‘সত্যের সন্ধান” বইয়ের নাম যুক্তিবাদ দিয়েও আরজ আলো মাতুব্বর তাঁর হাজতবাস ঠেকাতে পারেননি। তাই দ্বিতীয় বইয়ের নাম দিয়েছিলেন “অনুমান”, গ্রন্থটি সম্পর্কে নিজেই বলেছিলেন, “ তাই এবারে ‘সত্যের সন্ধান” না করে মিথ্যার সন্ধান করতে চেষ্টা করছি এবং “যুক্তিবাদ” এর আশ্রয় না নিয়ে আমি আশ্রয় নিচ্ছি “অনুমান”-এর। তাই এ পুস্তিকাখানার নামকরণ করা হলো– মিথ্যার সন্ধানে “অনুমান।”এতে যুক্তিবাদের কঠিন দেয়াল নেই, আছে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ।” তিনি স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ দিয়ে প্রতিকী চরিত্র সৃষ্টি করে নারীর অধঃস্তন অসহায় অবস্থানকে উপস্থাপন করেছেন।

“অনুমান” গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটির নাম ‘রাবণের প্রতিভা।’ রাবণ আর সীতার কাহিনীর মোড়কে রামকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বসবাসকারী গতানুগতিক একজন পুরুষ ও সীতাকে পুরুতান্ত্রিক সমাজের শিকার একজন অসহায় নারী হিসেবে এঁকেছেন।

কোন দম্পতির সন্তান না হলে সমাজ স্ত্রীকেই প্রথমে দায়ী করে।বাঁজা নামের অপবাদ নারীর প্রতিই সাধারণত ছোঁড়া হয়। আমাদের সমাজে নারীকে বন্ধ্যা বানিয়ে বহু বিবাহ প্রথা বহাল তবিয়তে বিরাজমান। কিন্তু রাম আর সীতার দাম্পত্য জীবনে বায়ান্ন বছর (পৌরাণিক কাহিনীর বছর)নিঃসন্তান থাকার জন্য আরজ আলী সীতাকে নয়, রামকে দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সীতাদেবী বন্ধ্যা ছিলেন না এবং উক্ত তেপান্ন বছরের মধ্যে বনবাসের দশ মাস(অশোককাননে রাবণের হাতে সীতা বন্দিনি ছিলেন ১০ মাস)ছাড়া বায়ান্ন বছর দু’মাস সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের অঙ্কশায়িনী। তথাপি এ দীর্ঘকাল রতিবিরতি রামচন্দ্রের বীর্যহীনতারই পরিচয়,নয় কি?”

এটাকে আমরা তাঁর গ্রামের বা পরিচিত বলয়ের কোন প্রত্যক্ষ ঘটনার প্রতিবাদের জন্য লেখা বলে গণ্য করতেই পারি। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন যে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ দিয়ে তাঁর “অনুমান” বইটি লিখেছেন।
আর দাম্পত্য জীবনের বায়ান্ন বছর অর্থাৎ দীর্ঘ বছর কাটিয়ে দেয়ার পর রাম সীতার সন্তান হওয়াকে নিঃসন্তান স্বামীদের বহু বিবাহ না করে ধৈর্য ধরার ইঙ্গিত করেছেন যা নারীকে সতীনের ঘর করা থেকে রক্ষা করবে। কারণ প্রবাদ রয়েছে যে নারী স্বামীকে যমকে দিতে রাজি থাকলেও পরকে অর্থাৎ সতীনকে দিতে রাজি হয় না।
নারীর এ রাজি হওয়া আর না হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে রয়েছে নারীর মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ। নারীর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া ও শ্রদ্ধা করা তো নারী আন্দোলনের দাবি। আরজ আলী মাতুব্বরের এ দাবির প্রতি সমর্থন ছিল বলেই সীতা ও রামের প্রতিকী কাহিনী বলে নারীকে সতীনের সাথে বসবাসের অসহায়তাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন।

নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার জন্য সময় লাগে না। যখন তখন, যেভাবে মন চায় ইচ্ছে মত গুজব রটিয়ে দিলেই হয়। রাম হাস্যকরভাবে প্রজা মনোরঞ্জন বা প্রজা বিদ্রোহের অজুহাতে বনবাস থেকে ফেরার ২৭ বছর পর সীতাকে ত্যাগ করে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “ … স্বতই মনে প্রশ্নের উদয় হয় যে, মরার দু’যুগের পরে কান্না কেন? বনবাসান্তে রামচন্দ্র স্ববাসে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর বনবাসের বিবরণ তথা লঙ্কাকান্ড দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিলো। তাঁর দেশে ফেরার সংগে সংগেই এবং সীতা কলঙ্কের কানাকানিও চলছিলো দেশময় তখন থেকেই। আর গুজবের ভিত্তিতে সীতাদেবীকে নির্বাসিত করতে হলে তা করা তখনই দরকার ছিলো সঙ্গত। দীর্ঘ ২৭ বছর পর কেন?”
তাঁর প্রশ্ন থেকে আমাদের মনে উত্তর উদয় হয় যে নারীকে অপবাদ দিতে সাক্ষী লাগে না, প্রমাণ লাগে না, সময় লাগে না। স্বামী তথা পুরুষ নিজের ইচ্ছে ও সুবিধামত নারীকে যখন ত্যাগ করতে চাইবে তখনই উপযুক্ত সময়। চরিত্রহীন আখ্যা দিয়ে তা করার জন্য জনমত, সমাজ, রাষ্ট্র ও আইন পুরুষের পক্ষেই কাজ করে। তথাকথিত চরিত্রহীন নারী পরিত্যাজ্য ও পরিত্যক্ত।

আর আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্ন করে অচলায়তন সমাজকে নিংরে দেখানোর কৌশল প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন “……..আরজ আলী মাতুব্বর প্রথম ও নির্মম যে অন্ধকার সুচিরকাল ধরে স্থায়ী হয়ে আছে এই বাংলাদেশে, তার কথাই বলেছেন তাঁর বইতে। বর্ণনা করে নয় প্রশ্ন করে।’’
পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রের আড়ালে আরজ আলী মাতুব্বর নারীর অসহায় অবস্থার জন্য দায়ী সমাজে বিরাজমান চরিত্র চিত্রণ করেছেন। প্রজা মনোরঞ্জন জন্য, নিজের সিংহাসন নিষ্কলুষ রাখার জন্য নিষ্কলঙ্ক পাঁচ মাসের অন্তঃসত্বা স্ত্রী সীতাকে রাম বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষায়, “রামচন্দ্র সীতাদেবীকে গৃহত্যাগী করেছিলেন শুধু জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য,স্বয়ং তাঁকে নাকি “নিষ্কলঙ্কা” বলেই জানতেন।এইরূপ পরের কথায় নিষ্ককলঙ্কা স্ত্রী ত্যাগ করার নজির জগতে আছে কি?”

ছিল। আছে। আর না থাকার জন্য নারী আন্দোলন। সমাজে এমন পুরুষ চরিত্রের ছড়াছড়ি যারা পরের কথায় ঘরের বউকে ত্যাগ করে, তালাক দেয়, শ্বশুর বাড়ির নামে বনবাসে পাঠায়। তথাকথিত লোক লজ্জার অপমানের আশংকায় নিজের স্ত্রীকে অপমান করে। নারী তার অধঃস্তন অবস্থা ও অবস্থানের জন্য তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। সীতার প্রতীকে তিনি বাংলাদেশের নারীর জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন।

তিনি প্রসঙ্গক্রমে গ্রেট বৃটেনের অষ্টম এডোয়ার্ড এর প্রেমের মহান উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, “পার্লামেন্ট এডোয়ার্ডকে জানালো যে হয় মিসেস সিম্পসনকে ত্যাগ করতে হবে, নচেৎ তাঁকে ত্যাগ করতে হবে সিংহাসন।এতে এডোয়ার্ড সিংহাসন ত্যাগ করলান, কিন্তু প্রেয়সীকে ত্যাগ করলেন না। শুধু তা-ই নয়, তাঁর মেঝ ভাই ডিউক- অব-ইয়র্ককে সিংহাসন দিয়ে তিনি সস্ত্রীক রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন বিদেশে। রামচন্দ্রেরও তো মেঝ ভাই ছিলো।”

আরজ আলী মাতুব্বর নিজে নারী প্রেমের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন এবং নারীর প্রতি প্রখর মর্যাদাবোধ ধারণ করতেন বলেই রামকে সীতার জন্য রাজ্য ত্যাগের পরামর্শ দিতে কুন্ঠিত নন। অর্থাৎ স্ত্রীর জন্য স্বামীকে ত্যাগী হবার মন্ত্র ছড়িয়েছেন।

সমাজ সব সময়ই নারীর তথাকথিত সতীত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। নারী সতী না হলে হয় পতিতা। কিন্তু পুরুষ পতিত হয় না কোন কালেই। এ গতানুগতিক বিষয়টি বহুল আলোচিত। ‘রাবণের প্রতিভা’ প্রবন্ধে আরজ আলী মাতুব্বর সীতার সতীত্বের বিষয়টি উহ্য রেখে, তার দেবত্বের মহিমা দূরে রেখে তাকে সমাজের বিভিন্ন চরিত্রে বিভিন্নরুপে বসিয়েছেন। রামায়ণের রাম সীতা আর রাবণের কাহিনীর আভরণে তাঁর আশেপাশের নারীর জীবন কথা তুলে এনেছেন। ‘সত্যের সন্ধান” বইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে যে এটা তাঁর কৌশলী অবস্থান তা তিনি বইয়ের ভূমিকায় নিজেই প্রকাশ করেছিলেন।

আরজ আলী মাতুব্বর প্রথমে রামায়ণের কাহিনী ঠিক রেখে পরে “— ঘটনাগুলো হয়তো এরূপও ঘটে থাকতে পারে। যথা—’’ বলে তিনি প্রতিকী সীতাকে রাবণের সাথে স্বেচ্ছায় শুইয়েছেন, অন্তঃসত্ত্বা বানিয়েছেন, আবার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণও করিয়েছেন।
হিন্দু সমাজে সাধারণত মেয়েদের নাম সীতা রাখা হয় না। প্রচলিত ধারণা সীতা নাম রাখলে মেয়েটির জীবন সীতার মতই দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে থাকবে। কদাচিৎ কারও নাম সীতা রাখা হলে দেখা যায় ওই মেয়েটির নবজাতক অবস্থায় তার মা মারা গেছে বা বাবা মারা গেছে, অথবা কোন পারিবারিক বিপর্যয় ঘটেছে। হয়ত এ ধারণাটিকে কাজে লাগিয়ে আরজ আলী মাতব্বর পৌরাণিক কাহিনী থেকে সীতা নামটিই বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশের নারীর দুঃখ গাঁথা তুলে ধরার জন্য।বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নারী নির্যাতনের যে চিত্র তা সীতা নামের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন।

দুঃখিনী সীতাদের সংসারে কিল চড় খাওয়া নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। তিনি লিখেছেন,‘সীতাদেবীকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌঁছলে লঙ্কাকান্ড প্রকাশ হওয়ায় সেখানে তখন সীতাকলঙ্কের ঝড় বইছিলো নিশ্চয়ই। হয়তো সীতার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য প্রথমত জেরা-জবানবন্দি, কটূক্তি, ধমকানি-শাসানি ও পরে মারপিট ইত্যাদি শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো তাঁর প্রতি। কিন্তু তিনি নীরবে সহ্য করেছিলেন সেসব নির্যাতন, ফাঁস করেননি কভূ আসল কথা। আর সেটাই হচ্ছে সীতার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া”।
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সর্বংসহা নারী তো এভাবেই বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না অবস্থায় মারপিট খেয়েও অবস্থান করছে। আর জেরা-জবানবন্দি, কটূক্তি, ধমকানি-শাসানি ও মারপিটসহ শারীরিক নির্যাতন পৃথিবীব্যপীই নারীর জীবনের অপরিহার্য লিখন। এজন্যই তো ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। । আর এ অভিজ্ঞতা থেকেই তো নারী আন্দোলনের স্লোগান—‘কিসের ঘর কিসের বর/ঘর যদি হয় মারধোর।’’

আরজ আলী মাতুব্বর বাস্তবতার নিরীখে দেবী সীতাকে মাটিতে এনে তথাকথিত অবতার রামকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যোগ্য উত্তরসূরী করে রাম ও সীতার সম্পর্ককে ও সংসারকে কিসের বর ও মারধোরের ঘর হিসেবে চিত্রিত করেছেন।

রাম আর সীতার পুরো কাহিনিটিই রামায়ণ থেকে ভিন্নভাবে আরজ আলী মাতুব্বর উপস্থাপন করেছেন, যা বাংলাদেশের নারীর দুঃখে ভরা জীবন যাপনের সাথে একাত্ম। বাংলাদেশে সীতাদের স্বামীরা সন্তানদের রেখে স্ত্রীদের তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দেবার ঘটনা অসংখ্য। আর তালাক প্রাপ্ত নিরুপায় নারী আত্মহত্যা ছাড়া বিকল্প উপায় খুঁজে পায় না। আরজ আলী মাতুব্বরের কাহিনীতে এরই প্রতিধ্বনি, “কুশ-লবকে গ্রহণ করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। সীতাদেবী হয়ত আশা করেছিলেন যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্ন-সহ রাজপুরীতে এসে এবার সমাদর পাবেন।কিন্তু তা তিনি পান নি,বিকল্পে পেয়েছিলেন যতো অনাদর-অবজ্ঞা। তাই তিনি ক্ষোভে দুঃখে হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। নারী হত্যার অপবাদ লুকানোর উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাবার ভয়ে শ্মশান দাহ করা হয়নি সীতার শবদেহটি, হয়তো লুকিয়ে প্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে,পুরীর মধ্যেই। আর তা-ই প্রচারিত হয়েছে ‘স্বেচ্ছায় সীতাদেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ’ বলে।”

নারী হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে অহরহ। পত্রিকার পাতাই এর সাক্ষী। আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় তা ঘা দিয়েছিল বলেই প্রতিকারের আশায় রাম সীতার কাহিনীর অবতারণা। এ অবতারণা আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় নারী মুক্তি আন্দোলনের সাক্ষ্য বহন করে।
(চলবে)