আলবার্ট এলিস ১৯১৩ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের পিট্সবার্গে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহন করেন এবং মারা যান, খুব বেশী আগে নয়, ২০০৭ সালের ২৪শে জুলাই । ১৯৫৫ সালে মনোবিশ্লেষনের জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন একটি পদ্ধতি Rational Emotive Behavior Therapy (REBT) উদ্ভাবন করেন। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম,এ এবং পি,এইচ,ডি ডিগ্রী লাভ করেন। নিউইয়র্ক ভিত্তিক আলবার্ট এলিস ইন্সটিটিউটের তিনি প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট এমিরেটাস ছিলেন। তাকে ধরা হয় সাইকোথেরাপীর বিপ্লবাত্বক উন্নয়নের পথিকৃত এবং কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপীর প্রতিষ্ঠাতা। তার সমসাময়িক একটি পেশা ভিত্তিক জরিপে দেখা যায়, তিনি তার জীবদ্দশায় কার্ল রজার্সের পরে ইতিহাসের দ্বিতীয় প্রসিদ্ধ সাইকোথেরাপিষ্ট।

বিংশ শতাব্দির ব্যাবহারিক মনোবিজ্ঞানের জগতে একটা বড় আবিস্কার এই আর,ই,বি,টি- একথা একবাক্যে বলা যায়। এই আর, ই,বি,টি কি জিনিস এবং কেনই বা এটা নিয়ে পড়লাম, সেটাই এখন বলতে চাই। আমার নিজের কিছু মানষিক সমস্যার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আলবার্ট এলিস এবং তার ত্বত্তের সন্ধান মিললো। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম এই থেরাপিটি শুধু অসুস্থ লোকের জন্যই নয়, এই ক্ষয়ে যওয়া, ভারসাম্যহীন সমাজের মধ্যে অবস্থানরত যে কোন মানুষের জন্য এর ত্বাত্তিক বিষয়বস্তু সমানভাবে প্রযোজ্য এবং উপকারি। এবার তার আর,ই,বি,টি কি বলে সেটা দেখতে চাই সংক্ষেপে। এই থেরাপিটি মূলত মানবীয় বুদ্ধিমত্তা, সক্রিয় নির্দেশ, দার্শনিক যুক্তি-তর্ক ও বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষন, পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত, যা মানুষকে আরও পরিপূর্ন জীবন যাপন করতে এবং আরও সুখী হতে সহায়তা করে। এশিয়া, গ্রীক, রোমান ও আধুনিক দার্শনিকদের মতাদর্শ ও জীবন পদ্ধতিতে অনুপ্রানিত ও উতসাহিত হয়ে এলিস আর,ই,বি,টি উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হন । এটা বলা যায়, আর,ই,বি,টি একটি দ্রুত এবং আধুনিক কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি। এলিস এটাকে প্রথম প্রয়োগ করেন এবং দিন দিন এর শ্রীবৃদ্ধি জারি আছে।

প্রতিদিন বহু রকম ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আমাদের জীবনে। এদের মধ্যে কিছু ইতিবাচক আর কিছু নেতিবাচক। ইতিবাচক ঘটনা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যাথা নেই, এগুলো শক্তি ও আনন্দের উতস। নেতিবাচক ঘটনাগুলো নিয়ে যত না সংকট। এই নেতিবাচক সংকটগুলোকে এলিস নাম দিলেন Adversity (A). সংকট গুলো হতে পারে কোন চিন্তা বা কাজ, অন্তর জগতের বা বহির্জগতের, হতে পারে অতীত, বর্তমান বা অনাগত ভবিষ্যতের। সংকট ঘটে যাবার পর আমরা তাদের মূল্যায়ন করতে বসলাম। এই মূল্যায়ন প্রধানত: ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, শব্দমালা এবং বাক্তিসত্ত্বা, গুনাবলী ও ক্ষমতা দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত। মূল্যায়নের পর অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌছা গেল, যা অধিকাংশ ক্ষত্রে ভুল । এই ভুল সিদ্ধান্তকে এলিস নাম দিলেন Belief (B)। বিশ্বাস পাকাপোক্ত হওয়ার পর ব্যক্তির দ্বারা যে সমস্ত কর্মকান্ড সংঘটিত হয় সেগুলি নেতিবাচক (Irrational) বা অযৌক্তিক। এই অস্বাভাবিক কর্মকান্ডই তাকে সাইকোটিকে পরিনত করে। ভুল সিদ্ধান্তের এই বাহ্যিক ফলাফলকে এলিস নাম দিলেন Consequences (C)। এটাই তার যুগান্তকারি আবিস্কার REBT -এর ABC-মডেল, যে মডেলের উপর ভিত্তি করে থেরাপি নকসা বা ডিজাইন তৈরী করা হয়। এক্ষত্রে থেরাপিটা অনেকটা ক্লিনিকাল ও কারিগরী বিষয় সমৃদ্ধ, যা এই পরিসরে আলোচনার সুযোগ কম।

কেন মানুষ সুখী হতে পারে না? কেন সে তার সমস্ত শক্তির সর্বোচ্চ ব্যাবহার নিশ্চিত করতে পারে না? কেন সে অসামাজিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়? এর কোন সমাধান আছে কি? এর সঠিক উত্তর হলো, মানুষ অতিসংবেদী বা নিউরোটিক, অসামাজিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়, কারণ এগুলো তার জীনে আছে। অসামাজিক উপাদান সমূহ আমাদের জীনে প্রগ্রাম করা থাকে, কারও কম আবার কারও বেশী। আবার কারও কারও অবস্থা এতটা প্রান্তিক এবং এতটা অসামাজিক যে, তাদের আর সাহায্য করার সুযোগ থাকে না। এদের মধ্যে সিংহভাগ মানুষকে এমন এক শ্রেনীতে ফেলান যায় যারা অনবরত চিন্তা ও কাজ করে অসামাজিকভাবে, কিন্তু তারা তাদের অন্তর্দৃষ্টি ও ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে এই অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সক্ষম।

অসামাজিক বিশ্বাস বা ধারনা শৈশবের কোন আঘাত, পীড়ন কোন কিছুর উপর নির্ভর করে না, এগুলি আসলে কোন সমস্যা নয়। আসলে এই অসামাজিক আবেগীয় বিচ্যুতি বা ত্রুটির মূল কারন হচ্ছে, তিনটা ভ্রান্ত ধারনা বা বিশ্বাস।
এক: মানুষ অবশ্যই আমার সাথে সঠিক আচারন করবে, এর ব্যাতিক্রম আমার জন্য অসহ্য।
দুই: জীবনের কাছে আমি সুবিচার চাই, এর অন্যথা আমার কাম্য নয়।
তিন: দুর্ভোগ ও সমস্যামূক্ত জীবনই আমার কাম্য, এর ব্যাতিক্রম আমার উপর অবিচার।
এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা ভাবনাগুলোকে এলিসের ‘মাস্টারবেশন’ বা ‘পাণিমেহন’ বলে নামকরন করা হয়। এই জগত আমাদের জীবনে কি দুর্ভোগ নিয়ে এলো, তার জন্যে আমাদের মানষিক বিপর্যয় ঘটে না বরং ঘটনাগুলোকে আমরা কিভাবে নিলাম, সেই সমস্ত ভিত্তিহীন ধারনা বা বিশ্বাস গুলোই আমাদের মানষিক বিপর্যয় ডেকে আনে, আমাদের অসামাজিক কাজ করতে প্রেরনা যোগায়। এটার কোন যৌক্তিক কারন নেই যে, জীবন সব সময় আমার প্রতি সদয় হবে, মসৃনভাবে চলবে, লোকেরা আমার সাথে সুন্দর-সাবলিল ব্যাবহার করবে। ধরা যাক এক লোক কোন এক সুন্দরীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলো। এটা অবশ্যই একটা বিরক্তকর বিষয় কিন্তু এতটা খারাপ নয়, যাতে মনে করতে হবে যে, এই নারী ছাড়া জীবনের কোন গতি নেই, মূল্য নেই। এটা একটা মিথ্যা ধারনা এবং এই ধরনাই তাকে অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করবে। সে নারীবিদ্যেষী হবে অথবা তাদের পরিত্যাগ করে চলবে ।

আরও কয়েকটা উদাহরন দেয়া যাক। ধরুন এক লোক তার প্রিয় চাকরীটা হারালো। তারপর থেকে তার মনে হতে লাগলো এবং দৃড় বিশ্বাস জন্মালো- একটা ভাল চাকরি ছাড়া জীবনটাই বৃথা, বেচে থাকা অপমানকর। এই ধরনের ভুল বিশ্বাস তাকে যে পীড়ন দিবে, তার ফলে সে আরও বেশী অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতে পারে, আত্মহত্যা করা, চাকুরির সাক্ষাতকার বর্জন, এমন কি নতুন চাকুরি খোজা থেকে বিরত হয়ে যেতে পারে।

এক অল্পবয়সী মেয়ের মনে হলো, সে কুতসিত হয়ে যাচ্ছে, শরীরে অস্বাভাবিক হারে মেদ জমা হচ্ছে। এই অবস্থা অসহ্য এবং এটা বয়ে নিয়ে বেড়ানো তার জন্য দুর্বিসহ। তাকে সুন্দরী এবং স্লিম হতেই হবে। এই ভুল এবং পীড়নকারি বিশ্বাস থেকে তার অসামাজিক কাজের সুত্রপাত। সে এমনভাবে খাওয়া দওয়া নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করলো, যার ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টিটুকুও শরীর আর পেল না। ফলে এনারেক্সিয়াতে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হলো। কিন্ত এই কুতসিত হয়ে যাওয়াটা বিরক্তিকর হলেও কোনভাবে ভয়ংকর ছিল না।

লিখতে আমার ভাললাগে তাই লিখে যাই। অন্যেরা সেটা পড়ে আমার প্রশংসা করবে, এটাতে আমার কোন প্রয়োজন নেই। যদি কখনো সেটা ঘটে, তবে ভাল, না ঘটলা তা বিরক্তিকর নয়। কোন অবস্থাতেই আমি তাতে লেখা থেকে বিরত হবো না। আবার এর উল্টোটাও হতে পারে । কেউ আমার লেখা পড়ে সমালোচনায় মূখরও হতে পারে। আমি কখনই সেটাকে ভয়ংকর বিষয় বলে ধরে নেব না। আমার লেখা পড়ে পাঠকদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিকৃয়া হওয়াই স্বাভাবিক। সবার প্রতিকৃয়া একই রকম হোক, সবাই আমার প্রশংসা করুক এগুলো ঘটার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। এই ধরনের চিন্তা-প্যটার্ন আমাকে আরও সুন্দর ও সামাজিকভাবে বিশ্বাস ও ধারনা নিতে শিখিয়েছে।

সংক্ষিপ্ত এই আলোচনার পর মূল বক্তব্য হলো, জীবনে যা কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটে চলেছে তার মধ্যে যেগুলোকে পার বদলে দাও, যেগুলোকে পার না তাদের গ্রহন করো বা মেনে নাও।

যিশুখৃষ্টের একটা কথা মনে পড়ে গেল- judge ye not, কোনকিছু বিচার করতে যেও না। সম্ভবত: তিনি কথাটা বলেছিলেন কারও জীবনে ঘটে যাওয়া কোন সংকটময় ঘটনার প্রসংগে। জীবন রূপে-রসে-গন্ধে বিপুল ঐশ্বর্যময় এবং তার ব্যাপ্তিও অপরিসীম। এই জীবনের জন্যে মহাবিশ্বে অগনিত ইতিবাচক উপাদান রয়েছে, যাদের অর্থ দিয়ে কেনার প্রয়োজন নেই, ইচ্ছে করলেই সেগুলো পাওয়া যায়। অনেক সময় নিয়তি ও ইচ্ছার দ্বন্দ্ব, জীবন ও মৃত্যুর দ্বন্দ্ব, সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি ধরে নাড়া দেয়, করে ফেলে দিশাহারা বিভ্রান্ত। তার জন্যে আমাদের অন্তরে এমন এক বিশ্বাসের উর্বর ভূমির স্থিতি প্রয়োজন, যে ভূমির সকল বৈপরিত্তের গ্রহন সক্ষমতা আছে।

নীচের স্বরচিত কবিতাটি একটা বোনাস। জীবনের ক্রীড়াভূমে বৈপরিত্তের সহাবস্থানের বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে কবিতাটিতে। মূল নিবন্ধের সাথে এর কোন সামঞ্জস্য থাকলেও থাকতে পারে।

স্থিতি বিশ্বাসেরই

উন্মিলিত চক্ষু মোর, আন্দলিত হিয়া !
অন্তরেতে অন্তহীনা, চিন্তা সহজীয়া ।
মর্ম হতে উতসরিয়া কর্মচিন্তা ধায়,
দেশে কালে, কালান্তরে অরুদ্ধ দুর্জয় ।

আলোকনৃত্য, মর্মর ধ্বনী পশিল মম এ চিত্তে,
বর্নিতে নারি কেবা কোথা হ’তে ভরিল বিভব বিত্তে।
স্বাদে, আঘ্রানে , মৃদু পরশনে সিঞ্চিত স্নায়ু তথ্যে।
জানিবার ভারে ন্যুজ্ব স্নায়ুকলা, ভরেছে পরম সত্যে।

দুর্বার, দুর্জ্ঞেয় সকরুন নিয়তি,
নিঃসীম, অবারিত জীবনের জয়তি।
মৃত্যুর কুহেলিকা নিঠুরিয়া, নির্মম-
নির্দয় খড়গে ধারাপাত অবিরাম ।
করি সত্যের অভিনয়, মিথ্যায়ও বসবাস।
অক্ষত থাকে বেঁচে থাকে অন্তরে বিশ্বাস।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

ইন্টারনেট
উইকিপেডিয়া