সুরবেক বিশ্বাসের ‘বর্ণময় জীবনে ঝোঁকই ছিল নিত্যনতুনে’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ দিসেম্বর, ২০১২) প্রসঙ্গে এই লেখা বা সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া। রবিশঙ্করের জীবনে বহু নারীর আনাগোনা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার লেখায় চারটি নারীর কথা বলা হয়েছে, আরও কত নারীতে অনুরক্ত ছিলেন তা অনুক্ত রয়েছে । নিবন্ধটিকে প্রায় একটি সফট পর্নগ্রাফী বলা চলে । যে জীবনযাত্রার বর্ণনা করা হয়েছে তা সাধারন বাঙালীর সামাজিক আচার, বিচার, মূল্যবোধের নিরিখে সহজ বাংলা ভাষায় একটি দুশ্চরিত্র লম্পটের জীবন । অনেকে বলতেই পারেন যে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ গোঁড়া, অতিনৈতিক, পুরনো পন্থী বা যুগোপযোগী নয় । সে এক অন্য আলোচনা । কিন্তু যুগোপযোগী হোক বা না হোক এই সামাজিক অনুশাসন সবার ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য ঠিক যেমন আইন সবার ক্ষেত্রে সমান । বিশ্বব্যাপী খ্যাতি, অর্থ, বহু গুনমুগ্ধ শ্রদ্ধাবনত ভক্তকুল, অনেক নারীর সান্নিধ্যের সুযোগ, ইত্যাদির প্রভাবে রবিশঙ্করের মনে হতেই পারে যে তিনি ভগবানের সমকক্ষ এবং বাঙালীর সংকীর্ণ সামাজিক মূল্যবোধের বেড়ায় আটকে থাকার দায় তাঁর নেই । প্রশ্ন সেটা নয় । প্রশ্ন যেভাবে আনন্দবাজার এই জীবনযাত্রাকে মোলায়েম প্রলেপ লাগিয়ে, গরিমান্বিত বৈধতা দেওয়া হয়েছে । বর্ণময় জীবনসাগরে ঢেউ, উনি তো সাধারন মানুষ নন, সুরসৃষ্টির মতই সিরিয়াস সম্পর্ক ছিল, ওঁর জীবনসংগী হতে গেলে উদার হতে হয়, অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে হয়, ইত্যাদি উক্তির মাধ্যমে পাঠককে সম্মোহিত ( নোম চমস্কি্র ভাষায়ে ‘manufacturing consent’) করা হয়েছে যে এইরকম বিখ্যাত ব্যাক্তির ক্ষেত্রে বহুগামীতা হতেই পারে । প্রথমেই হুসেনের উক্তির খোঁচায়ে বোঝানো হয়েছে যে এটা সুর-মুরছনার প্রেরনাও হতে পারে । এটা জানা যায় নি যে এই সৃষ্টিশীল মানুষটি যদি মহিলা হতেন, তাঁর জীবনসঙ্গী কি একইরকম উদার হতেন বহুগামীতায় । আনন্দবাজার কিভাবে পেশ করতেন সেই বর্ণময় চরিত্র? সেও এক অন্য আলোচনা ।

একটি নিম্নগামী, হীনমন্যতায় ভোগা জাতি হিসেবে আপামর বাঙালীর মধ্যে অতি বীরপূজা বা নায়ক-বন্দনার (hero-worship) প্রবনতা থাকতেই পারে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রমান। রবীন্দ্রনাথের কোন সমালোচনা বা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এখন কার্যত অসম্ভব । চারিদিকে হা হা রব উঠবে) । কিন্তু তথাকথিত একটি প্রথম শ্রেনীর সংবাদমাধ্যমের কাছে এটা প্রত্যাশিত নয় । আরও একটু নিরপেক্ষতা, সৎসাহস আশা করা যায় । সাদাকে সাদা বলা এবং কালোকে কালো বলার সাহস তো সংবাদমাধ্যমেরই থাকার কথা। “ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রসারে, একনিষ্ঠ সাধনায়, পরীক্ষামুলক সৃষ্টিতে, বিশ্বব্যাপী বিস্তারে রবিশঙ্করের অবদান অনস্বীকার্য এবং আমাদের গর্বের আধার । কিন্তু ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি দুশ্চরিত্র, লম্পট ছিলেন, যা আমাদের সামাজিক অনুশাসনে ক্ষমার অযোগ্য”, এই কথাগুলি আনন্দবাজারেরই লেখার কথা। কারো মৃত্যুর পরে তার সন্মন্ধে কটু কথা বলা প্রথা নয়। তাই যদি হয় তো এই প্রসঙ্গের অবতারনা এখন করার দরকার ছিল না, তাঁর সঙ্গীত নিয়েই অনেক আলোচনা করা যেত। নাকি লোভ সংবরন করা যায় নি। রসালো গল্প বাজারে কাটে ভাল। বিখ্যাত ব্যাক্তির হলে তার বিনোদন মুল্য, টি আর পি আরও বেশি। যদি মানুষটাকে জানা বা জানানো উদ্দেশ্য থাকে তাহলে দোষগুণ নির্বিশেষে অকপটে তা পেশ করা উচিত। বিশ্বের সঙ্গীত জগতে তাঁর অবদানের জন্য যেমন আমাদের গর্ব হয়, তেমনই তাঁর অসংযমী চরিত্রের (সাংগীতিক অবদানকে খাটো না করে) দায় ও লজ্জাও আমাদেরই।

আমার অভিযোগ দুটি। এক, প্রকারান্তরে মিথ্যাভাষণ। দ্বিতীয়টি আরও গুরুতর, এক ধরনের elitist শ্রেনীবিভাগ। ধরা যাক বসিরহাটের বাস ড্রাইভার মদন মান্না যদি এই ধরনের একই সাথে বহুনারীতে জীবনযাপন করত তাহলে কি আনন্দবাজার একই ভাবে তার বর্ণময় জীবন বর্ণনা করত? যারা নিয়মিত সংবাদমাধ্যমের সাথে পরিচিত এবং বাস্তবের জমিতে বাস করেন, তাঁরা জানেন যে মদন মান্নাকে সমাজ এবং আনন্দবাজার দুশ্চরিত্র আখ্যাই দিত খুব সম্ভবত তার হাজতবাসও ঘটত। তাহলে রবিশঙ্করের ক্ষেত্রে এই দ্বিচারিতা কেন? তাঁর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি বলে, তিনি অসাধারন শিল্পী বলে? এলিট শ্রেনীর জন্য একরকম নিয়ম, বিচার – তাদের কোন দোষই দোষ নয়, বরং ভক্তিতে গদগদ। অন্য সবার জন্য আর এক নিয়ম। এই দোষে বাঙালী সমাজও দোষী। অতীতেও আনন্দবাজার যখন কোন বিখ্যাত ব্যাক্তির জীবন নিয়ে রচনা লিখেছে, তখনি যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশী, বিশ্লেষণের চেয়ে বন্দনা বেশী, এবং অতিরঞ্জিত রোম্যান্টিক বিবরন পাওয়া গেছে ।

একটি উদাহরন, একটি কারন, কোন বিষয়বস্তুর উপর সম্পূর্ণ আলোকপাত করে না। একটি জাতির গত দুশো বছরের ইতিহাসে সমাজের নানা বিভাগে বহু মনীষীর জন্ম হয়েছে যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে উৎকর্ষের শীর্ষে ছিলেন – যে ভাগ্য সব জাতি, প্রদেশ বা দেশেরও সব সময় হয় না। তা সত্ত্বেও কেন সাধারন মানুষের জীবনযাত্রায় তাঁদের ছাপ অকিঞ্চিৎকর, কেন সেই জাতির সামগ্রিক সমাজ জীবন আপেক্ষিক ভাবে নিম্নগামী, এটা বাঙালীর ভাবা দরকার। কারণগুলো চারপাশে ছড়ানো রয়েছে।
__________________________________________________________________
পার্থসারথি বন্দ্যোপাধ্যায় নিউ জার্সিতে বসবাস করেন। তাঁর ইমেইল ঠিকানা – [email protected]