাই শ্রেষ্ঠ, আমাদের ধর্মে অবিশ্বাসীরা মহাপাপী… অপর ধর্মের লোকে সদা সর্বত আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে……) থেকেই যাবে। এ ধরনের মূল্যবোধের চর্চা করা হতে থাকলে সে সমাজে বিধর্মীদের অবস্থান কেমন হবে তা বোঝা খুব কষ্টকর কিছু নয়। দ্বিতীয় শ্রেনীতে পরিনত হওয়া বিধর্মীদের যায়গা সম্পত্তি হাত করা এমন অবস্থায় তেমন কঠিন কিছু নয়। সাম্প্রদায়িক হামলা হোক না হোক, বিধর্মীদের অবস্থান আমাদের মত দেশগুলিতে মোটামুটি দ্বিতীয় শ্রেনীর।
– পাকিস্তান আমলে অব্যাহত শোষনের কারনে বাংগালী জাতিসত্ত্বার বিকাশ ঘটতে বাধ্য হয়েছিল। ধর্মীয় জাতিসত্বার জিগির সাময়িকভাবে চাপা পড়েছিল। তার মানে এই না যে বাংগালী মুসলমান ধর্মীয় আইডেন্টিটি চিরতরের জন্য ভুলে গেছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর বিদেশী শত্রুর চিন্তা মাথা থেকে নামার পর সেই ধর্মীয় আইডেন্টিটির ভূত আবারো মাথা চাড়া দিতে খুব সময় লাগেনি। আপনার পাড়ায় আজ আগুন লাগলে বিএনপি আওয়ামী জামাতি সকলে মিলেই আগুন নেভাবেন নিশ্চয়ই, সে সময় কার পরিচয় কি তা নিয়া মাথা ঘামাবেন না। আগুন নেভার পর আবারো মনে হবে কে আওয়ামী কে বিএনপি কে জামাতি। ধর্মীয় আইডেন্টিটি এবং ধর্মীয় সমাজ কায়েম করার স্বপ্ন মাথা চাড়া দেবার পর থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় যুদ্ধ করা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদে্র মাঝেও বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সেলিব্রিটি যোদ্ধাদের মধ্যে শুরু মনে হয় এক কালের বামপন্থী মেজর জলিল, এ তালিকায় পরবর্তিতে আরো অনেকে…হালের কাদের সিদ্দিকীও যোগ দেন। ওনারা খুব সম্ভব মুখে বলেন না, কাদের সিদ্দিকী হয়ত আরো বছর দশেক বাঁচলে ইনশাল্লাহ ‘৭১ সালে ভ্রার্তৃ প্রতিম পাকিস্তানী ভাইদের হত্যার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করবেন। বিএনপির সমর্থকদের মাঝে রাজাকার ধরনের লোকের মাঝে বহু মুক্তিযোদ্ধাও আছে। সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ শেষ জীবনে জামাতের সব অনুষ্ঠান আলোকিত করতেন। এ জাতীয় সব মুক্তিযোদ্ধার বর্তমান রাজনৈতিক দর্শন সামান্য অনুসন্ধান করলেই পালটি খাবার কারন বুঝতে পারবেন।
বংগবন্ধু নিজেই ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রতি সম্মান দেখাতে পারেননি। ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে বিচ্যূতি ওনার আমল থেকেই শুরু হয়। স্বাধীনতার পর তার আমলেই পাক আমলের চাইতেঈ ৩ গুন বেশী বরাদ্দ দেওয়া হয় মাদ্রাসা শিক্ষার পেছনে, সেই প্রবনতার ফল আজ তো ফলেছে হাতে নাতেই দেখতে পারছেন। অবশ্য তাকেই বা একা দোষ দেব কি। তিনি জননেতা ছিলেন, মুসলমান মন কি চায় তা না বোঝার মত মানুষ তিনি ছিলেন না। উনি একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার কাগুজে নীতি, আরেক দিকে ধর্মীয় মৌলবাদে বিশ্বাসী লোকজনকেও খুশী রাখার নীতি শুরু করেছিলেন। যে কোন মুসলমান দেশ বার করে দেখতে পারেন ধর্মনিরপেক্ষতা কতটা সম্ভব, সেখানে সংখ্যালঘুদের কতটা সমাধিকার দেওয়া হয়।
জিয়া সাহেব ক্ষমতায় আসার পর নানান প্ল্যাটফর্মে বিচ্ছিন্ন মৌলবাদী এবং ডানপন্থীরা একাট্টা হতে পেরেছে এই যা, তাদের নুতন করে জন্ম হয়নি। জিয়ার আবির্ভাব ছাড়াই ব্যাপারটা ঘটতই।
@আদিল ভাই,
আমিও জানি কোন মুসলিম সংখ্যাগোরিষ্ঠ দেশে রাজনীতিকে ধৰ্ম হতে আলাদা রাখার কোন উপায় নাই, কারন ইসলাম ধৰ্মকে তৈরি করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু কেন এদেশে ধৰ্মীয় রাজনীতির পুনরায় বিকাশ একটা ৭৫ ছাড়া কঠিন ছিল সে বিষয়ে আমার একটা বিশ্লেষন আছে। সেটা হল: ১৯৭০ সালে নিৰ্বাচনের ফলাফল দেখে আমার ধারনা পাকিস্থান আমলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি এদেশের মানুষ এক ধরনের বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছিল এবং এর পরবৰ্তীতে মুক্তিযুদ্ধে ঐ আমলের ইসলামপন্থী দলগুলোর বাঙ্গালিদের উপর ইসলামের নামে যে অমানুষিক নিৰ্যাতন ও গনহত্যার মত কাৰ্যকলাপ করেছে তা দেখে এদেশের মানুষের ধৰ্মভিত্তিক রাজনীতির উপর ঘৃনা চরম মাত্রায় পৌছে ছিল। যার ফলস্রুতিতে স্বাধীনতার পর যখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বাংলাদেশ ধৰ্মভিত্তিক রাষ্ট্র হবে না কিংবা যখন ধৰ্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন তখন ধৰ্মভিত্তিক রাজনীতির কুফল হাড়েহাড়ে টের পাওয়া এদেশের মানুষ আর ধৰ্মীয় রাজনীতির পক্ষে কথা বলে নাই। কিন্তু ১৯৭৫ পরবৰ্তী সময় হতে রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে ইসলামীকরন শুরু হয়, ধৰ্মভিত্তিক রাজনীতি উন্মুক্তকরন, পাকিস্থানের দালাল রাজাকারদের এদেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে পুৰ্নবাসন করা হয়, পাকিস্থানের সাথে ক্রমাগত রিকন্সিলেশনের চেষ্ঠা(মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই বলে!!) এবং সৰ্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে এদেশের মানুষের মন থেকে মুক্তিযুদ্ধে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কুকৰ্মকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়। আর অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস ও কাজ সৰ্ম্পকে অজ্ঞাত সাধারন মানুষের একটা বিরাট অংশকে বছরের পর বছর ধরে ঐ জামাত-শিবির তাদের এলাকা ভিত্তিক অফিস(মসজিদ!) হতে ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী রাষ্ট্র ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিতে থাকে। যার ফলে এদেশে আবার ৰ্ধমীয় রাজনীতির জয়জয়কার শুরু হয়।
ভাই আমার মূল কথা হল: বাংলাদেশের মানুষকে যদি ৭৫ পরবৰ্তী সময় হতে মুক্তিযুদ্ধে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বৰ্বরতার ইতিহাস সৰ্ম্পকে সঠিক তথ্য জানানো হতো, তাদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা না হতো এবং ৭১ কে সামনে রেখে ধৰ্মীয় রাজনীতির কুফল সৰ্ম্পকে জনগনকে সচেতন করার ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বৰ্তমানের মত পপুলারিটি পেত না বরং ৭১ এর পর ধৰ্মীয় রাজনীতি সৰ্ম্পকে মানুষের যে ঘৃনা জন্মে ছিল সেটাই অটুট থাকতো।
@তারিক,
-এটার গুরুত্ব এখানে নেই। ইসলাম কি উদ্দেশ্যে কে বা কারা তৈরী হয়েছে সেটা আমাদের আলোচনার বাইরে, দরকারও নেই। আমাদের ফোকাস হল ইসলামী মূল্যবোধ চর্চার নামে কিভাবে রাজনীতি প্রভাবিত হয় এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয় সেটা।
আপনাকে প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে ইসলাম নিজেই একটা রাজনৈতিক তত্ত্ব। অন্যান্য ধর্ম যেমন কালের আবর্তে কেবল বিশ্বাসে পরিনত হয়েছে ইসলাম সেভাবে বিবর্তিত হয়নি। অবশ্যই যুগের প্রয়োযনে ইসলামের দেহ থেকে বহু অংগ খসে পড়েছে এবং পড়ছে তারপরও ইসলাম পূর্নাংগ জীবন বিধান এই ধারনা থেকে মুসলমান দাবীদার (চরম মৌলবাদী থেকে অতি মডারেট মুসলমান) কারো পক্ষেই বার হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে যারা গলা ফাটান তাদের পক্ষেও ইসলাম পূর্নাংগ জীবন বিধান নয় এটা সরাসরি স্বীকার করা সম্ভব নয়। ইসলাম আর কিছু পারুক না পারুক একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে যেভাবে স্ববিরোধীতা বা আত্মপ্রতারনার জগতে স্থায়ীভাবে অবস্থান করাতে পারে তাতে অবাক হতেই হয়। পূর্নাংগ জীবন বিধান বলে কিছুকে স্বীকৃতি দিলে সেটা রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করবে না কোন যুক্তিতে? স্ববিরোধীতার সীমা থাকা দরকার না?
আপনি ৭০ সালের নির্বাচন, ৭২ এর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, ৭৫ এর পট পরিবর্তন, জিয়া এরশাদের আমল এসব সম্পর্কে সামান্য গভীরে গেলে বুঝবেন যে কেবল মাত্র ’৭৫ এর পট পরিবর্তনকে ধর্মীয় রাজনীতি/সাম্প্রদায়িকতার সূত্র হিসেবে চিহ্নিত করা কতটা ভ্রান্ত। মাত্র ৪ বছরে পুরো দেশের মূল্যবোধ এভাবে আসমান জমিন পরিবর্তিত হয় না। বিশেষ করে কেবল মাত্র এক সেনা শাসকের কাগুজে দুই লাইন সংবিধানের ঢোকা্নোর কারনে সব হয়েছে চিন্তা করা রীতিমত হাস্যকর।
আপনাকে আগেই বলেছি যে ’৭৫ এর পর জাতি রাতারাতি সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়নি কিংবা ধর্মীয় রাজনীতির প্রেমে পড়েনি। এর বীজ চিরকালই ছিল, পাকিস্তান আমলেও ছিল, কেবল চাপা ছিল পাকিস্তানী শোষকদের কারনে। পাকিস্তানীদের দোষেই বাংগালী জাতীয়তাবাদের নীচে সাময়িকভামে মুসলিম জাতীয়তাবাদ চাপা পড়েছিল। পাকিস্তানীরা বিদায় হয়েছে, বাংগালী জাতীয়তাবাদের সমান্তরালে মুসলিম জাতীয়তাবাদ আবার চাংগা হওয়া শুরু করেছিল। ’৭৫ ছিল এই যাত্রায় কেবল একটি বড় মাইল ফলক। পাকিস্তানীদের থেকে আমরা যেমন ’৭১ না হলেও ৮১ বা ৯১ এ হলেও স্বাধীন হতাম তেমনি ’৭৫ এর পটপরিবর্তন ছাড়াই ধর্মীয় রাজনীতির উন্মেষ, সাম্প্রদায়িকতার চরম চর্চা ঠিকই শুরু হত।
এটা তো নিশ্চয়ই জানেন যে বংগবন্ধুর ’৭০ সালের নির্বাচনের একটি গালভরা প্রতিশ্রুতি ছিল “কোরান সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন করা হবে না”? ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সাথে এর সামঞ্জস্যতা কোথায়? তারপর ধরেন হিন্দু, খ্রীষ্টান বৌদ্ধ বিশ্বাস পরিপন্থী কোন আইন করা হবে না এমন প্রতিশ্রুতি কেন দেওয়া হয়নি? এই প্রতিশ্রুতির কারন ছিল তখনকার আপনার ভাষায় অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ জনতা পাকিস্তানী শাসন অবসানের সাথে সাথে এসব কথাও শুনতে চাইতো, নয়ত বাংগালী জাতীয়তাবাদের সেই চরম উত্থানের যুগেও ভোটের বাজার রিস্কি হত। হুবহু এই একই প্রতিশ্রুতি আজকের দিনেও বিএনপি আওয়ামী লীগের মত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি দিয়ে ভোটে নামে। বলাই বাহুল্য যে আসলে এক ধরনের প্রতারনা ছাড়া কিছু না। এই প্রতারনার ইউনিক দিক হল প্রতারক এবং প্রতারিত সকলেই জেনে শুনেই কাজটি করে। দু’পক্ষই জানে যে বাস্তবে এমন সম্ভব নয়। আরো মজার দিক হল এই প্রতিশ্রুতি আবার ভুলেও কেউ দেয় না এবং আম জনতার দাবীও ওঠে না যে সব আইন কোরান সুন্নাহ মেনে করা হবে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় পরিপন্থী আইন করা হবে না। যাক, মূল কথা হল ধর্মীয় রাজনীতি যখন চরম কোন ঠাসা ছিল তখনো ধর্মকে পুরো সরিয়ে ভোটের বাজারে নামার হিম্মত বাংগালী জাতীয়তাবাদের প্রানপুরুষ বংগবন্ধুও করেননি। বাংগালীর অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতার এই হল বাস্তব চিত্র। স্বাধীনতা পরবর্তি দিনে দেখা যায় বংগবন্ধু নিজেই কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ রাখা শুরু করেছিলেন।
৭০ সালের নির্বাচন আসনে হিসেবে যতটা নিরবিচ্ছিন্ন রায় মনে হয় ভোটের হিসেবে ততটা আদতে নয়। প্রায় ২৫ ভাগ ভোট আওয়ামী লীগ পায়নি। কিছু ভোটার এমনিতেই হয়ত ভোট দেয়নি, কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে সে সময় স্বাধিকারকামী জনতা ভোট দেবার সুযোগের জন্য উন্মুখ ছিল। কাজেই যারা সরাসরি আওয়ামী বিরোধী ভোট দিয়েছিল এবং আদৌ ভোট দেয়নি (প্রায় ২৫ ভাগ) তারা মূলত স্বাধিকার চায়নি, ছয় দফাকে তারা ধরে নিয়েছিল বৃহত্তম মুসলমান রাষ্ট্র ভাংগার ষড়যন্ত্র। এদের ভয়েস সংগত কারনেই তেমন বড় ছিল না, তাই বলে এরা ছিল না এমন নয়। এরাই হল ধর্ম চালিত জনতা। কোনভাবেই এদের কন্সেপ্ট পরিবর্তন হয় না। স্বাধীনতার পর এরা ধর্মনিরপক্ষ বনে যায়নি, উলটা সময়ের সাথে সাথে ধর্মনিরপেক্ষ শিবির থেকে এই শিবিরে সমর্থন শিফট করেছে, যার কারনে জিয়ার বিপুল জনসমর্থন পেতে কোনই অসুবিধে হয়নি। বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে আসলে বিরাট বিভ্রান্তির ভেতর দিয়ে যার কেন্দ্রে আছে ধর্ম, দিনে দিনে সেই বিভ্রান্তি কেবলই বড় হয়েছে। আমরা যতই অস্বীকার করার চেষ্টা করি না কেন, ধর্মের নাই বলে মনে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করি না কেন।
– সেভাবে বলে নাই বলে যে একেবারে বলেও নাই সেটাও ঠিক নয়। ৭২ সালের যেদিন সংসদে ধর্মনিরপেক্ষ ধারা পাশ হয় সেদিন ঢাকার রাস্তায় একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়েছিল, সে মিছিলের শ্লোগান ছিল “জয় বাংলা জয়হীন, লুংগি ছেড়ে ধুতি পিন”। সংগত কারনেই এই ধরনের ইস্যুতে যারা মাঠ কাঁপিয়ে তান্ডব ঘটায় তারা অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক দল, মোল্লা আলেম শায়খ মাশায়েখের দল (কেবল জামাত শিবির মুসলিম লীগই স্বাধীনতা বিরোধী ছিল-এটাও ধর্মপ্রিয় সেক্যুলার অসাম্প্রদায়িক লোকজনের আরেক উদ্দেশ্যপূর্ন প্রচারনা) সে সময় ’৭১ এর ভূমিকার কারনে ছিল কোনঠাসা, ফলে তারা তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই বলে তারা নীরবে মেনে নিয়েছিল সেটও ভুল। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্মের প্রয়োগ দেখা গেছে সবচেয়ে কম, কারন সেই একই। ধর্ম নিয়ে যারা বড় গলায় ডাক ছাড়ে তাদের চেহারা তখন এতই কদর্য হয়ে দেখা গেছিল যে তাদের আর ধর্মের দোহাই পাড়ার মত অবস্থান ছিল না। তার মানেও এই না যে তারা ধর্ম ভুলে গেছে, কিংবা ধর্মের ভূত জনমন থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। মাত্র ৪ বছরের মাথাতেই ধর্ম আবার তীব্রভাবে ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে।
জিয়া দালাল রাজাকারদের ফিরিয়ে অন্যায় করেছিল ঠিকই, সেটা সে করেছিল নিজ স্বার্থে, আওয়ামী লীগ ঠেকাতে তার এসব অপশক্তির দরকার ছিল। সে ধর্মের মায়ায় এসব করেনি। কিন্তু বিশুদ্ধ ধর্মীয় মূল্যবোধের কারনেই মানসিকতার পরিবর্তন দিনে দিনেই আরো ঘটবে। মেজর জলিল, কাদের সিদ্দিকী, হামিদউল্লাহ, এ সময়ের জেনারেল ইব্রাহিম সাহেবদের কথা আগেই বলেছি, ওনারা ব্যাতিক্রম নন। এই দল দিনে দিনেই বাড়বে। ইসলামী মূল্যবোধ জাগ্রত হবার সাথে সাথে ’৭১ সম্পর্কে ধারনাও বদলের হার বাড়বে। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী নেজামে ইসলামীর সাথে সংযুক্ত আল্লামা শাফিকে বহু মুক্তিযোদ্ধার কাছেও মনে হবে জাতির পরিত্রাতা। এই প্রবনতা জিয়া এরশাদের মত চুনোপুটির সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
@আদিল ভাই,
একটা চরম বাস্তব কথা বলেছেন।
লেখক মিজান রহমানকে ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। আপনি লিখেছেন:
এখানে কোথাও ভুল হচ্ছে আপনার। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানটির কপি আইসিএসএফ এর ই-লাইব্রেরীতে রয়েছে। এই লিন্ক থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। ১৯৭২ এর মূল সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বা এ জাতীয় কোন কিছুই ছিল না। বরং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো যেখানে নথিবদ্ধ, সেখানে অনুচ্ছেদ#১২ তে স্পষ্টভাবে বলা রয়েছে –
এখানে উপরে অনুচ্ছেদ ১২ এর ‘খ’ লক্ষ করুন। স্পষ্টভাবেই এটা যে কোন ধরণের রাষ্ট্রধর্মের ধারণার বিপরীতে। এ কারণেই পরবর্তীতে প্রথম সুযোগেই সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ-১২ বিলোপ করা হয়েছিল, যাতে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঢোকানো যায় সংবিধানে।
তবে আপনার দাবীমতে সেই ৭২ এর মূল সংবিধানের ‘ছোটো অক্ষরগুলো’ (সংবিধানের ছোট অক্ষরগুলো ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেন, তাহলে লক্ষ করবেন যে ওতে লেখা আছেঃ বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, যদিও সব ধর্মকেই দেওয়া হবে সমান অধিকার’) ঠিক কি তা যদি অনুচ্ছেদ এর রেফারেন্স দিয়ে বলতে পারেন তাহলে আমি আরেকবার পরীক্ষা করে দেখতে পারতাম। তবে এক নজরে, ১৯৭২ এর মূল সংবিধানের ব্যাপারে আপনার দাবীটির কোন ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছি না আপাতত।
ধন্যবাদ।
@রায়হান রশিদ,
অশেষ ধন্যবাদ আমার ‘ভুল’ ধরিয়ে দেয়ার জন্যে। এবং এই ভুলের জন্য আমি যে খুব একটা দুঃখিত তা’ও নই। আশ্বস্ত হলাম বরং যে আমার তথ্যতে খানিক গলদ ছিল। তবে আমার তথ্যসূত্রটি কিন্তু গুগল স্বয়ং।
Constitution of Bangladesh এর প্রথম সূত্রটিই তো তাই বলছে বলে মনে হল আমার। আপনি যদি দয়া করে ওদের বলে দেন যে খবরটা ঠিক নয়, তাহলে উপকার হয়। ভালো থাকুন, মীজান রহমান।
@মীজান রহমান,
মীজান ভাই, গুগলে Constitution of Bangladesh লিখে সার্চ দিলে যে লিঙ্ক আসে সেটা হল এটা –
http://www1.umn.edu/humanrts/research/bangladesh-constitution.pdf
আমার জানা মতে এটা ৭২ এর সংবিধান নয়। সেখানে ইসলাম ধর্মের কথা আছে সত্য, কিন্তু এটা পরবর্তী কালের সংযোজন। পতিত স্বৈরশাসক এরশাদ সাহেব আমাদের বারটা বাজিয়ে গিয়েছেন। ৭২ এর সংবিধানে বিসমিল্লা বা রাষ্ট্রধর্ম কোনটাই ছিল না। রায়হান উপরে যে লিঙ্ক দিয়েছেন সেটাই সঠিক লিঙ্ক।
অবশ্য আমারও ভুল হয় অনেক সময়ই ৭২ এর সঠিক সংবিধান খুঁজে পেতে। ইন্টারনেটে হাজারো বারোয়ারি জিনিসপত্রে ভরপুর। একটু সতর্ক না হলে ভুল দিকে চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। বিশেষত: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম যখন দিকনির্দেশনা চাইছে, তখন একটু অসতর্ক হলেই ভুল বার্তা পৌঁছে যাবে। আর কিছু মহল তো আছেই আগুনে ঘি ঢালতে। দেখবেন তারাই আপনার মন্তব্য পুঁজি করে বলছে – ‘মুক্তমনার মীজান সাহেব বলেছে… ৭২ এই রাষ্ট্র ধর্ম ছিল’। তাই আমাদের সবার উচিৎ এই সময়ে একটু সতর্ক হওয়া।
আপনার মত মানুষ যিনি আপনি একাডেমিয়ার সাথে আজীবন জড়িত, তাকে ইন্টারনেটের তথ্য নিয়ে আর বিষদ বলার বোধ হয় দরাকার নেই। আপনি বুঝবেন কতভাবে লোকজন জল ঘোলা করে। সেই ত্রিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যা নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে, এমনকি গণহত্যা নিয়েও ( প্রয়াত হাবিবুর রহমান প্রথম আলোতে এটাকে এক লেখায় ‘পিটুনি অভিযান’ বলেছিলেন, যা মৌলবাদীদের দারুণভাবে ইন্ধন যুগিয়েছিলো)। এগুলো করে কেবল সমস্যাই তৈরি করা হয়েছে। আমি শঙ্কিত সংখ্যালঘুদের নিয়ে আপনার এই চমৎকার লেখাটার মূল বিষয় বাদ দিয়ে এক দুইটা লাইন নিয়ে নরকগুলজার শুরু হবে। এটা আমি জানি, আপনারও কাঙ্ক্ষিত নয়।
ধন্যবাদ জানাচ্ছি রায়হান এবং আপনাকে চমৎকার আলোচনার জন্য।
@অভিজিৎ দা,
ধন্যবাদ ইন্টারনেটের লিন্কটার জন্য।
@ ড. মিজান রহমান,
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
এখানে সমস্যাটা আসলে গুগলের না। ইন্টারনেটে যে সংস্করণটি আছে, সেটি কোন বিকৃত সংস্কৃরণও মনে হচ্ছে না। যতদূর বুঝতে পারছি বিভ্রান্তিটির সূত্রপাত হয়েছে মূলত সংবিধানের পাশে ‘১৯৭২’ লেখা থাকায়। আসলে বাংলাদেশের সব সংবিধানের শিরোনামেই ‘১৯৭২’ কথাটা লেখা থাকে। এমনকি সাম্প্রতিকতম সংশোধনীসম্বলিত কোন সংবিধান যদি এ বছরও মুদ্রিত হয়, সেটাতেও তাই লেখা থাকবে। আইনের মূল টেক্সটের রেফারেন্স রীতিই আসলে এটা, সেখানে মূল সনটাই দেখায় – কারণ সেটা শিরোনামের অংশ। যে কারণে ১৯৭৩ সালের ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (্ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩’ এর সাম্প্রতিকতম ২০১৩ এর সর্বশেষ সংশোধনী সম্বলিত গত বছরের মুদ্রিত সংস্করণেও লক্ষ করবেন তারিখটা দেয়া থাকে ১৯৭৩ এরই। তবে ফুটনোটে, এবং সংশোধিত অংশে তারকা চিহ্ন দিয়ে সংশোধনীর কথাটা বলা থাকাটাই এখানে রীতি।
ধন্যবাদ।
@শ্রদ্ধেয় মীজান রহমান,
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আপনার লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে কেউ কেউ রায়হান রশীদ, অভিজিৎ রায় কিংবা আপনার মন্তব্যগুলো না পড়েই লেখাটিকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে দাবী করতে পারেন যে, দেশের সংবিধানে শুরু থেকেই ইসলামকে রাস্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে। এধরনের বিভ্রান্তি যাতে না হয় সেজন্য লেখাটির এ অংশটুকু পরিবর্তনের অনুরোধ জানাই। ধন্যবাদ।
@মনজুর মুরশেদ,
ধন্যবাদ আপনাকে ও রায়হান রশিদকে, ‘৭২ এর মূল সংবিধান সম্পর্কে গুগল থেকে উদ্ধৃত অংশগুলো নিয়ে মন্তব্য করার জন্যে। আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছিনা এমন একটি মৌলিক বিষয় নিয়ে গুগল এত কাঁচা কাজ করে কিভাবে। যাই হোক, আমি আপনার পরামর্শ নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এই বিতর্কিত বিষয়টি সম্পূর্ণ তুলে দিলেও আমার মূল বক্তব্যে খুব একটা পার্থক্য দাঁরায় না। এবং তাই করা হল। আমার সংস্কারকৃত সঙ্কলনে ওই অংশটি নেই। মীজান রহমান।
এই বক্তব্যে নিয়ে এখনও কোন রোম্যানটিককে গোস্বা না করতে দেখে বেশ অবাক লাগছে।
একবারো না থেমে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম পড়া।একটা মাস্টারপীস লেখা, যেটার প্রশংসা করে ( শব্দ চয়ন যথার্থ না হলে) এটাকে খাটো করার ইচ্ছা আমার নেই। শুধুই লেখক শ্রদ্ধেয় মিজান ভাই কে শুভেচ্ছা।
তবে একটি কথা আমি উদ্ধৃত না করে পারছি না।
ইসলামের ভবিষ্যত অন্ধকার।কারণ ইসলামের ideological infrastructure খুবই দুর্বল। ইসলাম নামক বিশ্বাসকে সযত্নে পুষে না রাখলে এটার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না. আরবের খেজুর , জান্নাত আর জাহান্নামের মতো শিশুসুলভ কল্পনা শুধু মানসিক রোগী তৈরী করে।
মীজান ভাই , এ সবই প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিবর্তনীয় লীলাখেলা , দেশের ১০০% ধর্ম নিরপেক্ষ জনগনের এতে কোন হাত নেই। আমাদের মত নাস্তিকেরা যদি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মোজেজা না বুঝি , তাহলে কে বুঝবে বলুন ?
@সংশপ্তক,
বিবর্তনের রীতিনীতি সম্বন্ধে আপনার মন্তব্যটি খুব ইন্টারেস্টিং মনে হল। হতে পারে আপনার কথাই ঠিক। তবুও প্রশ্ন থাকেঃ তাহলে ভারতের ১০ কোটি মুসলমানদের সংখ্যাটি একই অনুপাতে কমে যাচ্ছে না কেন? তাহলে নেদারল্যাণ্ডসের মত দেশে সংখ্যালঘু মুসলমানের সংখ্যা কমে যাওয়ার পরিবর্তে দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে কেন? শুনে অবাক হবেন হয়ত যে সেখানে শতকরা ১০ ভাগ মানুষই সংখ্যালঘু—–অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় ঠিক বিপরীত গতি। না ভাই, ১০০ % ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশীর হাত, পরোক্ষভাবে হলেও, ছিল বলেই এই ধীরগতি রক্তক্ষরণ ঘটতে পারছে। এটা বিবর্তন নয়, বিবর্তনের উল্টোগতি। পরিশেষে, ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে। মীজান রহমান।
@মীজান রহমান,
ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বর্বরতার কারণে দেশে সংখ্যালঘুদের ক্রমহ্রাসমানতার সাথে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই, সংশপ্তক তা ভাল করেই জানেন। উনি সার্কাজম করেছেন বলে আমার ধারণা।
@অভিজিৎ,
একদিকে অবশ্য মরনঘাতী ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বিবর্তনতত্ত্ব মেনেই কাজ করে। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বর্বরতার ভাইরাসের বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় সারভাইবাল ফিটনেস বাংলাদেশের জনপূঞ্জীতে অফুরন্ত। 🙂
@মীজান রহমান,
দেশে হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার বিষয়ে অস্বীকার করার যে সংস্কৃতি প্রচলিত আছে , তাকে ব্যঙ্গ করতেই আমাকে প্রাকৃতিক নির্বাচন তথা বিবর্তনবাদের অবতারণা করতে হয়েছে যা নিচে অভিজিৎ রায় সঠিকভাবেই পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশে যে ঝুঁকিটা নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশী চিন্তিত যে , এখানে হিন্দুরা ‘গনতন্ত্র’ নিয়ে নিষ্ফল পরীক্ষা নিরীক্ষার বলি হয়ে শেষে না জাদুঘরে স্থান পায়। অসভ্যতা এবং বর্বরতা যেখানে বৃহত্তর সংস্কৃতি সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে গনতন্ত্র নয় বরং অসভ্যতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষকে বলি দিয়ে কোন সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার বাসনাটাই ভুল কারণ মানুষের কল্যানেই সরকার ব্যবস্থা তৈরী করা হয়, মানুষকে গিনিপিগের মত ব্যবহার করার জন্য নয়।
@সংশপ্তক ,
ভাই চরম বলেছেন। সহমত। (Y)
@সংশপ্তক ভাই, ১০০% ধর্ম নিরপেক্ষ জনতা আসলে বাংলাদেশে কয়জন আছেন এই বিষয়টাই আমার জানা নেই। যদি থেকেও থাকেন তবে মনে হয় এতই নগন্য যে তাঁরা বর্তমানে বিশেষ কিছু পরিবর্তনের ক্ষমতা অর্জনের মত সংখ্যায় পৌঁছুতে পারেন নি।
আর হ্যাঁ এই পান্ডব বর্জিত দেশে সংখ্যা অবশ্যই একটা বড় ফ্যক্টর বলেই মনে হয়। তবে হ্যাঁ মন্দের ভাল হয়ত আছে, তবে ইনাদের এখন সময় এসেছে আরো শক্ত হাতে হাল ধরার। প্রতিদিন আর এই হিন্দু নির্যাতনের খবর পড়লে ভাল লাগে না। মুসলিম হিসাবে জন্ম নিয়ে অন্তত আতংকে বাস করছি না হিন্দুদের মত, এই যে সুবিধা ভোগ করছি, কেন জানি এতে নিজেকে বড্ড স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছে। 🙁
@অর্ফিউস,
দেখুন আবার হিন্দুদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য কোন ‘সামাজিক ব্যবসা’ এর মধ্যে ফাঁদা হয় কি না ! বাংলাদেশ তো আবার ‘সামাজিক ব্যবসার’ সূতিকাগার !
@সংশপ্তক ভাই, কথা খারাপ বলেন নাই, এই দেশে সবকিছুই সম্ভব।যে দেশে এখনও ৩০ পারা কোরান দিয়ে দুনিয়ার সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে বলে প্রবল ভাবে বিশ্বাস করা হয়, সেই দেশে এইসবই হবে।
:)) :hahahee: শয়তানেও এই দেশের কিছু শয়তানের কাছে নস্যি। বেটা শয়তান ভাল হয়ে গেছে কারন এইদেশের কিছু লোক তার ভাত মেরে দিসে মেলা আগেই।
@অর্ফিউস,
বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তি এবং শয়তান ছাড়া কোন ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই।
অসাধারন এই লেখাটি পড়লাম। আর মনে মনে আমার চারপাশের যে ধর্মান্ধের গন্ধ পেলাম তাতে শংকিত। বিবর্তের ধারা কি নিন্ম গতির দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে? অর্থাৎ যে প্রানীর থেকে ধারাবাহিকতায় বর্তমানের মানুষের পুর্ন বিকাশ হয়েছে, এখন তারই নিন্মমুখি ধারাবাহিকতায় আবার সেই বানরের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। পৃথিবীর সব প্রান্তে হয়তো এটি হচ্ছে না। তবে বংগীয় সমাজে যে যাত্রা দেখছি তাতে আগামী দশকে এ জাতির বিলুপ্তির চিত্রই মনের চোখে ভেসে উঠছে। এই অসাধারন লেখাটির জন্য মিজান স্যারকে অনেক ধন্যবাদ।
বাংলাদেশের বৰ্তমান পরিস্থিতি ও ভয়ংকর ভবিষ্যত সৰ্ম্পকে জানার জন্য এই একটা লেখাই যথেষ্ঠ। ৭৫ পরবৰ্তী সময় থেকে বাংলাদেশ ও এই দেশের মানুষকে এমনভাবে ইসলামীকরন করা হয়েছে যে, বৰ্তমান অবস্থা থেকে এই রাষ্ট্রকে “ৰ্ধমনিরপেক্ষ” রাষ্ট্রে পরিনত করতে অনেক সময় লাগবে। শাহবাগ আন্দোলন তরুন প্রজন্মকে ধৰ্মনিরপেক্ষতার সাথে পুনরায় পরিচিত করেছে, ধৰ্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠনে জনগনকে জাগ্রত করতে ঐ ধরনের আরো কিছু আন্দোলনের দরকার হবে। বাঙ্গালি জাতি হার না মানা বীরের জাতি, এই জাতির পাকি/আফগানীদের মত পরাজয় অসম্ভব। এই অসাধারন লেখাটির জন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জন গোষ্ঠির সত্যিকারের চেহারা, ধারাবাহিক ভাবে জাতির পতনের বিবরন মুখ্য হয়ে উঠেছে লেখাটিতে। এই লেখাটি পড়লে নিজের অবস্থান, কর্ম, বিকাশ দারুন স্বচ্ছতায় ফুটে উঠে। মিজান সাহেবের লেখাটি সমাজের, ধর্মের, মানবতার, জাতির, সংখ্যাগুরুর দর্পন। এই লেখাটি পড়লে নিজেদেরকে দেখা যায় স্পষ্ট।
লেখাটিতে এত বাস্তব কথা আছে যে পড়তে কষ্ট হচ্ছিল।
এত ভাল লেখা বহুদিন পড়ি নি। আমি নিজেই ১০ টা ফেসবুক গ্রুপে শেয়ার করলাম।
মিজান ভাই, আমার শ্রদ্ধা রইলো। এমন করে ভাববার মানুষ কোথায় এখন দেশটিতে? সে জন্যেই বোধ হয় অভিজিৎ দা হতাশ, হতাশ আমরা সবাই সব মুক্তমনারাই। আমরা যেমন করে মনুষত্ত্বকে বুঝি সে ভাবে কি ধর্ম কাউকে বুঝতে দেয়? ছোটবেলায় জানতাম ধর্ম হলো অন্তরের বিষয়। এখনতো দেখি সামাজিক রাজনৈতিক ব্যাবসার খাঁটি কাঁচামাল! সব ধরনের চোঙ্গাতেই এদের বিজ্ঞাপন থাকে! আর আমার মাতৃভূমির কথা বলছেন? বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষ? স্যেকুলারিজম থেকেও অধস্তন হলেও এর যোগ্য আমরা এখনো হইনি। দেশে বসে শুনতাম আমরা নাকি খুব সভ্য জাতি। বিদেশে এসে বুঝেছি আমরা কতোটা নীচ প্রকৃতির অসভ্য, স্বীকারে এতোটুকুও দ্বিধা নেই। শুনতাম বাংলাদেশের মানুষ ধর্মান্ধ নয়, ধর্মভীরু! এখন কেনো যেনো মনে হয় আমরা অনেকেই শুধু ধর্মান্ধ নই, নেশাগ্রস্থ ধর্মান্ধ!
পরিশেষে একটি বিষয়,
আমাদের ‘৭২ এর সংবিধানে কি রাষ্ট্রধর্মের উল্লেখ ছিলো? আমি নিশ্চিত নই, তবে যতটুকু জানি রাষ্ট্রধর্মের উল্লেখ বোধ হয় ছিলোনা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টি সংযোজিত হয়েছিলো স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের কপটতায়।
@কেশব কুমার অধিকারী,
প্রিয় কেশববাবু,
হ্যাঁ ছিল। তবে ছোট অক্ষরে—-অনেকটা পাদটিকার মত। তথ্যটি আমি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। আমার জানাশুনা এক আওয়ামি লীগের রাজনৈতিক কর্মী তা স্বীকারও করেছেন। কথাটি পড়ে আমি নিজেও ভীষণ বিস্মিত হয়েছিলাম। আর হ্যাঁ, ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে। মীজান রহমান।
@মীজান রহমান,
মীজান ভাই, পাদটিকার তথ্যটি সম্ভবতঃ সঠিক নয়, কিংবা আওয়ামি লীগের রাজনৈতিক কর্মীটিও সংবিধান পড়ে দেখেননি। এ প্রসঙ্গে নিচে রায়হান রশীদের মন্তব্যটি পড়ে দেখতে পারেন। উনি ৭২ এর সংবিধানের পিডিএফও দিয়েছেন তার মন্তব্যে।
একটু দেখবেন কি?
অভিজিৎ
আফগানিস্থান ও পাকিস্তানের মত অবস্থার তৈরি হতে বেশি সময় লাগবে না এদেশেও। আফগানিস্থান ও পাকিস্তানের মত সংখ্যাগুরুদের মধ্যেই সৃষ্টি হবে প্রতিদ্বন্দ্বী দল উপদল, শুরু হবে ধর্মীয় হানাহানি সেই দিন আর বেশী দেরী আছে বলে আমার মনে হয় না। আর এই সুযোগে পশ্চিমারাও তাদের ষোলকলা পুর্ন করবে। এখনে মানবতা উপেক্ষা করে ধর্মকে পুজি করে সবাই বেস্ত যার যার স্বার্থ নিয়ে দেশ বরাবরই উপেক্ষিত তাদের কাছে
ধন্যবাদ জানাচ্ছি মীজান ভাইকে তার যথারীতি চমৎকার লেখাটির জন্য। কিন্তু নিচের লাইনগুলোর জন্য লজ্জিতই বোধ করছি –
না মীজান ভাই, আমি উঁচুমানের লেখকও না, বুদ্ধিজিবীও না, ইনফ্যাক্ট বুদ্ধিজীবী শব্দটার প্রতি আমার এক ধরণের এলার্জি আছে, তাই বুদ্ধিজীবী জাতীয় কিছু না হলেই মনে হয় আমার জন্য ভাল। তারচেয়ে যতদিন ধর্মান্ধের দল আর অপশক্তি আমাকে গালাগালি করে আমার চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করবে, ততদিন জানব আমি ঠিক পথেই আছি। তারা গালি বন্ধ করে দিলে বুঝব কোথাও গলদ হচ্ছে আমার, আসলেই তখন কোন কেউকেটা বুদ্ধিজীবী হয়ে যাব মনে হয়। 🙂
তবে আমার অতি সাধারণ মানের একটা লেখা যে আপনাকে ভাবিয়েছে, এবং একটা পূর্নাঙ্গ লেখা লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে সেটা দেখেই আমি আনন্দিত বোধ করছি। মুক্তমনায় আরো নিয়মিত লেখার অনুরোধ করছি।
@অভিজিৎ, দাদা আপনি আমাদের মাঝে একজন আপনার মতো অভিজিৎ রায় হয়েই থকেন এর বেশী কিছু চাই না। অনেক শুভ কাননা আপনার জন্য