ছোটবেলা থেকেই সাস্টে পড়ার আগ্রহ। কারণ আমার এক মামাতো ভাই। বেচারা সাস্টে পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে পাশ করে বেরিয়ে সাস্টেই শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে সে একবার পি. এইচ ডি করে পুনরায় করার পায়তারা করছে। এছাড়া আমার ভাইবোন আত্মীয় স্বজনের অনেকেই সাস্টে পড়েছে। আমাদের পরিবারে সাস্টে ভর্তি হওয়াটা একটা মানদণ্ডে রূপ নিয়েছে। খুব সম্ভব অক্টোবরের(কিংবা নভেম্বরের) ৬ তারিখে আমাদের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তার আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা হয়। আমি ঢাকার পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে সাস্টের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। কারণ আমি সাস্টেই পড়তে চেয়েছিলাম। কলেজে পড়ার সময় অনেক রসায়ন শিক্ষকের পড়ানোর পদ্ধতির সাথে পরিচিত ছিলাম। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় কি জানেন- এখানকার কলেজের প্রায় সকল রসায়নের ফুল টাইম অধ্যাপকরাই স্ব স্ব শিটের বাইরে পাঠ্যপুস্তক খুব একটা পড়ান না। অথচ সাস্টে ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্ন হয় পাঠ্যপুস্তক থেকে এবং তা যথেষ্টই গঠনমূলক। প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে একটা ছাত্র ভালমত রসায়ন পড়ার সুযোগ পায় না, সে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবে?
সাস্টে যখন প্রথম ভর্তি হওয়ার পরের কিছুদিন এ সংগঠন-ও সংগঠন করে কেটে যায়। বেশিরভাগই কালচারাল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি সংগঠনের বাইরেও কিছু সংগঠন আছে যাদের নাম অমুক জেলা সংগঠন, তমুক জেলা সংগঠন। যারা সাস্টে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসবে তাদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ব্যানার টানানো ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটা বৈশ্বিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের মধ্যে শুধুমাত্র জন্মপরিচয়ে বিভক্ত হয়ে থাকার মানে কি? অনেকেই বলবেন নিজের এলাকার ছেলেমেয়েদের থাকা খাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করা ব্লা ব্লা ব্লা। একটা জুনিয়র যখন আমার কাছে এসে বলে ভাই মেস পাই নাই, থাকার সমস্যা… তখন হাতে মেসের সিট থাকা স্বত্তেও আমি কি তাকে বলব তুমি অমুক জেলার না স্যরি? কিছুদিন পর ভার্সিটির কিছু ফ্রেন্ড দেখলাম সিলেটি সাস্টিয়ান নামক একটা গ্রুপই খুলে ফেলল। আমাকেও ঢুকানো হল সেই গ্রুপে। এখন আমার ভার্সিটির সবচেয়ে কাছের বন্ধু নাফি। তারসাথে বন্ধুত্বের আগে কি আমার তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল তুমি কি সিলেটি সাস্টিয়ানে আছো? নিজেদের হীনমন্যতা কেন এভাবে প্রকাশ করছি আমরা? একেবারে প্রথম সেমিস্টারেই সোস্যালজিতে পড়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন স্থাপিত হয়েছে বা কি উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। সেখান থেকে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করছি- ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের পর সমাজের বিভিন্ন শাখায় দক্ষ পেশাজীবির চাহিদা দেখা গেল এবং একই সাথে দেখা দিল কর্ম সংকট। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেটের দাম বেড়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেটধারীদের গুরুত্ব দেয়া হত দুটো কারণে-
১. সে কোনো একটা বিষয়ে দক্ষ।
২. বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেটের দাম হঠাৎ গজিয়ে উঠলে মূলত ১৮-২২ এই বয়স শ্রেণীর যুব সম্প্রদায় কর্মক্ষেত্র থেকে সরে যাবে এবং কর্মহীনতার আপাত একটা সমাধান হবে।
তৃতীয় আরেকটা কারণ হচ্ছে উপযুক্ত জীবনসঙ্গি খুঁজে পাওয়া। একারণে আজকাল একই পেশা বা কাছাকাছি পেশার দম্পতি বেশি দেখা যায়। সে যাই হোক এ বিষয় নিয়ে লেখার মূল কারণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য যেখানে নিজেদের প্রস্তুত করে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সেখানে আমরা পড়ে আছি কে কোন জেলায় অবস্থিত কে আবাদি কে সিলেটি এইসবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কি এতে পূর্ণ করা হচ্ছে? আর বৈশ্বিক চিন্তারই বা কোথায় বিকাশ ঘটছে?
সম্প্রতি গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে চারিদিকে অনেক তোলপাড় চলছে। আন্দোলনের শুরুতে প্রথমে দাবী ছিল গুচ্ছ পদ্ধতি বাতিল এবং পরবর্তীতে এখন তা পরিণত হয়েছে ৫০% কোঠা সংরক্ষিত রাখা নিয়ে। সুতরাং এখানে বুঝতে হবে কোথাও কোনো গন্ডগোল আছে। সাস্টে ভর্তি প্রক্রিয়া একেবারে জলের মত স্বচ্ছ একটা প্রক্রিয়া। এখানে ভর্তিরুমের অবস্থা, সিটের সংখ্যা, কোন বিভাগে কতটি আসন বাকি আছে, কে কোথায় ভর্তি হচ্ছে সব কিছুই প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখানো হয়। আপনারা চাইলে ভর্তির সময় এসে দেখতে পারেন। জুনিয়রদের ভর্তি দেখাটাও সাস্টে অনেকটা উৎসবের মত। বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের ফাঁকে দলবেঁধে ভর্তি প্রক্রিয়া দেখতে যায়। নিজেদের বিভাগে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে দেখা যায় বড় হলরুমের কোনো একটা দল আনন্দে চিৎকার করে উঠে অন্যরা তখন ওদের নিয়ে ব্যাঙ্গ করতে থাকে। সব মিলিয়ে একটা উৎসব মুখর পরিবেশেই ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এ ধরণের উৎসবমুখর পরিবেশ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় নাকি জানি না। সাধারণ্যে এটা আনন্দমুখর হলেও অনেকের কাছেই এটা ‘চুলকানীর’ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে সাস্টের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডঃ মোঃ সালেহ উদ্দিন তার বক্তৃতায় এ পদ্ধতি নিয়ে বলেছিলেন এ পদ্ধতি এতই স্বচ্ছ যে ভার্সিটি প্রশাসনে চাকরী করে এমন অনেক কর্মকর্তাই নাকি স্ব স্ব ছেলেমেয়ের জন্য নাকি তদবির করেছিল কিন্তু এ পদ্ধতির কারণে কেউ অবৈধভাবে কাউকে নিয়োগ দিতে পারে নাই। বিষয়টা ‘সচেতনদের’ অবশ্যই চিন্তার মূল বিষয় হিসেবে আশা করছি। বেশিরভাগ ‘সচেতন’ মনে করে সাস্ট তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। সাস্টে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভূমিপুত্র বা এই টাইপের কোনো একটা কৌটা আছে বলে শুনেছি। এর মাধ্যমে এমনিতেই অনেক সিলেটি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। অথচ ছাত্র নিয়োগের ক্ষেত্রে বাইরের ছেলেমেয়েরা অগ্রাধিকার পায় এটা কিভাবে সম্ভব! সুতরাং যেভাবেই হোক এটা বন্ধের আন্দোলন করতে হবে! ‘সচেতন’ মহল, আপনারা কি একবার চিন্তা করে দেখবেন আপনাদের ছেলেমেয়েরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,বুয়েট কিংবা মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে যায় তখন ঐ অঞ্চলের মানুষরা কি আপনাদের দিকে তেড়ে আসে?
এ বছর আমার বোন ভর্তিপরীক্ষা দেবে। আমার ভাল লাগছে এই ভেবে যে আমার বোন যশোরের পরীক্ষাও সিলেটে বসে দিতে পারছে। সামনে আমার সেমিস্টার ফাইনাল। গত প্রায় দু’বছর যাবত আমার মা-র শরীর খারাপ। তাই তাকে বাইরে পরীক্ষায় নিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব না। সে হিসেবে একসাথে দুইটা পরীক্ষা দেওয়াটা(একই যাতায়াত খরচেও) আমাদের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতই। যারা পরীক্ষা নিয়ে এত ‘সচেতন’ আমার ধারণা তারা হয়তো মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের এই সমস্যার সাথে পরিচিত না। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেকের কাছেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপনাদের কাছে হয়তো মনে হতে পারে এতে সিলেটের ছাত্রছাত্রীরা কম সুযোগ পাবে। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি উল্টো। যারা আসলেই সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের না বা অবস্থান কখনও তাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ কখনই একটা বড় বিষয় না। ইঞ্জিনিয়ারিঙয়ে না পড়তে পারলে যে জীবন শেষ তা না। এমন অনেক মা-বাবাই আছে যারা সন্তানদের হাতখরচের টাকা পর্যন্ত দিতে পারে না, সেখানে একই যাতায়াত খরচে দুইটি পরীক্ষা দেয়াটা তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমার অনেক সিলেটি বন্ধুই আছে সাস্টের ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স না পেয়ে সোস্যালজি বা পদার্থবিদ্যা পাওয়ায় না পড়ে কোনো প্রাইভেট ভার্সিটি বা মেডিকেলে পড়ছে। তাই উচ্চবিত্তের কাছে এ পরীক্ষার গুরুত্ব না থাকলেও মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের কাছে আছে। ‘সচেতন’ মহল কি এ বিষয়টি ভেবে দেখবেন? শুধুমাত্র আঞ্চলিকতার দোহাই দিয়ে আপনারা যারা আন্দোলন করছেন তারা আমাদের ভাবমূর্তির কথা একবার ভেবে দেখবেন, যারা কোঠা পদ্ধতি ছাড়া নিজ যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি? সর্বপরি ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের সাথে ‘আঞ্চলিক’(সিলেটি) কোঠা কি আদৌ মানায় ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখবেন? ‘অচেতন’ সাস্টিয়ানদের পক্ষ থেকে একটা অনুরোধ করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সর্বোচ্চ মননশীলতার জায়গাকে দয়া করে আঞ্চলিকতার গন্ডিতে আবদ্ধ করে রাখবেন না।
এখানে মূল বিষয়টা কি শুধুই আঞ্চলিকতা নাকি অন্যকিছু ?
৫০% কোটার পক্ষে আন্দোলনের নামে একটি গোষ্ঠী জাফর ইকবাল স্যারের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জাফর ইকবাল স্যার অনেক দিন ধরেই এদেশের মৌলবাদীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে আছেন, তাঁর কৰ্মকান্ডের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সচেতন করা ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারের জন্য । মৌলবাদীদের প্রশ্রয়দাতা বিএনপির সাবেক নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেছেন,
“তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হলে তারা নাকি আনন্দ মিছিল করবেন।”
আঞ্চলিকতায় সিলেটি, নোয়াখালী এবং বরিশাল কিংবদিতূল্য – এটা একেবারে জেনারাইলেজশন হলেও একেবারে ভুলও নয়। এর ভালো এবং খারাপ দুই দিকই আছে। খারাপ দিকটি এখন বোঝা যাচ্ছে শাবিপ্রবির ঘটনায় – ভালো দিকটি আপনি বুঝতে পারবেন যখন প্রফেশনাল লাইফে ঢুকবেন তখন – বিজনেস কিংবা চাকুরী ক্ষেত্রে সিলেট, নোয়াখালী এবং বরিশালের লোকজন নিজেদের এলাকার মানুষদের জন্য যা করে তা অন্য এলাকায় খুব কম দেখা যায়।
এদিক হতে চট্টগ্রাম হল দেশের একেবারে বটমে – চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মানুষরা দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে তুলনামূলক অর্থ সাহায্য তথা ফিলান্থ্রপি অনেক বেশি করলেও প্রফেশনাল লাইফে খুবই প্রফেশনাল।
আপনি ছাত্র – প্রফেশনাল লাইফে গেলে তখন সিলেটের এই বিষয়টি আপনাকে খুবই শান্তি দিবে 🙂